আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুসলিম হিসেবে প্রথাগত ব্যাংকের সেবা গ্রহণের ভয়াবহতা, সুদ কি ?



প্রথাগত ব্যাংক ব্যবস্থায় জনসাধারণের জন্য তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে যে সেবা প্রদান করে থাকে তার সবটাই সুদ নির্ভর। এ সকল ব্যাংকসমূহ ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে সুদ গ্রহণ করে থাকে। আবার ডিপোজিটরদেরকে তাদের গৃহীত সুদের একটি অংশ প্রদান করে তাদেরকেও সুদখোর বানিয়ে নিজের সমগোত্রীয় করে নেয়। তারা যে সকল ডিপোজিটরদেরকে সুদ দেয় না তাদেরকেও সুদের সাথে সংশ্লিষ্ট করে ফেলে। কেননা, এ সকল ডিপোজিটরগণ সুদ না পেলেও তাদের টাকা খাটিয়ে উক্ত টাকার উপর সুদ গ্রহণ করে নিজেরা খায়।

যেমন ঃ চলতি হিসাবের স্থিতির উপর, পে-অর্ডারকারীর জমাকৃত টাকার উপর এবং এল সি খোলার জন্য মার্জিন হিসাবে সংরক্ষিত টাকার উপর গ্রাহককে সুদ দেয়া হয় না বটে কিন্তু ব্যাংকসমূহ উক্ত অর্থ ঋণ হিসাবে বিতরণ করে সুদ অর্জন করে নিজেদের আয় আরও সহজেই বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। সুতরাং যে সকল ব্যক্তিই এ সকল প্রথাগত ব্যাংকের সাথে ব্যাংকিং করে তারাই সুদের সাথে জড়িয়ে পড়ে। কেননা, তারা হয়ত সুদের দাতা বা গ্রহীতা অথবা সুদের কারবারের সহযোগী। সুতরাং সংশ্লিষ্ট সকলেই সুদের অভিশাপের সাথে সম্পৃক্ত। নিজেদেরকে এ সকল ব্যাংকের সাথে কর্মচারী, ঋণ গ্রহীতা, ডিপোজিটর বা সেবা গ্রহণকারী যে কোনভাবেই সম্পৃক্ত করা কতবেশী ভয়াবহ তা সকলেরই অবগত থাকা উচিত।

এ ভয়াবহতার মাত্রা আঁচ করার জন্য আমাদেরকে সুদ কি? এ সুদ সম্পর্কে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাবধান বাণী ও নিজেদের জীবন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা অর্জন করতে হবে। সুদ কি ? মহান আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালামে হাকীমে রিবা শব্দটি দ্বারা যে জিনিস নির্দেশ করেছেন তাই সুদ বা ওহঃবৎবংঃ . রিবা শব্দটির অর্থ হলো অতিরিক্ত, বেশী, বৃদ্ধি, বিকাশ। তবে এর দ্বারা এমন একটি অতিরিক্ত অংশকে বুঝায় যার প্রাপক এর জন্য কোন বিনিময় প্রদান করে না। এ অতিরিক্ত অংশটুকু নগদ অর্থ হতে পারে আবার সমজাতীয় অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীও হতে পারে। যেমন ঃ কোন এক ব্যক্তি অপর কাউকে একশত টাকা ধার দিল এ শর্তে যে গ্রহীতা নির্ধারিত সময় পরে একশত দশ টাকা পরিশোধ করবে।

এখানে প্রাপ্ত একশত টাকার বিনিময় হল প্রদত্ত একশত টাকা। আর অতিরিক্ত দশ টাকার কোন বিনিময় নেই। একইভাবে কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে একটি নির্ধারিত মেয়াদে এক মন চাল ধার দিল এ শর্তে যে প্রতি মাস অতিক্রান্ত হওয়ার জন্য এক কেজি করে অতিরিক্ত চালসহ ফেরত দিবে। এখানে এক মন চালের বিনিময় হলো এক মন চাল। আর অতিরিক্ত অংশের কোন বিনিময় নেই।

সুতরাং তা সুদ। সুদের পরিচিতি সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়াতে নিম্নোক্ত বিবরণ পাওয়া যায় ঃ ১. সমজাতীয় দ্রব্য কম-বেশী করা হলেও সুদের আবির্ভাব ঘটে। যেমন ঃ আবূ সাঈদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন ঃ আমরা বিভিন্ন রকমের খেজুর পেতাম। অর্থাৎ ভাল-মন্দ মিশ্রিত খেজুর। আর সেগুলো আমরা (ভাল) এক সা খেজুরের বিনিময়ে দুই সা করে বিক্রি করতাম।

কিন্তু নবী করিম সা. বলেছেন ঃ এক সা (খেজুরের) পরিবর্তে দুই সা (খেজুর) এবং দু দিরহামের পরিবর্তে এক দিরহাম (বিক্রি করা) চলবে না। Ñবুখারী ২. ক্রয়কৃত কোন পণ্য সামগ্রী নিজের হস্তগত হওয়ার আগেই বিক্রয় করে যে মুনাফা ধার্জ করা হয় তা সুদেরই নামান্তর। যেমন ঃ রাসূল সা. বলেছেনঃ ইব্ন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ক্রয়কৃত খাদ্যদ্রব্য পুরোপুরি নিজের অধিকারে আসার আগেই বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। (তাউস বলেন) আমি ইব্ন আব্বাস রা. কে জিজ্ঞেস করলাম, এরূপ হবে কেন? (অধিকারে আসার আগে বেচা যাবে না কেন?) উত্তরে তিনি বলেন, তা না হলে তো পণ্যের অনুপস্থিতিতে দিরহামের বিনিময়ে দিরহাম বিক্রি করা হবে। Ñ সহীহ্ বুখারী ইব্ন আব্বাস রা. বলেন ঃ আমি এর সাদৃশ্য প্রত্যেক জিনিসের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য মনে করি।

৩. বাকীতে সমজাতীয় কোন বস্তুর ক্রয়-বিক্রয় করা হলে অতিরিক্ত অংশ সুদ হিসাবে গণ্য হবে। যেমন ঃ উমর ইবনুল খাত্তাব রা. রাসূল সা. থেকে বর্ণনা করেছেন; রাসূল সা. বলেছেন ঃ নগদ বিনিময় না হলে সোনার বিনিময়ে সোনা বিক্রি, গমের বিনিময়ে গম বিক্রি, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর বিক্রি এবং যবের বিনিময়ে যব বিক্রি করা সুদ হিসাবে গণ্য হবে। ৪. জাহিলিয়াতের যুগে সর্বাধিক প্রচলিত সুদ ছিল দু’ধরনের। প্রথমতঃ কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তিকে নগদে অর্থ লগ্নি করত এ শর্তে যে, ঋণগ্রহীতা নির্দিষ্ট সময় পরে অতিরিক্ত অর্থসহ মূলধন ফেরৎ দিবে। ঐ সময়ের মধ্যে সমুদয় অর্থ ফেরৎ দানে ব্যর্থ হলে মূলধনের সাথে উক্ত অতিরিক্ত যোগ করে মোট ঋণ হিসাব করে পুনরায় তার উপর সুদ ধার্য করা হত।

এভাবে সময়ের বৃদ্ধির সাথে সাথে বর্ধিত হারে সুদ গ্রহণ করা হত। দ্বিতীয়তঃ পণ্যের বিক্রেতা নির্দিষ্ট মেয়াদে কোন পণ্য নগদ মূল্য অপেক্ষা বেশী মূল্যে বাকীতে বিক্রয় করত। উক্ত নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হলে বর্ধিত মেয়াদের জন্য অতিরিক্ত মুনাফা যোগ করে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিত। এভাবে সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে সুদ হিসাবে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা হত। সুতরাং কোন বস্তু সমজাতীয় বস্তুর সাথে বাকীতে বিনিময় করে কোন অতিরিক্ত গ্রহণ করলে, নগদ অর্থ ঋণ হিসাবে প্রদান করে কোন অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করলে, কোন পণ্য বাকীতে বিক্রয় করে সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে এর বর্ধিত মূল্য গ্রহণ করলে, কাউকে কোন নগদ অর্থ বা কোন ভোগ্য পণ্য ঋণ হিসাবে প্রদান করে ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে কোন স্থায়ী সম্পদ ঐ সময়ের জন্য বন্ধক বা নিজের দখলে রেখে উক্ত স্থায়ী সম্পদ হতে কোন অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করলে, এ সকল গৃহীত বিনিময়হীন বস্তু সামগ্রীই হল সুদ।

সুদ সম্পর্কে আল্লাহ্ পাকের বাণী ১. যারা সুদ খায়, তাদের অবস্থা হয় সেই ব্যক্তির মত যাকে শয়তান আপন স্পর্শ দ্বারা পাগল ও সুস্থ জ্ঞানশূন্য করে দিয়েছে। তাদের এইরূপ অবস্থা হওয়ার কারণ এই যে, তারা বলে ঃ ব্যবসা তো সুদের মতই জিনিস। অথচ আল্লাহ্ ব্যবসাকে হালাল করেছেন ও সুদকে করেছেন হারাম। কাজেই যে ব্যক্তির নিকট তার রব এর তরফ হতে এই উপদেশ পৌঁছবে এবং ভবিষ্যতে এই সুদখোরী হতে বিরত থাকবে সে পূর্বে যা কিছু খেয়েছে, তা তো খেয়েছে Ñ সেই ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্রই উপর সোপর্দ। আর যারা এই নির্দেশ পাওয়ার পরও এর পুনরাবৃত্তি করবে, তারা নিশ্চিতরূপে জাহান্নামী হবে, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।

Ñ আল-বাকারা ঃ ২৭৫ ২. হে ঈমানদারগণ! এই চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খাওয়া ত্যাগ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর; আশা করা যায় যে, তোমরা কল্যাণ লাভ করবে। সেই আগুন হতে আত্মরক্ষা কর, যা কাফিরদের জন্য তৈরী করে রাখা হয়েছে। -আল ইমরান ঃ ১৩০-১৩১ ৩. যে সুদ তোমরা দিয়ে থাকো, যাতে মানুষের সম্পদের সাথে মিশে তা বেড়ে যায়, আল্লাহর কাছে তা বাড়ে না। -র্আ রূম ঃ ৩৯ ৪. হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর আর তোমাদের যে সুদ লোকদের নিকট পাওনা রয়েছে তা ছেড়ে দাও, যদি বাস্তবিকই তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো। কিন্তু তোমরা যদি এরূপ না কর, তবে জেনে রাখ যে, আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা রয়েছে।

-আল বাকারা ঃ ২৭৮-২৭৯ সুদ সম্পর্কে রাসূল সা. এর হাদীস ঃ ১. জাবির বিন আবদুল্লাহ্ রা. বর্ণনা করেছেন, রাসূল সা. সুদ দাতা, সুদ গ্রহীতা, সুদের চুক্তিপত্র সম্পাদনকারী, সাক্ষী সকলের উপর অভিশাপ (লানত) দিয়েছেন এবং বলেছেন তারা সকলে সমান অপরাধী। Ñসহীহ্ আল মুসলিম। ২. আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন ঃ সুদের সত্তর ভাগের ক্ষুদ্রতম ভাগ এই পরিমাণ যে, কোন ব্যক্তি স্বীয় মাতার সাথে যেনা করে। Ñ ইব্ন মাজাহ্ , বায়হাকী, হাকেম। ৩. সামুরা ইব্ন জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, নবী সা. বলেছেন ঃ আজ রাতে আমি স্বপ্নে দু’জন লোককে দেখলাম, তারা আমার নিকট এসে আমাকে নিয়ে একটি পবিত্র ভূমিতে গেল।

আমরা চলতে চলতে একটি রক্ত নদীর তীরে পৌঁছে গেলাম। নদীর মধ্যখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল, আর নদীর তীরে একটি লোক দাঁড়িয়েছিল যার সামনে ছিল কিছু পাথর। এরপর নদীর মাঝে দাঁড়ানো ব্যক্তি তীরের দিকে অগ্রসর হলে তীরে দাঁড়ানো লোকটি তার মুখণ্ডল লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করল এবং সে আগে যেখানে ছিল সেখানে ফিরে যেতে বাধ্য করল। এভাবে যখনই সে উঠে আসার চেষ্টা করছে তখনই তীরের লোকটি তার মুখ লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে মারছে, যার ফলে সে (পূর্বস্থানে) ফিরে যাচ্ছে এবং পূর্ববৎ অবস্থান গ্রহণ করছে। নবী সা. বলেন আমি জিজ্ঞেস করলাম এ লোকটি কে (কি কারণে তার এ শাস্তি হচ্ছে বা তার এ অবস্থা কেন? ) তারা (আমার সাথের লোক দু’জন) বললো ঃ নদীর মধ্যে দাঁড়ানো যে লোকটিকে দেখলেন, সে এক সুদখোর।

- বুখারী

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.