আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেসরকারী শিক্ষকদের হাল এবং আমাদের শিক্ষার বেহাল অবস্থা

শিক্ষা যেখানে অসম্পূর্ণ, জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।

ক'দিন আগে একটি বেসরকারী কলেজের একজন প্রভাষক CLS লোন করার জন্য ব্যাংকে এসেছিল। এই শিক্ষকের সাথে আমার প্রায় প্রতিদিন বিকেলেই গল্প-আড্ডা হয়। বেসরকারী শিক্ষকদের বেতন কাঠামো সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। তার স্যালারী শিটটি দেখে আমি এতটা বিস্মিত হই যে আমার বিস্ময় কাটতে দশ মিনিট লেগে যায়।

তার স্যালারী স্ট্রাকচারটা নিচে দেয়া হল। আপনার যদি বেসরকারী শিক্ষকদের বেতন কাঠামো সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকে তাহলে আপনিও আমার মত বিস্মিত হবেন। মূল বেতনঃ ১১০০০/- + ১২৫/- (ইনক্রিমেন্ট)=১১১২৫/- বাড়ি ভাড়াঃ ১০০/- মেডিকেলঃ ১৫০/- সর্বসাকুল্যেঃ ১১৩৭৫/- প্রভিডেন্ট ফান্ডে কর্তনঃ মূল বেতনের ৪% = ৪৪৫/- এর সাথে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত বেতনঃ মূল বেতনের ২০%=২২০০/- সর্বমোট প্রাপ্য বেতন=১৩১৩০/- ১৩১৩০/- টাকাকে আপাত দৃষ্টিতে ভাল বেতনই বলা যায় হয়তো। কিন্তু একটু বিশ্লেষণ করলে আপনারা ভাল চিত্র পাবেন। আপনারা যে ইনক্রিমেন্টটা দেখছেন এটা এক গ্রেডে কোন শিক্ষক যদি ১০ বছর চাকুরী করেন তাতেও একটাই থাকবে।

মানে একজন প্রভাষকের মূল বেতন কখনোই ১১১২৫/- টাকার বেশি হবে না (টাইম স্কেলের একটা ব্যাপার অবশ্য আছে যা আমি বুঝি না। আমার কাছে যে শিক্ষক এসেছেন তার চাকুরীর বয়স ৯ বছর। )। বাড়িভাড়া একজন প্রিন্সিপাল থেকে ঝাড়ুদার পর্যন্ত ১০০/- টাকাই। মেডিকেলের ক্ষেত্রেও তাই।

বছরে দুটো বোনাস পান যা মূল বেতনের ২৫%। এবার বলুন আপনিও বিস্মিত হয়েছেন কীনা? যদি না হোন তবে আরেকটু যোগ করতে হবে যে তারা পূর্বে মূল বেতনের ১০০% ই পেতেন না, ৮০% পেতেন। তারও আগে পেতেন ৫০%। এই একটা ইনক্রিমেন্টও অধুনা দেয়া হয়েছে। বর্তমান বাজার মূল্য এবং প্রতিনিয়ত ধনী-গরীবের ব্যবধান বৃদ্ধিমূলক আমাদের সমাজে এই বেতনকে তুলনামূলক বিচারের দায়িত্বটা আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম।

তাদের এই বর্তমান বেতন অনেক আন্দোলন-ত্যাগ-তিতীক্ষার ফসল। এবার আসুন পর্যালোচনায়। আমাদের দেশের মাধ্যমিক এবং তদোর্ধ শিক্ষায় বেসরকারী, সরকারী এবং অন্যান্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার শিক্ষার্থীর অনুপাত ৬ঃ৩ঃ১। সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজগুলো সবই জেলা শহরগুলোতে এবং কোথাও কোথাও উপজেলা সদরে অবস্থিত। দেশের গ্রামাঞ্চলে যে বিশাল জনগোষ্ঠী বাস করে তাদের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।

এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো যা প্রদান করা হলো তাতে আমাদের দেশের ক'জন মেধাবী ছেলে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর শিক্ষার দায়িত্ব কাধে তুলে নিবে? যাদের গ্রাম্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে ধারণা আছে তারা দেখে থাকবেন বেশিরভাগ শিক্ষকগণই অনন্যোপায় হয়েই শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছেন এবং এইসব শিক্ষকদের অনেকেরই শিক্ষাগত কিংবা পাঠদানের যোগ্যতা প্রশ্নসাপেক্ষ। কিছু মেধাবী শিক্ষকও আছেন কিন্তু তাদের অনেকেই জীবন সম্পর্কে এতখানি হতাশ যে পাঠদানে তারা তাদের সম্পূর্ণ মেধা ও মননকে কাজে লাগান না। অনেকেই অর্থনৈতিক দূরাবস্থাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের চেয়ে প্রাইভেট পড়ানোয় উৎসাহী বোধ করেন। সুযোগ পেলেই আমরা বাঙালী তথা বাংলাদেশীদের নীতিহীনতার বদনাম গাই, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্য ধর্মহীনতাকে গালাগাল দিই। সন্ত্রাসের উৎপাটনে ক্রশফায়ারকে জায়েজ করি।

ইভটিজিংকে প্রতিরোধ করার জন্য মানববন্ধন করি। দূণীতিবাজদের ধরার জন্য ওয়ান ইলেভেনের জন্ম দিই, কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তনের জন্য কোন ভাল পদক্ষেপ নিই না। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একজন ছাত্র স্বপ্ন দেখে শিক্ষক হওয়ার সেখানে আমাদের ছাত্ররা শিক্ষক হতে ভয় পায়। পেটের ক্ষুধা থাকলে নীতিরা গাছে উঠে। আমরা গাছের গোড়ায় জল না ঢেলে আগায় ইনসেকটিসাইড ব্যবহার করছি।

ফলাফল তথৈবচঃ। মাকসুদের একটা গান মনে পড়ছে- 'গরীব গরীব রবে, বড়লোক বড় হবে, বুদ্ধিজীবিগণ থাকবেন বেঁচে বুদ্ধিদীপ্ত কোন ছদ্মবেশে। ' মাধ্যমিকের এক শিক্ষকের একটা প্রবচণ দিয়ে শেষ করছি-'যার নেই কোন গতি, সেই করে পণ্ডিতি। '

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.