আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অচিন চীনে- ভগ্ন মনেঃ যাত্রা তব শুরু(শুভ) হোক[দ্বিতীয় কিস্তি]

প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ বাড়ী থেকে বেরিয়েছিলাম বৃহস্পতিবার। গৃহ ভর্তি মানুষ। আশেপাশের দুএক বাড়ীর বলতে গেলে সব্বাই। বন্ধুরা সবাই বাইরে অপেক্ষা করছিল, বন্ধু বলতে আমার গ্রামের বন্ধুরা। সেদিন বাড়ীর পাশে একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল ছিল।

ফাইনালে বেঁধে গেল গণ্ডগোল, এদিকে একের পর এক বেজে উঠে মুঠোফোন, আমি চুপচাপ, মুঠোফোনও চুপচাপ, সবার মধ্যে উৎকণ্ঠা, এরই মাঝে আমি ঘরে এলাম। রেডি। একটু পর বের হব। বিদায় নেয়ার পালা। বাবার কাছে গেলাম, সেদিনই বুঝলাম তিনি আমাকে কটটুকু ভালোবাসেন।

বলাইবাহুল্য, বাবার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল সর্বদা দুরত্বের। তাঁকে কখনোই আমার কাছের মনে হই নি, এমনও হয়েছে- মাঝেমধ্যে সপ্তাহ দশদিন তাঁর সাথে কথা বলি নি; তিনি নিজের মত থাক্তেই বেশি পছন্দ করেন। তাঁর সে কী কান্না!! হয়তোবা, পরিবারের কেউ আগে কখনো বাইরে ছিল না বলেই। তিনি কাঁদতেই ছিলেন, আমি নিশ্চিত সে কান্না থামেনি অনেকক্ষণ। এবার মা’র পালা।

আমি ভেবেছিলাম মা কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হয়ে যাবেন। কিন্তু কিসের কী, পুরাই তব্দা খেয়ে গেলাম। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিব, উল্টো তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, সাহস হারাতে বারণ করছিলেন, সর্বদা সতর্ক থাকতে বলছিলেন, আর বলছিলেন বেশি বেশি খোদার শরণ আর দরূদ পড়তে। সেদিনের মায়ের বিস্ময়কর আচরণের কোনও ব্যাখ্যা আজও পর্যন্ত আমার কাছে নেই। হয়তোবা তিনি কাঁদলে আমি আরও বেশি কাদব বলে, হয়তোবা না- তিনি অধিক শোকে কাতর ছিলেন বলে অশ্রু নামক সেই লোনা জল উধাও হয়ে গিয়েছিল।

প্রসঙ্গত, মা আমকে কটটুকু ভালোবাসেন তা আমার কল্পনার অনেক অনেক বাইরে(আপনারা হয়ত ভাবতে পারেন আমার মা বলেই বলছি। কিন্তু না- এই ব্যপারে সামনের কোনও এক পর্বে লেখার সংকল্প ব্যক্ত রইল। ) সেদিন সবচে’ বেশি কেঁদেছিল ছোট বোন টি। যাকে আমিই সবচেয়ে বেশি জ্বালাতাম, কারণে অকারণে। সব সময় তার খুঁত ধরার চেষ্টা থাকতো।

একেই বলে রক্তের টান, এই লাইন দ্বয় মনে পড়ে গেল- প্রেম নয়- বিচ্ছেদই মৌলিক বিচ্ছেদের সময় বোঝা যায়, ভালোবাসার গভীরতা। ফুফিদের বাসা একদম পাশাপাশি, বাসা থেকে বেরিয়ে ফুফিদের বাসায় যায়। আমি জীবনে যদি কারো অনুকরণ করে চলতে চাই বা চেয়েছিলাম তিনি হলেন আমার ফুফা। অসাধারণ একজন মানুষ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বললেই চলে, তবে তিনি প্রবলভাবে সুশিক্ষিত।

তাঁর প্রতিটি কথা তাঁর ঘোর শত্রুরাও মোহিত হয়ে শোনেন। চলাফেরা একেবারে সাদাসিদে, প্রমিত। তিনি আমাকে বললেন, ‘সবসময় দরূদ পড়বে, আর যত বিপদ আসুক ধৈর্য ধারণ করবে। ’ সেখান থেকে বেরিয়ে সিএনজি করে কর্ণফুলীর ঘাটে আসলাম। আমি এখন পর্যন্ত এই কর্ণফুলীকেই সবচেয়ে বেশি মিস করছি, আশৈশব সে ছিল আমার নিত্যদিনের সঙ্গী।

কী গ্রীষ্ম, কী বর্ষা, আর কী-বা ঘন কুয়াশা, কিছুই আমাকে আটকাতে পারতো না। তার অনবরত ছলাত ছলাত ছুটে চলা, প্রবল স্রোত, কূলের দিকে ধেয়ে আসা সেই ঢেউ গুলো; এসব আমি কটটুকু মিস করছি লিখে বোঝানর ভাষা জানা নেই। কর্ণফুলী ছিল আমার বিষণ্ণতার দাওয়াই। মন যত খারাপই থাকুক, তার দিকে তাকিয়ে থাকলে সব উধাও হয়ে যেত নিমিষেই। যখন নৌকা থেকে উঠছিলাম তখন আমার চোখে জল- সেই জল অনিশ্চয়তার জল, বিচ্ছেদের জল।

আমি জানি না, আর কখনো আমি সেথাই ফিরবো কি না! সেইদিন বাস স্ট্যান্ডে বাড়ীর সব বন্ধুরাই গিয়েছিল। তবে সেখানে ছিল না আমার কোনও সহপাঠী। দীর্ঘ দীর্ঘ বছরগুলো ধরে যাদের সাথে আমার প্রাত্যহিক চলাফেরা, তারা আজ কেউ নেই আমার পাশে, আমার জীবনের বদলে যাওয়ার চরম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে, এটাই নিয়তি। আমরা কেউ জানি না আমাদের নিয়তি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিংবা যাবে; তবুও আমরা ছুটে চলি, ছুটে চলি সকাল থেকে সন্ধ্যা নাগাত, একটু থমকে যায় আবার নতুন আশায় ছুটে চলা- নিয়তি সেদিন আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল সম্পূর্ণ অজানা এক গন্তব্যে, নতুবা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি আমার জীবনে এমন মুহূর্ত আসবে! সবকিছু ছেড়ে মায়ের মহৎ আশাটি পূর্ণ করার জন্য আমাকে হাজার মাইল দূরে যেতে হবে। বাস ছুটে চলে, আমার মুখ ভিজে যাচ্ছিল জলে।

[চলবে] ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।