আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্ষমতা ও জেন্ডার প্রসঙ্গে কতিপয় জরুরী আলাপ



আমরা Paradox নামে মুক্তচিন্তা বিষয়ক একটি সংগঠন পরিচালনা করি,যার প্রাণই হচ্ছে চিন্তার বিকাশ ঘটানো। এ মাসের শুরুর দিকে আমরা এই শিরোনামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করি। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে সেমিনারের সম্পূর্ণ পেপার তুলে ধরলাম। কারো ভাল লাগলে আমারও ভাল লাগবে। ক্ষমতা ও জেন্ডার প্রসঙ্গে কতিপয় জরুরী আলাপ - দেবাশীষ কুন্ডু** জনগনই সকল ক্ষমতার উৎস।

নির্বাচনী জনসভায়। পোস্টারে আর রাজনৈতিক আলোচনায় এই বাক্যটিই ঘুরে ফিরে আসে। জনগনের ভোটের একটি প্রলয়ংকারী ক্ষমতা আছে। সে হিসেবে জনগনই ক্ষমতার উৎস মুখ। কিন্তু সরকার গঠিত হবার পর জনগনের এই বিপুল ক্ষমতার ভান্ডার হস্তান্তরিত হয় সরকারের হাতে।

তখন জনগন কিছুই না। তারা স্রেফ আমজনতা। আর সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। এসব কারণে জনগন ক্ষমতা টের পায় তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের গভীরে ক্ষমতার রশ্মি সফল করে। ক্ষমতায় আক্রান্ত হলে সে কখনও নিগৃহীত হয়, আবার ক্ষমতার ছিটেফোঁটা ভাগে পেয়ে সে বর্তে যায়।

ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে এই দুই অবস্থান বিপরীত। প্রথমটি প্রান্তিকতা আর দ্বিতীয়টি কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকা। প্রারম্ভিকতার এই পর্যায় এসে অনুধাবন করার চেস্টা করি ক্ষমতা কি ? ক্ষমতার রুপগুলি কেমন কিম্বা তা কী রুপে আমাদের সামনে হাজির হয় যার ফলে আমরা ক্ষমতার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি। ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে কার কেমন অবস্থান ? এটা কিসের ভিত্তিতে তৈরী হয় ? এইসব উত্তর খোঁজার মধ্যে দিয়ে আমরা চূড়ান্ত বিচারে সে ঘটনাটি বোঝার চেস্টা করবো তা হলো ক্ষমতা কীভাবে জেন্ডার ধারণার সাথে সম্পর্কিত। এটি বুঝতে গিয়ে ক্ষমতার তথ্যগুলোকে একটু আলাদাই করবো, এবং ক্ষমতা কাঠামোর আলোচনায় নারী পুরুষের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণের চেস্টা থাকবে।

থমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯) ক্ষমতাকে দেখেছেন মানুষের বর্তমান উপায় হিসেবে, যার মাধ্যমে সে ভবিষ্যতে কিছু আপাত ভালো হাসিল করতে পারে ( Leviathan, Ch.10 )। নিকোলো ম্যকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭) বলেছেন, ক্ষমতা হচ্ছে যেকোনো সমাজে (সামাজিক ব্যবস্থায়) একটি জটিল কৌশলগত পরিস্থিতি। বিশ্ব শতকের আরেক দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিৎসে যেকোনো পরিবেশের উপর নিয়ন্ত্রন ও তাকে কাজে লাগানোর (আধিপত্য) ইচ্ছাকে ক্ষমতা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে ক্ষমতা সংক্রান্ত আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি মিশেল ফুকোর। তিনি বললেন, ‘ক্ষমতা সর্বত্র কেননা এটি সব জায়গা থেকেই উদ্ভুত হয়।

ফুঁকো মূলত তার ক্ষমতার তত্বে ক্ষমতার কৃৎকৌশল ও প্রযুক্তিগত দিক নিয়ে কথা বলেছেন। এখানে তিনি জ্ঞানের অপরিসীম ক্ষমতা লক্ষ্য করেছেন। এবং বিশ্বাস ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে এটিকে তিনি সাধারণ জ্ঞান হিসেবে অভিহিত করেন, যা আধিপত্য করতে সক্ষম। অন্যদিকে ডিসকোর্সের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আমাদের সামনে ‘ভালো’ ওয়াদা কিম্বা ‘সত্য’ ও ‘মিথ্যা’র ধারণা হাজির করেন। এরকম একটি পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে ক্ষমতার একটি অবয়ব উপস্থিত হয়।

একজন মানুষের তার পরিপার্শ্বকে নিয়ন্ত্রন করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাকে বিচার করা হয়। ক্ষমতা মূলত প্রভাবিত করার একটি কৌশল। এই কৌশলে ক্ষমতাকে দু’রকম ভাবে দেখা যেতে পারে, যার একটি হচ্ছে আগ্রাসন (বল প্রয়োগ), অন্যটি নিজের মতো করে ব্যবহার করা। ক্ষমতার ব্যাখ্যায় আমরা যৌক্তিক পছন্দের ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারি, যা গেম তত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত। এখানে কারক (Actor) পছন্দের বিকল্পসমূহ (Choice Set) থেকে সুযোগ সুবিধার কাঠামো তৈরীর মাধ্যমে দুধরনের ক্ষমতায় বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে।

একটি ক্ষমতার ফলাফল, অন্যটি সামাজিক ক্ষমতা। স্টিফেন লুকাস তার Power : A radical View (1974 গ্রন্থে এন্টোনিও গ্রামসি ও আলথ্রুজারের ছাত্র ভাদীকে অনুসরণ করে ক্ষমতার একমাত্রা, দুইমাত্রা ও তিনমাত্রা নির্ধারণের চেস্টা করেছেন। এক মাত্রায় বলা হচ্ছে ক্ষমতা হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে এটি কাজ করে। সিদ্ধান্তের ফলাফলের উপর এর কার্যকারিতা টের পাওয়া যায়। অন্যদিকে, দুই মাত্রায় বলা হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও এজেন্ডা নির্ধারণ, প্রতিষ্ঠান ও অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব, প্রভাব মাপতে পারা এবং যেসব কৌশলের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রয়োগ হয় সেগুলো হচ্ছে প্রভাব, নিজের পক্ষে কাজ করানো, কর্তৃত্ব, দমন ও সরাসরি বল প্রয়োগ।

তিন মাত্রার ব্যাখ্যাটি এমন দুটি মাত্রার সাথে সম্পর্কিত এবং অনেকটা তাদেরই সমন্বিত কৌশলসমূহের বর্ধিঞ্চু ব্যাখ্যা। তিন মাত্রা বলেছে, রীতি-নীতি, আদর্শের মধ্য দিয়ে প্রাধান্য বিস্তার। সকল ধরনের সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেই ক্ষমতা থাকে। কেননা ধারণাসমূহ ভাষা ও ক্রিয়ার সাথে যুক্ত, আবার ভাষার মধ্যেই ক্ষমতা অস্তিত্বশীল থাকে; ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যেও আদর্শ বা রীতিনীতির মাধ্যমে ক্ষমতা থাকে। এমনকি রাজনৈতিক কর্মকান্ড যখন কিনা নীতি তৈরীর কাজ করে, তার মধ্যে ক্ষমতা প্রকাশিত হয়।

ক্ষমতার রুপান্তরও ঘটে থাকে অন্ততপক্ষে তিনটি উপকরণের মধ্য দিয়ে যা কতৃত্ব, দমন ও আধিপত্য প্রকাশ করতে সক্ষম। এমন তিনটি বিষয় হচ্ছে Ñ সহিংসতা, সম্পত্তি ও জ্ঞান। আলভিন টফলার এই তিনটি বিষয়ের মধ্য দিয়েই ক্ষমতার রুপান্তর ঘটে বলে উল্লেখ করেন। এ পর্যায়ে ফ্রেন্স ও র‌্যাভেনের (১৯৫৯) একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রকল্পের কথা উল্লেখ করতে পারি। যেখানে তিনি দৃষ্টান্ত হাজির করে আমাদের বলেন সম্পর্কের মধ্যেই ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ করে।

এক্ষেত্রে আমরা পাঁচ ধরণের ক্ষমতার কথা উল্লেখ করতে পারি - ইতিবাচক ক্ষমতা, আনুগত্য তৈরীর ক্ষমতা, বিশ্লেষণের ক্ষমতা, পুরস্কারের ক্ষমতা ও দমনমূলক ক্ষমতা। এবারে আমরা ক্ষমতার জেন্ডার বিশ্লেষণ করার চেস্টা করি। ফুঁকোর যে ক্ষমতা সর্বত্র। সে ক্ষমতায় কি নারী কি পুরুষ সকলেরই ক্ষমতা থাকে। কিন্তু বাস্তব জনগন হচ্ছে পুরুষ।

কেননা প্রতিনিধিত্বশীল কাঠামোতে পুরুষই সাধারণ জনগন। সে হিসেবে নারীর যে সামাজিক নির্মান - তা ভ্রান্ত। প্রতিটি নির্বাচনের মহড়া ও মিছিলে নারীর অভিগম্যতা কম। কাজেই সামাজিক শক্তি হয়ে ক্ষমতার একটি বলয়সূচিতে বিদ্যমান বাধাসমূহের কারণে নারী কম দৃশ্যমান। এমনকি কোটা ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হলেও যে ক্ষমতা মাঠে-ঘাটে থাকে সে ক্ষমতায় কর্তৃত্ব পুরুষের হাতে।

ফুঁকো যে জ্ঞানের কথা বলেছেন, সেই জ্ঞানে মানুষের বদলে আদতে পুরুষকে বোঝায় কিম্বা কোনো একটি প্রবন্ধ বা কবিতায় ‘তিনি’ উল্লেখ থাকলে এটি অনিবার্যভাবে পুরুষ। যেমনটি ধর্মগ্রন্থে ঈশ্বরকে পুরুষ জ্ঞানে ব্যাখ্যা করা হয়। কাজেই জ্ঞানের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন দখল তৈরীর যে কৌশল, সে জ্ঞানের মৌলিক অভিধানসমূহে নারীর জন্যে জ্ঞানের স্থান অতি সামান্য। কাজেই পুরুষের জ্ঞান বা পুরুষের জন্যে জ্ঞান বা পুরুষ উৎপাদিত জ্ঞান একটি প্যাকেজ, যা পুরুষ ক্ষমতার নির্দেশক। এ কারণে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্ষমতার আলোচনায় নারী হচ্ছে অচিহ্নিত দল ( Unmarked Category )।

অনেকে হয়তো বলে থাকবেন ক্ষমতার বলয়ে নারী প্রান্তিক, আবার তেমনটা নাও হতে পারে। তবে সহিংসতার মাধ্যমে যে ক্ষমতার প্রয়োগ হয়। পিতৃতন্ত্র তা ভালোভাবেই করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে তার পক্ষে রয়েছে সামাজিক রীতি-নীতি, ধর্মীয় বিধিনিষেধের আদর্শ। অধুনা বিশেষ যে জ্ঞান নিধারণ করে দিচ্ছে ক্ষমতার রাজদন্ড।

ফুঁকোর আলোচনায় সে জ্ঞান আর ক্ষমতা আদতে একই বস্তু। এই আলাপে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন উলরিখ বেখ। তিনি বিশ্বায়ন বাস্তবতার মধ্যে ঝুঁকি বলে একটি প্রত্যয়ের আমদানী করেন। বিশ্বায়ন পূর্ব সময়ে অজ্ঞানতা ছিলো বড় ঝুঁকি। এখন জ্ঞান মোটামুটি সবার আয়ত্বে আসার কারণে জ্ঞানই বড় ঝুঁকি।

বেখ তার The Risk society বইতে উল্লেখ করছেন, এই আধুনিক শিল্প সমাজ প্রতিনিয়ত প্রাযুক্তিক অর্থনৈতিক ঝুকি নির্মাণ করে যাচ্ছে। যেনো এটিই তার একমাত্র কাজ। চোখ রাখুন জলবায়ু পরিবর্তনে। যার একটি চক্রাবর্ত প্রভাব থাকা সম্ভব। ফুঁকো আর বেখকে একসাথে মেশালে একটা ককটেল হয় - তার শিরোনাম হতে পারে ক্ষমতা মানেই ঝুঁকি।

নো রিক্স নো গেইম - বলে যে প্রবাদটি প্রচলিত, এ যেনো তারই প্রতিধ্বনি। এই ক্ষমতা যদি হয় পুরুষ, তাহলে পুরুষরাই সবচেয়ে বড় ঝুকিতে। অন্তত উনাদের মতামত তো এমনই। এই শ্রেনী মার্কসীয় শ্রেনী নয়, আবার সম্পত্তির বাটোয়ারায় নারীর সমানাধিকার নেই। কাজেই বংশের পূর্বতন মানুষের সম্পত্তির হস্তান্তরের মাধ্যমে ক্ষমতায় যে রুপান্তর, তাতে নারীর ভাগে ক্ষমতা/সম্পত্তি কমে আসছে অথবা আসছেই না।

আবার জ্ঞানের কথা বললে দেখা যাবে, পৃথিবীর লোকায়াত জ্ঞানের একটি বড় সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়েছে নারীর মাধ্যমে। কিন্তু এই জ্ঞানের রুপান্তরের সময় তা পুরুষের হাতে পড়েনারীর ভাগে কম হয়ে যাচ্ছে। কাজেই জ্ঞানের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজটি পুরুষের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র, আইন, ধর্ম সমাজ সবই জ্ঞানের। পুরুষের পক্ষে।

পাচ ধরণের ইতিবাচক ক্ষমতায় নারীর অভিগম্যতা আছে। শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতিতে নারীর অবস্থান আগের চেয়ে খানিকটা সংহত, যদিও স্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশেষত্বের ক্ষমতাও নারীর অবস্থান আগের চেয়ে খানিকটা সংহত, যদিও স্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশেষত্বের ক্ষমতাও নারীর হস্তগত আছে। তবে পুরস্কারের, স্বীকৃতির ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।

পন্ডস্ নারী দিবস, ফেয়ার এ্যন্ড লাভলী ফাউন্ডেশন বৃত্তি, রাধুঁনী নারী সম্মাননা নারীর ক্ষমতায়নের চেয়ে বহুজাতিক কর্পোরেট ক্ষমতাকে তুলে ধরে। আর দমনমূলক ক্ষমতার পুরোটাই প্রয়োগ হয় নারীর উপরেই। ঘরে-বাইরে, বিদ্যায়তনে, শাস্ত্রে সর্বত্রই ক্ষমতা প্রয়োগের জন্যে একটি সর্বসংহা ক্ষেত্রের দরকার হয়। ক্ষমতার বিশ্লেষণে নারী ক্ষমতার কেন্দ্রে নয়। বরং ক্ষমতার আলোচনায় নারী সচেতনভাবেই অনুপস্থিত।

**শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.