আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সর্বাধিক 'বোধ' নিয়ে গল্প বলার যে অন্ধকার

ঘরেও নহে পারেও নহে,যে জন আছে মাঝখানে...............

বেশ লোকজন জমে গেছে। পাড়া মাড়িয়ে-মুড়িয়ে লোকে কখন হুড়মুড় করে এবাড়িতে আসে,এসে ‘তামশা’ দেখে জানার বাকি ছিল না। দশ বছরের বালক হই আর ‘বাচ্চা’ই হই,স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ঝগড়ায় দেখার মধ্যে আছে অনেক কিছুই,এটুকু তখন বুঝি। সেজ চাচার দক্ষিণের বারান্দায় আমি একলা যেতাম না। পশ্চিমের চিপামতো,বারান্দামতো জায়গাটাতে এলেই কলমি ফুলের মতো লাগত।

লাটিমের মতো করে ঘুরতে পারলে হয়তো আরও তৃপ্তি পেতাম,লাল রেডিওটা কানের একেবারে কাছাকাছি রেখে সবচেয়ে বেশি জোরে গান বাজাতে পারলে আরও বেশি। উঠানে এসে মনে হলো বেশ দেরি হয়ে গেছে। বড়চাচা চলে গেছেন;ততক্ষণে চাচি ও অনেকটা থেমে থেমে গলাবাজি করছেন। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে মিনিট দশেক পার হবার জো। আমার বোন কেন কাঁদবে? কাঁদবে না কেন?আটবছরবয়েসী কারও কাঁদার জন্য খুব একটা কারণ লাগে না।

কিন্তু কারণ ছিল,বোঝার মতো কারণ বলার মতো না;মনে রাখার মতো কিন্তু মনে করিয়ে দেওয়াতে বাধা-বাধা লাগে। তখনও বিব্রত হতে শিখিনি। রাগে গলা ধরেছিলাম ,অনেকক্ষণ কথা বলিনি। বারবার খালি অভিশাপের মতো মনে মনে কথা বল বারবারই ভাবলাম এটা আবার দোষ হয় কীভাবে। এখনও মনে হয়,৩৩ বছর পরে আমি বিবেক দিয়ে পরখ করি,আবেগ ঝেরেঝুরে তবু অভিযোগ করি।

বড়চাচা তখন ইউ পি চেয়ারম্যান। পরপর দুইবার ছিলেন। সৎ ছিলেন আর সারাক্ষণের চিন্তা বলতে ছিল,কখন না জানি লোক জানাজানি হয়। মানুষ নিন্দা করে ধুয়ে দিতে পারে এমন কোন কারণ মনে হয় ছিল না,তবু চোখ জমিয়ে রাখতেন,মাথা বাঁচানোর চেষ্টায় তিনি কয়কেশ’বার ঘরোয়া চিল্লাপাল্লা করতন। লোক জড়ো হতো।

সবকথা ভিতর-বাহির হয়ে দেখা যেতে সবকিছুর রেজাল্ট উল্টা। সেবার চাচি ‘সের কে সের’ সুপারি -গাছেই নয়তো গাছের তলায় পড়ে গচ্চা যাচ্ছে,এ ও নিয়ে যাচ্ছে-বেচার লোভ সামলাতে পারেননি বোধয়, না হলে অন্য কেন কারণ ছিল। টাকার দরকার জরুরি হয়েও থাকতে পারে। চাচাকে জানানো যাবে না এ কথা অনেকে এমনিতেই বুঝে গিয়েছিল;তিনি নিজে থেকেও অনেককে না করলেন। আমার বোন বাদ ছিল।

গাছে কে উঠেছিল,কে হাটে নিয়ে গেল,ইচ্ছামতো জানিয়ে দিল দাদীকে,তারপর বড়চাচা,এরপর আর কিছু বাদ থাকল না। বড়চাচির ঝাঁঝে জব্দ হয়েছিল অনেকক্ষণ,পরে তো কেঁদেই দিল। সন্ধ্যা ততক্ষণে বেশ গাঢ়। মাকে দেখলাম,কিন্তু মুখের দিকে দেখলাম না। রাগ তাঁর উপরে কম হয়নি।

তিনি হয়তো মুষড়ে যাচ্ছিলেন,হয়তো রেগে উঠছিলেন ভিতর ভিতর। তেত্রিশ বছর পার হওয়াতে আরও আবছা লাগে। চাচির সাথে সেদিন ও কথা হলো। তখন মায়ের যে মুখ দেখলাম,সেই সন্ধ্যার ঘটনা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন মা, বিব্রত,কলের পানির স্রোত বুঝে যেন কুয়ার মতো দাঁড়িয়ে গেছেন। স্হির,শান্ত,বিব্রত।

২. তিন বছর পর। কথাটা মিথ্যা ছিল। স্কুলের বন্ধুদের তবু বললাম,আমার ঘর এটা,বাবা-মা পাশের ঘরটায় থাকেন। চারজন প্রায় চার ঘণ্টা ছিল। মা দুপুরের খাওয়ার আয়োজন শেষ হতেই ডাকলেন।

সাথে আমিও খেতে বসলাম । ভাত দিতে দিতে মায়ের শাড়ির আঁচল ঝ’রে ঝ’রে যাচ্ছিল,কয়েকটা পাকা চুল দেখা গেল,সে যাক। আমাদের সামনে তিনটা চীনামাটির প্লেট আর একটা অ্যালুমিনিয়াম-জাত বেজাত প্লেট!মায়ের মুখে বিদঘুট করে জানান দিচ্ছিল দশ-বারোটা কালো দাগ,সেও বড়ো কথা না। কেবল খাওয়াতে গিয়ে যতই আন্তরিকতা দেখাচ্ছিলেন,আধাবাধা রাগে ক্ষোভ চরম হয়ে উঠছিল ততই! ওরা সব চলে যেতেই বেগের বশে আর উচ্চ শব্দে যত অভিযোগ ছিল জানালাম। মায়ের কথা, “এড আর তেমন কি কতা!আমরা থাকমুনি বাঙলা ঘরে।

এই ঘরে একলাই থাকিস তুই। তর বাপেক কিছু কইসনা ,আমি বুজাইয়া ক’লি দেহিস তর বাপ খড়ি সরাইয়া জায়গা বাইর কইরব। ” মা একটুও রাগেন নাই। সে রাতে প্রথমবাররে মতো একা ঘুমানো। তেরো বছরের ‘যৌবন’ আমার কাছে দোলা দেওয়া ঢিলার মতো,‘জল তরঙ্গে’র সামনে কানপাতার মতো ঠেকছিল।

পুরো বিছানায় এপাশ ওপাশ করার সুখ আর অভিজ্ঞতা আজকের দিনে বোঝানো অসম্ভব;এখনকার রাতগুলোতে আবার বোঝাও সম্ভব না। পরদিন সকালে মায়ের মুখের কালো দাগ বেশি উদ্ধত লাগল। দাগগুলোকে তুলে ধরে ফুলে উঠেছে সারা মুখ। বিব্রত হলাম, মশাগুলোর কারণে বেশ লজ্জিত হতে হলো। ৩. ‘যাদুর বাঁশি’ ছবিতেদেখা যায় কয়েকটা ‘বিলাতি-মাটি’র গড়া সুয়ারেজের রিঙরাখা।

কষ্ট করা ঘর-কন্নার উপযোগি মনে করে ভাড়া দেওয়া হয় প্রতি রাতের জন্য। ফেরারি,প্রেমিক,সদ্য বিয়ে করা কিশোর হিরো-হিরোইনের কথা হচ্ছে এমনি আচমকা,একদিনের বাসর ঘরে। এবার গান। ‘আকাশ বিনা চাঁদ যেমন বাঁচিতে পারে না, যাদু বিনা পাখি তেমন থাকিতে............। ’ আমার স্বপ্ন খানিকটা এরকম ,মনে পড়ে ,আমার বেলায় গানের কথা এলোমেলো লেগেছে ,তবু আমার দিকে চেয়ে গাইতে গিয়ে সে নায়িকা একবারও আবেগে কাঁপে নাই।

ঘর গড়িয়ে পড়ে নাই কোনদিকে। ‘যাদু,পাখি এক দু’জনা’ -স্বপ্নের ভেতর আমি ভেতর ভেতর গাইছিলাম কিন্তু গলায় প্রকাশ পাচ্চ্ছিল না কিছুই ,সাড়া শরীর যার অনুভব টের পেয়ে প্রতি রোমের গোড়াকে জাগাতে পেরেছিল। সকাল হওয়ার আগেই জাগলাম,মনে হলো গানের শেষ হয়েছে,গায়িকা হারালাম মাত্র ,নয়তো কারও প্রাণ গেল, খোয়াব খেয়ে দেয়ে শেষ। এখন ভাবলে মনে হয় এমনিই ভাব ছিল। আসলেই কি তাই?অন্য কিছু কি ছিল যা সেই কিশোর বোঝে নাই,আজ আমি অতদূর যেতে পারি না?বিব্রত হই নি ?সেদিন ভেজা লুঙ্গির কী হবে,মনে হয়নি, রাতের কতো বাকি? ৪. তেরো বছর দুই মাসের বাবা আমি।

ছেলে কোন বয়েসেই দেখতে আমার মতো হবে না,এ নিশ্চিত,প্রায় সবাই বলে। মোটামুটি ঠাণ্ডা মেজাজ,বুঝলাম স্বভাবেও বাবাকে পাবে না। আজকে,সকালে একটা পিসির আবদার করেছে। ওর মায়ের পিসি তে বলতে গেলে সারাক্ষণ ওই বসে,তবু নিজের ঘরে চায়। শুনলাম এই দাবিতে মায়ের উপর চড়াও হয়েছে, এমন আগে হয়নি।

এই প্রথম বাপে-পুতে মিল পেলাম। আলাদা বিছানা, নিজের ঘরে কম্পিউটার। ছেলের মা বিরক্ত। আমার মায়ের কি কোন আপত্তি ছিল? ৫. আজ আবার মনে হচ্ছে রাত কোনদিন এত ঘন হয় নাই। সব অভিজ্ঞতা বাদ রেখে যদি জানালা বন্ধ করে দাঁড়াই,ঘটবে কিছু?অন্ধকারে ,স্মৃতির গন্ধ পেয়ে গুলিয়ে উঠছি।

সবকিছু সবিশেষ নির্বাসনে পাঠাবো? তেরো বছরের ছেলের চোখ স্পষ্ট আমার মতো। কেউ খেয়াল করে দেখে নাই? বিব্রত হওয়ার মতো আমার কোন ঘটনার প্রতিবেদন পড়ছি যেন ‘প্রথম আলো’য়!‘সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক’।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.