আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জামালপুরের লুটেরা কামরুজ্জামান ও মীরপুরের কসাই কাদের মোল্লা



রিপোর্ট @ মিলটন আনোয়ার @ আমাদের সময় - ১৩ জুলাই ২০১০ কামরু রাজাকার জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের সময় জামালপুরে আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিলেন। তখন তিনি জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার নেতা ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কামারুজ্জামানের স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা ও যুদ্ধাপরাধের বিবরণসহ তৎকালীন সংবাদপত্র, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থ ও নির্যাতিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা গেছে। তিনি সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সম্পাদক ও জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক। ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদেনে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের ২৫তম আজাদি দিবস উপলক্ষে মোমেনশাহী আলবদর বাহিনীর উদ্যোগে মিছিল ও সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়।

স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এ সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব করেন আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক কামারুজ্জামান। জামালপুরের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হিসেবে আলবদর বাহিনী গড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে জামায়াত নেতৃত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে পারে যে, ছাত্র সংঘকে তারা সশস্ত্র করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাধারণ তৎপরতা চালানো ছাড়াও বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য বিশেষ স্কোয়াড হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। পরীক্ষামূলকভাবে সারা ময়মনসিংহ জেলার ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের আলবদর বাহিনী হিসেবে সংগঠিত করে সশস্ত্র ট্রেনিং দেয়া হয়। এ সাংগাঠনিক কার্যক্রমের পরিচালক ছিলেন কামারুজ্জামান। কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে মাসখানেকের মধ্যেই ময়মনসিংহ জেলার সব ছাত্রসংঘ কর্মীকে আলবদর বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

’ শেরপুরের একজন শহীদের পিতা ফজলুল হক যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত গণতদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন, তার ছেলে শহীদ বদিউজ্জামানকে মুক্তিযুদ্ধের সময় আষাঢ় মাসের একদিন কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে ১১ জনের একটি দল ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর শহীদের বড় ভাই হাসানুজ্জামানের দায়ের করা মামলায় কামারুজ্জামান অন্যতম আসামি ছিলেন। শেরপুরের শহীদ গোলাম মোস্তফার ভাই শাহজাহান তালুকদার জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ২৪ আগস্ট আলবদররা গোলাম মোস্তফাকে শেরপুর শহরের সড়ক থেকে ধরে নিয়ে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। শেরপুর শহরের সুরেন্দ্রমোহন সাহার বাড়িটি দখল করে আলবদররা তাদের ক্যাম্প বানিয়েছিল। সে ক্যাম্পে গোলাম মোস্তফাকে ধরে নিয়ে আলবদর তার গায়ের মাংস ও রগ কেটে, হাত বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় শেরী ব্রিজের নিচে।

সেখানে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কামারুজ্জামানের প্রত্যক্ষ নির্দেশেই এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল। শেরপুরের জাতীয় পার্টির নেতা এমদাদুল হক হীরা জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকেই কামারুজ্জামানের সহায়তায় পাকিস্তানিরা তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছিল। সেখানে তারা পাঁচটি বাঙ্কার বানিয়েছিল। অপর একজন প্রতক্ষদর্শী মুশফিকুজ্জামান জানিয়েছেন, ৭১ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে কামরুজ্জামানের নির্দেশ ও উপস্থিতিতে তিনআনি বাজারের বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো লুট হয়।

শেরপুরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, রাজাকার ও আলবদরদের দিয়ে নিরীহ লোকজনদের ধরে আনা এবং তাদের লাশ বহন করতে ব্যবহৃত ট্রাকগুলোর একজন চালক জানিয়েছেন, কামারুজ্জামান নকলার মুক্তিযোদ্ধা হত্যার বাড়ি পোড়ানোর জন্য পাকিস্তানি বাহিনীকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যান। তখন হত্যার বাড়ি থেকে কামারুজ্জামান প্রায় একশ মণ চালও লুট করেন। এ ছাড়া কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদররা সাধারণ মানুষের গরু, ছাগল ধরে নিয়ে আসত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তিসহ অন্যান্য জমি-সম্পত্তি জোর কর দখল করতেন বলে জানিয়েছেন এ ট্রাক চালক। কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে সে সময় ডাকাতির অভিযোগও পাওয়া গেছে। কসাই কাদের মোল্লা জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার মিরপুর এলাকার স্থানীয় বাঙালিদের কাছে ‘জল্লাদ’ ও ‘কসাই’ নামে পরিচিত ছিলেন।

স্থানীয় অধিবাসীরা জানিয়েছেন, শিয়ালবাড়ী ও রূপনগরসহ সমগ্র মিরপুর এলাকায় হাজার হাজার বাঙালি হত্যার প্রধান নায়ক ছিলেন কাদের মোল্লা। স্বাধীনতার পর দেশের অন্যতম বৃহৎ গণকবর আবিষ্কৃত হয় মিরপুরের শিয়ালবাড়ীতে। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ই কাদের মোল্লার নেতৃত্বে মিরপুরে বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। মিরপুরের তালতলার বাসিন্দা মো. ফরজ আলী যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত গণতদšক্স কমিশনকে জানান, তার ছোট ভাই মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র শহীদ পল্লবকে কাদের মোল্লার নির্দেশে পাকি¯ক্সানি হানাদার বাহিনীর স্থানীয় দালাল ও স্বাধীনতাবিরোধীরা হত্যা করেছে। মার্চের প্রথম থেকেই শহীদ পল্লব স্থানীয় বাঙালি ও অবাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন।

এসব কারণে স্বাধীনতাবিরোধীদের হত্যা পরিকল্পনায় তার নাম যোগ হয়। ৭১ সালের ২৯ মার্চ স্বাধীনতাবিরোধীরা পল্লবের অবস্থান জানতে পেরে নবাবপুর থেকে তাকে ধরে মিরপুরে কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে যায়। পরে কাদের মোল্লার নির্দেশে তার সহযোগীরা পল্লবকে মিরপুর ১২ নম্বর থেকে ১ নম্বর সেকশন শাহ আলী মাজার পর্যšক্স হাতে দড়ি বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় এবং একইভাবে তাকে ১১ নং সেকশনের ঈদগাহ মাঠে নিয়ে যায়। সেখানে গাছের সঙ্গে বেঁধে পল্লবকে দুইদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর ঘাতকরা তার হাতের আঙুল কেঁটে ফেলে।

তারপর আবদুল কাদের মোল্লা তার সহযোগী আখতার ও অন্যদের নির্দেশে পল্লবকে গুলি করা হয়। প্রতি রাউন্ড গুলির জন্য কাদের মোল্লা পুরস্কারও ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৭১ এর ৫ এপ্রিল ঘাতক আখতার গাছে ঝোলানো পল্লবের বুকে পরপর ৫টি গুলি করেন। পল্লবকে গুলি করে হত্যার পরও কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা তার লাশ দুইদিন গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিল মানুষকে ভীতসন্ত্র¯ক্স করার জন্য। এরপর ঘাতকরা পল্লবের লাশ মিরপুর ১২ নং সেকশনে কালাপানি ঝিলের পাশে আরো ৭ জনের লাশের সঙ্গে মাটি চাপা দেয়।

১৯৭১ সালে মিরপুরে কাদের মোল্লার দুষ্কর্মের অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী মো. শহিদুর রহমান চৌধুরী জানান, ’৭১ সালের অক্টোবরে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে রাজাকাররা মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে মহিলা কবি মেহেরুন্নেসাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেখে সেই বাড়ির সিরাজ নামে এক ব্যক্তি তখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন, তিনি এখনো একইরকম আছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ মিরপুর ১২ নং সেকশনের সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজের গেটের সামনে ৭ মার্চকে সামনে রেখে স্বাধীনতাকামী জনতার একটি সভা হয়। সেই সভায় অংশগ্রহণকারীরা ‘জয় বাংলা’ সে­াগান দিলে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে তার সহযোগীরা ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগান দিয়ে তলোয়ার, দা ও অন্যান্য ধারালো অস্ত্র হাতে সভায় হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে আহত করে। এই তথ্য দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী মো. শহিদুর রহমান।

সাক্ষ্যদাতারা আরো জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে কাদের মোল্লা মনিপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া এবং মিরপুর ১২ নং সেকশনে বসবাসকারী অবাঙালিদের নিয়ে নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী গঠন করেছিলেন। তাদের সহযোগিতায় কাদের মোল্লা মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে শিয়ালবাড়ী, রূপনগর, বালুঘাট প্রভৃতি স্থানে ধরে নিয়ে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেন।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.