আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীনের বাদশাহ ।। রেজা ঘটক

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

জীনের বাদশাহ । । রেজা ঘটক আষাঢ়ের মেঘ গুড়ি গুড়ি জটলা পাকিয়ে আমাদের ঘিরে বসেছে স্বাধীনতা চত্বরে। উদ্যানের গাছগুলো সারাদিন আষাঢ়ের ঘন বর্ষায় স্নান করে করে এখন গা শুকিয়ে নিচ্ছে। প্রকৃতি যেন এখন সদ্য স্নান হওয়া এক উর্বষী বালিকা।

শরীরে তার ভেঁজা ঘ্রাণ। সোডিয়াম লাইটগুলো এক লাফে জ্বলে উঠে জানান দিল রাজধানীতে এখন ঝুপ ঝুপ অন্ধকার ছাপিয়ে সন্ধ্যা নামছে। ঝিঁঝিঁ পোকারা থেমে থেমে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গেয়ে যাচ্ছে। মৃদু বাতাস না শীত না উষ্ণ প্রকৃতি বেশ শান্ত যেন গল্প শোনার জন্য অপো করছে। আমাদের অপোর পালাও শেষ।

মামু জুয়েল এসে যোগ দিল আড্ডায়। মামু জানতে চাইল মডেল হওয়ার ঘটনাটা আসলে কি? আমারেও ফোন করেছিল ওরা। আমি তখন ভীষণ ব্যস্ত। তাই ওদের সাথে ঠিকমত কথা বলতে পারিনি। আর আমার মনে হয়েছে ওরা কোন এ্যাড ফার্ম নয়, আমার কোন বন্ধু হয়তো দুষ্টামী করছে।

আমরা মামুর কথায় হেসে তখন গড়াগড়ি। মডেল হবার ফর্মুলাটা বেশ চমৎকার। এই নিয়ে আমাদের কাছে দশজনের খবর আসল। আর একজন হলেই এগারো জনের টিম করব আমরা। এগারো জন মডেল।

এগারো জন নতুন তারকা। বিল বোর্ডে সবার বড় বড় ছবি। আহ কী মজা। রাতারাতি তারকা। মামু জুয়েল বাদে নয়জনের মধ্যে চারজন মডেল হতে গিয়ে মোবাইল খুইয়েছে।

যেতে পারেনি পাঁচজন। শিশির, ইভা, সাগর, শর্মী আর মিজান। মডেল হতে গিয়েছিল বরিশাল থেকে তুহিন, ছবির হাট থেকে লিমন, শ্যামলী থেকে রং আর ইস্কাটন থেকে আমাদের শুভ। এবার আমরা ফয়সালের মুখে শুনব শুভ মডেল হতে গিয়ে কী অভিজ্ঞতা অর্জন করল। সেদিন ছিল শুক্রবার।

সকাল ১০ টায় শুভ’র সেল ফোনে একটা ফোন আসে। আপনি কী শুভ ভাই বলছেন? আমরা দিকবিদিক এ্যাডভারটাইজিং হাউজ থেকে বলছি। আমরা ঢাকাসহ সারা দেশে একটা কনজুমার প্রোডাক্টের বিল বোর্ডে বিজ্ঞাপনের জন্য মডেল খুঁজছি। আমরা জানি, আপনি একটা নাট্যদলে কাজ করেন এবং আপনার অভিনয় দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের। আমাদের বিল বোর্ডে বিজ্ঞাপনের জন্য মডেল হিসেবে আপনাকে আমরা পছন্দ করেছি।

ন্যুনতম এক বছরের জন্য আপনাকে আমরা আমাদের প্রোডাক্ট মডেল হিসাবে বাছাই করেছি। আপনি যদি মডেল হতে ইচ্ছুক হন এবং আমাদের সাথে কাজ করতে রাজী থাকেন তাহলে আজ দুপুর ১২টার মধ্যে গুলশান-২-এ চলে আসুন। শুভ তখন কিছু পাল্টা প্রশ্ন করেছিল বটে কিন্তু এমন চমকে দেবার মত একটা সুযোগ হাতছাড়া করে কীভাবে? আধঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে শুভ গুলশান রওনা দিল। দিকবিদিক এ্যাডের একজন মার্কেটিং অফিসার শুভকে গুলশানে রিসিপ করলেন এক ঘণ্টা পর। এবার তিনি ডিরেক্টারকে ফোন দিলেন।

ডিরেক্টার জবাবে জানালেন ওনাকে উত্তরা নিয়ে আসো। আমি শুটিংয়ে আছি। মার্কেটিং অফিসার বললেন- চলুন উত্তরা, ডিরেক্টার স্যার ওখানে আছেন, ফাইনাল কথাবার্তা স্যারই বলবেন। তারপর ওরা একটা হলুদ ট্যাক্সিক্যাব হায়ার করে। পথে মার্কেটিং অফিসার বসের সঙ্গে একবার কথা বলেন।

সেই ফাঁকে তিনি জানান- আমরা ট্যাক্সিক্যাবে আসতেছি। স্যার আমার ফোনের চার্জ শেষ, এসে কথা বলব। কিছুণ পরে ডিরেক্টার স্যার স্বয়ং শুভ’র মোবাইলে ফোন করেন। হ্যা, আপনারা মাসকাট প্লাজার সামনে আসুন। আর ফোনটা আপনার সাথে থাকা আমার লোককে একটু দেন।

ইতিমধ্যে ট্যাক্সিক্যাব উত্তরা রাজলীর সামনে একটু থেমেছে মার্কেটিং অফিসারের ইসারায়। কথা বলতে বলতে তিনি গাড়ির দরজা খুলে বাইরে নামেন। এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কথা বলতে বলতেই রাজলী মার্কেটের মধ্যে ঢুকে পড়েন। এতোণে শুভ বুঝতে পেরেছে ঘটনা আসলে কী ঘটল! শুভ এখন বিখ্যাত মডেল। মোবাইল ফোনের তারকা মডেল।

সারা দেশে বড় বড় বিল বোর্ডে শুভ’র বড় বড় ছবি। হা হা হা হা... .... .... মামু জুয়েল সব শুনে বলল- আল্লাহ বাঁচাইছে। ভাগ্যিস আমি ব্যস্ত ছিলাম, নইলে হয়তো আমিও যাইতাম। আমরা আরেক পশলা যে যার গায়ে হেসে গড়াগড়ি। মামু তুমি মডেল হবার সহজ চাঞ্চ মিস করলা? হা হা হা হা .... .... .... এরপর ইখতার জানাল যে ওই এ্যাড হাউজের সর্বশেষ শিকার আমাদের লিমন।

তাই নাকী? কস কী? লিমন মানে আমাদের ডিরেক্টার কাম স্ক্রিপ্ট রাইটার অভিনেতা লিমন? লিমনের ঘটনা তো শুনিনি। ক’তো লিমনের কী হইছিল? ইখতার শুরু করল- ওইদিন লিমনের মোবাইলে ওইরকম একটা ফোন আসে। তারা জিগায়- আপনি কী লিমন ভাই বলছেন? আমরা দিকবিদিক এ্যাডভারটাইজিং হাউজ থেকে বলছি। আমরা ঢাকাসহ সারা দেশে একটা কনজুমার প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপনের জন্য স্ক্রিপ্ট রাইটার খুঁজছি। আমরা জানি, আপনি একটা নাট্যদলে কাজ করেন এবং আপনার অভিনয় আর টিভির জন্য লেখা নাটকগুলো দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের।

আপনার স্ক্রিপ্ট লেখার কৌশলটা ভারী চমৎকার। আমাদের বিজ্ঞাপনের জন্য স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে আপনাকে আমরা পছন্দ করেছি। ন্যুনতম এক বছরের জন্য আপনাকে আমরা আমাদের প্রোডাক্ট স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসাবে পেতে চাই। আপনি যদি আমাদের স্ক্রিপ্ট রাইটার হতে আগ্রহী হন এবং আমাদের সাথে কাজ করতে রাজী থাকেন তাহলে বনানী আমাদের অফিসে চলে আসুন। জবাবে লিমন জানতে চায়- আপনাদের অফিসের ঠিকানা বলুন।

ওপাশ থেকে জানতে চাওয়া হয়- আপনি এখন কোথায়? - আমি শাহবাগ। লিমনের জবাব। - আচ্ছা শুনুন, আপনি যদি ছবিরহাটের দিকে যান, ওখানে আমাদের একজন আছেন এখন, ওনার সাথে চলে আসতে পারেন। এরপর লিমনকে ছবিরহাট থেকে ওদের এক প্রতিনিধি ফোন করেন। তার সাথে দেখা হবার পর লিমন আর সে ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে বনানী রওনা দেয়।

মহাখালী গিয়ে একইভাবে ফোন নিয়ে সটকে পরে ওত পেতে থাকা এ্যাড হাউজের সেই লোকটা। খালি হাতে ফেরৎ আসে স্ক্রিপ্ট রাইটার লিমন। আমরা আবারো হো হো করে গড়াগড়ি যাই। শিশির, শর্মী, ইভা, মিজান, সাগরও ওদের ফোন পেয়েছিল। ওরা কেউ কেউ যাবার জন্য উতলাও ছিল।

কেউ কেউ সময় করতে পারেনি। কেউ কেউ পরের দিন ভুলে গেছে। তবে শিশির ডাউট করেছিল যে ওরা কোন সমস্যা করতে পারে। তাছাড়া দেখি না একবার কারা আমাকে মডেল বানাতে চায়। তাই শিশির মিজানকে ফোন করেছিল।

আর মিজান জানায় সেও একই রকম ফোন পেয়েছে। সময় পেলে যেতে চেষ্টা করবে। কিন্তু শিশির বিষয়টা নিয়ে অনেক চিন্তা করে র‌্যাবের এক অফিসারের সাথেও কথা বলেছে। র‌্যাবের ওই মহিলা অফিসার পরামর্শ দিয়েছিলেন- আপনি একা যাবেন না। সঙ্গে কাউকে নিয়ে যান।

আর সমস্যা দেখলে আমাদের জানাবেন। মিজানও সময় করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত শিশিরের আর যাওয়া হয়নি। এই ফাঁকে আমরা চিড়ার মোয়া আর সিখারেট খাই। আর মামু জুয়েল জানায়- এরচেয়ে জীনের বাদশাহর খবর আরো ইন্টারেস্টিং।

আমরা সমোস্বরে জানতে চাই- জীনের বাদশাহ আবার ক্যাঠায় গো মামু? মামু জুয়েল শোনায়- ওইডা আমার শ্বশুরের ঘটনা। রোজ রাতে আমার শ্বশুর একজনের সাথে মোবাইলে কথা বলেন। কিছু দিন যেতে না যেতে দেখা গেল শ্বশুর আমার বদলে যাচ্ছে। ওদিকে পরিবারের সবাই তখন তাঁকে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। কার সাথে কথা বলেন কিছুই উনি স্বীকার করতে চান না।

আমার দাদী শ্বাশুড়ি অনেক পিড়াপিড়ি করলে জবাবে শ্বশুর মশাই বলেন যে- আমি জীনের সাথে কথা বলি। শুনে আমরা সবাই আরো বিস্মিত হই। এরপর আমরা গোপনে পরিকল্পনা করে ঠিক করি- ওনার টেলিফোন কথোপকথনের সময় ঘরের সবাই ওৎ পাতব। রাত আড়াইটা। শ্বশুরের ফোন আসল।

শ্বশুর মশাই মনে করেছেন আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছি। উনি জীনের সাথে কথা বলা শুরু করলেন। আমরা শুনতে পাচ্ছি- শ্বশুর মশাই ফোনের এপাশে শুধু বাবা বাবা করছেন। তারপর আমরা সবাই তাঁর ঘরে ঢুকলাম। আজ আপনাকে বলতে হবে কার সাথে কথা বলেন? কী নিয়ে কথা বলেন? শ্বশুর মশাই বলতে চান না।

আমার দাদী শ্বাশুরি, শ্বাশুরি, আমার বৌ সবাই মিলে আমরা ওনাকে চেপে ধরলাম। আজ বলতে হবে ঘটনা কী? এরপর শ্বশুর মশাই স্বীকার করলেন যে জীনের সাথে ওনার কথা হয়। আমরা জানতে চাই কী কথা হয়? শ্বশুর মশাই বলেন- জীনের বাদশা বাংলাদেশে দুইজন লোক খুঁজে পেয়েছেন। একজন ওনার খাদেম আরেকজন আমি। আমাদের এই দুইজনকে উনি কিছু সোনার মহর দিয়ে সৌদি আরব চলে যাবেন।

আমাকে উনি ওনার কথিত জায়গায় দেখা করার জন্য বলেছেন। আগামী অমাবশ্যার রাতে ওনার খাদেম যে মাজারে আছেন সেখানে আমাকে যেতে বলেছেন। আমরা জানতে চাই আর কী কী বলেছেন? শ্বশুর মশাই জানান- যাবার সময় আমাকে একটা গরু, এক মণ সিন্নির চাল আর মাজারের জন্য কিছু খরচ সঙ্গে নিতে বলেছেন। আমরা জানতে চাই- মাজারের খরচ কতো? - এক লাখ বিশ হাজার টাকা। শ্বশুর মশাইর জবাব।

- আপনি কী সেখানে যেতে চান? ওনার মেয়ের প্রশ্ন। - হ্যা, আমি আগামী অমাবশ্যার রাতেই যেতে চাই। - কিন্তু জায়গাটা কোথায়? আমার জানতে চাই। - ওটা বাবা তিন দিন আগে জানাবেন। - তারপর? আমাদের সমোস্বরে জিজ্ঞাসা।

রোজ রাতে তাদের কথা হতে থাকে। জীনের বাদশা বলেন- কোরআন শরীফ আমার মুখস্থ। আমরা নূরের তৈরি আর তোমরা মানুষ। আল্লাহ আমাদের ভুলের জন্য একটা শাস্তি দিয়েছেন। তাই তোমাদের মত আমরা পৃথিবীতে বসবাস করতে পারিনা।

আমরা আকাশে থাকি। কিন্তু আমাদেরও আল্লাহর সেবা করতে হয়। কোরআন শরীফ পড়তে হয়। নামাজ কায়েম করতে হয়। মানুষের উপকার করতে হয়।

আমাদের ওপর আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ- তোমরা আসল মুসলমানকে সব সময় উপকার করবে আর আমার কথা স্মরণ করিয়ে দিবে। বাংলাদেশে আমি এবারের জন্য দুইজন খাঁটি মুসলমান পেয়েছি। একজন আমার সত্যিকার খাদেম। আরেকজন তুমি। আমাকে সৌদি আরবে হজ পালনে যেতে হবে।

আর তার আগেই তোমাদের দুজনকে আমার সোনার মহরগুলো দিয়ে যেতে চাই। মনে রেখো- অমাবশ্যার রাতে আমার খাদেমের মাজারে তুমি আসবে। যা যা বলেছি, যেভাবে যেভাবে বলেছি সব সঙ্গে আনবে। মনে রেখো, যদি কোন ভুল করো তোমার অনেক তি হবে। তোমার বংশ নিঃবংশ হয়ে যাবে।

তোমার নিজের মৃত্যুর সময় প্রচুর কষ্ট হবে। তোমার বংশে কেউ আর জীবিত থাকবে না। সবাই অপঘাতে মারা যাবে। মনে রেখো- আমি তোমার জীনের বাদশাহ। আর আমার কথা তুমি অগ্রাহ্য করলেই তোমার বিপদ।

তুমি বিপদ চাও নাকি আল্লাহর পাঠানো উপঢৌকন নিতে চাও, তা তুমিই ঠিক করো। মনে রাখবা- পৃথিবীতে তোমাদের সকল কর্মকাণ্ডের একদিন বিচার হবে। আর সেদিন আমি তোমার পক্ষে নাকি বিপক্ষে সাক্ষি দিব তা তুমিই ঠিক করো হে মানব সন্তান। শ্বশুর মশাই জানতে চায়- আচ্ছা আপনি তো জীনের বাদশাহ। আপনি মোবাইলে কথা বলেন কীভাবে? জবাবে জীনের বাদশা বলেন- আজ আর কোন কথা নয়।

আগামীকাল ঠিক রাত বারোটায় আমি ফোন করব। তুই আমার এই নাম্বারে এক হাজার টাকা পাঠাস। নইলে তোর অমঙ্গল হবে। আর শোন, এই ফোনটা আমার খাদেমের। উনি একটা মসজিদের ইমাম।

উনি রাত এগারোটায় ঘুমিয়ে যান। উনি ঘুমিয়ে গেলে আমি ওনার ফোন নিয়ে তোকে ফোন করি, বুঝলি। আরেকটা কথা তুই বিশ্বাস রাখিস- জীনেরা সবকিছু দেখতে পায়। এখন ঘুমিয়ে পড়। আর নামাজ কাযা করিস না।

দুনিয়া দুই দিনের বাহাদুরি। যা এখন ঘুমা। আর ফোনে টাকা পাঠাতে ভুলিস না যেন। হক মাওলা। জীনের বাদশাহর ফোন কেটে যায়।

পরদিন শ্বশুর মশাই একহাজার টাকা পাঠান ওই মোবাইলে। ঠিক রাত বারোটায় জীনের বাদশাহ আবার ফোন করেন। আমার শ্বশুর শুধু এপাশে জী বাবা, জী বাবা করতে থাকেন। শ্বশুর মশাইয়ের সুস্পষ্ট ধারণা উনি জীনের বাদশাহ-ই হবেন। পুরো কোরআন ওনার মুখস্থ।

ওনেক সময় কথা না বলে উনি শুধু কোরআন তেলোআত করেন। আমরা ক্রমে উদ্বিগ্ন হতে থাকি। শ্বশুর মশাই কী পাগল হয়ে যাচ্ছেন! নইলে এইরকম আচরণ কেন করছেন? তিনি ঠিক করেছেন আগামী বুধবার অমাবশ্যা। আর ওই রাতেই তিনি সবকিছু নিয়ে রওনা হবেন। সেই অনুযায়ী উনি একট বড় গরু কিনেছেন।

এক মণ চাল কিনেছেন সিন্নির জন্য। আর মাজারের খরচ বাবদ এক লাখ বিশ হাজার টাকা আলাদা করে রেখেছেন। আমরা কেউ ওনাকে কিছু শোনাতে পারছি না। উনি যাবেন-ই যাবেন। আর ফোনে কথা বলার সময় উনি আমাদের কাউকে ফোন দিতে চান না।

গত রবিবার রাতে জীনের বাদশা ফোনে শ্বশুর মশাইকে দিনাজপুরের একটা মাজারের ঠিকানা দিয়েছেন। বলেছেন ওখানে অমাবশ্যার রাতে তাকে সোনার মহর হস্তান্তর করেই তিনি সৌদি আরবে রওনা হবেন। আমরা জানতে চাই দিনাজপুরে কোন মাজারের কথা বলেছেন? আর ওখানে আপনি কীভাবে যাবেন? কীভাবে যেতে বলেছেন? জবাবে শ্বশুর মশাই বলেন- আমাকে গাবতলি থেকে বাসে উঠতে বলেছেন। যে বাসে আমি উঠব সেই বাসের নাম, সিট নম্বর আর আমার সময় সূচি ফোন করে বাবাকে জানাতে বলেছেন রওনা দেবার আগে। আমরা জানতে চাই আপনি কী যেতে চাচ্ছেন? শ্বশুর মশাইর জবাব- না গিয়ে আমার আর কোন উপায় নেই।

তোমরা আল্লাহ আল্লাহ করো। আমরা আবদার করি- আমরা একবার জীনের বাদশাহর সঙ্গে কথা বলতে চাই। কিন্তু শ্বশুর মশাই রাজী না। মঙ্গলবার রাত দেড়টায় জীনের বাদশাহ আবার ফোন করেন। শ্বশুর মশাই ফোন ধরে বলেন- জী বাবা, আমি ভোরেই রওনা দেব।

সব কিছু ঠিক মত গুছিয়েছি। এখন আপনার দোয়ায় সকালে রওনা হব। ঠিক এই সময় আমার দাদী শ্বাশুরি চিৎকার করে ওঠেন। কীসের জীন সে? দে ফোনটা আমারে দে, আমি কথা বলব। ওপাশ থেকে জীনের বাদশাহ হুঙ্কার দেন- তোর ঘরে মেয়ে মানুষের কণ্ঠ কেনরে? তুই নিজের তি নিজে ডেকে আনছিস! শ্বশুর মশাই জবাব দেন- উনি আমার মা।

আপনার সাথে কথা বলতে চায় বাবা। জীনের বাদশাহ জবাব দেয়- আমি মেয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলিনা বোকা। তুই নিজের তি করিস না। আমার কথা মত রওনা দে। দাদী শ্বাশুরি তখন শ্বশুর মশাইর কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করে- তুই কোথাকার জীন আমারে ক? আমি তোর জীনের বাপ! শয়তান কোথাকার? আমারে চিনোস তুই? তোর জীন গিরি আমি পানিতে চুবাইয়া ছুডাইয়া দিমু।

ফাজিল কোথাকার? ওপাশ থেকে জীনের বাদশাহ জবাব দেন- তুই স্ববংশ নিঃবংশ হবি। তোর ঘরে দুবলা গজাবে। তুই ধ্বংস হয়ে যাবি। ওদিকে শ্বশুর মশাই সবাইকে সাবধান করে দেন- আমরা যেন বাবার সাথে বেয়াদবি না করি। কারণ, উনি নাকি সত্যি সত্যিই জীনের বাদশাহ।

কিন্তু আমার দাদী শ্বাশুরি তখন জীনের বাদশাহর সঙ্গে প্রচণ্ড গালাগালিতে লিপ্ত। এক পর্যায়ে দাদীর থেকে ফোনটা আমি নেই। জীনের বাদশাহর কাছে জানতে চাইÑ আপনি তো জীনের বাদশাহ। বলেন তো আমি কে? আমার বাড়ি কোথায়? আমি কী করি? আমি আপনার ভক্তের কে? আমি একটা আরবি বলব আপনি বাংলা অর্থ বলবেন? ওপাশ থেকে জীনের বাদশাহ জবাব দেন- আমি ভক্ত ছাড়া কারো সাথে কথা বলিনা। আর তুই আমার সঙ্গে বেয়াদবি করছস।

তুইও মরবি। তোর বউ মরবে। তোর বংশও ধ্বংস হবে। আমার সঙ্গে বেয়াদবি! আমি পাল্টা প্রশ্ন করি- দিনাজপুরে কোথায় যেতে হবে বল। তোর জীনের গুষ্ঠি আমি দেখে আসব।

ফাজিল কোথাকার? ফাজলামো পাইছস? এবার জীনের বাদশার মেজাজ আরো চড়া হয়। জীনের বাদশাহ জবাবে বলেন- তোর কেমন মতা তুই পারলে দিনাজপুরে আয়? তোরে মাটির সঙ্গে মিশাইয়া দেব শয়তান কোথাকার। জীনের সঙ্গে বেয়াদবি! ইনসানে তোর বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর আমি জীনের বাদশাহকে বলি- তোর এতো মতা থাকলে পারলে ঢাকায় আয়? দেখি তোর কেমন মতা? জীনের বাদশাহ জবাবে বলেন- আমি ঢাকায় যাই না। তুই সাহস থাকে তো দিনাজপুরে আয়।

আর শোন ফোনটা তুই আমার ভক্তকে দে। নইলে তোর এখনই রক্ত বমি শুরু হবে। আর তুই পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিশ্চিন্থ হয়ে যাবি। পৃথিবীর আলো বাতাস তোর জন্য হারাম হয়ে যাবে। এরপর ফোনটা আমি আবার শ্বশুর মশাইর হাতে দেই।

জীনের বাদশাহ বলেন- শোন, তুই আমার সঙ্গে বেইমানী করেছিস। তোর বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। তোর মেয়ে মরবে। তোর ছেলে মরবে। তোর বউ মরবে।

তোর মা মরবে। তোর চৌদ্দ গুষ্ঠি মরবে। তুই মরবি। তোর ঘরে দুর্বা ঘাস গজাবে। আর শোন, তোর জন্য এখনো একটা সুযোগ আছে।

তোর মাজারের খরচ এখন পাঁচ লাখ লাগবে। শ্বশুর মশাই বাবা বাবা করতে থাকেন। আর বলেন- এতো টাকা আমি কোথায় পাবো বাবা? জীনের বাদশাহ জবাবে বলেন- তোর টাকা আছে আমি জানি। আমাকে মিথ্যা বললে তোর আরো তি হবে। ভালো চাস তো আজ রাতেই রওনা দে।

নইলে সকালেই তোর ঘরে আগুন লাগবে। তোর জন্য আর মাত্র আড়াই ঘণ্টা সময় আছে। এখন তুই ঠিক কর। কী করবি? গরু, সিন্নির চাল আর টাকা নিয়ে রওনা দিবি নাকি বংশ নিয়ে মরবি। তুই ঠিক কর।

তুই ঠিক কর। তুই ইজ্জত কর। কর কর কর কর কর.. .. .. জীনের বাদশাহ ফোন কেটে দেয়। আমার শ্বশুর মশাই হায় হায় করতে থাকেন। এখন কী হবে উপায়।

তাছাড়া আমরা সবাই অনেক বেয়াদবি করেছি জীনের বাদশাহর সঙ্গে। শ্বশুর মশাই পাঁচ লাখ টাকা নিয়েই রওনা দিতে রাজী। আমাদের কারো কথা তিনি শুনবেন না। সারা ঘরে একটা উদ্বিগ্ন। এখন কী হবে? শ্বশুর মশাই কারো কথাই আর শুনতে চাইছেন না।

তিনি রেডি হচ্ছেন। সারা ঘরে একটা লংকা কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে। শ্বশুর মশাই রেডি। আমরা ওনাকে যেতে দিব না। উনি যাবেন।

ভোরবেলা আযান দেবার আগে আগে শ্বশুর মশাই আমাদের শত বারণ অমান্য করে জীনের বাদশাহর উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। আমরা ঠায় শূন্য ঘরে বসে থাকি। মামু জুয়েলের গল্প বলা শেষ হয়। আমরা অন্ধকারে সবাই চুপ মেরে যাই। আষাঢ়ের আকাশে ঘন মেঘের গুরু গম্ভীর নিরবতা।

তারপর কী হল? অনেকণ নিরাবতা। এবার জুয়েল মামু অট্টহাসী দিয়ে জানায়- ওই দিন ভোরে মিরপুর থেকে জীনের বাদশাহ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। জীনের বাদশা এখন র‌্যাবের বড় মডেল। ইনসানের মডেল। ২৮ জুন ২০১০ ।

১৪ আষাঢ় ১৪১৭ । সোমবার গাবতলা, মগবাজার, ঢাকা।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.