আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় সান্ধ্যকালীন শিফট (বদরুদ্দীন উমর)

"যারা স্বর্গগত তাঁরা এখনো জানে স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি এসো স্বদেশ ব্রতের মহা শিক্ষা লভি; সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি। "

[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে তালা লাগিয়েছেন, এই সংবাদ পড়ে এই কর্মকান্ডের পেছনের কথা বুঝতে লেখাটি কপি পেষ্ট করা হলো সমকাল(২৫.০৫.২০১০) থেকে। --মাথা পাগলা] কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন সান্ধ্যকালীন ক্লাস নেওয়ার অর্থাৎ সান্ধ্য শিফট চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন আমি 'বিশ্ববিদ্যালয় না পাঠশালা?' নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রমণ্ডলী এই সান্ধ্য শিফটের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও এর বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ হয়।

শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই প্রতিরোধের মুখে সান্ধ্য শিফট চালুর সিদ্ধান্ত বাতিল করে। এ ঘটনার বেশকিছু আগে থেকে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শিফটের দাবি জানিয়ে আসছিল। শিক্ষা সম্মেলন করে সেখানেও তারা এই দাবির সপক্ষে অনেক আলোচনা করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় ছিল, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন সত্যি সত্যি দুই শিফট চালুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো তখন তার বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া দেখে তারা আর এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। তারা এতদিন উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই শিফটের পক্ষে যে যুক্তি বিস্তার করেছিল, সে যুক্তির ফাঁকা চরিত্র ছাত্ররাই নিজেদের আন্দোলনের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে 'বিশ্ববিদ্যালয় না পাঠশালা?' নামে যে প্রবন্ধ আমি লিখেছিলাম তাতে বলা হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস লেকচার আসলে শিক্ষার মুখ্য পদ্ধতি নয়, যেমন সেটা পাঠশালা বা স্কুলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় ক্লাস লেকচারের গুরুত্ব থাকলেও ছাত্রদের আসল কাজ করতে হয় লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরিতে। তাছাড়া যেখানে টিউটোরিয়াল ব্যবস্থা আছে, সেখানে টিউটোরিয়ালের কাজ করে। এই টিউটোরিয়াল পেপার তৈরির জন্য লাইব্রেরি কাজের কোনো বিকল্প নেই। ঢাকাসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজকাল যত ছাত্র ভর্তি করা হয়, তার জন্য উপযুক্ত কোনো ব্যবস্থাই নেই।

এর মধ্যে সব থেকে বেশি হৈচৈ হয় আবাসিক ব্যবস্থা নিয়ে। খাওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে ছাত্রক্ষোভ, বিশেষত ছাত্রীদের নিজেদের হোস্টেলের কামরায় নিজেদেরই রেঁধে খেতে হয়। এটা যে কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই এক কেলেঙ্কারি ব্যাপার। কারণ পড়তে এসে হোস্টেলে যদি ছাত্রছাত্রীদের রেঁধে খেতে হয়, তাহলে অহেতুক পরিশ্রম ও ক্লান্তির বিষয় বাদ দিয়েও পড়াশোনার জন্য সময় কমে আসে।

তাছাড়া কামরাকে রান্নাঘর বানিয়ে রাখা এক অস্বাস্থ্যকর ব্যাপার। কিন্তু এসব দিকে খেয়াল করা বা এসব সমস্যা সমাধানের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো আগ্রহ আছে এমন মনে হয় না। এ তো গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ছাত্রসংখ্যার তুলনায় তাদের থাকা-খাওয়ার অব্যবস্থার কথা। কিন্তু পড়াশোনার ক্ষেত্রে যে অসুবিধা তা হলো, ছাত্রসংখ্যার তুলনায় লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরি সুবিধা অনেক কম। বইপত্র এবং যন্ত্রপাতির কমতি তো আছেই, তার ওপর আছে স্থান সমস্যা।

একসঙ্গে লাইব্রেরিতে বসে ছাত্রদের পড়াশোনা করার মতো জায়গার অভাব আছে। ল্যাবরেটরিতেও আছে প্রয়োজনীয় জায়গার অভাব। এ অবস্থায় যদি দ্বিতীয় শিফট করা হয়, তাহলে তার ফল কী দাঁড়াতে পারে, এটা অনুমান করা কঠিন নয়। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের একটি হাটে পরিণত হয়ে শিক্ষার পরিবর্তে হট্টগোলের রাজত্বই সেখানে কায়েম হওয়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই 'হাট' চরিত্র ইতিমধ্যেই দেখা যায় এবং হাটের হট্টগোল এখন এক নিয়মিত ব্যাপার।

যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শিফটের চিন্তা করেন, এমনকি তা কার্যকর করতে নিযুক্ত হন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ধারণার অভাব আছে। তারা মনে করেন, লেকচারই হলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মূল পদ্ধতি। কাজেই লেকচারে উপস্থিত থেকে শিক্ষকদের বক্তৃতা শুনলেই ছাত্রদের উচ্চশিক্ষা এগিয়ে যায়। তার জন্য অন্য বিশেষ কিছুর প্রয়োজন হয় না। এই চিন্তা যদি তাদের মধ্যে না থাকত, তাহলে তারা অবশ্যই ভাবতেন লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরির অবস্থার কথা, সেখানে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা ও ল্যাবরেটরি কাজের বাস্তব অবস্থার কথা।

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। আজকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষক আছেন, তাদের একটা বড় সংখ্যা বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত থাকেন। এ কাজ করতে গিয়ে তারা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যথাযথভাবে মনোযোগ দেন না, সেখানে সময় দেন না এবং ক্লাস লেকচারের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে নিয়মিত পড়াশোনাও করেন না। এর ফলে তাদের পক্ষে যতটুকু পাঠ ছাত্রদের দেওয়া সম্ভব, সেটা দেওয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি সুসংগঠিত পাঠ ও গবেষণার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে বলার কিছু নেই।

কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা যদি নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে অতিরিক্ত অর্থের সন্ধানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দেন, তাহলে সেটা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হতে বাধ্য। সে ক্ষতি অবশ্যই হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের এই দায়িত্বহীনতা রোধ করতে সক্ষম হচ্ছে না। সন্দেহ হয়, এর কোনো গুরুত্ববোধও তাদের মধ্যে নেই এবং তারা এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতেও আগ্রহী নন। আজকের পত্রিকায় (ডেইলি স্টার, ২৪.৫.২০১০) দেখা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ 'কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে'র সান্ধ্যকালীন মাস্টারসের প্রোগ্রাম শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

এর প্রতিক্রিয়ায় ওই ডিপার্টমেন্টের ছাত্রছাত্রীরা এই প্রোগ্রাম বাতিলের দাবিতে ক্লাস বর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই 'বাণিজ্যিক কোর্স' বন্ধের দাবিতে কার্জন হলের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। তাদের কথা হলো, ডিপার্টমেন্টে শিক্ষকের সংখ্যা কম, তার ওপর এই শিক্ষকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন। এর ফলে তাদের পক্ষে রহ-পড়ঁৎংব ও সরফ-ঃবৎস পরীক্ষা সময়মতো নেওয়া সম্ভব হয় না। এছাড়া তারা পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর সময়মতো পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে পারেন না, কারণ খাতা দেখার সময় তাদের হয় না। এ অবস্থায় আবার সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু হলে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার অবস্থা কী দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

এই পরিস্থিতিতে ছাত্ররা অবিলম্বে দ্বিতীয় শিফট সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, কয়েকদিন আগে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্র রিপোর্টে দেখা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি ডিপার্টমেন্টে সান্ধ্যকালীন দ্বিতীয় শিফট চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, কিছুদিন আগে উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের অজুহাত দেখিয়ে বাণিজ্যিক কারণে দ্বিতীয় শিফট চালুর যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং যা মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই প্রতিরোধের মুখে বাতিল করা হয়েছিল, সেই বাণিজ্যিক প্রোগ্রাম এখন আবার গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে চালু না করে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কর্তৃক চালু করার ব্যবস্থা হচ্ছে। বাংলাদেশে নিম্নতম থেকে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার বেহাল অবস্থা এক বাস্তব ব্যাপার। তার ওপর এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দ্বিতীয় শিফট চালু করে এগুলোকে পাঠশালা বানানোর যে ব্যবস্থা হচ্ছে সেটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত শিক্ষক, শিক্ষিত সম্প্রদায় ও সেই সঙ্গে সামগ্রিকভাবে সচেতন জনগণের প্রতিরোধ দরকার।

এই প্রতিরোধের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দ্বিতীয় শিফট চালুর মাধ্যমে ইতিমধ্যেই বাণিজ্যিকীকরণকৃত শিক্ষাব্যবস্থার আরও শোচনীয় বাণিজ্যিকীকরণ যদি বন্ধ করা না হয়, তাহলে কার্যকরভাবে শিক্ষাব্যবস্থার ধ্বংস রোধ করা হবে এক অসম্ভব ব্যাপার। ২৪.৫.২০১০

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.