আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সস্ত্রীক জেএমবিপ্রধানসহ পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছেজামায়াতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক জঙ্গি সাইদুরের

দেশকে ভালবাসা

সস্ত্রীক জেএমবিপ্রধানসহ পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছেজামায়াতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক জঙ্গি কার্জনপুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের সাবেক দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ বজায় রেখেছিল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) প্রধান সাইদুর রহমান ওরফে জাফর। দলটি তাকে আর্থিক সহযোগিতাও করছিল। বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সাইদুর ও তার সহযোগীদের দিয়ে বড় ধরনের পরিকল্পনাও চলছিল। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে এসব তথ্য জানিয়েছে জঙ্গিনেতা সাইদুর। গত সোমবার রাতে স্ত্রী, তিন সহযোগীসহ সাইদুরকে রাজধানীর দনিয়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে খোঁজাখুঁজির পর শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের এই উত্তরসূরিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। সাইদুরকে গ্রেপ্তার করতে দনিয়া ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় সোমবার রাতে পুলিশের একটি বিশেষ দল অভিযান চালায়। এ অভিযানে সাইদুর ও তার তৃতীয় স্ত্রী নাইমা আক্তার ছাড়াও গ্রেপ্তার হয়েছে জেএমবির সামরিক শাখার সমন্বয়ক আমির হোসেন ওরফে শরীফ, এহসার সদস্য নুর হোসেন ওরফে সবুজ ও আবদুল্লাহেল কাফি। এ সময় তাদের কাছ থেকে অস্ত্র, গুলি, বোমা, গ্রেনেড তৈরির সরঞ্জাম, 'জিহাদি বইপত্র' ছাড়াও বোমা ও গ্রেনেড তৈরির কলাকৌশল বিষয়ে হাতে লেখা খাতা উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানায়, জেএমবির সাবেক প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, অপারেশনাল কমান্ডার সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইসহ শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির পর থেকে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নেতা (হবিগঞ্জ জেলা শাখার আমির) সাইদুর রহমান আত্দগোপনে থেকে সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছিল।

দেশ-বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ, সংগঠনকে শক্তিশালী করতে নতুন শুরা কমিটি গঠনসহ সবকিছুই চলছিল তার নেতৃত্বে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দীর্ঘদিন থেকে তাকে খুঁজছিল। পুলিশ সূত্র মতে, বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর 'ইসলামী শাসন' প্রতিষ্ঠা করতে আটঘাট বেঁধে নেমেছিল সাইদুর ও তার সহযোগীরা। এরই মধ্যে সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত উগ্র ও মৌলবাদী অন্য সংগঠনগুলোর সঙ্গেও তারা যোগাযোগ বাড়িয়েছিল। ওই সব সংগঠনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহেরও চেষ্টা করা হচ্ছিল।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে বড় পরিকল্পনা ছিল তাদের। এ জন্য অর্থ সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল একটি ধর্মপন্থী রাজনৈতিক দল। সাইদুর ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারের পর গতকাল মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের সঙ্গে জঙ্গিনেতা সাইদুরের সংশ্লিষ্টতার কথা জানা যায়। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) নূর মোহাম্মদ দাবি করেন, দেশে জঙ্গিদের তৎপরতা আছে। তবে তাদের বড় অপকর্ম করার শক্তি নেই।

সাইদুরকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে জঙ্গি নেটওয়ার্ক আপাতত ভেঙে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। আইজিপি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক কোনো চক্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ সময় সাইদুর ও তার সহযোগীদের ছবি তুলতে দেওয়া হলেও তাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। নূর মোহাম্মদ আরো জানান, সাইদুরের অনেক অনুসারী আছে। তাদের বাসাতেই ঘুরে-ফিরে থাকত সাইদুর।

তাকে গ্রেপ্তারের অভিযানে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি বিশেষ দল ছাড়াও স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), ডিবি ও সিআইডি সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত পুলিশের বিশেষ একটি দল অংশ নেয়। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহীদুল হক, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান জাবেদ পাটোয়ারী উপস্থিত ছিলেন। সাইদুরের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে এ ধরনের মিথ্যাচার একটি পুরনো কৌশল। তিনি বলেন, পুলিশি হেফাজতে থাকা কোনো ব্যক্তি এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকলে তার ওপর আস্থা রাখা যায় না। বাস্তবতা হচ্ছে, তার সঙ্গে জামায়াতের নিবিড় সম্পর্ক তো দূরের কথা, সাধারণ সম্পর্কও নেই।

সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এ ধরনের কোনো সন্ত্রাসীর সঙ্গে জামায়াত কাজ করে না এবং এ ধরনের কাজে জামায়াত বিশ্বাসও করে না। জামায়াত সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক ও আইনগত প্রক্রিয়ায় প্রতিবাদ করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। এর আগে গত রবিবার রাতে রাজধানীর জুরাইনের একটি বাসায় পুলিশি অভিযান চলার সময় জঙ্গিদের বোমা ও গুলিতে আট পুলিশ সদস্য আহত হন। ওই রাতে আহতাবস্থায় জেএমবির সামরিক কমান্ডার (ঢাকা অঞ্চল) আবু বক্কর গ্রেপ্তার হলেও আরো তিনজন পালিয়ে যায়। জামায়াত থেকে জেএমবি : মাদ্রাসায় পড়ার সময় সাইদুর রহমান ছাত্রশিবির করত বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়।

এরপর সে হবিগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। ওই সময় তার পরিবারের সবাই জামায়াতের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। সাইদুর বেশ কিছুদিন জামায়াতের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রামের হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। ১৯৮৩ সালে তাকে হবিগঞ্জ জেলা জামায়াতের আমির করা হয়। নৈতিক স্খলনের অভিযোগে ১৯৮৯ সালে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

এরপর কিছুদিন সে ইসলামী হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানির জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করে। সেখান থেকে বেরিয়ে সাইদুর জেএমবিতে যোগ দেয়। সখ্য গড়ে ওঠে শায়খ রহমান ও বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে। ২০০৫ সালে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর সাইদুরের ছেলে শামীমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেই ঘটনার পর থেকে জেএমবির নেতৃত্বে জোরালো হতে থাকে সাইদুরের অবস্থান।

জেএমবির সাবেক সামরিক কমান্ডার ফাঁসিতে দণ্ডিত আতাউর রহমান সানি ছিল তার মেয়ে শিরিনের স্বামী। শায়খ রহমান ও বাংলা ভাইয়ের উত্তরসূরি হিসেবে শেষপর্যন্ত জেএমবিপ্রধানের দায়িত্ব পায় সাইদুর। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে সিলেটে র‌্যাবের অভিযানে শায়খ রহমান ধরা পড়লেও সাইদুর পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এর পর থেকেই সে আত্দগোপনে থাকে। ওই অবস্থায় বিভিন্ন প্রয়োজনে পুরনো দল জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত সে।

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চালানোর অভিযোগ ওঠে জামায়াতের বিরুদ্ধে। এ কাজে সহযোগী হিসেবে এগিয়ে আসে সাইদুর। বিদেশি জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সাইদুরের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। যেভাবে অভিযান : পুলিশের দাবি, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জেএমবির একাধিক আস্তানা আছে। তারা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি আস্তানা চিহ্নিত করে।

এর মধ্যে একটি ছিল জুরাইনে। আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, জঙ্গিদের ওই আস্তানাটির ব্যাপারে ধারণা থাকলেও পুলিশের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল না। পুলিশের একটি দল ওই রাতে জঙ্গিদের আস্তানাটি শনাক্ত করতে জুরাইন যায়। একপর্যায়ে মায়া ভিলা নামে একটি বাড়ির বাসিন্দাদের সম্পর্কে খোঁজ করতে গেলেই জঙ্গিরা দরজা খুলে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা ছোড়ে। এ সময় তিন জঙ্গি পালিয়ে গেলেও আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে নজরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সন্ধান মেলে নারায়ণগঞ্জের পাইনাদীর আস্তানাটির। সেখান থেকে জেএমবির সামরিক শাখার সমন্বয়ক আমির হোসেন ওরফে শরীফ, এহসার সদস্য নুর হোসেন ওরফে সবুজকে অস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরকসহ গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে সন্ধান মেলে দনিয়ার আস্তানাটির। সেখানে এহসার সদস্য আবদুল্লাহর বাসায় সস্ত্রীক আত্দগোপনে ছিল জেএমবির প্রধান সাইদুর রহমান। জিহাদে উদ্বুদ্ধ করতে পাঠচক্র : পুলিশের একটি সূত্র জানায়, জঙ্গি আস্তানা থেকে অস্ত্র, বিস্ফোরক, গুলি, জিহাদি বই ছাড়াও বেশ কয়েকটি খাতা উদ্ধার করা হয়েছে।

এসব খাতার মধ্যে একে-৪৭ রাইফেলসহ বিভিন্ন অস্ত্রের ছবি আঁকা রয়েছে। এসব ছবির মাধ্যমে অস্ত্র চালানোর পাশাপাশি এ সম্পর্কে নানা ধারণা দেওয়া হতো জঙ্গিদের। এ ছাড়া বোমা তৈরির নানা কৌশল নিয়ে পাঠচক্রে নিয়মিত আলোচনা হতো। হাতে-কলমে অস্ত্র ও বোমা তৈরির প্রশিক্ষণও দেওয়া হতো। পুলিশ আরো বলেছে, জিহাদে উদ্ধুদ্ধ করার জন্য ব্যবহার করা হতো বিভিন্ন ধরনের বই।

সেসব বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কোরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা দেওয়া হতো। অভিযানে আসাদ বিন হাফিজ, মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ গালিবসহ বেশ কয়েকজন লেখকের বই উদ্ধার করা হয়েছে। জামায়াত-শিবির ঘরানার বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত কয়েকজন লেখকের বইও আছে এর মধ্যে। এ ছাড়া বহুল আলোচিত-সমালোচিত মতিয়ুর রহমান রেন্টুর 'আমার ফাঁসি চাই' বইটি উদ্ধার করা হয়েছে জঙ্গিদের আস্তানা থেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে উসকে দিতেই জঙ্গিরা এই বইটি বিভিন্ন জায়গায় 'রেফারেন্স' হিসেবে ব্যবহার করে আসত বলে মনে করছে পুলিশ।

হবিগঞ্জে স্বস্তি : কালের কণ্ঠের হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সাইদুর রহমানের গ্রেপ্তারের খবরে হবিগঞ্জের অনেকেই স্বস্তি বোধ করছেন। সাইদুর রহমানের বাড়ি হবিগঞ্জে হওয়ায় এলাকাবাসী জঙ্গি হামলার আতঙ্কে ছিল। কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত বর্তমান সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবু জাহির বলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াসহ সাধারণ মানুষকে হবিগঞ্জের মাটিতে গ্রেনেড মেরে নির্মমভাবে হত্যার সঙ্গে সাইদুর রহমান ও তার সংগঠন জড়িত ছিল। হবিগঞ্জে আরো হামলার পরিকল্পনা হয়তো তাদের ছিল। হবিগঞ্জবাসী হত্যাকারীদের ফাঁসি চায়।

সাইদুর রহমানের গ্রেপ্তারে হবিগঞ্জে জঙ্গি তৎপরতা অনেকটা হ্রাস পাবে বলে আশা করছেন হবিগঞ্জ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি শহীদ উদ্দিন চৌধুরী। জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মনোয়ার আলীও সাইদুরের ফাঁসি দাবি করেন। দুই মামলায় বক্কর : এদিকে গ্রেপ্তারকৃত আবু বকরকে কদমতলী থানায় করা দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গতকাল কদমতলী থানা পুলিশের আবেদনে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত তাকে গ্রেপ্তার দেখান। কদমতলী থানায় বিস্ফোরকদ্রব্য আইন ও পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধাদানের অভিযোগে করা দুটি মামলায় আবু বকরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

গত রবিবার রাতে পুলিশের ওপর বোমা হামলা চালায় আবু বকর। ওই দিনই তাকে আটক করা হয়। তবে আহত থাকায় আবু বকর বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কত নাম তার?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.