আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বামী বিবেকাননন্দঃ এক পরম মনুষ্যত্বের মানবের উদাহরণ

পরজীবীর মত বেঁচে আছি। সবার শ্রম আর ঘামের উপর দখলদারিত্ব করে। আমার মত অসৎ সকলে, যারা উৎপাদন ও শ্রমের সাথে যুক্ত না হয়ে বেঁচে থাকে।

“কিছু চাহিও না_ উহাই ঈশ্বর, উহাই মনুষ্যত্ব_স্বামী বিবেকানন্দ। ‘লোভ মানুষকে পশুত্বে রুপান্তরিত করে”।

১২ জানুয়ারী। মহর্ষী স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন। ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারী তাঁর ১৪৭ তম জন্মবার্ষিকী। ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা আয়োজন ও অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে তাঁর এই জন্ম দিন পালিত হয়। আমারা তাঁর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি। কলকাতার শিমুলিয়া পল্লিতে। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর বাবা বিশ্বনাথ দত্ত। তিনি ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবি।

তিনি দানশীল, সামাজিক ও ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে ছিলেন প্রগতিবাদী। মা ভুবনেশ্বরী দেবী। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণা নারী। http://www.biplobiderkotha.com পিতার যুক্তিবাদী মানস ও মাতার ধর্মীয় চেতনা স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তা ও ব্যক্তিত্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। প্রথম জীবনেই পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানের সংস্পর্শে আসেন।

যে কারণে তথ্য প্রমাণ ও ব্যবহারিক পরীক্ষা ছাড়া কোনো বক্তব্যই তিনি গ্রহণ করতেন না। অন্যদিকে অতি অল্পবয়সেই ধ্যান ও বৈরাগ্যের আধ্যাত্মিক আদর্শের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। নরেন্দ্রনাথের বাল্যশিক্ষার হাতেখড়ি পরিবারে। ১৮৭১ সালে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ১৮৭৯ সালে ওই বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। [ বেদ, উপনিষদ, ভাগবত গীতা, রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের প্রতিও তাঁর সমআগ্রহের ছিল। কণ্ঠসংগীত ও যন্ত্রসংগীত - শাস্ত্রীয় সংগীতের উভয় শাখাতেই তাঁর পারদর্শীতা ছিল। বাল্যকাল থেকেই খেলাধূলা, শারীরিক ব্যায়াম ও অন্যান্য সংগঠনমূলক কাজকর্মেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন। অতি অল্পবয়সেই বিভিন্ন কুসংস্কার, ধর্ম ও বর্ণের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তাঁর আধ্যাত্মিক চিন্তা বিকাশে মায়ের ভূমিকাটি ছিল অত্যন্তু গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী জীবনে তিনি তাঁর মায়ের একটি কথা বারংবার উদ্ধৃত করতেন, “সারা জীবন পবিত্র থাকো, নিজের সম্মান রক্ষা কোরো, অন্যের সম্মানে আঘাত কোরো না। কোমল হও, কিন্তু প্রয়োজনবোধে নিজের হৃদয়কে শক্ত রেখো”। ১৮৮০ সালে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৮১ সালে তিনি চলে যান স্কটিশ চার্চ কলেজে।

এখানে তিনি পাশ্চাত্য যুক্তিবিজ্ঞান, পাশ্চাত্য দর্শন ও ইউরোপীয় জাতিসমূহের ইতিহাস বিষয়ে পড়াশুনা করেন। পাশাপাশি তিনি ছেলেবেলা থেকে আধ্যাত্মিকতা, ঈশ্বরোপলব্ধি, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ধর্মীয় ও দার্শনিক ধ্যানধারণা নিয়ে তিনি পড়াশোনা অব্যহত রাখেন। একই সময় তিনি ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শে আসেন। ওই সময় তিনি সময়ে ব্রাহ্মসমাজের দুই সর্বোচ্চ নেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে সাক্ষাত করে তাঁদের কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন। কিন্তু কোনো সদুত্তর পান না।

১৮৮১ সালে এফ.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৪ সালে ব্যাচেলর অফ আর্টস ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ডেভিড হিউম, ইমানুয়েল কান্ট, জোহান গটলিব ফিচ, বারুখ স্পিনোজা, গেয়র্গ ভিলহেল্ম হেগল, আর্থার সোফেনহয়্যার, ওগুস্ত কোঁত, হারবার্ট স্পেনসার, জন স্টুয়ার্ট মিল ও চার্লস ডারউইন প্রমুখের রচনাবলি অধ্যয়ন করেছিলেন। হারবার্ট স্পেনসারের বিবর্তনবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি নিজের প্রকাশক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের জন্য স্পেনসারের এডুকেশন (Education) নামক গ্রন্থখানি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয়।

নরেন্দ্রনাথের জীবনের ধারাটিকে তিনি পরিবর্তিত করে দেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন কালীর উপাসক। অদ্বৈত বেদান্ততত্ত্বকেও নরেন্দ্রনাথ নাস্তিকতা ও পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে এ বিষয় নিয়ে উপহাস করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের ধ্যানধারণা গ্রহণ করতে না পারলেও নরেন্দ্রনাথ তা উড়িয়ে দিতে পারতেন না।

কোনো মত গ্রহণ করার আগে তা যাচাই করে নেওয়াই ছিল নরেন্দ্রনাথের স্বভাব। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে পরীক্ষা করেন। শ্রীরামকৃষ্ণও কোনোদিন তাঁকে যুক্তিবর্জনের পরামর্শ দেননি। তিনি ধৈর্য সহকারে নরেন্দ্রনাথের তর্ক ও পরীক্ষার সম্মুখীন হন। পাঁচ বছর শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে থেকে নরেন্দ্রনাথ এক অশান্ত, বিভ্রান্ত, অধৈর্য যুবক থেকে এক পরিণত ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হন।

ঈশ্বরোপলব্ধির জন্য তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত হন। শ্রীরামকৃষ্ণকে গুরু রূপে স্বীকার করে নিয়ে নিজেকে তার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে দেন। ১৮৮৬ সালের ১৬ অগস্ট কাশীপুর উদ্যানবাড়িতে রামকৃষ্ণ পরমহংস মারা যান। শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর বিবেকানন্দের নেতৃত্বে সন্ন্যাসী শিষ্যরা বরানগরে এক পোড়ো বাড়িতে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ছিল রামকৃষ্ণ সংঘের দ্বারা স্থাপিত প্রথম মঠ।

১৮৮৭ সালের প্রথম দিকে নরেন্দ্রনাথ ও তাঁর আটজন গুরুভ্রাতা আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর নরেন্দ্রনাথ স্বামী বিবেকানন্দ নাম ধারণ করেছিলেন। ১৮৮৮ সালে পরিব্রাজক রূপে মঠ ত্যাগ করেন বিবেকানন্দ। পরিব্রাজক হিন্দু সন্ন্যাসীর এক ধর্মীয় জীবন বেছে নেন। পরিব্রাজক জীবনে তাঁর সঙ্গী ছিল একটি কমণ্ডলু, লাঠি, এবং তাঁর প্রিয় দুটি গ্রন্থ - ভগবদ্গীতা ও ইশানুসরণ।

পাঁচ বছর ধরে ভারতের সর্বত্র ভ্রমণ করেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে তিনি প্রত্যেক শিক্ষাকেন্দ্র দর্শন করেন এবং বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও সমাজব্যবস্থার সহিত সুপরিচিত হন। এ সময় সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্টের প্রতি তাঁর সহানুভূতি জন্মায়। তখন থেকে তিনি জাতির উন্নতিকল্পে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। এই সময় তিনি সারা ভারত পদব্রজেই পর্যটন করেন।

১৮৮৮ সালে তিনি বারাণসী থেকে তাঁর যাত্রা শুরু করেন। বারাণসীতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত হয় বিশিষ্ট বাঙালি লেখক ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও বিশিষ্ট সন্ত ত্রৈলঙ্গস্বামীর। এইখানেই বিশিষ্ট সংস্কৃত পণ্ডিত বাবু প্রেমদাস মিত্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। বারাণসীর পর তিনি একে একে যান অযোধ্যা, লখনউ, আগ্রা, বৃন্দাবন, হথরাস ও হৃষীকেশে। ১৮৮৮-৯০ মধ্যবর্তী সময়ে তিনি বৈদ্যনাথ ও এলাহাবাদ ভ্রমণ করেন।

এলাহাবাদ থেকে গাজিপুরে গিয়ে তিনি পওহারি বাবাকে দর্শন করেন। পওহারি বাবা ছিলেন এক অদ্বৈতবাদী সন্ত। যিনি অধিকাংশ সময়েই ধ্যানমগ্ন থাকতেন। ১৮৯০ সালে গুরুভ্রাতা স্বামী অখণ্ডানন্দের সঙ্গে তিনি পুনরায় পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর রূপে দেশভ্রমণে বের হন। মঠে ফেরেন একেবারে পাশ্চাত্য ভ্রমণ সেরে।

প্রথমে তিনি যান নৈনিতাল, আলমোড়া, শ্রীনগর, দেরাদুন, ঋষিকেশ, হরিদ্বার এবং হিমালয়ে। ১৮৯১ সালের শেষদিকে অন্যান্য গুরুভ্রাতাদের ছেড়ে তিনি একাকী দিল্লির পথে অগ্রসর হন। দিল্লির ঐতিহাসিক স্থানগুলি দেখার পর তিনি চলে যান রাজপুতানার ঐতিহাসিক রাজ্য আলোয়ারে। পরে তিনি যান জয়পুরে। সেখানে এক সংস্কৃত পণ্ডিতের কাছে অধ্যয়ন করেন পাণিনির অষ্টাধ্যয়ী।

তাঁর পরের গন্তব্য ছিল আজমেঢ়। সেখানকার বিখ্যাত দরগা ও আকবরের প্রাসাদ দেখে তিনি চলে যান মাউন্ট আবুতে। মাউন্ট আবুতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় খেতরির মহারাজা অজিত সিংহের। তিনি পাণিনির সূত্রের মহাভাষ্য অধ্যয়ন করেন। খেতরিতে আড়াই মাস কাটানোর পর ১৮৯১ সালের অক্টোবরে তিনি রাজস্থান ও মহারাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা হন।

পশ্চিমে যাত্রাপথে তিনি ভ্রমণ করেন আমেদাবাদ, ওয়াধওন ও লিম্বদি। আমেদাবাদে তিনি ইসলামি ও জৈন সংস্কৃতির পাঠ সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি যান জুনাগড়, গিরনার, কচ্ছ, পোরবন্দর, দ্বারকা, পালিতানা ও বরোদা। পোরবন্দরে সন্ন্যাসজীবনের নিয়ম ভেঙে তিনি নয় মাস অবস্থান করেন পণ্ডিতদের থেকে দর্শন ও সংস্কৃত গ্রন্থাবলি অধ্যয়নের জন্য। এই সময় সভাপণ্ডিতের সঙ্গে একযোগে বেদ অনুবাদের কাজও করেন।

এরপর তিনি যান মহাবালেশ্বর এবং তারপর যান পুণায়। পুণা থেকে ১৮৯২ সালে তিনি খান্ডোয়া ও ইন্দোর ভ্রমণ করেন। কাথিয়াওয়াড়ে তিনি বিশ্বধর্ম মহাসভার কথা শোনেন। খান্ডোয়া থেকে তিনি বোম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১৮৯২ সালে তিনি বোম্বাই পৌঁছান।

পুণার পথে ট্রেনে বাল গঙ্গাধর তিলকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। কিছুদিন তিলকের সঙ্গে অবস্থান করার পর ১৮৯২ সালে তিনি বেলগাঁও যাত্রা করেন। বেলগাঁওতে তিনি অধ্যাপক জি এস ভাটি ও সাব-ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার হরিপদ মিত্রের আতিথ্য গ্রহণ করেন। বেলগাঁও থেকে তিনি যান গোয়ার পাঞ্জিম ও মারগাঁওয়ে। গোয়ার প্রাচীনতম ধর্মতত্ত্ব কনভেন্ট-কলেজ রাচোল সেমিনারিতে তিন দিন অবস্থান করেন।

এই কনভেন্ট-কলেজে সংরক্ষিত ছিল লাতিনে রচিত দুষ্প্রাপ্য ধর্মীয় সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত রচনাবলি। এখানে তিনি খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে মূল্যবান জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। মারগাঁও থেকে বিবেকানন্দ রেলপথে যাত্রা করেন ধারওয়াড়ের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে আসেন মহীশূর রাজ্যের ব্যাঙ্গালোরে। স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ সালে ‘পেনিনসুলার’ জাহাজে করে বোম্বে থেকে আমেরিকা যান।

দীর্ঘ দুই মাস যাত্রাপথে কাটানোর পর ৩০ জুলাই শিকাগোয় পৌছান। প্রায় দু স্তাহ শিকাগোয় থেকে তিনি রওনা হলেন বস্টন অভিমুখে। যাত্রা পথে ট্রেনে পরিচয় হল এক মাঝবয়সী মহিলার সঙ্গে, নাম ক্যাথেরিন স্যানবর্ন। স্বামীজীকে দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে নিজেই এসে পরিচয় করলেন স্বামীজীর সাথে। ঐ মহিলাও থাকেন বস্টনে।

তাঁর খামার বাড়িতে থাকবার জন্য স্বামীজীকে তিনি আমন্ত্রণ জানালেন। স্বামীজী মহিলার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। বস্টনে থাকাকালীন মিস ক্যামেরিন স্যানবর্নের সূত্রে সেখানকার শিক্ষিত সমাজে স্বামীজী সুপরিচিত হয়ে উঠলেন। বিভিন্ন ক্লাবে, গির্জায় ও সভায় স্বামীজী বক্তৃতা করতে লাগলেন। বস্টনের সংবাদপত্রে তাঁর খবর বের হতে লাগল।

মিস স্যানবর্নের সূত্রেই স্বামীজীর সঙ্গে পরিচয় হল হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসিদ্ধ অধ্যাপক জন হেনরি রাইটের সঙ্গে। এই অধ্যাপককে বলা হয়েছে বিশ্বকোষতুল্য জ্ঞানভাণ্ডারের অধিকারী। স্বামীজীর প্রতিভা তাঁকেও মুগ্ধ করে। তিনি স্বামীজীকে বলেছিলেন, তিনি কেন আসন্ন ধর্মমহাসভায় যোগ দিচ্ছেন না। কারণ, আমেরিকার জনসাধারণের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য ধর্মমহাসভাই একমাত্র উপযুক্ত স্থান।

স্বামীজী যখন বললেন যে, পরিচয়পত্র নেই বলেই যোগ দিতে পারছেন না, তখন অধ্যাপক রাইট যে উক্তি করে বলেছিলেন, “আপনার কাছে পরিচয়পত্র চাওয়ার অর্থ হল সূর্যকে প্রশ্ন করা তার কিরণ দেওয়ার অধিকার আছে কিনা”। ধর্মমহাসভার এক কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে অধ্যাপক রাইট নিজেই এক পরিচয়পত্র লিখে ছিলেন স্বামীজীর সম্বন্ধে। তাতে তিনি লিখলেন, ইনি এমন একজন ব্যক্তি যে, আমেরিকার সমস্ত অধ্যাপকের পাণ্ডিত্য এক করলেও তাঁর পাণ্ডিত্যের সমান হবে না। এইভাবে অধ্যাপক রাইটের চেষ্টায় অসম্ভব সম্ভব হল। শিকাগোর বিশ্বধর্মসভা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর সোমবার ধর্মমহাসভা শুরু হয়। ঠিক দশটার সময় আর্ট ইনস্টিটিউটের কলম্বাস হল-এ সমবেত দশটি ধর্মের উদ্দেশ্যে দশটি ঘণ্টাধ্বনি হয়। সেই বিরাট হল, তার অদ্ভুত জাকজাঁমক আর তাতে আমেরিকার সুশিক্ষিত সমাজের বাছা বাছা-ছয়-সাত হাজার নরনারী বসে আর প্লার্টফর্মের উপরে পৃথিবীর সব জাতের পণ্ডিতের সমাবেশ। দ্বিতীয় অধিবেশনে চারজনের পর স্বামীজী বক্তৃতা দিতে উঠলেন। সংক্ষেপে বললেন : আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না।

সকল ধর্মকে সত্য বলে বিশ্বাস করি। ...বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে কিন্তু তারা সমুদ্রে এসে এক হয়ে যায়। ... তাই আমরা বিভিন্ন পথ দিয়ে চলি। কিন্ত্ত শেষ পর্যন্ত, হে ভগবান, তোমার কাছেই আমরা পৌঁছব। আমেরিকার পত্র-পত্রিকাগুলো তার উচ্ছসিত প্রশংসা করল।

‘দি হেরাল্ড’ লিখল : “ধর্মমহাসভায় বিবেকানন্দই অবিসংবাদিত রূপে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি”। ধর্মমহাসভায় স্বামীজীর শেষ ভাষণের কিছু অংশ : মাটিতে বীজ পোঁতা হল, মাটি, বাতাস আর জল তার চারদিকে রয়েছে। বীজটি কি মাটি, বাতাস বা জল হয়ে যায় ? না চারাগাছ হয় : ঐ চারাগাছ বড় হয়, মাটি, জল, বাতাসকে আত্বস্থ করে সেগুলোকে বৃক্ষের উপাদানে পরিণত করে। ধর্মের ক্ষেত্রেও একই কথা। স্বামীজীর বক্তৃতার শেষ বাণীটি ছিল-“বিবাদ নয়, সহায়তা, বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ, মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি”।

১৮৯৫ সালে ভগিনী নিবেদিতা বিবেকানন্দকে সর্বপ্রথম দেখেন। স্বামীজির বাণী তাঁর হৃদয়ে অসামান্য প্রভাব বিস্তার করে। ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে বিবেকানন্দ স্বদেশে ফেরেন আর দেশবাসীর কাছ থেকে তুমুল সম্বর্ধনা পান। ১৮৯৮ সালে তিনি স্বামীজির আহবানে ভারতে আসেন। স্বামী বিবেকানন্দের মতে ত্যাগ ও বৈরাগ্যই ভারতের চিরন্তন আদর্শ।

তিনি ভারতের ইতিহাসে সমাজ সেবার এক নতুন অধ্যায় রচনা করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রদর্শিত শিবজ্ঞানে জীবসেবার উদ্দেশ্যে তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন ১৮৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে সফল কথ্যভাষায় তিনি অন্যতম প্রথম প্রচারক। তাঁর মূল ইংরেজী ও বাংলা রচনাবলী বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ১৮৯৯ সালের জুন মাসে তিনি আবার পাশ্চাত্য দেশে যান এবং আগের বারের মতই প্রচারে সফলতা লাভ করেন।

বিদেশে কয়েকটি স্থায়ী বেদান্ত কেন্দ্র স্থাপন করে ১৯০০ সালের শেষে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দের ৪ জুলাই বেলুড় মঠে তিনি মারা যান। সম্পাদনায়ঃ শেখ রফিক

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।