আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লেখকের নিরাপত্তার প্রশ্ন



মনুষ্যত্বের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো সৃজনশীলতা। মৌচাক বা উইঢিপির গঠন আদিতে যেমন ছিলো, আজো তা-ই। কিন্তু এককালের গুহাবাসী মানুষ নির্মাণশৈলীর ক্রমোন্নতির ধারায় দুনিয়াকে অনেকখানি বদলে দিয়েছে। অগ্রসর চেতনার মানুষ যেখানেই হাত দেয়, তা-ই শিল্পময় হয়ে ওঠে। সৃজনশীলতা ও শিল্পবোধের সঞ্চারে কথা ছন্দময় হয়েছে, চলা গতিময় হয়েছে, চিন্তা সত্যময় হয়েছে।

মানুষের এ সৃজন-বুননের উৎকর্ষই তার শ্রেষ্ঠত্বের মাপক। কাজেই যিনি যতো সৃষ্টিশীল, তিনি ততো সার্থক মানুষ। এ দৃষ্টিকোন থেকে, সৃষ্টিশিল্পের মৌলিকতায় বিজ্ঞানী আর গভীরতায় বহুলতায় উচ্ছলতায় লেখক-সাহিত্যিকরাই পৃথিবীর অগ্রগণ্য মানুষ। অতএব নীতিগতভাবেই প্রত্যাশা করা যায় যে, আধুনিক সভ্য সমাজে গুরুত্ব, মর্যাদা, ভূমিকা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে প্রজ্ঞাবান সাহিত্যিকরাই অগ্রবর্তী শ্রেণী হিসেবে মূল্যায়িত হবেন। হয়েছেনও।

গাযালী-ফেরদৌসী-ইকবাল স্বজাতির শ্রেষ্ঠ পুরুষের মর্যাদায় অভিষিক্ত। ইউরোপের বিদ্বৎসমাজের মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তা সত্ত্বেও, বিপরীত উদাহরণগুলো আমাদের প্রত্যাশাকে আহত করে। কেন করে, আমি সেই প্রশ্নটিই তুলবার চেষ্টা করছি। জাতীয় পর্যায়ে আমাদের কীর্তিমান ব্যক্তিদের নিয়ে আমরা গর্ব করি।

কিন্তু তা খর্ব হতে দেরি হয় না যখন আমরা পৃথিবীর অন্যান্য অগ্রসর জাতিসমূহের চিন্তার সঙ্গে সার্বিকভাবে আমাদের চিন্তাচর্চাকে তুলনা করি। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, তারা অশিক্ষা ও দারিদ্রের খাঁচায় বন্দি হয়ে আছে বলে গুণীদের গুণগ্রাহী হবার অবকাশ না পেতে পারে। কিন্তু শিক্ষিত রাষ্ট্রকর্তাগণ কী কারণে মনীষার মূল্য বুঝবেন না? সাহিত্যিকের জন্মজয়ন্তীতে অসাহিত্যিক মন্ত্রী প্রধান অতিথি হয়ে কেন মন্ত্রপাঠ করবেন? এইসব উৎকট অসঙ্গতি আমাদের বিব্রত করে। চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত সমাজে হুমায়ূন আজাদের মতো সাহসী চিন্তকের রক্তাক্ত দৃশ্য আমাদের অনেক নিচে নামিয়ে দেয়। শুধু তো ব্যক্তি আজাদকে হারাই নি, ভাষাতত্ত্বে তাঁর আরো অনেক মৌলিক কাজের সম্ভাবনা হারালাম।

এতো শুদ্ধভাষী লেখক বাঙলায় বিরল বললে কম বলা হয়। ধর্মের বিপক্ষে তাঁর অবস্থান ছিলো বুদ্ধিবৃত্তিক ও শৈল্পিক, সেভাবেই তার মোকাবেলা সঙ্গত হতো। 'আমার অবিশ্বাস' আপত্তিকর ঠেকলে 'আমার বিশ্বাস' লিখে জবাব দেয়াই উচিত ছিলো। তা কেউ লেখেন নি। কাপুরোষিত হামলা হয়েছে।

স্রেফ নীচতা। রাষ্ট্রও এর প্রতিকার করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতা সকল লেখক-চিন্তকের জীবনকে আরো ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। প্রসঙ্গত, একসময় এক নারী লেখকের বিরুদ্ধে দেশে তুমুল আন্দোলন হয়েছে। সংগঠিত প্রতিবাদী আলিম ও ধার্মিকরা তখন যে ব্যাপারটি খেয়াল করেন নি তা হলো ওই লেখক কিন্তু আদতে কোনো সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী বা গবেষক নন।

ইসলামের ওপর তার অভিযোগগুলোর আদৌ কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি ছিলো না। যে কুরআনের একটি শব্দেরও মানে জানে না, তার পক্ষে কুরআনকে ভুল বলা দুঃখজনক ঘটনা নয়, হাস্যকর প্রলাপ। যে কেউ তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে থামিয়ে দিতে পারতেন। তা না করে মিছিল-মিটিং করে, মাথার মূল্য ঘোষণা করে তাঁকে বিখ্যাত লেখক বানিয়ে তোলা হয়েছে। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যশহর প্যারিস কৌতূহলী হয়ে তাঁকে নিমন্ত্রণ করেছে।

বিপরীতে হিত! অথচ বাঙলাদেশে ইসলামের ওপর সবচে' শক্ত আক্রমণ রচনা করেছিলেন লোকদার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর। স্বাধীনতার পরপরই তাঁর 'সত্যের সন্ধান' বইটি প্রকাশিত হয়ে আজ অবধি প্রচুর বিক্রি হয়ে আসছে, সংস্করণের পর সংস্করণ ছাপছে, নির্মোহ যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক এ বইটি নাস্তিকতার এমন এক ইশতেহার, যা পাঠকমাত্রকেই প্রভাবিত করবার শক্তি রাখে। যাঁরা প্রথাগত ধর্মশিক্ষার বাইরে গিয়ে গভীরভাবে ইসলামের জীবনবোধ উপলব্ধি করেছেন, তাঁরাই কেবল ওই যুক্তিগুলোর সীমাবদ্ধতা ধরতে সক্ষম হবেন। কিন্তু সাধারণ মুসলমান বা হিন্দু পাঠকদের স্বীয় ধর্ম বিষয়ে ততোটা প্রজ্ঞা নেই। ফলে বিশেষত শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে নাস্তিকতা ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের মতো, ইন্টারনেটে বাঙলা ব্লগগুলিতে ঢুকলেই সে আগুনের আঁচ আপনাকে স্পর্শ করবে।

'সত্যের সন্ধান' বইটিই সেই অগ্নিকাণ্ডের সূচনাকাঠি জ্বালিয়ে দিয়েছে এমনটি বলা না গেলেও বইটি যে তাতে বিপুল ইন্ধন যোগাচ্ছে, তা নিশ্চিত। তবে নিজের একক চেষ্টায় দার্শনিক হয়ে ওঠা আরজ আলী মাতুব্বরের প্রতি আমি ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধাশীল। কেননা তাঁর রচনায় ধর্মবিদ্বেষের ছায়া নেই। আছে কেবলই যুক্তি, অনুসন্ধান, জিজ্ঞাসা, পর্যবেক্ষণ। এসবে যদি ভুল থেকে থাকে, অন্তত বিশ্বাসীদের দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই আছে, তবে সেই ভুলগুলো ধরিয়ে দেবার দায়িত্ব ছিলো যেসব আলিমদের, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাই বরং মুশকিল হয়ে পড়েছে।

কারণ তাঁরা ছকের বাইরে কিছুই পড়েন না বলে চল্লিশ বছর ধরে একটি বই কীভাবে মানুষকে বিশ্বাসের আয়তন থেকে সংশয়ের অন্ধকারে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে, আদৌ তার পাত্তা রাখেন বলে মনে হয় না। বিশ্বাসী তাত্ত্বিকদের বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত। কারণ বিশ্বাসের ভিত ছাড়া নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আমরা মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করি, কিন্তু জানি যে আমাদের রাজনীতি চলে চিন্তায় নয়, অর্থে আর পেশিতে। ফলে জ্ঞান নিয়ে আরজ আলী মাতুব্বরের মুখোমুখি কেউ না দাঁড়ালেও পেশি নিয়ে হামলা হয়েছে বহুবার, তবু ন্যূনতম সরকারি নিরাপত্তা তিনি কখনোই পান নি।

মানুষের জ্ঞানজগত বিষয়ভিত্তিক নানা বিভাগে বিন্যস্ত। বিশেষ বিষয় আলোচনার জন্যে নির্দিষ্ট মূলনীতিও দাঁড় করা হয়েছে। চর্চা সহজ করতেই এ শৃঙ্খলা। কিন্তু সাহিত্য প্রকৃতপক্ষে কোনো নিয়মের বন্ধনে শৃঙ্খলিত নয়। প্রবল গতিতে সকল বন্ধ ভেঙে যাওয়াই তার স্বভাব।

বিচিত্র রসে অজস্র স্রোতে সহস্র চিন্তার ছটায় সাহিত্য নিয়ত ঋদ্ধ ও প্রমত্ত হয়ে চলেছে। অপরাপর শাস্ত্র বিশেষ যুগবোধ ধারণ করে স্থিতিলাভ করে, কিন্তু সাহিত্য ভিন্ন মতের দ্রোহ ও বিপরীত পথের রোমাঞ্চে সতত পরিবর্তমান। ঐতিহাসিক বহু জনগোষ্ঠির বিদ্রোহের ইতিহাস ছাপিয়ে তাই একজন কবির বিদ্রোহই আমাদের চেতনায় বড় হয়ে ওঠে। কেননা কবির দ্রোহ আসলে জড়তার বিরুদ্ধে মানবাত্মার দ্রোহ। সাহিত্যের পাতায় আত্মার এই জড়তা-ক্ষুদ্রতার শেকল ভাঙার পরম আবেগ মূর্ত হয়।

সাহিত্যই নিখিল মানবের সেই প্রাণোচ্ছল মিলনমেলা, যেখানে সমস্ত ভাবের বৈভব স্বচ্ছন্দে তরঙ্গিত হয়। বিপত্তি ঘটে, যখন আমরা তা ভুলে যাই। সত্য আড়াল হয়, যখন আমরা দেয়াল নির্মাণ করি। প্রতিভা অবমূল্যায়িত হয়, যখন আমরা ব্যক্তিমনের সীমাবদ্ধতা সাহিত্যে আরোপ করতে উদ্যত হই। এভাবেই আমরা আধুনিক বাঙলার শক্তিমান কবি ফররুখের ওপর অবিচার করেছি।

সাহিত্য যদি 'সব পেয়েছির দেশ' হয়, তাহলে কেন আমরা কবিতায় ইসলামী ঐতিহ্যের চিত্রকল্পের ব্যবহার সহজভাবে নিতে পারি না! ভুল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুযোগে সরকার তাঁকে চাকরিচ্যূত করেছিলো, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক প্রত্যাখ্যানকারী আত্মমর্যাদাশীল কবিকে একঘরে করা হয়েছিলো, তাতে কি তিনি অকবি হয়ে গিয়েছিলেন? হন নি। কারণ রাজনীতি দিয়ে সাহিত্যের বিচার চলে না। চলে না বলেই হিটলারকে সমর্থন করার দোষে এজরা পাউন্ডকে কবিকৃতি থেকে খারিজ করবার চেষ্টা কেউ করে নি। কেননা তা সম্ভব নয়। অনুদার আমরা ফিরে ফিরে সেই অসম্ভব চেষ্টাই করে গিয়েছি।

আমাদের জাতীয় সাহিত্যের পরিচর্যায় জীবনভর খেটে যাওয়া কবিকে নিজেরাই খাটো করতে চেয়েছি। আহমদ ছফা, শেষ পর্যন্ত এক মহৎ লেখকেরই কণ্ঠ এ বিপন্ন কবিপরিবারের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার প্রশ্নে উচ্চকিত হয়েছিলো। আজকাল সাহিত্য ও সাংবাদিকতার পারস্পরিক সম্পর্ক অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ঘনিষ্ঠতর। স্বল্পায়ূ সংবাদের সঙ্গে দ্রুত হারিয়ে যাবার নেতিবাচকতা সত্ত্বেও দৈনিকের সাময়িকীগুলোই এখন বাঙলা সাহিত্যের প্রধান ও নিয়মিত প্রকাশমাধ্যম। তাছাড়া আধুনিক যশস্বী লেখকদের অনেকেরই সাহিত্যের হাতেখড়ি হয়েছে সাংবাদিকতা পেশায়।

সাংবাদিকতার ভাষাপ্রশিক্ষণপর্বে প্রমিত বানানরীতি, শব্দপ্রয়োগ ও বাগবিন্যাসের আত্মীকরণ নতুন লেখককে পরিণত সাহিত্যে উত্তরণ ঘটাতে সাহায্য করে। অধিকন্তু সাংবাদিকমাত্রই সাহিত্যিক না হলেও লেখক তো বটেই। এসব কারণে সংবাদকর্মীর নিরাপত্তার বিষয়টিও এ প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিক। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ এ পেশাজীবীদের জীবনের ঝুঁকি বর্তমানে ভয়াবহভাবে বেড়ে গিয়েছে। সরকারবিরোধী সংবাদ প্রকাশের দায়ে একটি পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকের ওপর উপর্যুপরি মামলা ও হামলার ঘটনা বর্তমান সরকারের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দারুন দৈন্যকেই প্রমাণিত করেছে।

পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দুর্নীতিপরায়ন কর্মকর্তা, অসৎ ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের হাতে প্রতিনিয়ত খুন, নির্যাতন ও অপহরণের শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। প্রতিবাদে সারা দেশের প্রেসকাবগুলো সভা-সেমিনার-মানববন্ধন করছে, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে, সাধারণ মানুষ পথে নেমে এসেছে। কিন্তু প্রশাসন নির্বিকার। ফলে অস্বীকারের উপায় নেই যে সম্প্রতি সিলেটের নন্দিত সাংবাদিক ও লেখক ফতেহ ওসমানী হত্যার জন্যে সরকারের এ ইচ্ছাকৃত উদাসীনতা অনেকখানিই দায়ী। ঘটনার পরপরই মুক্তস্বর সাংস্কৃতিক ফোরাম শহীদ মিনারে মানববন্ধন করে এ বিষাদবার্তাটিই দেশময় ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছে যে একজন লেখকের প্রাণহানি মানে শুধু ব্যক্তিমাত্রেরই মৃত্যু নয়, এটি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অস্তিত্বের মূলে কুঠারাঘাত।

শোকবিহ্বল মানুষ, সাহিত্য-সাংবাদিকতাসংশ্লিষ্ট সকল সংগঠন নির্বিরাম সভা-সেমিনার করে চলেছে এখনো, বেদনা ও ক্ষোভের তরঙ্গরাশি আছড়ে পড়ছে ক্রমাগত। গণমানুষের চোখেমুখে কালবোশেখির বিদ্যুৎরেখার মতো থেকে থেকে ঝলসে উঠছে লেখকের নিরাপত্তার প্রশ্ন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।