আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উত্তরাধির সূত্রে প্রাপ্ত

বিস্ময় মুছে দিও না...

১.কিছুক্ষন হলো বৃষ্টি নেমছে। তেমন তীব্রতা নেই তবুও এ যেনো দারুন তৃপ্তিদায়ক। কতো দিন পর বৃষ্টি হচ্ছে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শামান ভাবছে। শেষ বৃষ্টি হয়েছিলো সম্ভবত ৮/১০ মাস আগে। আজ বৈশাখের কতো তারিখ মনে নেই।

তবে আন্দাজ করতে পারছে বৈশাখের অর্ধেক কেটে গেছে। যেখনে চৈত্র মাসেই দু এক পশলা বৃষ্টি হবার কথা সেখানে প্রথম বৃষ্টি নামলো বৈশাখের মাঝামাঝি। এ যেনো প্রকৃতির রুদ্র প্রতাপ এবং সারল্য- এতো দিন রোদে পুড়িয়ে প্রকৃতি দেবী তার সন্তানদের বর্ষা-জল-সঙ্গমে তৃপ্তি দিচ্ছে। ২০১২ সালে পৃথিবীতে বড়ো রকমের বিপর্যয় ঘটবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। এ নিয়ে তুমুল মাতামাতি হচ্ছে ইদানিং।

কেউ কেউ ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যে এর বিরোধীতা করলেও প্রাকৃতিক নানাবিধ বিরুদ্ধাচরণে তা ধোপে টিকছে না। মানুষ আজ শঙ্কিত। সবাই নিজেদের পাপ পঙ্কীলতার পারলৌকিক পরিনামের দুঃশ্চিন্তায় দিন যাপন করছে। ভাবছে " দিন থাকিতে দিনের সাধন কেনো জানলে না..."। ২. শামানের দিনযাপনে আজকাল কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।

যে লোক প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই বেড়িয়ে পড়তো। সে এখন দিনের বেলা বের হয় না বললেই চলে। এমনকি খুধাও অগ্রাহ্য করে মাঝেমধ্যে। একান্ত বের হয় যখন সিগারেট ফুরিয়ে যায় অথবা চায়ের তীব্র ঝোঁক চেপে বসে। তাছাড়া কেবল সন্ধ্যার দিকে ঘর ছাড়ে।

সারাদিন সূর্যের যা তাপ! তার উপর এবারের সূর্য যেনো যৌবনে পদার্পণ করেছে। যৌবন উদ্দিপ্ত তেজ আগুনে পুড়ে ফেলতে চাইছে সব কিছু। যেনো সূর্য মানুষের নির্বুদ্ধিতায় বিরূপ হতে হতে ক্ষেপে গেছে পুরো মাত্রায়। এবারে আর নিস্তার নেই কোনো। আজো শামান অন্যান্য দিনের মতো সন্ধ্যার পর বের হয়েছিলো্ যথারীতি প্রথমেই বিপ্লব দার চায়ের দোকানে ঢোকে।

এখানে এলেই অনেকের সাথে দেখা হয় কথা হয়। কিন্তু আজ বাধ সাধলো হঠাৎ শুরু হওয়া কালবৈশাখী। আগেই কিছুটা বাতাস বৈছিলো। তবে এবার প্রচণ্ড বেগে শুরু হলো। রাস্তার সমস্ত ধুলো সানন্দে লাফালাফিতে মেতে বীরদর্পে ঝাঁপিয়ে পড়লো দোকানের মধ্যে।

শামান কোনো রকমের চা শেষ করে কয়েকটা সিগারেট নিয়ে রাস্তায় বালি গিলতে গিলতে দৌড়ে শিশিরেরে রুমে আসে। শিশির মহা উদ্দিগ্ন। সামনে পরীক্ষা কিন্তু কিছুই পড়া হয়নি। শামান ঢোকার সাথে সাথেই এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা শুরু করলো। ওকে বললো, " এই কদিনে কেমনে শেষ করবো?" শামান একটু বিরক্ত হলো, এমনিতেই ও কথা বলা তেমন পছন্দ করে না।

সব সময় নিজস্ব ভাবনায় ডুবে থাকতেই পছন্দ করে। নিজের সমস্ত স্বপ্ন-ক্ষোভ-ভালোলাগা-হতাশা ভাবনার বলয়েই বয়ে বেড়ায়। কারো কাছে প্রকাশকে গ্রাহ্য করে না। বন্ধুদের সাথে সময় কাটালেও ও যেনো জীবনানন্দ দাশের মতো " সকল লোকের মাঝে বসে/ আমারি মুদ্রা দোষে/ আমি একা হতেছি আলাদা..." ধরনের ছেলে। "এতোই যদি বুঝিস তো সারা বছর কী করছিস?" এই বলে কিছু একটা লেখায় মনোনিবেশ করলো।

একটু পড়ে শিশিরকে বললো, - দেখ, দু'লাইন লিখছি। - না, পরে দেখবো। - আরে দেখ না। - আচ্ছা দাও। শিশির শামানের চেয়ে কিছুটা ছোটো।

তবুও ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব বেশ। সময় পেলেই একসাথে বসে আড্ডা মারে। তবে ওদের মধ্যে অমিলই বেশি। শামান সব সময় কবিতা, মিথ, ভরী ভারী তত্ত্ব জ্ঞান নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। অন্যদিকে শিশিরের পছন্দ হালকা রঙ্গ রস।

আর এ নিয়ে প্রায়ই ওদের মধ্যে লাগে। ৩. বৃষ্টি শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। তবে যতোটা আয়োজন ছিলো। সে তুলনায় বৃষ্টির বেগ বেশ ক্ষীন। তবুও কারো অভিযোগ নেই।

কেননা এতোদিনের খড়ার পীড়নে জর্জরিত মানুষগুলো একফোটা বৃষ্টিতেই দারুণ তৃপ্ত। যেনো এতোটুকু বৃষ্টিই ঈশ্বরের বড়ো কৃপা। হয়তো মনেমনে ভাবে ঈশ্বর কতো দয়াময় একফোটা বৃষ্টি দিয়েছে। তারা ভুলেই যায় পিছনের যন্ত্রণা ক্লিষ্ঠ দিনগুলোর কথা। এই ভাবনা থেকেই শামানের জেলি ফিসের কথা মনে পড়ে গেলো।

জেলি ফিস ১৫ সেকেন্ডের বেশি কিছু মস্তিষ্কে রাখতে পারে না, ভুলে যায়। এরমধ্যে এসে হাজির হলো মাহিন। আধ ভেজা অবস্থায় ঘরে ঢুকলো। মাহিন ছেলেটা দেখতে একটু রোগা ধরনের। তবে প্রচণ্ড তেজ আছে ওর মধ্যে।

খোঁচা খোঁচা দাড়ি রাখে । ওর যে-দিকটার জন্য বন্ধু মহলে অলোচিত তাহলো কট্টর নাস্তিকতা। ধর্মের কোনো কিছু ও সহ্য করতে পারে না। ধর্মের যতো ক্ষতিকর দিকগুলো ওর চোখে পড়ে। এর কোনো ভালো দিক আছে বলে মাহিন মনে করে না।

ওকে একবার শামান প্রশ্ন করেছিলো- "তুই নাস্তিক তো দাড়ি রেখেছিস কেনো?" ও অকপটে উত্তর দিয়েছিলো, " এটা আমার প্রেম হারানোর প্রতীক হিসেবে রেখেছি। " উত্তরে খারাব বলেনি। দেবদাসও নাকি একই কারণে দাড়ি রেখছিলেন। এছাড়া পৃথিবীর বহু বিখ্যাত মানুষ দাড়ি রেখেছেন। শিল্পিরাতো হরহামেশা দাড়ি কাটতে চানই না।

অল্পক্ষনের মধ্যেই যথারীতি ওদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়ে গেলো। মাহিন থাকা মানেই বিতর্কের ঝড়। এক পর্যায়ে শিশির মাহিনকে প্রশ্ন করলো- - আচ্ছা ভাই, কোরাণ যদি ভুল হয় তবে এতামানুষ কেনো কোরান মানছে? - কে বলেছে মানুষ কোরান মানছে। যারা মুসলমান দাবী করে তারাও কোরান মানতে পারছে না। কারণ এটা একটা ব্যাকডেটেড পুস্তক।

সবাই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম বিশ্বাস লালন করে আর তা থেকে সুবিধা আদায়ের ধন্ধা করে। এর বেশিকিছু না। আর যদি মানুষের মানা না মানার উপর নির্ভর করে তবে ইসলাম তো ৩/৪ নাম্বারে চলে যায়। এ ব্যাপারে কী বলবা? আসলে ধর্মগুলো এখন অচল। আমাদের দরকার নতুন অবকাঠামো।

শামান ওদের কথায় তেমন গুরুপ্ত দিলো না। আজ ওর মন ভালো নেই। যদিও কোনো দিনই ভালো থাকে না। তবে আজ একটু অন্য রকম লাগছে। এ-রকম অবস্থায়ই মনে হয় কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, " স্মৃতিগুলো পাগলা কুকুরের মতো দাঁত খিচিয়ে তাড়া করে।

"। শামান যখন কোনো ভাবনাকে আয়ত্বে না আনতে পারে, তখনই এরকম অবস্থার সৃষ্টি হয়। ৪. মাহিন আর শামান শিশিরকে বিদায় জানিয়ে উঠে পরলো। ওরা চললো মাহিনের বাসার দিকে। পৌঁছেই দেখে বিদ্যুৎ নেই।

খুব হতাশ হলো শামান। ও ভাবছিলো মাহিনের পিসি থেকে কিছু ডকুমেন্ট নেবে। ওরা একটা চায়ের দোকানে বসলো। চা-সিগারেট শেষ করে শামান বাসার দিকে রওনা দিলো। এখনো বৃষ্টি হচ্ছে।

হালকা পাতলা বৃষ্টি। একটা ঝিরঝিরে আবহ চারিদিকে। রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। মাঝেমধ্যে দু'একটা রিকশার তাড়াহুড়ো চোখে পরে। শামান হাঁটছে আপন মনে।

মনে এক অস্ফুট ভাবনা ওকে গ্রাস করে নিচ্ছে। কিন্তু ও ধরতে পারছেনা ভাবনাটাকে। ভীষণ ভারী মনে হচ্ছে। মধুমিয়ার পোল পেরিয়ে কলেজ রোড এ উঠে এলো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।

বাতাস আর বৃষ্টির ঝাপ্টায় ওর নিজেকে পালকের মতো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি উড়ে যাবে দূরকোনো খানে অথবা মেঘের মেতা চলিষ্ণু শিকরহীন কোনো ঠিকানায়। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো, আসলে আমি কি ভালোবাসি? আমাকে কি ভালোবাসে? নাকি আমি বুঝি না বলেই ব্যর্থতার কাছে নিজেকে পরাজিত করছি? অমীমাংসিত সব প্রশ্নে নিজেকে আক্রমন করে কোনো লাভ হলো না। সব যেনো ভুল আয়োজন। ও মনে করার চেষ্টা করলো, কখনো কোনো কথা দিয়েছিলো কিনা ওর প্রেমিকা।

মনে করতে পারলো না। ভাবলো, তবে কথা দেয়নি। " তবে কেনো এই অস্থিরতা?" ভাবতেই নিজেকে হালকা লাগলো। আস্তে একবার বোদলেয়ার উচ্চারণ করলো- "আমি ভালোবাসি মেঘ চলিষ্ণু মেঘ...." হঠাৎ হেডলাইটের আলো ওর চোখে পরায় আচ্ছন্নতা ভাঙলো। একটা এম্বুলেন্স আসছে হুইসেল বাজিয়ে।

এই দুর্যোগের রাতে একজন মানুষ এম্বুলেন্সে মুমূর্ষু। এটা ঈশ্বরের কোন ধরনের দয়া মততা? নাকি এটা ঈশ্বরের বর্বরতম রসিকতা। ওর মধ্যে হঠাৎ চিন্তা খেলে গেলো, ঈশ্বর কি তবে অশুভ কেনো শক্তি। এই ভেবে ও চলছে। কিছুদূর এসে দেখলো অনেক লোক রাস্তার পাশে একটা অসমাপ্ত দালানের নিচে জড়ো হয়ছে।

প্রথমে ভাবলো কিছু বুঝি ঘটেছে। পরক্ষনেই বুঝলো তা নয়। বৃষ্টি থেকে নিজেদের রক্ষা করতেই এরা এখানে আশ্রয় নিয়েছে। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতেই হেসে ফেললো শামান। বৃষ্টি কি শত্রু? এই লোকগুলোই দুপুরের প্রচণ্ড দগ্ধতার মধ্যে ঘামের দুর্গন্ধ নিয়েই রাস্তার বালি-ধূলো গায়ে মেখে প্রতিদিন ছোটাছুটি করে আর ঈশ্বরের কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে।

সেই লোক গুলোই এখন এই স্নিগ্ধ বর্ষার চুম্বনের ভয়ে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে ছাদের নিচে। কী আশ্চর্য মানুষ। শামান ভেবেই পায় না মানুষ এতোটা নির্বোধ হয় কী-করে। অপার্থিব বর্ষার মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে ও। আস্বাদ করছে নিসর্গ সুখ।

সারাদিনের কলুষিত মন হঠৎ উজ্জল হয়ে উঠলো। ওর মনে হলো প্রমিথিউসের অভিশপ্ত জীবন বুঝি এইমাত্র মুক্তি পেলো। যেনো জীবনের এই পরম পাওয়া, এরই জন্যে অপেক্ষা করেছিলো এতোকাল। জীবনের অর্থ কী? জীবন কি শুধুই অভিজ্ঞতা অর্জন নাকি অন্য কিছু? এসব প্রশ্ন এখন বাতুলতা। শুধু বৃষ্টি স্নান, শুধু শান্তি, শুধুই অবিরল আনন্দের মুর্ছনা।

আকস্মিক বিদ্যুতে জ্বলে উঠলো পৃথিবী। পরক্ষনেই বিপুল গর্জনে বাজ পড়লো। শামান এমন আকস্মিকতায় কেঁপে উঠলো। ভীত বিহ্বল হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। কয়েক মুহুর্ত পর নিজেকে সামলে নিলো আর মুখে খেলে গেলো বিদ্রুপের হাসি।

নিজেকে একটা গালি দিলো। ভাবলো,বহু দিনের ভাবনাগুলো ফেলে মুহুর্তেই কেমনে চমক ভাঙে! রক্তের পরিক্রমায় আবদ্ধ আমাদের এ-সত্তায় উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ভীতি আজো অবচেতনে কেমন কার্যকর...!!! ২৭/০৪/১০

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.