আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লালন আখড়া অভিযান ২০১২


এক শুরুর কথা পূর্নিমা রাতে লালন আখড়ায় যাইবার মনোবাসনা প্রায়শই বন্ধু রনির কাছে ব্যাক্ত করিতাম আর কালজয়ী এ বাউল শিল্পীর আস্তানায় গান শুনিতে শুনিতে রাত্র কাটাইতে কিরুপ মজা হইবে তাহা ভাবিয়া রোমাঞ্চিত হইয়া পড়িতাম। অবশেষে একদিন হঠাৎ রাত্র দেড়টায় বন্ধু রনির ফোন আসিল। কুষ্টিয়ার লালন আখড়ায় দোল পূর্নিমার উৎসব চলিতেছে যাইবা নাকি। নানাবিধ কারনে সিদ্ধান্ত লইতে হইবে খুব দ্রুত। এসময় বন্ধু রাব্বিকে (লজিক ম্যান) ঘটনা জানাইয়া সিদ্ধান্ত লইলাম আগামীকাল আমরা লালন আখড়ায় যাইতেছি।

দুটো গ্রুপ আলাদা আলাদা ভাবে রওনা হইয়া লালন আখড়ায় মিলিত হইবো এবং রাত্র কাটাইয়া পরদিন সকালে আবার ফিরিয়া আসিব ইহাই ছিলো পরিকল্পনা। আমি আর রাব্বি যাইবো ঢাকা হইতে অন্যপ্রান্তে রনি, তাঞ্জিল আর কনক রওনা হইবে খুলনা হইতে। দুই বিপর্যস্ত যাত্রা তারিখ ৮ মার্চ ২০১২। দুপুর দেড়টায় গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে আসিয়া বসিয়া রইয়াছি, রাব্বির চাঁদ বদনখানীর দেখা নাই। দুর্দান্ত সময়জ্ঞানের করনে পূর্ব হইতে বিখ্যাত লজিক ম্যান রাব্বি বাস স্ট্যান্ডে আসিয়া পৌছাইলো ঝাড়া দেড়টি ঘন্টা পর।

এবার বাস ধরিবার পালা। ঘন্টা খানেক দৌড় ঝাপ করিয়া বাস না পাইয়া যখন মিশন ক্যান্সেল করিতে লাগিলাম তখন সাঁ করিয়া একজন আসিয়া দুটো ঝিনাইদহের টিকিট গছিয়ে কহিল আমাদের রানিং গাড়ী এখনি ছুটিয়া চলিবে, ঝিনাইদহে নামিয়া আপনাদের কুষ্টিয়া যাইতে বিশেষ বেগ পাইতে হইবে না। সসম্মানে গাড়ীতে উঠিয়া বসুন। আমরা লক্কর ঝক্কর গাড়ীর শেষ সীটে চাপিয়া বসিলাম। রানিং গাড়ী রানিং হইতে ১ ঘন্টা সময় লাগাইলো! অতঃপর সাভার পার হইতে না হইতে গরররর আওয়াজ তুলিতে তুলিতে বন্ধ হইয়া গেলো।

ড্রাইভার দাঁত কেলানো হাসি দিয়া কহিল গাড়ীর তেল নাই! রাগে দুঃখে বিস্ময়ে যাত্রীগন ক্ষেপিয়া উঠিল। সারা রাত্র জাগিয়া থাকা জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র রাব্বির মেজাজও বিগড়ায়া গেলো। আমাকে কহিল এ গাড়ির যাত্রা জাহাঙ্গীরনগর পর্যন্তই। জাহাঙ্গীরনগর পৌঁছাইয়া শুধু মাইর হবে মাইর!!! একেতো চেয়ার কোচ গাড়ী পাই নাই তাহার উপর এহেন গাড়ীর শেষ সীটের যাত্রী আর গাড়ীর এই অবস্থা! যাহা হউক টং দোকানে বসিয়া ড্রাইভার আর যাত্রীদের মজা দেখিতে দেখিতে সময় বেশ ভালোই কাটিতেছিল ৪০ মিনিট পর (প্রায় ৬ টা বাজে তখন) গাড়ী আবার ছাড়িল। পরবর্তীতে চাঁদের আলোয় যে লঞ্চ ভ্রমণ হইয়াছিলো তাহা ভাষায় বর্ননার নয়।

ইহার জন্য বোধহয় আমি হাজার বছর ধরিয়া তৃষ্ণার্থ ছিলাম! তিন পরিকল্পনা বিপর্যয় রাত্র সাড়ে বারোটায় ঝিনাইদহ নামিলাম। অতঃপর পরোটা আর খাসীর ঘিলু দিয়া আহার করিতে করিতে অপর পক্ষের খোঁজ নিতে লাগিলাম। তাহারা একই সময়ে লালন আখড়ায় পৌছাইয়াছে। রাত্র গভীর হওয়ার ফলে সকালের আগে আমাদের কুষ্টিয়ায় যাইবার মত অবস্থা নাই। কোন মতে রাতটি পার করিবার জন্য হোটেল খুজিয়া পাইতে আমাদের রাত ৩ টা বাজিয়া গেলো।

সারা রাত্র আমার ঘুম বিশেষ হয় নাই। ভোর ৬ টায় ওদিক থেকে ফোন আসিল তাহারা খুলনায় ফিরিয়া যাইতে চায়। কনক তাহার এনার্জির শেষ সীমানায় পৌছাইয়া গিয়াছে, তাঞ্জিলও কূটনৈতিক ভাবে থাকিতে পারিতেছে না। পরিকল্পনায় এমন বিপর্যয় ও তাহাদিগের এমন কান্ড-জ্ঞানহীনতায় আমরা যে ক্ষুব্ধ হইয়াছিলাম তা বলাই বাহুল্য। এ ঘটনায় বন্ধুত্তে যে চিড় ধরিয়াছিলো এবং তাহার রেশ পরবর্তীতে যে কিরুপ ছিলো তাহা আর বর্ননা করিলাম না।

রাব্বি অঘোরে ঘুমাইতেছিলো। সূর্য উঠিবার পরপরি তাহাকে না জানাইয়া রুমে তালাবদ্ধ করিয়া আমি বেরিয়ে পড়িলাম ঝিনাইদহের রাস্তায়। মন মেজাজ খারাপ থাকা সত্ত্বেও সকালটা অনুমানের চেয়ে ভালো কাটিয়াছিলো। দারুন লাগছিলো হাটিতে। চা-টা পান করিয়া রুমে ফিরিয়া রাব্বিকে উঠাইলাম।

গোসল সেরে বেরিয়ে পড়িলাম কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে। লালন আখড়ায় প্রবেশের প্রকান্ড গেইট। চার কুষ্টিয়ার লালন আখড়ায় কুষ্টিয়া নামিয়া একটি অটো লইলাম আমরা। লালন আখড়ায় যাইতে যাইতে আধো ঘুম আধো জাগার কারন না আশেপাশের পরিবেশের কারনে জানিনা আমার মনে হইতেছিলো আমাদিগের পিছনে ৮০র দশকের একজন ডিরেক্টর ধেয়ে আসিতেছে উদ্ধত ক্যামেরা হাতে লইয়া আর আমরা ব্রিটেন হইতে আনা অস্টিন গাড়িতে চাপিয়া যাইতেছি কোন জরুরি সভায় যোগদান করিতে! বেলা প্রায় ১২ টা। লালন আখড়ার প্রবেশমুখে পৌছাইয়া চারিদিক দেখিতে লাগিলাম।

বিচ্ছিন্ন ভাবে একতারার টুং টাং আওয়াজ ভাসিয়া আসিতেছিলো। তবে জায়গাটা কেমন ঝিমানো, সারা রাত্র গান বাজনা করিয়া সাধকগন এলমেলোভাবে বিশ্রাম লইতেছিলো কেহ আবার তাবিজ-কবজ-মাদুলি-আংটি এসকল বিক্রয় করিতেছে। তাহাদিগের আচার আচরন ছিলো বেশ মজার। ক্যামেরা সঙ্কটের কারনে রাব্বির Nokia 6303 classic দিয়া ছবি তুলিতে শুরু করিলাম। সকলে বেশ সাবলীল ভঙ্গীমায় পোজ দিতে লাগিল।

লালন আখড়ার শো-পিসের দোকানগুলো বেশ চমকপ্রদ। একতারা সহ নানারকম বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি কাঠ আর গাছের শিকড়ের তৈরী হাজারো জিনিসপত্রে ঠাসা। কৌতুহলী হইয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিতেছিলাম এসকল জিনিসপত্র। রাব্বি যাহাই দেখে তাহাই কিনিতে উদ্যত হইয়া বেশ খরচ করিয়া ফেলিল। মনের সুখে উপুর্যপুরি লালন আখড়ায় ঘুরিয়া, বাউল-সাধকদের কির্তীকর্ম দেখিয়া সময় বেশ কাটিয়া যাইতেছিলো।

প্রায় বৈকালে ক্ষুধা নিবারনের জন্য নিকটস্থ খাবারের দোকানে ঢুকিলাম। মামুলি খাবারের আয়োজন, অবশ্য আমরা এখানে খুব বেশী কিছু আশাও করি নি। ছোটমাছ আর ডাল দিয়া ভাত খাইবার পর ৫ টাকা খরচ করিয়া লালন একাডেমীর জাদুঘর দেখিলাম। অতঃপর রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি দর্শন করিয়া আসিলাম। ইনি রীতিমত পোজ মাস্টার একতারা একতারা পাঁচ রাতের লালন আখড়া ও আমি রাব্বি আর থাকিতে পারিতেছে, তাহার জরুরি কাজ রইয়াছে তাহা আগেই জানিতাম।

কিন্তু আমি রাতের লালন আখড়া না দেখিয়া ছাড়িব না। তাই উহাকে সন্ধ্যায় বিদায় জানাইয়া আমি আখড়ার মূল স্টেজের সামনে আসন লইলাম। সন্ধ্যার আখড়া সম্পূর্নরুপে ভিন্ন। এ যেনো এক অন্য জগত, দলে দলে লোক আসিয়া জড় হইতেছে গান শুনিবার জন্য। দেখিতে দেখিতে আখড়া এক মহাসমুদ্রে রূপ লইলো।

দু-তিনটি গান সবে হইয়াছে এর মধ্যে এক মন্ত্রী তাহার চ্যালাবেলা সমেত স্টেজে হাজির। গান শুনিতে বসিয়া একি উপদ্রোপ। অতঃপর মন্ত্রীমহোদয় আর তাঁর চ্যালাবেলারা মিলিয়া গাঁজা সেবনরত বিচ্ছিন্ন দর্শকগনের মধ্যে গাঁজার অপকারিতা ও ইহা বন্ধ করিবার লক্ষ্যে কি কি পদক্ষেপ লওয়া হইতেছে সে বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করিলেন। সকলে বিপুল উতসাহে করতালি দিতে লাগিল। গান শুনিতে বসিয়া বক্তব্য শুনিতে শুনিতে বিরক্ত হইয়া রাতের খাবারের ব্যাবস্থা করিতে বাহির হইলাম।

খিচুড়ি আর ডিম ভাজি দিয়া মোটামুটি ভালো আহার হইলো। খাবার দাবারের ব্যাপারে সতর্ক অবস্থানে রইয়াছি, এমন কিছু খাওয়া যাইবে না যাহা শরীরকে কাবু করিয়া ফেলে। ডিহাইড্রেশন ঠেকাইতে ওরস্যালাইন কিনিয়া লইয়াছি। সারা রাত গান শুনিতে শুনিতে এলাকার লোকজনের সাথে খাতির পাতাইয়া বেশ তর্ক (আসর) বাধাইয়া দিলাম। বুঝিলাম স্থানীয় বাসিন্দারা লালন ইস্যুতে বেশ সেনসিটিভ ও লালনের গানের একনিষ্ঠ ভক্ত।

লালনের গানের অবমাননা কিছুতেই তাহারা মানিয়া লইবে না। ছয় সমাপ্তি ও বিষাদময় ঢাকা প্রত্যাবর্তন নিরাপত্তার কথা ভাবিয়া টাকা পয়সা বিশেষ পকেটে রাখি নাই। তাহাই আমার কাল হইলো। স্থানীয় সকল এটিএম বুথে সার্ভিস গোলাযোগের কারনে বেশ দিশেহারা হইয়া উঠিলাম। উপায়ন্ত না দেখিয়া ২৫ টাকার ট্রেনের টিকিট কাটিয়া যশোহর আসিবার মতলব করিলাম।

ওখান থেকে টাকা তুলিয়া ঢকায় ফিরিব। ট্রেনে সীট না পাইয়া নামাজ ঘরে আসিয়া বসিলাম। টানা দু রাত না ঘুমাইয়া বেশ কাহিল হইয়া পড়িয়াছিলাম ফলে নামাজ ঘরে বসিতে না বসিতেই মহাকালের মহা ঘুমে পাড়ি লাগাইলাম। ঘুম থেকে উঠিয়া দেখি আমি খুলনায় চলিয়া আসিয়াছি!!! আগামীকাল থেকে দেশের বিরোধী দলের তিন দিনের হরতাল সহ ঢাকা ঘেরাও কর্মসুচি। ওদিকে জরুরি কাজ পড়িয়া রইয়াছে তাই নিজ বাসা খুলনায় থাকা সত্ত্বেও তিন দিন আটকাইয়া থাকাটা মানিয়া লইতে পারিতেছিলাম না।

ঢাকার টিকিট কাটিতে আসিয়া দেখি সকল গাড়ি বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে, কি করি এখন? অবশেষে একটি ভলবো এসি গাড়ি পাইলাম যাহা দিনের শেষ ঢাকাগামী গাড়ী। তাহাতে চাপিয়া বসিয়া কম্বল মুড়ি দিয়া বেশ ঘুম দিতে লাগিলাম। গাড়ী ফেরিঘাটে আসিলে ফের বিপত্তি শুরু হইলো, ঢাকা ঘেরাও ঠেকাইতে সরকার একটি মাত্র ফেরী খুলিয়া রাখিয়াছে। তাহার উপর পুলিশ গাড়ি আটক করিয়া ইয়ার্কি মারিতেছে, টাকা খাইবার নিমিত্তে। জট পাকানো ফেরী ঘাটে ড্রামা আর প্রহসন চলিতে লাগিল।

সুদীর্ঘ ১৮ ঘন্টা পর আমি ঢাকায় ফিরিলাম। শেষ হইলো আমার মহাকাব্যিক ভ্রমন! এখন শুধু ঘুম আর ঘুম। ঘুমের ঘোরে আমি শুনিতেছি টুং টাং আওয়াজ আর কেহ গাহিছে- “ আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময় পারে লয়ে যাও আমায় “ লালন আখড়ার শো-পিসের দোকানগুলো বেশ চমকপ্রদ। লালনের সমাধিস্থল। সাধকরা যে যার মত... লালন-অনুরাগী।

এনার সাথে আমরা খুব খাতির জমাইছিলাম। আমাদের বিদায় জানাচ্ছেন।
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.