আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাভারে ট্রাজেডী: রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির ফসল

হে নাগরিক, শুনতে পাচ্ছো কি? ভাঙ্গা দেয়াল, কংক্রীট আর লাশের স্তুপের ভেতর যে শিশু ভূমিষ্ট হলো, তার আর্তচিৎকার, মৃত্যুর আগে যে ছেলেটি যে মেয়েটি জড়িয়ে আকড়ে ধরে পরস্পর বাঁচতে চেয়েছিল, তাদের হৃদয়ের স্পন্দন। শুনতে পাচ্ছো কি? তপ্ত পাঁজর ভাঙ্গার শব্দ, সন্তান হারা মা, স্বজনের আকাশ ভারী করা কান্নার আওয়াজ। গার্মেন্টস কারখানা আজ এক বিভীষিকাময় অবধারিত মৃত্যু কূপের নাম। এ এমনই এক অনিয়ম, লুটপাট, শ্রম শোষণের দেশ যে আধুনিক শিল্প যুগে এসেও আমাদের একশ বছর পিছিয়ে দাবী তুলতে হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের অন্তত জীবনের নিরাপত্তা চাই। যাদের শ্রমে ঘামে খুরছে এ রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকা, যারা স্রেফ দুবেলা খাদ্যের যোগানে নিঃশেষ করে দিচ্ছে পুরোটা দেহ, তাদেরই কেন মরতে হবে বার বার কাতারে কাতার? এ প্রশ্নের উত্তর দেবেনা রাষ্ট্র, দেবেনা বিকেএমইএ, দেবেনা বিজেএমইএ এর নেতারা।

তাদের কাছে শ্রমিকরা মানুষ নয় যেন হাত-পায়ে শেকল বাঁধা পশু। হাজার শ্রমিকের মৃত্যু তাদের কাছে কেবলই সংখ্যা মাত্র্‌ আর আমরাও গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে টিভি পর্দায় সেই সংখ্যা গুনি, কাটা হাত-পা, থেতলানো মগজের ছবি দেখে আহা উঁহু করি। তারপর শীতনিদ্রা। নতুন কোন মৃত্যু এসে কেড়ে নিয়ে যায় গত মৃত্যুর ছবি। এক দিকে চলে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরানো শ্রমিকের আর্তবিলাপ অন্যদিকে মালিক শ্রেণীকে বাচানোর প্রানান্ত চেষ্টারত সরকার ।

আর আমরা দর্শক আমরা দুটোই দেখি। বাতাসে তাজরিন গার্মেন্টেসের মানুষ পোড়া গন্ধ মিলিয়ে যেতে না যেতে আবার শ্রমিক হত্যার উৎসব সংঘটিত হলো সাভারের রানা প্লাজায়। ভবন ধ্বসের ঝুঁকি জানা সত্ত্বেও জোর করে কারখানায় ঢুকতে বাধ্য করে হত্যা করা হলো শত শত শ্রমিক। চিরদিনের মতো কর্মহীন, পঙ্গু করে দেয়া হলো হাজারো শ্রমিক। কিন্তু কেন একের পর এক শ্রমিক হ্ত্যার উৎসব? লাশের মিছিল আর কত দীর্ঘ হলে হন্তাকারকদের ক্ষুধা মিটবে।

এর জন্য দায়ী কারা, কেবল কি গুটিকয়েক গার্মেন্টস মালিক? বিকেএমইএ-বিজেএমইএ-প্রশাসন-সরকার এর তবে কার স্বার্থে নিয়োজিত? ২৪এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসে পড়ে কয়েক শত শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ভবনে ফাটল থাকায় শ্রমিকরা কাজ থেকে বিরত থাকার ইচ্ছা জানালেও ভবন মালিক ও কারখানা মালিকরা ছাঁটাই ও বেতন না দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে জোর করে প্রবেশ করতে বাধ্য করে। শ্রমিকদেরকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে লুটেরা মালিক শ্রেণী। এর পূর্বে তাজরিন, স্পেকট্রাম, হামীম গ্রুপের শ্রমিক হত্যা আপনারা প্রত্যক্ষ করেছেন। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষেরা মুনাফালোভী হায়েনাদের কাছে মানুষ নই।

তাদের কাছে শ্রমজীবী গৃহপালিত পশু সমতুল্য। গৃহপালিত পশু দিয়ে পশুর মালিক যেমন ইচ্ছেমত হাল চাষ করে ইচ্ছেমত খেতে দেয় ঠিক তেমনি এই মালিক শ্রেণীও আমাদের পশুর মত ব্যবহার করছে। আমাদের অধিকারের কথা বলতে গেলে ওরা আমারেদ গলা টিপে ধরে, পোষা গুন্ডাবাহিনী দিয়ে, পুলিশ দিয়ে আমাদের নির্যাতন নিপীড়নসহ হত্যা করে। যারা ইতোমধ্যে মারা গেছেন তাঁরাতো বেঁচেই গেছেন। আর আমরা যারা বেঁচে আছি তারা মানুষের মত বেঁচে নেই।

শ্রমিকদের মৃত্যুতে শাসক শ্রেণীর উভয় পক্ষ শোকবাণী লেখেন, এমনকি জাতীয় শোকও পালন করেন। এগুলো ভাওতাবাজী, এখন পর্যন্ত তাজরিন, স্পেকট্রাম ও হামীম গ্রুপের কোন মালিককেই গ্রেফতার করে বিচারে সোপর্দ করা হয়নি। বাংলাদেশে আজ লুটপাট চলছে, এদেশ আজ লুটের বাজার। মহাজোট ও আঠারো দলীয় জোট ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে যার যার আখের গুছাচ্ছে। এতে দেশে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সমূহ সম্ভবাবনা দেখা দিয়েছে।

আজ একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, যে গত ২৪ এপ্রিল, ২০১৩ তারিখে সাভার রানা প্লাজার ৯ তলা ভবন ধ্বসে ভয়াবহ ঘটনা এবং মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটেছে তা স্মরণকালে মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক ইতিহাসে তৈরী হয়েছে। উদ্ধারকাজের হিসেব অনুযায়ী মৃত গলিত লাশ ১১৩৭ জন অতিক্রম করে লাশের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলছে, যা পোষাক কারখানায় এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা পৃথিবীর রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এমনিতেই এ দেশের শ্রমিকেরা খেয়ে না খেয়ে, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার অভাবে জেলখানায় কয়েদীদের চেয়েও মানবেতরভাবে জীবন-যাপন করে চলছে। শ্রমিকের জীবনের সবকিছু স্বপ্ন-সাধ বিসর্জন দিয়ে শুধুমাত্র মালিকদের অতি মুনাফার স্বার্থে দিনরাত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে বেঁচে আছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করার জন্য উপযুক্ত মজুরী, ন্যায্য পাওনা থেকে শ্রমিকেরা বঞ্চিত হয়ে আসছে।

পোষাক শিল্পে আমাদের দেশের অবস্থান দ্বিতীয় স্থানে উন্নীত হলেও এ শিল্পে শ্রমিকদের গতর খাটা ছাড়া কোন উন্নতি হয়নি বরং পৃথিবীতে বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরী প্রাপ্তির স্থান সর্বনিম্ন। ১৯৯০ সাল থেকে মিরপুররের সারাকা গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ডে ২৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু ও ২০০ জন আহতের পর থেকে ১৯৯৫ সনে লুসাকা গার্মেন্টসে নিহত ১০, আহত ১১০, ১৯৯৬ সালে পল্লবীর সানটেঙ্ গার্মেন্টসে নিহত ১৪ জন, আহত ১৬০, ১৯৯৬ সালে ঢাকার তৌহিদুল ফ্যাসনে নিহত ১৪, আহত ২০০, ১৯৯৭ সালে মিরপুরের রহমান অ্যাপারেলসে নিহত ২২, আহত ১৬০, ১৯৯৭ সালে মিরপুরে তামান্না গার্মেন্টসে নিহত ২৭, আহত ২১০, ২০০০ সালে বনানীর গ্লোব নিটিংয়ে নিহত ১২, ২০০৫ সালে নারায়নগঞ্জে সান নিটিংয়ে নিহত ২৬, আহত ২০০, একই সালে সাভারে স্পেকট্রাম গার্মেন্টসে ৮তলা ভবন ধসে নিহত ৬৮ আহত ৪০০,২০০৬ সালে চট্ট্রগ্রামে কেডিএস গার্মেন্টসে নিহত ৬৫ আহত ৩০০, ২০১০ সালে গাজীপুরের ভোগরায় গরীব এন্ড গরীব গার্মেন্টসে নিহত ৩৬ আহত ২৬০, একই সনে আশুলিয়ার হামীম গ্রুপে নিহত ৩১ আহত ১৩০, ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনে নিহত ১২৪ আহত ২০০, স্মার্ট ফ্যাশনে নিহত ৮ আহত ৭০ জন সহ ২২১ গার্মেন্টসে এ পর্যন্ত অগ্নিকান্ডে ও ভবন ধ্বসে অন্তত ২ হাজার শ্রমিকের অকাল মৃত্যু ও ২৫ হাজারের উপরে শ্রমিক আহত- পঙ্গু হয়েছে। উল্লেখিত ভাবে অগ্নিকান্ড ও ভবন ধ্বসে একের পর এক শ্রমিকের প্রাণহানি ও চিরতরে পঙ্গুত্ববরনের ঘটনায় এ পর্যন্ত একটি গার্মেন্টসে সঠিকভাবে তদন্ত করে দায়ী দোষী মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হয়নি। নিহত আহত শ্রমিক পরিবার ন্যায় বিচার ও সুশাসন থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হয়েছে। পোষাক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি বিজিএমইএ-বিকেএমইএ তাদের ঘোষিত লেবার স্ট্যান্ডার্ড, কমপ্লায়েন্স, নিরাপদ কর্ম পরিবেশ- কর্মস্থলে শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা প্রদানে অমনোযোগী, অবহেলা, দায়ীত্বহীনতা এবং দোষী-দায়ী মালিকদের পক্ষ অবলম্বন করা তাদের সাধারণর্ রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

বিরাট অর্থ-বিত্তের প্রতাপশালী মালিক সমিতির একচ্ছত্র অনৈতিক প্রভাবে সরকার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর নির্বিকার ও চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে আসছে। পূর্ববর্তী ঘটনাসমূহের বিচার ও শান্তি না হওয়ায় আইন ক্যাছা-করেঙ্গায় পরিণত হয়েছে, যার কারণেই অগ্নিকান্ড ভবন ধ্বসের মতো ঘটনা ঘটেই চলছে। বর্ণিত আলোচিত ঘটনাসমূহের কারণে বিশ্বব্যাপী পোষাক শিল্পের বাজারে ও বাংলাদেশের সুনাম এ শিল্পের মালিকরাই ধ্বংস করে ফেলেছে, যা জাতীয় স্বার্থে অত্যন্ত দুঃশ্চিন্তা ও উদ্বেগের কারণ। বাংলাদেশের পোষাক শিল্পের শ্রমিকদের প্রতি যে অন্যায় আচরন ও দায়িত্বহীনতার ঘটনায় পুঁজিবাদী বিশ্ব শিউরে উঠেছে। আজ পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশ পোষাক শিল্প শ্রমিকদের ক্রীতদাস সমতুল্য শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছেন।

কোন ভাবে যেন পরিস্থিতি আজ এমন কোন ভাবেই যেন এই ভবন ধ্বংস ও অগ্নিকান্ড রোধ করা যাচ্ছে না। এখনো ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী শিল্প এলাকায় কয়েকশত বহুতল গার্মেন্টস ভবন রয়েছে যেগুলোকে কারখানা না বলে মৃত্যুকুপ বলা যেতে পারে। তাছাড়াও শ্রমিকের প্রাণহানির ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার পরিবার-পরিজনকে এতদিন কোথাও ৫০ হাজার বা ১ লাখ টাকা, বর্তমানে ৩/৪ মাস যাবৎ ৫/৬ লক্ষ টাকার গোজামিলের সাহায্য দিয়ে তাজরীন গার্মেন্টসের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে শ্রমিকের নির্মম মৃত্যুকে জায়েজ করা হচ্ছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের প্রাণহানি বা পঙ্গুত্ব পর্যায়ের ঘটনায় শ্রমিকের জীবনের ক্ষতি পূরণ হিসেবে আর্থিক মূল্য কত তার কোন বাস্তব নীতিমালা বা উপযুক্ত আইন সংশোধন বা বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ২০০৬ সালের গদবাধা আইনে প্রাণহানির জন্য ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ মানে ১২৫০ ডলার।

যাহা তৈরী পোষাক শিল্পের বায়ার কান্ট্রি ইউরোপ-আমেরিকান একজন শ্রমিকের সারা জীবনতো দূরের কথা ১ মাসের বেতনেরও কম। সারা পৃথিবীতে মোটা দাগে যে ক্ষতি পূরণের নিয়ম চালু আছে তা হল এ ধরনের কোন মারাত্মক দূর্ঘটনার কারণে শ্রমিকের মৃত্যু হলে ঐ শ্রমিক বাকী জীবনে যত টাক আয় করতেন তার সমমুল্য এবং ১৮৮৫ সালের মারাত্মক দূর্ঘটনা আইন অনুসারে অবশিষ্ট জীবনে শ্রমিক বেঁচে থাকতে যা আয় করতেন তার দ্বিগুন ক্ষতি পূরণ হিসেবে তার পরিবার পাবেন। এ পর্যন্ত অগ্নিকান্ড ভবন ধ্বসে যে সকল শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে তাদের গড় বয়স ছিল বিশ। সে সকল শ্রমিক অন্তত আরো ৪০ বছর কাজ করতে পারতেন। আনুমানিক মাসিক ৫,০০০/- টাকা হিসাবে তাদের বাকী জীবন প্রতি মাসিক আয় ধরা হলো তার হিসেবে হয় ২৪ লক্ষ টাকা।

সুতরাং সেই আইন অনুযায়ী নিহত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের ৪৮ লক্ষ টাকা হওয়া উচিত। পিলখানায় বিডিআর হত্যাকান্ডের পরে নিহত প্রতি সেনা সদস্যদের সবমিলিয়ে ৪০ লক্ষ টাকা করে প্রদান করা হয়েছিল। তাহলে একজন শ্রমিকের জীবনের মূল্য কত হওয়া উচিত এবং আহত বা চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ববরণকারী শ্রমিক তাদের বাকী জীবন পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন কি হবে? এখনো পাঁচ শতাধিক শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছে, তাদেরই বা পরিবার-পরিজনের কি পরিণতি হবে? আপনারা জানেন দেশের বর্তমানে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকান্ড শুণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে। মুনাফালোভী মালিক শ্রেণীর উৎপাদনের অন্যতম হাতিয়ার শ্রমিক শ্রেনীর প্রতি কোন মায়া-মমতা নেই। বাঁচার মতো মজুরী নেই।

নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, পে-স্লিপতো সোনার হরিণ। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও স্বাধীন দেশের উপরোগী একটি শ্রম আইন প্রণীত হয়নি। প্রায় শতভাগ বেসরকারী কারখানায় কোন সিবিএ নাই, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ভূ-লুন্ঠিত। বাংলাদেশের ৮০ ভাগের বেশী মানুষ শ্রমিক। ছোট কৃষক, ছোট দোকানদার, ছোট চাকুরীজীবী এরাও শ্রমিক শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত।

গার্মেন্টস, নির্মাণ, দোকান কর্মচারী, দর্জি, ইটভাটার শ্রমিক, সরকারী-বেসরকারী কর্মচারীসহ আমাদের রয়েছে দেশের অর্থনীতির ভিত গড়ার জন্য দেশে বিদেশে কর্মরত বিপুল সংখ্যক পরিশ্রমি শ্রমিক। কেউ আমাদের শ্রমিকদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। শ্রমিকরা কারও চোখ রাঙ্গানিকে ভয় পায়না। আমরা যারা শ্রমজীবি মেহনতি মানুষ,আমাদের শ্রমেই গড়ে উঠেছে সকল সম্পদ। পৃথিবীর যত সম্পদ আছে সবই আমাদের শ্রমে তৈরী অথচ সেই সম্পদে আমাদের কোনো মালিকানা নেই।

পূঁজিবাদী মালিক শ্রেণী আমাদের দিন-রাত খাটায়, আমরা খাটি। তবু তারা আমাদের বেঁচে থাকার মত নূন্যতম মজুরীটুকুও দেয় না, উপরন্ত তারা আমাদের বিভিন্নভাবে হত্যা করেছে, করছে। কিছুদিন আগে আগুনে পুড়িয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক হত্যা করেছে আজ আবার ভবন ধ্বসে হত্যা করলো। আশির দশক থেকেই বাংলাদেশে নিয়মিতভাবেই এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে মালিকশ্রেণী কিন্ত আজও তাদের কোন বিচার হয়নি বা কোন মালিকের শাস্তিও হয়নি এমনকি তারা প্রাপ্য ক্ষতিপূরণও প্রদান করেনি। আমাদের জানতেও দেয়া হয়নি ঠিক কতজন শ্রমিক ভাই-বোন মারা গেছেন বা কতজনের লাশ গুম করা হয়েছে।

এই হত্যা ও লাশ গুম করতে সহায়তা করছে এই ধনীকশ্রেণীর রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ক্ষমতাভোগী ও ক্ষমতালিপ্সু দলগুলো। কিন্তু সময় এসেছে আজ নিজেকে প্রশ্ন করার-আমরা কি কেবল নির্বাক দর্শকের আসনে বসে থাকবো? বসে বসে দেহের চামড়াকে সকল বেদনা সইবার মতো পুরু আর ভোঁতা করে তুলবো? নাকি মানবিক বোধের সজাগ জানান দেবো আজ। যদি মানুষ হই তবে এই অন্যায়, এই হত্যাযজ্ঞ মেনে নেবো না আর। রাষ্ট্রের দিকে আঙ্গুল তুলে বলি, এই গণহত্যা বন্ধ করো এক্ষুনি। আর কোন শ্রমিক হত্যা আমরা মেনে নেবা না।

হে রাক্ষুসে মালিকের দল, তোমাদের হুঁশিযার করে দিতে চাই, সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন গ্রাম থেকে উঠে আসা এই নিদারুন লাঞ্ছিত লাখো লাখো শ্রমিক রাজপথে নেমেেআন্দোলনের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় করে নেবে। তোমাদের পাহারাদার রাষ্ট্রীয় কোন বাহিনীই তোমাদের বাঁচাতে পারবেনা সেইদিন। আমাদের আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি। আমরা দেখি রানা প্লাজার ধ্বসের পর অধিকাংশ সাধারণ মানুষই এগিয়ে যায় মানুষকে বাঁচাবার তাড়নায়। এই তাড়নাই আমাদের প্রেরণা।

আমরা বিশ্বাস করি মানুষ জাগবে ফের, উনসত্তর, একাত্তরের মতো জাগবে মানুষ। সেই মানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে আমরা দাবি জানাই, অবিলম্বে রানা প্লাজার ধ্বসে শ্রমিক হত্যার জন্য দায়ী ভবন মালিক, কারখানা মালিকসহ সকলকে সকলকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। নিহতদের পরিবারের জন্য তাদের সারাজীবনের আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূলণ দিতে হবে। আহতদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসা এবং পরবর্তীতে তাদের কর্মসংস্থান ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। জাতীয় কমিটি গঠন করে সারা দেশের ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা চিহ্নিত করে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে।

আমরা তাজরিন গার্মেন্ট অথবা রানা প্লাজার আর কোন ধারাবিাহিকতা দেখতে চাইনা। আসুন আমরা সিদ্ধান্ত নেই, আমরা কোন পক্ষে যাবো। আমাদের সংস্কৃতি কি মালিক শ্রেণীর সেবা দাসে পরিণত হবে, নাকি সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধের চেতানায় দেশ গড়ার লক্ষ্যে শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুখপাত্র হবে। আসুন আমরা শোষণ-লুটপাট-শ্রমিক হত্যার বিপরীতে মানুষের অধিকারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার লড়াইকে বেগবান করি। সংবিধানে গালভরা অঙ্গীকার আছে 'রাষ্ট্রের' অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে-এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি দান করা'র অথচ বাস্তবতার সাথে এই অঙ্গীকারের কোন মিল নেই।

উপরন্ত রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা ব্যস্ত লুটপাটের মধ্য দিয়ে নিজেদের আখের গোছানোর কাজে আর মালিকরা ব্যস্ত শ্রমিকদের ওপর শোষনের স্টিমরোলার চালিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলতে। আর শ্রমজীবীরা জীবনে সকল প্রাণশক্তি নিঃশেষ করে বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে। এই অবস্থায় শ্রমিকদের বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার আর কোন পথ খোলা নেই। শ্রমিকদের স্বার্থের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়ত ইসলামী-জাতীয় পার্টির মাঝে কোন পার্থক্য পাওয়া যায় না। কাজেই লুটেরা, গণবিরোধী এই দলগুলোকে প্রত্যাখান করে শ্রমিকের স্বার্থে আন্দোলন করতে হবে যাতে শ্রমিকের বাঁচার মত মজুরি নিশ্চিত হয়, নিশ্চিত হয় গণতান্ত্রিক শ্রম আইন ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারসহ শ্রমিকের সকল ন্যায্য দাবি দাওয়া।

আমরা রানা প্লাজা ধসে শ্রমিক গনহত্যার জন্য দায়ী ভবন মালিক সোহেল রানা সোহেল রানার মদদদাতা ও গার্মেন্টস মালিকদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়ার মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই যাতে আর কোনো শ্রমিককে ভবন ধসে বা আগুনে পুড়ে জীবন দিতে না হয়। ### পোপের ক্ষোভ - বাংলাদেশ পোশাক কারখানাগুলোতে নিয়োজিত কর্মীদের অবস্থা ক্রীতদাসের মত বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। - ২৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিরোধীদলের লোকজন পিলার ধরে নাড়াচাড়া করায় ভবন ধ্বস হয়েছে। - রাশিয়ার কাছ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ক্রয় চুক্তি বাতিল করে উদ্ধার কাজের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনতে হবে। - শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলন বাধাগ্রস্থ করতে ভিন্ন ভিন্ন দিনে সাপ্তাহিক ছুটির বিধান বাতিল করতে হবে।

- শ্রমিকের দাবি-দাওয়া নিয়ে মালিকের সার্থে দর কষাকষির সর্বজন স্বীকৃত পথ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নেই। তাজরীন - ৫ মাসেও ক্ষতিপূরণ পায়নি নিহত ৩৭ শ্রমিকের পরিবার। - তজগাঁয়ে ফিনিঙ্ ভবন ধ্বস, স্পেকট্রাম ভবন ধ্বসে কোন মাীলককে শাস্তি দেয়া হয়নি। - ২০০৯ সালের ২৭ জুন সাভারের জামগড়া। - ৩১ অক্টোবর নিপ্পন গার্মেন্ট - ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের ইপিজিডের কিরাহ বয়ান গার্মেন্টস।

- ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারী নারায়নগঞ্জ এসিআই কারখানায় পুলিশের গুলিতে অর্ধশতাধিক শ্রমিক নিহত হলেও কোনো বিচার হয়নি। - বিএনপি-জামায়ত, আওয়ামীলীগ, জাতীয় পার্টি গুনী বর্বর গার্মেন্টস মালিকেরা সেবা করে। মেয়র/ইউএনও বরখাস্ত - জনস্বার্থের পরিপন্থী কাজ করায় সাভার পৌসভার মেয়র মোঃ রেফাতল্লিহকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। - সাভারের ইউএসও মোঃ কবির হোসেনকে ওএসডি করা হয়েছে। - ইউএনওর আশ্বাসের ১৬ ঘন্টা পর ধ্বস নামে রানা প্লাজায়।

- রানা প্লাজায়। রানা প্লাজায় অবস্থিত ব্রাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ২৩ এপ্রিল বন্ধ ঘোষণা করায় ১১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জীবন রক্ষা পায়। - সাভার ট্রাজেডি রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির দৃষ্টান্ত। - শিল্প বান্ধব পরিবেশ চাই। - নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত কর।

- রানা প্লাজা ধসের ফলে নিহত, আহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের পূর্নাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে হবে। - ঝুঁকিপূর্ণ সকল কারখানা চিহ্নিত করে তা বন্ধ করতে হবে। - রানা প্লাজার জমিতে নিহত শ্রমিকদের সম্মানে স্মৃতিসৌধ ও শ্রমিকদের আবাসস্থল নির্মাণ কর। - প্রত্যেক নিহত শ্রমিককে তার সারা জীবনের আয়ের সমপরিমাণ ৩০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। - গার্মেন্টস শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি ৮০০০ (আট হাজার) টাকা নির্ধারণ করতে হবে।

- সকল কারখানায় ও ইপিজেডে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার দিতে হবে। - রানা প্লাজ ধসে শ্রমিক গনহত্যার জন্য দায়ী ভবন মালিক সোহেল রানা সোহেল রানার মদদদাতা মুরাদ জং ও গার্মেন্টস মালিকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। এদের পুঁজি ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। - তজারীন, হামিম, গরীব এন্ড গরীব স্পেকট্রাম তেজগাঁও ফিনিঙ্, নারায়নগঞ্জের সান নিটিয়ং, নরসিংদির চৌধুরী নিটওয়্যার, চট্টগ্রামের কেডিএস আগুনে পুড়ে, ভবন ধসে শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনার বিচার হয়নি। ক্ষতিপূরণ দেয়নি।

শ্রমিকদের উপর শাসকশ্রেণী ও মালিকদের ধারাবাহিক গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। - শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধ হোন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।