আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গবেষণার ফলাফল: ল্যাব থেকে খবরের কাগজ

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
কিছুদিন আগে আমার কোন এক পোস্টে উল্লেখ করেছিলাম আমি বর্তমানে আইসিডিডিআর, বি তে কাজ করছি। সেটা দেখে জনৈক ব্লগার জানতে চেয়েছিল, “সোয়াইন ফ্লু বিষয়ে আইসিডিডিআর, বি যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে সেই বিষয়ে কিছু বলুন”। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েছিলাম তাকে কিন্তু মাথার রয়ে যায় বিষয়টি। তাই আর একটু বিষদ ভাবে লিখতে চেষ্টা করছি। বাস্তবে কোন গবেষক বা তার গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে খুব একটা ভূমিকা রাখবার সুযোগ তেমন পান না।

যদি পাওয়া যেত তবে বিজ্ঞানীর নামের আড়ালে যে রাজনীতি অর্থনীতির খেলা চলে তা হয়ত এত বেশি হত না। আমি নিজে জীববিজ্ঞানের ছাত্র বিধায় এই বিষয়ে নিয়েই কথা বলব। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে থাকার সময়ই শেখানো হয়েছিল আমাদের লেখালেখিতে যেন বেশির ভাগ সময় Generally, usually, most probably, possible that, to our knowledge, as far as we are concern ইত্যাদি শব্দ থাকেই। Scientific writing এ absolutely, doubtless জাতীয় শব্দ গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে লিখবার কারন হচ্ছে, কোন গবেষণাই শেষ না।

হয়ত কতগুলো সুনির্দিষ্ট কারনে একটা বিশেষ ব্যবস্থায় এমনটা ঘটছে কিন্তু বাস্তবে সবসময়ই এমনটাই হবে মনে করার কোন কারন নাই। সব কিছুরই ব্যতিক্রম কোথাও না কোথাও থাকতেই পারে। যদি একটা গবেষণাতেই সব প্রমান হয়ে যেত তবে পৃথিবীতে জ্ঞানের অনেক শাখাই থেমে যেত। অথচ জ্ঞানের এক শাখা হতে বিভিন্ন উপশাখা আমরা অহরহই তৈরি হতে দেখি। যখন কোন গবেষক তার গবেষণার রিপোর্ট দেন কর্তৃপক্ষকে বা তা প্রকাশ করেন কোন স্বীকৃত জার্নালে তাকেও এভাবেই লিখতে হয়।

অনেক ক্ষেত্রেই কোন পর্যবেক্ষণকে doubtless উল্লেখ করার পর জার্নালের Reviewer এর প্রশ্নবানে জর্জরিত লেখককে সম্পাদনা করতে হয়। যা তিনি বলেছিলেন, “এটা নিঃসন্দেহে প্রমানিত হইল। ”, তার পরিবর্তে তার লিখতে হয় “আমাদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এটাই মনে হয়ে যে হয়ত এমনটাই হবার বিশাল সম্ভবনা রয়েছে”। এইসব গবেষণার ফলাফল নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন রিপোর্ট তৈরি করেন, সাংবাদিক তৈরি করেন সংবাদ। ঘাপলাটা শুরু হয় এখানেই।

হয়ত গবেষণার রিপোর্টে বা নিবন্ধে লেখা হয়েছে, “আমাদের পর্যবেক্ষণে যতদূর মনে হয়, হয়ত কোন এক সময় মঙ্গল গ্রহে পানি থাকার যথেষ্ট সম্ভবনা রয়েছে। যেহেতু পানির সাথেই জীবনের সৃষ্টি জরিত, তাই হয়ত অদূর ভবিষ্যতে মঙ্গলগ্রহে প্রানের উপস্থিতির প্রমান পাওয়া যেতে পারে”। এসবকেই আমরা খবরের কাগজে ছাপতে দেখি, “মঙ্গল গ্রহে পানি পাওয়া গেছে” অথবা “পৃথিবীর বাইরে প্রাণের উপস্থিতির প্রমান মিলেছে”। প্রতিবছরই এমনসব খবর সংবাদপত্রে পাওয়া যায়। এগুলোই হয়ে যায় বিভিন্ন বক্সঅফিস হিট মুভির উপাত্ত।

সোয়াইন ফ্লুর ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। আমার জানামতে আইসিডিডিআর, বিতে টেস্ট হয় এবং শুধু রিপোর্ট দেওয়া হয় যে এই স্যাম্পল পজিটিভ ঐ স্যাম্পল নেগেটিভ। রিপোর্ট খুবসম্ভবত সরকার পায় এবং তারাই এটা জনগনকে জানাবার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। বাংলাদেশে প্রথম সোয়াইনফ্লু ভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাবার পরে কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রীই জানিয়েছিল সংবাদমাধ্যমে যে বাংলাদেশে এই ভাইরাস পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে গবেষণা প্রতিষ্ঠান শুধু টেস্ট করে দেয়।

সরকার যদি সিদ্ধান্ত নিত যে জনগনের মাঝে ভয়ভীতি ছড়াতে পারে তাই এইখবর প্রকাশ করা যাবে না তাহলে কিন্তু কেউ জানতেও পারত না বাংলাদেশে কখন ভাইরাস আসল, কখন ছড়াল আর কখনইবা চলে গেল। সরকারের নিজস্ব নীতি থেকেই তারা সিদ্ধান্ত নেয়। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রত্যেক দেশের সরকারকেই এসব সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বিজ্ঞানী বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এখানে করার তেমন কিছু নেই। আর একটা বড় সমস্যা হল সাংবাদিকদের।

অন্যদেশের খবর জানি না, কিন্তু আমাদের দেশের সংবাদপত্রগুলোর বিজ্ঞান বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত খবরগুলো যারা লেখেন তাদের অধিকাংশই বিজ্ঞানের ছাত্র না। তাই বিজ্ঞান বিষয়ক খবরগুলো পড়তে হাসি পায়। জনগনকে খবর খাওয়াবার জন্য এমন ভাবে উপস্থাপন করা হয় যে তাতে মূল অর্থই হারিয়ে যায়। হয়ত টেস্ট করে পাওয়া গেছে বাংলাদেশে ৫০০ জন ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত ব্যক্তি। খবর ছাপা হবে “অর্ধসহস্রাধিক ব্যক্তি সোয়াইনফ্লুতে আক্রান্ত”।

ভেতরে লেখা হবে ভয়ভীতি ছড়ানো অনেক কথা। কিন্তু লেখা হবে না কতজনের মাঝে এই ৫০০ জন আক্রান্ত। এককোটিতে মানুষের মাঝে ৫০০ জন আক্রান্ত হওয়া আর এক হাজারে ৫০০ জন আক্রান্ত হওয়া নিশ্চয়ই এক নয়? কেউ মারা গেলে যদি লেখা হয় “ফ্লুতে আক্রান্ত ব্যক্তির নির্মম মৃত্যু”। তাহলে কে না ভয় পাবে। অথচ দেখা যাবে, কয়েক লক্ষ মানুষের মাঝে এই একজনই মারা গেছেন এবং মৃত্যুর হয়ত ফ্লু ছাড়াও অন্য কারন আছে।

বিজ্ঞানের প্রত্যেক শাখাতেই কিছু এমন শব্দ থাকে যা বিশেষ অর্থ বহন করে। এগুলো অন্য বিষয়ের ছাত্রের জন্য বোঝা মুশকিল। একটি রোগের ২০০১ থেকে ২০০৯ Prevalence হল 500 এটার অর্থ ২০০৯ পর্যন্ত মোট ৫০০ জন আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া গেছে। কিন্তু যদি লেখা হয় ২০০৯ সালে ৫০০ ব্যক্তি ঐ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তাহলে কিন্তু এর মর্মার্থ অন্যরকম হয়ে যায়। শুধু সাংবাদিকরাই নয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের আর্থিক সুবিধার জন্য গবেষনার ফলাফলকে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করে।

এনজিওগুলো ফান্ড আনার জন্য ভাল পরিস্থিতিকে খারাপ ভাবে উপস্থাপন করে, সরকার ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য খারাপ পরিস্থিতিকে ভাল করে। এইসব ক্ষেত্রে গবেষনা প্রতিষ্ঠান বা গবেষকের কিছুই করার থাকে না। পলিসিমেকাররাই সব কিছু নিয়ন্ত্রন করে।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.