আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যুদ্ধাপরাধের বিচার হোক যারা সত্যি সত্যি চান তাদের ব্যক্তিগত মত ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে

পরিবর্তনের জন্য লেখালেখি

সারা বাংলাদেশ জুড়ে দেশের নাগরিক এবং বাংলাদেশের বাইরে যারা প্রবাসী বাংলাদেশী আছেন তাদের সকলেই এখন আগ্রহী, কৌতুহলী ও একটু আশংকা আর অনেক আশা নিয়ে বাংলাদেশে কি ঘটছে তাই অনুসরণ করে চলেছেন । যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে আসলে কি হচ্ছে এইটা একটা বিশাল প্রশ্ন । রয়েছে বিভিন্ন পক্ষ ও মত । রয়েছে প্রয়োজন ও গুরুত্ব নিয়ে পরস্পরবিরোধীতা । অনেকেই ষড়যন্ত্রের নীল নক্সা খুঁজে পাচ্ছেন, উভয় পক্ষেই আবার তার সবটাই যে স্রেফ সন্দেহ নয় তার প্রমানও মিলছে প্রতিদিন।

এমন অবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা মানুষকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে ফেলছে তা নিয়ে একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা প্রয়োজন । আমি বিষয় গুলোকে প্রশ্ন আকারে আলোচনায় আনতে চাই। ১। আপনি কি চান ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষের হত্যা , ২ লাখ নারীর ধর্ষণ ও লক্ষ লক্ষ বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেওয়া , সম্পত্তি নষ্টের একটা আইনানুগ বিচার সম্পন্ন হোক? উত্তর যদি না হয় , তাহলে এই পোস্ট আর পড়ার দরকার নেই। কিন্তু উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে আপনাকে খুব গভীর ভাবে চিন্তা করতে হবে , এই বিচার হোক এই মতের পক্ষে আপনার যুক্তি গুলো।

২। বিচার হোক আপনি কার জন্য চান? সমগ্র বাংলাদেশের জন্য নাকি আপনার পরিবারের জন্য ? যদি আপনি আপনার পরিবারের মানুষ খুন হয়েছে কিংবা ৭১এ আপনার বাড়িঘর , সম্পত্তি নষ্ট/লুট হয়েছে বলে বিচার চান তাহলে আপনার ক্ষতির জন্য আমি দুঃখিত , বিষন্ন এবং দোয়া করি এই ক্ষতি যা পূরণ হওয়ার নয় তার একটা শাস্তি কিংবা পরিণতি হোক যা আপনাকে কিছুটা হলেও সান্তনা দিতে পারে। আর যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পাওয়া যায় তাহলে তার কাছে থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় হোক । কিংবা তার ফাঁসি হোক। এমন কিছু হোক যাতে আপনার মনে এই বিশ্বাস জন্মায় যে আপনার পক্ষে ন্যায় পাওয়া গেছে ।

আর যদি ব্যাপারটা এমন নয় যে আপনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে , বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে যে গণহত্যা ও গণধর্ষণ,সম্পদ নাশ, লুটপাট হয়েছে-দেশপ্রেমিক হিসেবে আপনি তার বিচার চান, তাহলে আসুন একটু গভীর করেই ভাবি। এই বিচার আসলে কি। সরাসরি ব্যক্তিগত ক্ষতি না হলেও আপনি কেন ভাবছেন যে আপনার ক্ষতি হয়েছে , অপরাধ হয়েছে, সে অপরাধের বিচারের কেন প্রয়োজন আছে। ৩। যুদ্ধাপরাধের বিচার মানে আসলে কোন অপরাধের বিচার? খুব সোজা সাপ্টা ভাবে চিন্তা করলে ৭১ এর যুদ্ধাপরাধের বিচার বলতে আসলে আমি যেইটা বুঝি তা হলো " যুদ্ধের বিচার নয়" - "যুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া অপরাধের বিচার"।

এখন কথা হইলো যুদ্ধ হইলে দুই পক্ষে মারামারি হবে , প্রাণ যাবে, সম্পদ নষ্ট হবে - তাহলে যুদ্ধ করার জন্য কেন কেউ বিচারের মুখোমুখি হবে? তুমিও মেরেছো , আমিও মেরেছি - তাই না? না , ব্যাপারটা তা নয় । যুদ্ধ হয় দুইটা ভিন্ন রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে । একই দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী আর দেশের নাগরিকের মধ্যে কখনো যুদ্ধ হয় না । আপনাকে বুঝতে হবে , যতক্ষণ পর্যন্ত একটা দেশ কোন ভূখন্ডকে তার নিজের দেশের অংশ মনে করে এবং নাগরিকদের নিজের নাগরিক মনে করে তখন পর্যন্ত দেশের প্রতিটা নাগরিক সংবিধান নামক আইন দ্বারা সুরক্ষিত থাকে । সরকারের দায়িত্ব এই আইন ও অধিকার এর প্রয়োগ করা।

তাই যে কোন নাগরিকের জন্য নিজের দেশের নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা, তাদের ধর্ষণ করা ও সম্পদ লুট করা হলো " অপরাধ" । সরকার নিজেই যদি এই রকম কিছু করে তখন এইটা যুদ্ধ না , স্রেফ গণহত্যা। আর এই অপরাধে যারা অংশ নেবে , সাহায্য করবে তারা সকলেই একই অপরাধের অপরাধী। রাজনৈতিক বিরোধের কারণে ( তৎকালীন পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থার দখল) নিজের দেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ও জামায়াত শিবির,রাজাকার, আল বদর , আল শামস বাহিনী দিয়ে দমন, হত্যা ইত্যাদি তাই অপরাধ। রাষ্ট্র মানেই তাকে আইন ও বিচার বিভাগের মাধ্যমে একটা নিয়মতান্ত্রিক ও গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

১৯৭১ এ তা না করে পাকিস্তান গনহত্যা করে দমনের পথ নিয়েছিলো আর তাতে সাহায্য করেছিলো বাংলাদেশ বিরোধী কিছু পশু যারা কিনা এই দেশেরই রাজনৈতিক ক্ষমতার দাবী করছে এখন। ৪। যুদ্ধ কখন অপরাধ? দুইটা ভিন্ন রাষ্ট্র যখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখনও অপরাধ সংঘটিত হতে পারে যার বিচার করা যায়। যারা যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে না, সেই সিভিলিয়ান নাগরিকের উপর সশস্ত্র বাহিনীর হামলা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যদি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার সময় পাকিস্তানের সিভিলিয়ান হত্যা করে , তাহলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অপরাধী হবে।

একই কারণে আপনারা এখন খবরে দেখেন যে কোন দেশের যুদ্ধ করার বাহিনী, স্থাপনা , অস্ত্র, বিমান কিংবা নৌযান ইত্যাদি ছাড়া সিভিলিয়ান নাগরিকের বাড়িঘর, হাসপাতাল, দোকান পাট ইত্যাদি আক্রমণ করাটা অপরাধ হিসেবে টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে । প্রতিরক্ষামন্ত্রী/ কর্মকর্তা এই ধরনের আক্রমনের জন্য ক্ষমা চাইছেন। তারমানে, নিরস্ত্র ও সিভিলিয়ানদের জান ও মালের উপর হামলা যুদ্ধচলাকালীন সময়েও অপরাধ। ১৯৭১ এ যারা এই কাজ করেছে ও যারা সাহায্য করেছে তারা সকলেই অপরাধী। যারা ইসলাম রক্ষার নামে কাজটা করেছে তারা আরও বড় অপরাধী ।

কারণ ইসলাম নিজের জান ও মাল আক্রান্ত না হলে , অর্থাৎ একমাত্র আত্মরক্ষা ছাড়া অন্য যে কোন কারণে অন্য মুসলিম কিংবা অমুসলিমকে আঘাত করা সম্পূর্ণ হারাম করেছে । সেই কারণে জামাত ও শিবিরের " ইসলাম রক্ষার জন্য হত্যা, ধর্ষণ , লুটপাটে সাহায্য করাটা " সম্পূর্ণ ভাবে কঠিন গুনাহ , এর বিচার হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। ৫। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখন্ডে কারা এই সব অপরাধের স্বীকার হয়েছিলো? একই দেশের নাগরিক হয়ে ( ২৫শে মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তানই ছিলো) নিজের দেশের সেনাবাহিনীর হাতে যারা খুন হয়েছিলো তারা সকলেই ছিলো সাধারন মানুষ যাদের সিভিলিয়ান বলা হয় । দেশের বিরুদ্ধে সংগঠিত কোন সশস্ত্র বাহিনী পর্যন্ত না ।

এখন কথা হলো , স্বীকৃতি দেওয়ার আগ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান বা আজকের পাকিস্তানের কাছে কিন্তু এই দেশটা ছিলো পাকিস্তান। তার মানে এইখানকার সকল নাগরিক হইলো একই দেশের নাগরিক। আর যারা এই একই মতামতে বিশ্বাসী ছিলো এবং আছে , তারাও তাহলে বিশ্বাস করে যে বাঙ্গালী জাতি আসলে পাকিস্তান নামক একটা দেশের নাগরিক। তারা নিজেরাও সেই পাকিস্তানের নাগরিক। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির সংবিধান পাকিস্তানের সরকার কিংবা কোন নাগরিককে অপর একজন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা , হত্যার জন্য আক্রমণ , ধর্ষণ ও তার সম্পদ কেড়ে নেওয়ার অধিকার দেয় না ।

সুতরাং , কেউ যদি মনে প্রাণে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রতে বিশ্বাসী হয়েও থাকে , তাহলেও উল্লেখিত কাজ গুলো " অপরাধ" এবং জড়িত থাকলে সে নিজে "অপরাধী"। ঠিক এই কারণেই ২৫শে মার্চের হত্যা হলো ইতিহাস এর অন্যতম বৃহৎ গণহত্যা। পরবর্তী নয় মাসে পাকিস্তানী সেনা , রাজাকার, আল বদর , আল শামসসহ সকলেই যারা সরাসরি হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে জড়িত তারা সকলেই অপরাধী। ৬। কেন বিচার হওয়া প্রয়োজন? অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলেই বিচার প্রয়োজন ।

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এর সংবিধান, পাকিস্তানের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কনভেনশন, ট্রিটি , চুক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি সবখানেই আমরা নিশ্চিত করেছি যে মানব জাতি হিসেবে, কোন দেশের নাগরিক হিসেবে এবং বিশ্ব নাগরিক হিসেবে আমরা একটি নিয়মতান্ত্রিক, ন্যায্য, আইন কানুন সমৃদ্ধ সুশৃঙ্খল সমাজ, দেশ , রাষ্ট্র চাই । এই চাওয়ার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে যারা এর বিরুদ্ধে গিয়েছে , যারা অন্যের জান ও মালের ক্ষতি করেছে তাদের বিচার ও শাস্তি হওয়া প্রয়োজন । ৭। তাহলে কাদের বিচার করা প্রয়োজন ? যারা এই গণহত্যা, গন ধর্ষণ , লুটপাট এর সাথে সরাসরি জড়িত, যারা সাহায্যকারী , যারা প্রশ্রয়দাতা এবং যারা এই অপরাধের বেনিফিশিয়ারী তাদের সকলেরই বিচার করা প্রয়োজন । এইখানে কোন ধর্ম , বাহিনী, রাজনৈতিক দল ইত্যাদি বিবেচ্য হবে না ।

অপরাধী মানেই অপরাধী । তার বিচার হওয়া চাই। সুতরাং, বাংলাদেশের নাগরিক যারা সিভিলিয়ান তাদের অপরাধের বিচার হতে হবে। বাংলাদেশের নাগরিক যারা আর্মি কিংবা যে কোন মিলিটারী বা প্যারামিলিটারী ফোর্সের সাথে যুক্ত ছিলো তাদের অপরাধের বিচার হতে হবে। ( বাঙ্গালী অফিসার বা নাগরিক কেউ যদি পাকিস্তানী কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে অপরাধ করে সেইটাও কিন্তু অপরাধ।

বিচার প্রক্রিয়াতে কম কিংবা বিচ্ছিন্ন হলেও এই অপরাধের উল্লেখ থাকাটাও উচিত। ) এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রথমত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিচার। কারণ , এই ২০১০ সালে যারা অপরাধ করেছে তারাও বাংলাদেশের নাগরিক , যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ হয়েছে তারাও বাংলাদেশের নাগরিক। সুতরাং, এই পর্যন্ত বিচারে বাংলাদেশের বাইরের কারো হস্তক্ষেপ আসলেই কোন দরকার নাই । এর পরে আসে ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধের মধ্যে যারা এখন পাকিস্তানের নাগরিক তাদের কি হবে? এইটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পারস্পরিক কূটনীতি ও সমঝোতার উপর।

এখন কথা হলো, এই বিচারের সাথে বাংলাদেশের নাগরিকের বিচারের কোন সম্পর্ক আছে কি? নাহ, নাই । জামাত শিবির খুব করে প্রচারের চেষ্টা করছে যে লিস্টে অন্তর্ভূক্ত পাকিস্তানী ১৯৫ জন কর্মকর্তাকে বাংলাদেশে এনে বিচারের ব্যবস্থা করতে । কিন্তু পাকিস্তান তার নাগরিকদের আমাদের হাতে তুলে দেবে কেন? এইটাত বাংলাদেশ - পাকিস্তান যৌথ বিচার প্রক্রিয়া নয়! পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা যারা সিভিলিয়ান হত্যা, ধর্ষণ ও লুটের সাথে জড়িত ছিলো তাদের বিচার পাকিস্তান নিজেই করতে পারে কারণ পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ীও এইগুলা অপরাধই হওয়ার কথা । তাছাড়া সেনা কর্মকর্তার বিচার কোর্ট মার্শাল এর বাইরে অন্য কোন দেশী বা আন্তর্জাতিক আদালতে করতে হলে সেইটা বিশাল আয়োজনের ব্যাপার। ১৯৫ কর্মকর্তার অপরাধের বিচার হোক সেইটা আমরা সকলেই চাই কিন্তু পাকিস্তানের আদালতকে সাক্ষ্য , প্রমাণ দিয়ে সাহায্য করেও আমরা বিচার নিশ্চিত করতে পারি।

এইটা জরুরী নয় যে ১৯৫ জন কর্মকর্তাকে বাংলাদেশে এনে একটা শো ডাউন করতে হবে। আমরা কি বাংগালী অপরাধীদের পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে রাজি আছি? পাকি সেনা অফিসারকে হত্যা করে তার স্ত্রীকে মাসের পর মাস আটকে রেখে ধর্ষণ করাটাও কিন্তু যুদ্ধাপরাধের মধ্যে পড়ে! আমার মনে হয় যে সব বাংলাদেশী পাকিস্তানী নাগরিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ করেছে তাদের বিচারটাও আমরাই করার চেষ্টা করতে পারি। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এইটা খুব বেশি জরুরী । ৮। বিচারের পরিণতি কি হতে পারে? যতটুকু সম্ভব - ক্ষতিপূরণ , শাস্তি ইত্যাদির ব্যবস্থা নেওয়া চাই।

এমন কিছু একটা পরিণতি হতে হবে যাতে জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে আমরা ন্যায় পেয়েছি, একটা কিছু ব্যালেন্স করা সম্ভব হয়েছে। সেই ব্যালেন্স হতে পারে ফাঁসি, কিংবা জেল, কিংবা ক্ষতিপূরণ , কিংবা রাজনীতি নিষিদ্ধ , কিংবা নাগরিকত্ব বাতিল , দেশ থেকে বহিষ্কার ---- অথবা সবগুলাই। এমন ও হতে পারে অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমা চাওয়া । এইটা জাতি হিসেবে আমাদের একমত হতে হবে যে আমরা বিচার প্রক্রিয়াতে কোন অপরাধের জন্য ( গুরুত্ব ও মাত্রা অনুসারে) কি শাস্তি আশা করছি। ৯।

১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধের বিচার আর ১৯৭২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অপরাধের বিচার কি পরস্পরের বিরোধী নাকি পরিপূরক? নাহ, এরা পরস্পরবিরোধী নয় । যদিও জামায়াত শিবির প্রচার করছে যে বর্তমানের সমস্যা বাদ দিয়ে কেন ১৯৭১, আসলে ঘটনা হলো ১৯৭১ হলেই বরং বর্তমানের বিচার করা আগের চেয়ে সহজ হবে। উপরে পড়ে দেখুন, আপনি যখন ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করছেন, নিজের সময় -শক্তি -অর্থ ব্যয় করছেন তখন আপনি আসলে যে সব অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন - ক) আপনি আইন ও সুশৃঙ্খল বিচারের পক্ষে দাঁড়িয়ে, ক্ষমতাসীন সরকারের "যা ইচ্ছা তাই করবো" কিংবা বিচারবিহীন ভাবে হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধের বিরুদ্ধে আপনার রায় ও ভোট দিচ্ছেন। ( বাংলাদেশের সরকার পাকিস্তানী সরকারের মতই দেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে অপরাধ করে এই ২০১০ সালে এসেও। যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে আপনি এই সরকারী অপরাধের পথ বন্ধ করতে ১ম ধাপটা নিতে সাহায্য করতে পারেন।

) খ) বাংলাদেশের একজন নাগরিক , সে যেই দল, মত, ধর্ম কিংবা পরিচয়ের হোক না কেন, আরেকজন নাগরিকের জান, মাল ও অধিকারের উপর হামলা করতে পারবে না , যুদ্ধের পরিস্থিতিতে হলেও - আপনি এই সুস্পষ্ট ঘোষণার পক্ষে আপনার শক্ত মত ব্যক্ত করছেন। (স্বাধীন ও শান্ত বাংলাদেশে এই ঘোষণার প্রয়োজন আজকে সবচেয়ে জরুরী। কারণ সরকারী দলের ক্যাডারদের হাতে সাধারণ মানুষের কিংবা বাংলাদেশের ধনী ও ক্ষমতাশালী পরিবারের পেটোয়া বাহিনীর হাতে , তাদের লবিং এর হাতে সাধারন মানুষ এর জান, মাল ও অধিকার আজকে আক্রান্ত। আপনি এই আক্রমণের বিরুদ্ধে আপনার ভোট দিচ্ছেন) গ) সরকার এ অবস্থান করলেই দেশের ভিতরের সমস্যা সৃষ্টিকারী কিংবা আন্দোলনকারী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইন- বিচার- জবাবদিহিতাবিহীন দমননীতি চালানো যাবে না । এই রকম কিছু করলে ৩৮ বছর পরে হলেও শাস্তি পেতে হবে - এই ঘোষণাকে প্রতিষ্ঠিত করছেন ( পাহাড়ে হত্যা কিংবা সেনাবাহিনী ও বি ডি আর এ হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করতে যুদ্ধাপরাধের বিচার সাহায্য করবে) ঘ) সরকারী আইন শৃঙ্খলা বা সেনাবাহিনীকে সরকারের বেতনভুক্ত খুনী বা লাঠিয়াল বাহিনী বানানোর পথ বন্ধ করতে সাহায্য করছেন ।

( র‌্যাব কিংবা পুলিশের হাতে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক বিনা বিচারে খুন হচ্ছে , এই রাষ্ট্রীয় খুন বন্ধ করা দরকার। আইন ও বিচারের হাত শক্ত করা দরকার । নইলে খুন করাটাই স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতি হয়ে যাবে) ঙ) আপনার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও খুনের বদলে খুন, ধর্ষণের বদলে ধর্ষণ, লুটের বদলে লুট - এই পাশবিক আচরণের পরিবর্তে আপনি একটি নিয়মনীতিতে আবদ্ধ মানবিক বিচার ও শাস্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে শক্তিশালী করছেন । ( একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রই পারে তার নিজের নাগরিকদের উপার্জন ও মৌল চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দিতে। রাষ্ট্রের শক্তি তার সামরিক ক্ষমতা থেকে আসে না ।

আসে রাষ্ট্রের শাসন কাঠামো বা এডমিনিস্ট্রেশন এবং রাষ্ট্রের সমস্যা নিরসণের ক্ষমতা তথা বিচার ও আইন বিভাগের শক্তিশালী করার মাধ্যমে) চ) বাংলাদেশের নাগরিক তথা আপনার আমার নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করছেন। একটা স্বাধীন ও স্বার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিটা নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করছেন। ( বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র বাঁচলে আমরা বাঁচবো। আমাদের আত্মরক্ষার খাতিরেই একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র আমাদের প্রয়োজন। পাহাড়ের সমস্যা আমাদের বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে কারো নাগরিক অধিকার যখন সংরক্ষিত হয় না তখন রাষ্ট্র টুকরো টুকরো হয়ে যায় , যেতে বাধ্য।

১৯৭১ এ যেমন আমরা নিজেদের অধিকারের দাবীতে আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কনফ্লিক্টকে শান্তিপূর্ণ বিচারের আওতায় আনা তাই ভীষণ প্রয়োজন) ছ) উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্ম কিংবা অন্য কোন পরিচয়কে পুঁজি করে দেশের সাধারণ নাগরিকের উপর হত্যা, ধর্ষণ ও লুন্ঠনের নৃশংসতার বিরুদ্ধে আপনার অবস্থানকে দৃঢ় করছেন । ( পাহাড় সমস্যা, রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবসা , মাইনরিটি গোষ্ঠীর সম্পদ লুন্ঠন বন্ধের জন্য আজকের বাংলাদেশ এর প্রয়োজন) জ) দেশের ভিতরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধের নামে হত্যা, ধর্ষণ , লুন্ঠনের বিরুদ্ধে আপনার সুস্পষ্ট ঘোষণা জানান দিচ্ছেন । ( বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এই অপরাধ গুলো বন্ধ হোক , এই কি আপনি চান না?) ঝ) গায়ের জোরে কারো সম্পদ লুন্ঠন বা হত্যার ভয় দেখিয়ে কিংবা আটকে রেখে বেশ্যাবৃত্তির বিরুদ্ধে আপনার অবস্থানকে দৃঢ় করছেন। ( আজকের বাংলাদেশে সরকারী দলের ক্যাডার যখন আপনার কাছে চাঁদা চায় কিংবা জোর করে আপনার জমি দখল করে কিংবা লীগের মেয়েদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করায় - এই সবই কিন্তু সেই ১৯৭১ থেকে চলে আসা সরকারী দলের যথেচ্ছাচারের অভ্যাসের ফল।

আজকে যদি আমরা যুদ্ধাপরাধের ইস্যুতে দল ও মত নির্বিশেষে পাকিস্তানী সরকারী অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে পারি, যুথবদ্ধ হতে পারি তাহলে কালকে আমরা বর্তমানের সরকারী অপরাধীদের জবাব্দিহিতার মুখোমুখি করতে পারবো। ঞ) আপনারা খুব ভালো করেই জানেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলই চায় না । তারপরেও এই পর্যন্ত আসা সম্ভব হয়েছে স্রেফ জনমত এর চাপের ফলে । বাংলাদেশের জনগণ , অন্তত সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ, এই একটা ব্যাপারে একমত হতে পেরেছে , পারছে বলেই আজকে আওয়ামী লীগ বাধ্য হচ্ছে এই ব্যাপারে কিছু করতে , সামান্য হলেও। এইটা রাজনৈতিক ভাবে পঁচে যাওয়া নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে জনগণের এক রকম বিজয়।

সুতরাং, আপনি আমি যদি আজকে লীগকে বাধ্য করতে পারি যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে , তাহলে এর পরে আরো অনেক ইস্যু আছে যা দেশের জনগণের স্বার্থের পক্ষে আনতে আমরা এই যুথবদ্ধতাকে কাজে লাগাতে পারি। এইখানে কে কোন রাজনৈতিক দল করে, এইটা গৌণ। দল নয়, আজকে আমাদের ইস্যু ভিত্তিক ঐক্য খুব বেশি প্রয়োজন। ক্ষমতায় গেলে সব দলই সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করে , নিজেদের আখের গুছায়। সুতরাং, এখন দরকার বাংলাদেশের সরকারী সিদ্ধান্ত গুলো নেওয়ার ক্ষমতা ও পলিসি সংসদ সদস্যদের হাত থেকে , আমলাদের হাত থেকে জনগণের হাতে নেওয়া ।

যুদ্ধাপরাধের বিচার তার ১ম ধাপ মাত্র। উপরের ১০টি যুক্তি বিবেচনা করে আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিন, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াতে নিজেকে যুক্ত রেখে সক্রিয় অংশগ্রহন করে , ব্যক্তিগত দল-মত-ধর্ম- পরিচয়ের উর্ধ্বে থেকে আপনি বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী, শান্তিপূর্ণ , জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত করবেন? নাকি, যুদ্ধাপরাধীদের বিনা বিচারের ঘুরে বেড়াতে দিয়ে বাংলাদেশকে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে সাহায্য করবেন?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.