আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আন্তর্জাতিক মিডিয়ার একপেশী বিশ্লেষণ



আন্তর্জাতিক মিডিয়ার একপেশী বিশ্লেষণ অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের চিত্র সাংবাদিক নিক উট যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন তার ১০০ গজের মধ্যেই ঘটে গিয়েছিল বিশ শতকের নারকীয়তম ঘটনাগুলোর একটা। অ্যাং ব্যাং থেকে ততদিনে ফ্রন্টলাইন কিছুটা সরে গেলেও জনবহুল, অসামরিক এই এলাকায় নিক্ষিপ্ত হয়েছিল বিধ্বংসী নাপাম। বিধ্বংসী আগুনের লেলিহান শিখা, কালো ধোঁয়া, আর চারপাশে শুধু কান্না আর বুকফাটা আর্তনাদ। আর্তনাদ আর হাহাকার মিশে গিয়েছিল ভিয়েতনামের আকাশে-বাতাসে। বিপর্যস্ত স্বজনহারানো মানুষের ছবি, চোখের সামনে দাউ দাউ আগুনে জ্বলছে যাবতীয় আশ্রয়, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া কোনো মূল্যবান জিনিস খুঁজে চলেছেন কেউ কেউ।

শিশুকে কোলে নিয়ে আগুনের হাত থেকে বাঁচাতে উদভ্রান্তের মতো ছুটে চলেছেন মা। ঘটনার আকস্মিকতায় মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন উট। বিবশ হয়েছিল স্নায়ু। নিজেকে সামলে নিতে যতটা দেরি তারপর ক্রমাগত ক্যামেরার শার্টার আর ওয়াইন্ডার এর ওপর তাঁর আঙুল চলেছে পেশাদার টাইপিস্ট-এর মতো অক্লান্ত দ্রুতগতিতে। সেদিন অ্যাং ব্যাং-এ উট না থাকলে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতম অভিজ্ঞতার অনেকটাই থেকে যেত সেলুলয়েড-এর বাইরে।

এভাবেই ভিয়েতনাম যুদ্ধে সব থেকে পরিচিতি পেয়েছিল কিম ফুওক নামে এক হতভাগ্য মেয়ের ছবি। জ্বলন্ত পোশাক পরে রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে মেয়েটা। তার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে ভয় আর আতঙ্ক। তখনও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়নি আজকের মতো। জার্নালিজম-এর মতো পরিভাষা তখনও এত জনপ্রিয়তা পায়নি।

আর এখন খবর-ছবি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাঠানো কত সহজ। ল্যাপটপ-ডিজিটাল প্রযুক্তি--ইন্টারনেট—উন্নত সফ্টওয়্যার একুশ শতক বাস্তবিকই তথ্য বিপ্লবের, তথ্য বিস্ফোরণের শতক। দেশে দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ, সংঘাত, সংঘর্ষ, সন্ত্রাসবাদী হানার খবর মুহূর্তে স্যাটেলাইট-কেবল টেলিভিশনের দৌলতে আপনার-আমার বসার ঘরের টেলিভিশনের পর্দায়। যুদ্ধের খবর পাওয়া এখন কত না সহজ। তবুও এত কিছুর পরও কিছু ‘কিন্তু’ থেকে যায়।

এর কারণ অন্য। একুশ শতকে তথ্য বিপ্লবের যুগে ইরাক আগ্রাসনের মতো এত বড় এক যুদ্ধের একপক্ষের কোনো খবরই সরাসরি পাওয়ার উপায় ছিল না। আকাশ থেকে বোমা ফেলার খবরই একমাত্র খবর। সেই বোমা কোথায় ফাটছে তার সন্ধান ছিটেফোঁটা। সে খবরেও জোগানদার বি বি সি বা সি এন এন।

আটলান্টায় সি এন এন-এর সদর দপ্তরে হাজারখানেক যুদ্ধবিরোধী দাবি তুলেছিলেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের ব্যাপক প্রচার হোক। লস এঞ্জেলসে বিক্ষোভকারীদের ধিক্কারের লক্ষ্য ছিল সি এন এন এবং এন বি সি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম প্রেসিডেন্ট বুশের যুদ্ধ নীতির পক্ষ নিয়ে খবর ‘বিকৃত’ করছে বলে অভিযোগ তোলেন হলিউডে একদল বিক্ষোভকারী। ইরাকী টিভি চ্যানেল যুদ্ধবন্দীদের ছবি দেখিয়ে জেনিভা চুক্তি ভেঙেছে বলে অভিযোগ করে আমেরিকা। অথচ মার্কিন সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে দেখানো হয়েছিল ইরাকী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবি।

ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ আর্থার পসঁনবি বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ যখন ঘোষণা হয় প্রথম নিহত হয় সত্যই’। কসোভো আগ্রাসনের সময় শরণার্থী শিবিরে বোমাবর্ষণের ঘটনা প্রথমে ন্যাটো বেমালুম অস্বীকার করে। পরে সাংবাদিকরা ক্ষতবিক্ষত উদ্বাস্তু শিবিরের ছবি তুলে ধরলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। বাগদাদের কেন্দ্রে টিভি সেন্টারের বিশাল বাড়িতে বোমা ফেলেছিল জোটের বিমানবাহিনী। লক্ষ্য ছিল, ইরাকের টিভি সেন্টার ধ্বংস করা।

উদ্দেশ্য ছিল, টিভিতে সাদ্দামের ছবি ও ভাষণ সম্প্রচার বন্ধ করা। হালফিলের হাইটেক যুদ্ধে শুধু সমরাভিযান নয়, কূটনীতি নয়, গণমাধ্যমকে কৌশলে ব্যবহার করাও এক বড় অস্ত্র। মার্কিন রাষ্ট্রপতি, সেনানায়ক ও প্রশাসনের নজর ছিল সেদিকেই। ২০০১-এর ২৪শে সেপ্টেম্বর। স্টকহোমের এ বি এফ হাউসে এক ভাষণে প্রাক্তন সি আই এ কর্তা ফিলিপ আগি সি আই এ সাংবাদিকদের কীভাবে ব্যবহার করে সে প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।

সাংবাদিক ও সম্পাদকের নিজস্ব তথ্য ও ধারণা জুগিয়ে তাঁদের এমনভাবে খবর তৈরি করতে বাধ্য করা হয় যা পড়ে মনে হবে খবর একান্তই সাংবাদিকের লেখা। এভাবেই সি আই এ-র আত্মপ্রচার ‘নিরপেক্ষ’ খবর হিসেবে বৈধতা পায়। আগি বলেছিলেন, “Journalistic are also very important to the CIA for non-journalistic activities. They serve as very convenient agents of access for the agency. …The fact is that journalists are used for non-journalistic purposes—as collection agents for intelligence, and for making contacts, because a journalist can approach practically any one and ask for an interview or develop some type of relationship.” যে গণমাধ্যম ও তার কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, তাদের ওপর হানা দিতে হয়েছিল। সে আলজাজিরা বা ইরাকী টেলিভিশন, যাইহোক। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ও সাংবাদিকদের অধিকার খর্ব করা হয়েছিল।

খবর জোগাড়ের তিন কেন্দ্র ছিল। এক, মার্কিন জোটের ফ্রন্টলাইন হিসেবে হোয়াইট হাউস সূত্র। বাছাই করা সাংবাদিকরা সেন্সর করা যুদ্ধের খবর লিখতেন। আর তামাম দুনিয়ার বাকি সাংবাদিকরা সেই প্রতিবেদনের ‘পুল খবর’ থেকে লিখতেন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, যুদ্ধের অকৃত্রিম ছবি। সেন্সর সত্ত্বেও যুদ্ধের হাত বদল খবর।

পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক ম্যালকম ব্রাউনির মন্তব্য ছিল, ‘‘সাংবাদিককূল সেদিন বেতন ছাড়াই মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের হয়ে কাজ করে গেছেন। ’’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খবর মিলেছিল রেডিওয়। ভিয়েতনামের যুদ্ধ ছিল বিশ্বের প্রথম টেলিভিশনাইজড যুদ্ধ। উপসাগরীয় যুদ্ধ ছিল প্রথম উপগ্রহের অ্যান্টেনা ছোঁয়া সংবাদযুদ্ধ। অনলাইন যুদ্ধ আফগান অভিযান থেকেই।

ইরাকের ওপর হামলাও তাই। কিন্তু অধিকাংশই একপেশে। ভিয়েতনামের যুদ্ধের খবর কিছুটা সত্যের কাছাকাছি ছিল। আর তাতেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সন ও তাঁর পারিষদদের অভিযোগ ছিল, ‘যুদ্ধের কভারেজই জনমতকে বিরুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে। ’ আফগান যুদ্ধে মার্কিন অপারেশনের যাবতীয় ছবি কিনে নিয়েছিল পেন্টাগণ।

অসামরিক উপগ্রহ ‘ইকোনোজ’-এর বিক্রি বণ্টন ও সরবরাহের যাবতীয় স্বত্ত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ২০০২ সালের ১৭ই অক্টোবর গার্ডিয়ান পত্রিকায় সামরিক গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ ডানকান ক্যামবেল লিখেছিলেন, ‘নিজেদের প্রয়োজনে মার্কিন সেনাবাহিনীর ছবির দরকার নেই। ’ আফগান যুদ্ধে যা হয়েছে ইরাকের যুদ্ধেও কতকটা তারই প্রতিফলন। মিডিয়ার স্বাধীনতা অটুটু থাকছে কি? বেপরোয়া সেন্সরের কাঁচি চালানো হচ্ছে ইন্টানেটেও। প্রসঙ্গত, ২০০১-এর ১০ই সেপ্টেম্বরের পর থেকেই ইন্টারনেটের ওয়েবপেজে মার্কিন রণতরীর অবস্থান রিপোর্ট দেওয়া বন্ধ করেছিল পেন্টাগন।

আমেরিকার ইরাক আগ্রাসনের খবরও সি এন এন, বি বি সি সরবরাহ করেছিল অনেক সাফুতরো করে। ১৯৬৮-তে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় নাছোড় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দিশেহারা তৎকালীন মার্কিন বিদেশসচিব ডিন রাস্ক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, ‘আপনারা কোন পক্ষে? স্মরণে থাকতে পারে আফগান আগ্রাসনের কয়েকদিন আগে রাষ্ট্রপতি বুশের হুঁশিয়ারি ‘মার্কিনসঙ্গী না হলেই সন্ত্রাসবাদী’। ইরাক আগ্রাসনের সময়ও একই সুর ছিল রাষ্ট্রপতি বুশের গলায়। আফগান আগ্রাসনের সময় সি এন এন, এন বি সি, এ বি সি, সি বি এস, ফক্স টিভিকে সেন্সর করেছিল মার্কিন সরকার। কাতারের আলজাজিরা টিভির ফুটেজ এবং ব্যবহার করেনি।

ইন্টার আমেরিকান প্রেস অ্যাসোসিয়েশন-এর প্রেসিডেন্ট ড্যানিলো আর্বিল্লা-এর তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘‘বিপন্ন মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা, তৈরি হয়েছে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কট। ’’ আলজাজিরা, ইরাকী টিভির ফুটেজ যেটুকু সি এন এন, বি বি সি ব্যবহার করেছিল তাতেই বেদম চটেছিল হোয়াইট হাউস। ইরাক ও আফগানিস্তান আগ্রাসনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক স্তর থেকে পড়েছিল আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও সাংবাদিকদের ওপর। ৯/১১-এর মার্কিন জোড়া মিনারে সন্ত্রাসবাদী হানার পর বদলে গিয়েছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের খবর পরিবেশনের মান্যরীতি। বিশ্বব্যাপী বড় শক্তির মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের জায়গা আরও শক্ত হয়েছে।

সত্যিই কি সাংবাদিকদের যুদ্ধ, সন্ত্রাস বিষয়ে খবর সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের স্বাধীনতা থাকছে?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.