আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কলম্বো -কে যেমন দেখেছি

বাংলায় কথা বলি,বাংলায় লিখন লিখি, বাংলায় চিন্তা করি, বাংলায় স্বপ্ন দেখি। আমার অস্তিত্ব জুড়ে বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ।

২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারির কোন এক নিষুতি রাতে এসে নেমেছিলাম রাবণের দেশে: শ্রীলংকার রাজাধানী কলম্বোতে। Bandaranayake International Airport -এ। মুল কলম্বো শহর থেকে এটি ৩৫ কি.মি. দূরে।

টার্মিনাল বিল্ডিং থেকে বের হয়েই বুঝা গেল বাইরের গরমের সে কি দাপট। পরে শুনলাম এখানে সারা বছরই গরম। কোন শীতকাল এখানে নেই। দুইটই ঋতু- গ্রীষ্ম আর বর্ষা। বাইরে এসেই ঢাকার সাথে পার্থক্যটা প্রথম উপলব্ধি করলাম।

গাড়ীওয়ালাদের কোন টানাটানি নেই। কাউন্টার থেকে যে কোন ধরনের গাড়ী পাওয়া যায়। ভাড়াও নির্ধারিত। গাড়ীগুলো ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেনা। আমি দেখেছি, রাত ৩ টায় লাল বাতি জ্বললেও গাড়ি থেমে যায়।

যদিও তখন ইচ্ছে করলেই গাড়ী টান মেরে যে কোন দিকে চলে যাওয়া যায়। তা না করে চালকেরা সবুজ বাতির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আইনকে এরা অনেক মানে। এখানকার মানুষের সাথে বাংলাদেশের মানুষের অনেক মিল রয়েছে। কি গায়ের রং কি উচ্চতায় সব কিছুই বাংলাদেশের মতো।

কেবল মিল নেই ভাষায়। তবে দুরত্বে ব্যবধান না থাকলে ভাষার অমিল খুব থাকত বলে মনে হয় না। কারণ সিনহালা ভাষার অনেক শব্দের সাথে বাংলা শব্দের বেশ মিল দেখা যায়। যেমন-গাছ,হাত,কান ইত্যাদি অনেক শব্দই বাংলার কাছাকাছি। প্রথমে সংক্ষেপে দেশটির পরিচয় দিতে চাই।

দক্ষিণ এশিয়ার বৃত্তম দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলংকা। আয়তন ২৫,৩৩২ বর্গমাইল বা ৬৫,৬১০ কিমি । আয়তনের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের ১২১ তম দেশ। আযতনে ছোট হলও দেশটিতে ৯ টি প্রদেশ রযেছে। প্রদেশগুলোর আবার রয়েছে আলাদা সরকার।

জেলা মাত্র ২৫ টি। ১৯৪৮ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে সিলন(Ceylon) নাম নিয়ে। ১৯৭২ সালে এর নতুন নামকরণ করা হয় শ্রীলংকা (Democratic Socialist Republic of Sri Lanka )। বর্তমান লোক সংখ্যা ২০.২ সরষষরড়হ (টঘ, ২০০৯). প্রধান ভাষা সিনহালা, তামিল ও ইংরেজি। প্রধান ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হচ্ছে’ বৌদ্ধ ৬৯.১%, হিন্দু, ৭.১%মুসলিম ৭.৬%ও খৃস্টান ৬.২% অন্যান্য ১০% ।

শিক্ষার হার ৯০.৭%। পাহাড়-পর্বতের দেশ শ্রীলংকার দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বতের নাম এডাম পিক। এটি মুসলিম,বৌদ্ধ,খ্রীস্টান আর হিন্দু চার ধর্মের লোকদের কাছেই অতি পবিত্র স্থান। কারণ বৌদ্ধদের মতে- প্রভু বৌদ্ধ এখানে তার তৃতীয় এবং শেষ লংকা সফরের সময় এখানে প্রথম পা রেখেছিলেন। হিন্দুদের মতে, শিব এখানে প্রথম পা রাখেন।

খ্রীস্টানদের মতে , ষোড়শ শতকে পর্তুগীজ ধর্মপ্রচারক সেন্ট থমাস যিনি শ্রীলংকাতে খ্রীস্ট ধর্ম প্রথম প্রচার করেন তার পদচিহ্ন এটা। আর আরবদের মতে, স্বর্গ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে প্রথম মানব হজরত আদম ( আ এখানে সর্বপ্রথম পা রাখেন। মতামত যাই হোক না কেন এডাম পিক চার ধর্মের অনুসারীদের কাছে অতি পবিত্র স্থান। দেশটির উন্নয়নের অনেক সম্ভাবনা থাকলেও ৩০ বছরের গৃহ যুদ্ধের কারণে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। তবে আশার কথা গত বছর সমাপ্তি ঘটেছে রক্তাক্ত সেই গৃহযুদ্ধের।

ফলে এই দেশটি এখন তরতরিয়ে উঠে যাবে উন্নতির দিকে। কেননা, এদের জন সংখ্যা একটি সহনীয় মাত্রায় রয়েছে। সাধারণ মানুষের মাঝে যথেষ্ট সততা রয়েছে। সততার বড় অভাব আমাদের দেশে। এখানে অত অভাব নয।

কলম্বোতে আছি অনেক দিন হল। অনেক ভাল এখানকার আইন-শৃঙ্খলা অবস্থা। মেয়েরা অবাধে পথে চলতে পারছে। কোন ছেলে তাদেরকে টিজ করছেনা। এখানকার মেয়েরা অনেক ফাস্ট।

জিন্স-টি শার্ট আর সংক্ষিপ্ত ড্রেস পড়ে এরা অবাধে চলাচল করতে পারছে। ঘরে-বাইরে কাজ করছে সর্বত্র। বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে টেলিকম ও ব্যাংকিং সেক্টরে নারী কর্মীর সংখ্যা পুরুষ কর্মীর চেয়ে অনেক বেশীই বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। সবধরনের বাসে নারী-পুরুষ এক সাথে দাড়িয়ে- সে যাচ্ছে।

কোন হাঙ্গামা নাই। ভাড়া নিয়ে নেই কোন ক্যাচাল। যা ঢাকার বাসগুলোতে নিত্যদিনের ঘটনা। বাসগুলোতে অবশ্য কয়েকটি সিট সংরক্ষিত থাকে। ২টি ধর্মীয় গুরু, ২টি গর্ভবতী আর ২টি অক্ষমদের জন্য।

এধরনের যাত্রী এলে সবাই সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে যাবে। এটা আমাদের দেশে কি আমি আশা করতে পারব? কলম্বোতে শপিং মলের সংখ্যা অনেক। বেশ কটি বিখ্যাত শপিং মলের নাম: হাউজ অব ফ্যাশনস, নোলিমিট, কেন্দ্রা, ফ্যাশন বাগ, আরপিকো সুপার সেন্টার, কিল্স সুপার,কারগিলস ফুট সিটি ইত্যাদি। অনেক পণ্যের দামই এই সব মলে যা বাইরের সাধারণ দোকানেও তা। বাংলাদেশে এটা আশাই করা যায় না।

কলম্বো শহরের লোক সংখ্যা ১০ লাখ । এর মাঝে ৪ লাখ আবার ভাসমান। এর দিনে শহরে আসে আবার সন্ধ্যায় চলে যায়। ফলে শহরের পরিবেশ রাতের হয়ে যায় নীরব। এখানে দুটি নির্বাচন দেখেছি।

আধুনিক নির্বাচন। একটি প্রাদেশিক নির্বাচন আর আরেকটি ২০১০ সালের আলোচিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বাংলাদেশের মতো অমন নির্বাচন এখানে হয়না। প্রচারণা চলে নীরবে। মিছিল নই।

ভাংচুর নেই। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া নেই। যে যার পছন্দ মতো ভোট দিয়ে আসে। এখানে মানুষ অনেক সচেতন। ভোটের ফলাফলের পর অহেতুক বিজয় মিছিলও হয়না ।

৩০ বছরের গৃহ যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। আর পেছনে থাকা নয়। উন্নয়নের বাধভাঙ্গা জোয়ার আসছে সামনে। অদুল ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উন্নত দেশে পরিণত হবে লংকা। আর বাংলাদেশে কবে হবে এমন।

তবে জিনিসপত্রের দাম বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশী। দাম দেখলে মনেই হয় না যে এটা দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ। আমি ২০০৭ সালে এসে জিনিসপত্রের যে দেখেছিলাম তা এখন ৩ গুণ হয়ে গেছে। তবে এনিয়ে এখানে কোন মাতামাতি নেই। এখানে আজ পর্যন্ত এই নিযে একটা মিছিল পর্যন্ত হয়নি।

তার মানে এই নয় যে এখানে অনেক প্রাচুর্য। এখানে কেউ বসে থাকে না। সবাই কাজ করে । ফলে যে কোন পরিবার চলে অনায়াসে। যদি কোন পরিবারে একটি মুদির দোকা ন থাকে তাহলে ঐ পরিবারের সবাই দোকানে কাজ করে।

যাদের তা নেই তারা কোন একটা দোকানে বা প্রতিষ্ঠানে কাজ খুজে নেয়। কোন কাজইকেই এরা ছোট করে দেখে না। আমাদের দেশে তো সবাই কাজ করতে চায়না। গায়ে ফু দিয়ে বেড়াতে বড় ভালবাসে তারা। একটি কথা না বললেই নয়।

এখানে যতগুলো টিভি আছে তার সবগুলোই ডিশ ছাড়া দেখা যায়। অর্থাৎ সব গুলো টিভিই টেরেসট্রিয়াল সম্প্রচারের ব্যবস্থা আছে। তিনটা চ্যানেল আছে যেগুলো সব সময়ই ইংরে জি অনষ্ঠান প্রচার করছে। হিন্দি গান, হিন্দি ছবি টিভিগুলো হরহামেশাই প্রচার করছে। সিনেমা হলেগুলোতে প্রায়ই চলে হিন্দি সিনেমা।

ইংরেজি ও স্থানীয় ভাষার ছবিও চলে অনেক। আশ্চর্য জনক ব্যাপার হল সিনেমা হলগুলোতে পরিবেশ খুবই ভাল। সপরিবারে ছবি দেখার মতো পরিবেশ থাকায় এখনো মানুষ আগ্রহভরে সিনেমা হলে ছবি দেখতে যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনো সেই একমাত্র বিটিভি ছাড়া আর কোন টিভি দেখার কোন উপায় নাই। টিভিগুলো যখন ইংরেজি বা হিন্দি ছবি প্রচার করে তখন সাবটাইটেল বা সংলাপগুলো স্থানীয় ভাষায় পর্দাও নীচে দেখানো হয়।

ফলে দর্শকরা সহজেই ছবি বুঝতে পারে। বাংলাদেশে এক সময় বিদেশী ছবিতে বাংলা সংলাপ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। সরাসরি সংলাপ না ঢুকিয়ে পর্দায় সংলাপগুলো বাংলায় দেখালে সেটা অনেক ভাল হত। টিভিতে কোন ধুমপান কিংবা মদ্যপানের দৃশ্য এলে তা সাথে ঢেকে দেয়া হয়। যদিও এদেশে মদ্যপান খুব প্রচলিত।

এরা অন্য খাবার না খেয়ে থাকতে পারে কিন্তু মদ না খেযে থাকতে পারবে না। তাই দেশের অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছে মদের দোকান। সব ধরনের ক্রেতারা ভিড় করে কিনছে মদ। পুরো দেশটাই ঘুরে দেখার মতো। সাধারণ নিরাপত্তা থাকায় অবাধে আসছে পর্যটকরা।

একেবারে অজপাড়া গাঁয়েও ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটা করা যায়। অধিকাংশ মানুষ মোটামুটি ইংরেজি বলতে পারে বলে পর্যটকরা সহজেই ঘুরে বেড়াতে পারে, কেনা-কাটা করতে পারে। আজ দেখতে দেখতে তিন বছর চলে গেল। এই তিন বছর সময়কে আমার কাছে মনে হয়েছে ৩ হাজার বছর। সময় আর কাটে না।

কবে যে দেশে যেতে পারব। তবে দেশ তো আর ভাল নেই। কেবল সমস্যা আর সমস্যা। এখানে কোন আমাদের কোন কমিউনিটি না থাকাতে অনেক অসুবিধার মাঝে আছি। আমারে একমাত্র কন্যা নিহিম তাজরিয়ান ।

তাকে রাখা অনেক কঠিন হওয়াতে আমার স্ত্রী জিনাত সুলতানা ভেলা এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। ফলে আমি অনেক একা হয়ে গেছি। সময় আর কাটছেনা। দিন গুনছি কবে দেশে ফিরে যেতে পারব। হনুজ বঙ্গ দুর অস্ত: বঙ্গ অনেক দুর!


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।