আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শহীদ মিনার

গোধুলি ভালবাসায় ভিজে একসারা একাকী একজন।

মা শহীদ মিনার দেখতে কেমন? এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত প্রশ্ন করল দীপ্ত। শম্পার হাত ধরে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা গাছের নিচে। একটু আগে প্রভাত ফেরী শেষ হয়েছে। পুরো শহীদ মিনার চত্তর লোকে লোকারণ্য।

সবাই হাসছে, গল্প করছে, ছবি তুলছে। চারিপাশে উৎসব মুখোরিত পরিবেশ। শম্পা আগ্রহ নিয়ে দেখছিল সবকিছু। প্রভাতফেরীতে সবার সাথে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো...” গাইতে গাইতে খালি পায়ে শহীদ মিনারের দিকে যাওয়া,ফুল গুলো রেখে কিছুহ্মন দাঁড়িয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সব কিছু স্বপ্নের মত। কত বছর পর শম্পা দেশে ফিরেছে! সেই বিয়ের পর থেকে দেশ ছাড়া।

দেড় যুগ পর আসা শহীদ মিনারে তাও ছেলের জন্য। দীপ্ত ভীষণ খুশি আজ। খুব আনন্দ নিয়ে গাইছিল গান মিছিলের সাথে হাঁটতে হাঁটতে। গত এক সপ্তাহে এই গানটা ও অসংখ্যবার শুনেছে তবুও এই মিছিলে যেনো খুব অন্যরকম লাগলো কথাগুলো। ছোট্ট দীপ্ত ছটফট করে উঠলো আবার।

শম্পা ছেলের দিকে তাকালো। শহীদ মিনার কেমন দেখতে এই প্রশ্নের উত্তর কী দেবে শম্পা? দীপ্তের পৃথিবী যে নিরেট আঁধারে ঢাকা। সেই পৃথিবীতে কোন আলো নেই, রঙ নেই, কিছুই নেই। শুধু আছে শব্দ। শম্পা একটু অসহায় বোধ করতে লাগলো।

ও কিছুতেই দীপ্তকে এটা বুঝতে দিতে চায় না যে ও জন্মান্ধ। দীপ্তের যেন কখনও এমন মনে না হয় সে জন্য শম্পা দীপ্তকে অন্য বাচ্চাদের কাছাকাছি রাখেনি। ওকে স্পেশাল চাইল্ড কেয়ার স্কুলে দিয়েছে। কি প্রচন্ড সংগ্রাম করে বাচ্চাটাকে বড় করেছে তা ভাবলে এখনও ওর বুক কাঁপে। দীপ্তের জন্মের পরপরই ডাক্তার জানিয়েছিল ওদের যে দীপ্ত জন্মান্ধ।

প্রবল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল সেদিন শম্পা। আর শিহাব, দীপ্তের বাবা ভ্রু কুঁচকে দেখছিল ওর কান্না। এক সকালে ঘুম ভেঙ্গে শম্পা আবিস্কার করে শিহাব চলে গেছে। ব্রিসবেনের তখন কিছুই চেনে না শম্পা। কি দুর্বিষহ ছিল সেই দিনগুলো! প্রতিদিন ভোর হতো জীবিকার অনুসন্ধান নিয়ে।

ছুটতে ছুটতে কাজে যাওয়া। সারাদিনের প্রচন্ড খাটুনীর পর ক্লান্ত দেহে বাড়ী ফেরা। আসলেই কি বাড়ী ফেরা নাকি ছোট্ট এক কামরার এপ্যার্টমেন্টে ফেরা? হ্যাঁ সেখানেই ফেরা। তবু এত কষ্টের মাঝেও ও বেঁচে ছিল। দীপ্ত ওকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।

এই ব্যাস্ততার মাঝে দীপ্তকে দেবার মত সময় থাকতো না। ঘরকন্নার ফাঁকে যতটুকু সময় পেত দীপ্তকে গল্প শোনাত ও। বাংলাদেশের গল্প, শম্পার স্কুলবেলার দুরন্ত দিনগুলোর গল্প। এমন করে ভালই দিন কাটছিল মা ছেলের। শম্পা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর ভাবছে কি করা যায়।

ছেলেটা অস্থির ভাবে মায়ের হাতে ঝাঁকুনি দিলো আবারও। এমন সময় ছেলেটার দিকে চোখ পড়ল শম্পার। পাঞ্জাবী পড়া ছিপছিপে ছেলেটা অদুরে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিল এতহ্মণ। শম্পা তাকাতেই এগিয়ে এলো। “আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?” শম্পা বলল “ না-আ ঠিক খুঁজছিনা” একটু ইতস্তত করে বলল “একটা সমস্যায় পড়েছি আসলে-”।

ছেলেটি মুগ্ধ হয়ে দীপ্তকে দেখছিল। কী অপুর্ব একটা মুখ, কী অদ্ভুদ মায়া ভরা নিস্পাপ দুটি চোখ! শম্পার কথা শুনে ওর দিকে চাইলো। “আমার ছেলেটা শহীদ মিনার দেখতে চাইছে”। ছেলেটা বলতেই যাচ্ছিল যে ঐতো সামনে শহীদ মিনার...কিন্তু শম্পা ইশারায় থামিয়ে দিল ছেলেটিকে। ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল দীপ্ত দেখতে পায় না।

ছেলেটি আহত চোখে তাকালো দীপ্তের মুখের দিকে। এত অপুর্ব একটা শিশু অথচ দৃষ্টিহীন? ছেলেটি তাড়াতাড়ি বলে ওঠে “ আপনারা একটু দাঁড়ান আমি এখুনি আসছি-”। ছেলেটি এক দৌঁড়ে ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেলো। শম্পা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এক মাস আগের একটি সন্ধ্যা।

দীপ্ত নিঃশব্দে এসে ওর মার কাছে দাঁড়ায়। একটুহ্মণ চুপ থেকে পরিষ্কার বাংলায় বলে “মা আমি বাংলাদেশে যেতে চাই” শম্পা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকালো। ‘কেন?’ দীপ্ত বলল “শহীদ মিনারে যেতে চাই মা”। কদিন আগে স্কুলে দীপ্ত একটা লেখা পড়ে শুনিয়েছিল ওর ক্লাসে। ক্লাস টীচার মাতৃভূমি নিয়ে লিখতে দিয়েছিল বাচ্চাদের।

শম্পার কাছে শোনা ভাষার গল্পটা ব্রেইলে লিখে নিয়ে গিয়েছিল দীপ্ত। বাংলা ভাষার জন্য এ দেশের তরূণদের অবদান আর আত্নত্যাগের কথা শুনে ওর টীচার চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। সেই দীপ্তকে উদ্বুদ্ধ করেছে বাংলাদেশে আসার জন্য। সেই থেকে যুদ্ধ চলছে দীপ্তের ওর মায়ের সাথে। খুব কষ্ট করে একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছিল একটা বাড়ী কিনবে বলে ছেলেটাকে একটা ভাল পরিবেশ দেবে বলে, কিন্তু ছেলের জেদের কাছে হার মানতে হয়েছিল শম্পার।

শুধু এই দিনটির জন্যই ব্রিসবেন থেকে বাংলাদেশে আসা। পাঞ্জাবী পড়া ছেলেটা ফিরে আসছে সাথে আরও দুজন। হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল “চলুন-”। দীপ্ত শহীদ মিনারের স্তম্ভ গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। ওর ছোট্ট বুকটা ভরে গেছে আনন্দে, খুশিতে ঝলমল করছে দীপ্ত।

শম্পা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.