আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তারুণ্য ও আমরা

এক. এই লেখা শুরু করার ঠিক আগে আমি হংকংয়ে আমার ছেলে নিলয় মান্নার সঙ্গে ফেসবুকে কথা বললাম। ক্যাথে প্যাসেফিকে ও কানাডা যাচ্ছে লেখাপড়া করতে। হংকংয়ে ১৪ ঘণ্টার যাত্রাবিরতি। এয়ারলাইন্স কোনো হোটেল দেয়নি। ওর বয়স ২০ বছর।

জীবনে প্রথম এতদূর যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ৩৬ ঘণ্টার জার্নি। একা।

আমি আমার সন্তানের এই বিদেশ যাওয়ার পক্ষে ছিলাম না। দেশে তো ১৬ কোটি মানুষ বাস করে।

তাদের অর্ধেকের মতো যুবক। আমার ছেলের যুক্তি, এই কোটি কোটি যুবককে বল তোমাদের সবার জন্য আমেরিকা/কানাডার ভিসা দেওয়া হবে। তোমরা কি যাবে? একজনও পাবে না_ যে না বলবে। দেশের নেতারা সবাই নতুন প্রজন্মের কথা বলছে; কিন্তু এই প্রজন্মের জন্য তারা করছে কি? খানিকক্ষণ থেমে আবার বলেছে, আব্বু আমি বিশ্বাস করি, তুমি দেশের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছ। কিন্তু কিছু করতে পেরেছ কি? আমি তর্ক করিনি।

আমি জানি কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমার ছেলের সঙ্গে পড়ত এরকম অন্তত ২৫ জন ইতোমধ্যেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে।

নিলয় নিজে বাইরে যোগাযোগ করেছে। ভর্তির ব্যবস্থা করেছে এবং গত পরশু রাতে কানাডার উদ্দেশে দেশ ছেড়েছে। আমি কেবল তার জন্য অনেকগুলো টাকা ধার করেছি।

যেন সে যেতে পারে। একটু আগেই বললাম হংকংয়ে ওর জন্য কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ১৪ ঘণ্টা কেবল অপেক্ষা। আমি খবর পাচ্ছিলাম না, সে এখন কোথায় আছে, কীভাবে আছে। কিন্তু আমার মেয়েটি ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে ওর ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ফেলল।

প্রায় ১০০ কানাডিয়ান ডলার খরচ করে সে একটি লাউঞ্জ ভাড়া করেছে এবং সেখানে সাইবার ক্যাফের মাধ্যমে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

পাঠকবৃন্দ, আমি কি খুব বেশি পরিমাণে ব্যক্তিগত বিষয় এনে ফেলেছি? মাহমুদুর রহমান মান্নার ছেলেটি কি বিশেষ কেউ? সেও তো এ দেশের কয়েক কোটি তরুণ যুবকের একজন। সে তো আর তারেক রহমান কিংবা সজীব ওয়াজেদ জয় নয়। তার পিতা দুই তিনবারের কেন একবারের জন্যও দেশের প্রধানমন্ত্রী হননি। আর প্রধানমন্ত্রী বলছি কেন, জনাব মাহমুদুর রহমান মান্না তো একবারের জন্যও মন্ত্রী এমনকি এমপিও হতে পারেননি।

দুই কলাম লিখতে পারেন বলেই কি নিজের কথা, নিজের পরিবারের কথা মানুষকে সুযোগমতো শুনিয়ে দিতে হবে। এর আগে এই কলামে আমি ঐশীর কথা লিখেছিলাম। আমি ঐশীর কেউ নই। তারপরও ব্যক্তি ঐশীকে বোঝা দরকার মনে হয়েছিল আমার। একটা উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজে যুবসমাজ সব সময় একটি গবেষণার বিষয়।

যুবসমাজ যদি দিকভ্রান্ত হয় তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ ভ্রান্তিতে পড়বে।

ঐশী কী কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা? ইয়াবা তথা মাদক কি কেবল কালিক বা দেশীয়? পুরো যুবসমাজকে কি তা ধ্বংস করে দিচ্ছে না? এ জন্যই ঐশী কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়। মাদক আমাদের সমাজেরই একটি প্রপঞ্চনা। যা যুবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কত দুর্ভাগ্যজনক যে, আমরা ঐশীদের সুস্থ করে তুলছি না।

বরঞ্চ অসুস্থ ঐশীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছি। সত্য উদ্ঘাটন করছি অথবা সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা করছি।

আমার সন্তানের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটিও আমার একটি পরাজয় বলে মনে হয়। আমি তাকে রাখতে পারলাম না। আমরা আমাদের তারুণ্য ও মেধাকে ধরে রাখতে পারছি না।

দেশের কাজে লাগাতে পারছি না। আমি বলছি, আমি খুব চিন্তিত ছিলাম আমার ছেলের এই দীর্ঘ যাত্রায়। ও পারবে এ পথ পাড়ি দিতে? পেঁৗছতে পারবে তার গন্তব্যে? আমি আমার কথা বলতে পারি। আমার তারুণ্যে আমি একা এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সাহস পেতাম না। 'হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনো খানে' এ কথা বলার সাহস পেতাম না আমি।

আমি হয়তো একটু ভীরু প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু এখনকার তারুণ্য ভয় পায় না। তারা কেবল নিজের দেশ নয়, 'দেখব এবার জগৎটাকে, জয় করব গোটা বিশ্বকে', এ কথা বলার সাহস রাখে। তারা হয়তো কখনো দিকভ্রান্ত, হয়তো কখনো পথ হারিয়ে ফেলে, কিন্তু কখনো পথ ছেড়ে দেয় না। কাল সারা রাত ছেলেটি ফোন করেনি সকালে উঠেই বাংলাদেশ বিমানের হংকং ম্যানেজারকে ফোন করি।

তাকে আগেই খবর দিয়েছিলাম। তিনি রাতে ব্যস্ত ছিলেন কোনো খবর দিতে পারলেন না। বললেন, এত বড় এয়ারপোর্টে তাকে খুঁজে বের করা তো কঠিন। কিন্তু আমার মেয়ে যখন ঘুম থেকে উঠল, তখন পাঁচ মিনিটে ফেসবুকে তার ভাইকে খুঁজে বের করল। কথা বলল।

আমি পারিনি কিন্তু এই ছোট মেয়েটি ঢাকা-হংকং-কানাডার মধ্যে কি দ্রুত যোগাযোগ করে ফেলল। বাংলাদেশ দ্রুতই ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা প্রধানমন্ত্রী, তার ছেলে, বিরোধীদলীয় নেতা কিংবা তার ছেলে করছে না। করছে আমাদের মতো মধ্যবিত্তের সন্তান-সন্ততিরা। নেতারা কি করছেন?

দুই. একটা অনিশ্চিতের পথে চলছে বাংলাদেশ।

একটা বিরাট দৈত্য, তার মুখ ব্যাদান করে আছে। যে কোনো সময় গিলে খাবে দেশটিকে। সময়টা যে কখন তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু সেটা যে সনি্নকটে তা বোঝা যাচ্ছে। সবাই খুব উদ্বেগের মধ্যে আছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন যারা সাধারণত অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলে না, তারাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, তার উদ্বেগের কথা। সবাই বলছেন, দুই নেত্রীর বসা উচিত, সংলাপ করা উচিত, একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান নির্মাণ করা উচিত। দুই নেত্রী কি করছেন? ২৩ আগস্ট শুক্রবার বেলা ১১টায় জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেছিলেন। তার সঙ্গে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'বিরোধী দলের যে কোনো প্রস্তাবকে আমরা স্বাগত জানাব, যদি তা জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশনে দেওয়া হয়।

' প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, তিনি নিজে এবং তার সরকার সব সময়ই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী। তার সরকার শান্তি চায়, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর দেখতে চায়। আগামী সাধারণ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী যথাযথ সময়ে অনুষ্ঠিত হবে এবং জনগণ কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে বলে শেখ হাসিনা আস্থা প্রকাশ করেন। তিনি জানিয়েছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেই অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।

নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপের পর সন্ধ্যায় বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গেও কথা বলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায় জাতিসংঘ। এ জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জাতিসংঘ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। জবাবে খালেদা জিয়া বলেছেন, সংকট সমাধানে সংলাপ কিংবা আলোচনার বিকল্প নেই। বিএনপি যে কোনো ধরনের সংলাপ ও আলোচনায় প্রস্তুত রয়েছে।

পাঠকবৃন্দ খেয়াল করেছেন দুই নেত্রী সংলাপের কথা বলেছেন, উভয়ই বলেছেন তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী।

আপনাদের বিশ্বাস হয় এ কথা? এর আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বর্তমান সংবিধানের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। এ কথা তিনি বান কি মুনকেও বলেছেন। সাংবাদিকদের বলেছেন, সংবিধান থেকে তিনি এক চুলও নড়বেন না। তাহলে আলাপ-আলোচনার বিষয় কি থাকে? আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, তার প্রথম কথা সত্য নয়। সত্য তার পরেরটা।

যেখান থেকে তিনি একচুলও নড়বেন না।

বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এখন সংলাপের কথা বলছেন, সেটাই স্বাভাবিক। কারণ এখন শেখ হাসিনা সংলাপ করতে রাজি হলে তার কথার স্বীকৃতি পায়। কিন্তু যখন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি এ সত্যটি বোঝেননি। এখন তিনি ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছেন।

যে ঝড়ে শেখ হাসিনার মাথার সব চুল উড়ে যাবে।

কোথাও কি মিলবেন এই দুজন? একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে কি আসতে পারবেন? এই কোটি টাকার প্রশ্নের জবাব কে দেবেন? শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়া। তারা তো তাদের জেদের রশি বেঁধেই রেখেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিবের কথাও শুনছেন না। বেচারা বান কি মুন! কিন্তু এই জেদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমগ্র দেশ।

ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হচ্ছেন। দেশে কোনো বিনিয়োগ নেই। ছাত্ররা সব দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। ঐশীরা নিজেকে মেরে_ বাপ-মাকে মেরে ফেলে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলছেন, এভাবে চললে দেশে অসাংবিধানিক সরকার আসবে, যারা ১০ বছরেও ক্ষমতা ছাড়বে না।

আমরা অকর্মরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথামতো বসে বসে আঙ্গুল চুষছি।

সব দোষ কি সরকারের? অথবা বিরোধী দলের? না, আমি তা বলছি না। অনেক বিষয় আছে, যা পরম্পরায় তৈরি হয়েছে। কিন্তু এগুলো বদলানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের পরিচালকদের।

তারা তা করছেন না। বরং এমন সব কুৎসিত কাজ করছেন, যাতে আমাদের সমাজের চেহারাই বদলে যাচ্ছে। হয়ে যাচ্ছে আরও কুৎসিত।

লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।

ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com

 

 



সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।