আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একুশ নিয়ে দলীয়করণ হবে না, এটাই আমার প্রত্যাশা: শফিক রেহমান

ছাত্র

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে অপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ভাষার দাবিতে আন্দোলন-রতদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে বায়ান্ন সালে। তিপ্পান্ন সালে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। চুয়ান্ন সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন সামনে রেখে আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। তার একটি বড় কারণ ছিল, কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদিত 'একুশের সংকলন'।

আন্দোলন বেগবান করতে বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। চুয়ান্ন সালে বইটি নিষিদ্ধ করে দেয় সরকার। ভাষার জন্য সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী স্বেচ্ছায় জেল বরণ করেন চুয়ান্ন সালে। ওই বছরই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ...' গানটির বেশি প্রভাব পড়েছিল। সেই বছরই ছাত্ররা বুকের মধ্যে কালো ব্যাজ পরেছিল।

তাতে লেখা ছিল 'পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ' ভাষা আন্দোলনের সময় কিছু গান আমাদের খুব উজ্জীবিত করত। তার মধ্যে আছে কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'কারার ঐ লৌহ কপাট...', 'দুর্গম গিরি...', সলিল চৌধুরীর 'নওজোয়ান নওজোয়ান ...', আবদুল লতিফের গাওয়া 'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায় ...'। 'একুশে ফেব্রুয়ারি' গানটি বায়ান্নের ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে লিখেছিলেন গাফ্ফার। গানটি তিনি আমার রুমে বসেই লিখেছিলেন।

ভাষা আন্দোলনে আমার অনেক বন্ধু গ্রেফতার হন। তাদের মধ্যে তালেয়া রেহমানও ছিলেন। তালেয়া ও কবি শামসুর রাহমান তখন এসএম হলের ছাত্র পরিষদের সদস্য ছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে গাজীউল হকের প্রাণবন্ত স্লোগানে আন্দোলনে উজ্জীবিত হয়েছিলাম। মনে পড়ে, বায়ান্ন সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির দু কি তিনদিনের পরের ঘটনা।

বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের উল্টোদিকে পুরনো হাইকোর্ট বিল্ডিংয়ের ফুটপাত দিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম। আমাদের পেছনে পুলিশ। পুলিশের হাতে ছিল দুই ফুট লম্বা পালিশ করা লাঠি। টিয়ার গ্যাস শেলও ছুড়ছিল পুলিশ। জায়গায় জায়গায় টিয়ার শেল পড়ে ধোঁয়া উঠছিল।

তাতে আমাদের চোখ জ্বালা করছিল। দোয়েল চত্বরের দিকে দৌড়াচ্ছিলাম আমরা। আমার সঙ্গে বন্ধু আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন। হঠাত্ পেছনে ফিরে দেখি, পুলিশের ছুড়ে মারা লাঠি পায়ে লাগায় পড়ে গেছেন গাফ্ফার। তখনও দশাশয়ী শরীর ছিল তার।

সেজন্যই বোধহয় দুর্গতিটা হয়েছিল। আমি পেছনের দিকে গেলাম। আমার কাঁধে ভর দিয়ে গাফ্ফার রিকশায় উঠলেন। দু'জন রিকশা নিয়ে গেলাম পুরনো ঢাকার বেগম বাজারের ৩৬ নম্বর বেচারাম দেউড়িতে। সেখানে আমার একটা সিঙ্গেল রুম ছিল।

আমার বাবা সাইদুর রহমান তখন ঢাকা কলেজের প্রফেসর। তার আনুকূল্যে ঢাকা কলেজের কপিং মেশিনটি আমার রুমে নিয়ে আসি, সেটার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন খবর প্রচার করার জন্য। গাফ্ফার আমার সঙ্গে আহত অবস্থায় চার মাস পর্যন্ত ছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই তখন তার পদসেবা আমাকে করতে হয়। যেমন, তার পায়ে ওষুধ, মলম লাগানো।

আমার মাও গাফ্ফারের সার্বিক পরিচর্যা করেছিলেন। আমাদের ওই বাড়িতে থাকা অবস্থাতেই গাফ্ফার 'একুশে ফেব্রুয়ারি...' গানটি লিখেন। এক পর্যায়ে সরকার ঢাকা কলেজসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেয়। অনেক ছাত্রকে তাই চলে যেতে হয় গ্রামের বাড়িতে বা ঢাকার বাইরে। কপিং মেশিনটা দিয়ে আন্দোলনের খবর এবং গাফ্ফারের এ গানের কপি গ্রামমুখী ছাত্রদের মাধ্যমে সারাদেশে প্রচারের সুযোগ পেয়েছিলাম।

গ্রামমুখী ছাত্রদের মাধ্যমে গানটি সারাদেশে পৌঁছে যায়। আরেকটা বিষয়, চুয়ান্ন সালে 'একুশের সংকলন' নিষিদ্ধ হওয়ার পর হাসান হাফিজুর রহমান আশ্রয় নিয়েছিলেন উমেশ দত্ত রোড, বকশিবাজারে, আমাদের বাড়িতে। ওই বাড়ির পাশেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। আমার রুম থেকে দেখা যেত জেলবন্দিদের কাজ করার দৃশ্য। ওই দৃশ্য দেখিয়ে হাসান হাফিজুর রহমানকে রসিকতা করে বলতাম, 'আপনার ভাগ্য ভালো, আপনি ওই দেয়ালের বাইরে এদিকে আছেন, ওদিকে নেই।

' ভাষা আন্দোলনের আটান্ন বছরে অনেক অর্জন আছে। বাংলা হয়েছে রাষ্ট্রভাষা। বাংলা চর্চা বেড়েছে। পাশাপাশি ইংরেজির চর্চা বজায় রাখা দরকার ছিল। ইংরেজির সঙ্গে তো বাংলার বিরোধ নেই।

নিজের ভাষা জানতে হলে অন্য ভাষাও জানার দরকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু ইংরেজি জানতেন। আমাদের ভাষা আন্দোলনের উত্স 'একুশে ফেব্রুয়ারি' গানটি। এর মধ্যে তিনটি অক্ষর বাংলা (একুশে), চারটি অক্ষর ইংরেজি (ফেব্রুয়ারি)। শুধু তাই নয়, বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকারের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী।

এর মধ্যে তিনটি অক্ষর বাংলা (বাংলা)। চরটি অক্ষর ইংরেজি (একাডেমী)। সুতরাং বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ করতে হলে ইংরেজি জানতে হবে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, পশ্চিম বাংলায় সাহিত্য চর্চার প্রথমদিকের অনেক লেখক ইংরেজির ছাত্র ছিলেন। বাংলাদেশেও সেসময় সাহিত্যিকরা ইংরেজির ছাত্র ছিলেন।

কবি শামসুর রাহমান ইংরেজির ছাত্র। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ইংরেজির ছাত্র, পরে তিনি এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন। এরকম অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের আরও গবেষণা করতে হবে। পদক দিলে আর বইমেলার আয়োজন করলেই ভাষার চর্চা, গবেষণা হয় না।

তবে পদকের স্বীকৃতি এবং বইমেলার বিস্তৃতিরও দরকার আছে। ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ, শেখ মুজিবুর রহমান-জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড, সাতাত্তরের ব্যর্থ ক্যু, এরশাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ওয়ান ইলেভেন, বিডিআর বিদ্রোহের ফলে মানুষের জীবন, রাষ্ট্র ও সমাজে যে উলটপালট ঘটেছে, সেগুলো নিয়ে বাংলা ভাষায় কালজয়ী উপন্যাস, গল্প, কবিতা লেখা হচ্ছে না। বিডিআর বিদ্রোহের সময় এক বিডিআর সদস্য তার মাকে ফোন করে বলেছিল, মা, আমি মানুষকে রক্ষা করতে এসেছি। হত্যা করতে আসিনি। অথচ আমাকে হত্যা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

হত্যা না করলে আমাকে হত্যা করবে। এই যে ছেলেটির জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্ব, এগুলো সাহিত্যে উঠে আসছে না। জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্ব নিয়ে পৃথিবীর বড় উপন্যাস যেমন 'ওয়ার এন্ড পিস', 'টেল অব টু সিটিস', 'ফ্রম হিয়ার টু ইটার্নিনিটি' লেখা হয়েছে। মহাভারত, রামায়ণ, বিষাদসিন্ধুও তাই। এসব বিষয় নিয়ে কালজয়ী সাহিত্য লেখা হবে, একুশ নিয়ে দলীয়করণ হবে না, এবারের একুশের কাছে এটাই আমার প্রত্যাশা।

Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।