আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্থপতি রফিক আজমের সাক্ষাৎকার



ঐতিহ্যবাহী পুরনো ঢাকার লালবাগ এলাকায় ১৯৬৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেছেন স্থপতি রফিক আজম। বাংলাদেশের সমকালীন স্থাপত্যচর্চা ঐতিহ্য আশ্রয়ী এবং একই সঙ্গে আধুনিক অনুষঙ্গী। দেশের স্থাপত্যশিল্পীদের মধ্যে রফিক আজম আলঅদাভাবে চিহ্নিত। তিনি তাঁর নির্মাণে ও সৃষ্টিতে এতিহ্য, জলবায়ু, আলো, পরিসর, নিসর্গকে প্রাধান্য দিয়ে নাগরিক বসবাসক্ষেত্রকে করে তুলেছেন আনন্দকর ও সুখকর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে, এবং চেন্নাই অথবা অস্ট্রেলিয়ার কোনো শহরেও তাঁর স্থাপত্যদর্শন আর শৈলীর স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করেছে।

রফিক আজম এরই মধ্যে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন, যেমন বিশ্বব্যাপী তরুণ স্থপতিদের জন্য শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে বড় পুরস্কার এ. আর. অ্যাওয়ার্ড ফর ইমার্জিং আর্কিটেক্টস ২০০৭; ২০০৭ সালের যুক্তরাষ্ট্রের কেনেথ এফ ব্রাউন এসিয়া-প্যাসিফিক কালচার অ্যান্ড আর্কিটেকচার ডিজাইন পুরস্কার; ১৯৯৯, ২০০৩ ও ২০০৫ সালের সাউথ এশিয়া আর্কিটেকচার কমেন্ডেশন পুরস্কার এবং সাউথ এশিয়ান আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ডে অন্তর্গত ‘ইয়াং আর্কিটেক্ট অ্যাওয়ার্ড ১৯৯৯’। ২০০৪ ও ২০০৭ সালে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের হ্রস্ব তালিকাতেও ছিলেন রফিক আজম। বাংলাদেশের ভেতরেও বেশকটি নামী পুরস্কার তাঁর হাতে এসেছে। এছাড়া, স্থাপত্য বিষয়ে অনেক আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিনি মূল বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছেন। সাতত্য নামে তাঁর নিজের একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যার মন্ত্র হচ্ছে ‘সবুজ সচেতন স্থাপত্য’।

এই সাক্ষাৎকারটি শিল্পরূপ পত্রিকার জন্য নেয়া হয়েছিল। সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় সাঈদ জুবেরী'র সাথে বিমূর্ত ভাবে উপস্থিত ছিলেন রিজভী রিয়াজ। সাঈদ জুবেরী : আর্কিটেক্চার শুনলে প্রথমেই মনে আসে ইট, কাঠ ইত্যাদি নিয়ে কংক্রিট একটা বিষয় কিন্তু আপনার কাজে ন্যাচারালি সবুজ মিশে যায়, এই জায়গা থেকে আপনার কাজের উদ্দেশ্যটা কী? র: আ : কাজের উদ্দেশ্য যদি বলি, পৃথিবীতো সুন্দর সৃষ্টি, ইট সেলফ। এখানে দেখার মতো অনেক কিছু আছে; পাহাড়-পর্বত, পানি, গাছগাছালি, পাখি, বড় পশু থেকে ছোট পিঁপড়া অসংখ্য জিনিস। তো দেখা যায় যে এই অসংখ্য জিনিসের মধ্যে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে বিষয়গুলোর সমন্বয় করতে পারে।

দুনিয়াটা চলছে কিভাবে, কিভাবে কি ঘটছে এগুলো সে চিন্তা করে সমন্বয় করে। তো মানুষ যখন চিন্তা করে তখন কিছু অসুবিধাও মাঝে মধ্যে দেখা যায়; যদি ঝড় আসে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, অনেক বৃষ্টি হলে সমস্যা তৈরি হয়। তো সবকিছু সে শরীরের উপর দিয়ে নিতে পারে না। এরকম কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার মিনিমাম নিরাপত্তার দরকার হয়। টু স্টার্ট লিভিং, থিকিং এন্ড এনজয়ইং দ্য হোল ওয়ার্ল্ড।

সেটা করতে গিয়ে তাকে কিছু একটা করতে হয় এক সময়; যে আমার মতো করে একটু সাজিয়ে নেই যাতে করে আমি নিজের মতো করেই সব আয়ত্তে পাই। এখন এগুলো আর্কিটেক্চারের উপলব্ধির বিষয়। প্রাকৃতিক উপাদান, সৌন্দর্য; আলো, বাতাস, পানি সব কিছু মিলিয়ে আর্কিটেক্ট। এখন আর্কিটেকচার করতে গিয়ে যদি এই সৌন্দর্যবোধ থেকেই দূরে সরে যাই তাহলে তো মূল উদ্দেশ্যটাই ব্যাহত হবে। আমি সেই জায়গা থেকে যদি চিন্তা করি তাহলে কেন এমন কিছু করব যেটা আর্কিটেক্চারের উদ্দেশ্যকেই, প্রক্রিয়াকেই ধ্বংস করে।

প্রাণীকে মেরে ফেলে, আলোর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, বাতাসকে বাধা দিয়ে যদি আর্কিটেকচার করে তাহলে তো সে আর্কিটেক্টই না। আমার উদ্দেশ্য আর্কিটেক্চার করার এবং যত সৌন্দর্য আছে সেটাকে উপলব্ধি করে তার প্রয়োগ করা। সা:জু : আপনি আর্কিটেক্চারে যে সৌন্দর্য ধারণ করাতে চান আপনার ক্লায়েন্টের চাহিদার সাথে তার সমাধান কিভাবে করেন। আর্কিটেক্চার বলতে এখন তো আমরা অনেক ফ্ল্যাট সম্বলিত সুউচ্চ ভবন বানানো বুঝি। সেখানে আলো, বাতাসের অবাধ চলাচলের চাইতে খুপড়ি বানানোর প্রতি আগ্রহটা বেশি।

আপনার কি অভিমত? র: আ : এটা তো শিক্ষার বিষয়। দোষ কাকে দেব। জাতিগতভাবে মানে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার অভাব। শিক্ষা বলতে স্কুলের পুঁথিগত শিক্ষা না শুধু। আপনার বোধশক্তি যদি ডেভেলপ না করে তাহলে ঐ খুপরি নিয়েই আপনার মনে হতে পারে বিশাল একটা কিছু।

আমি একটা এ্যাপার্টমেন্টের মালিক, এই পর্যন্তই। কিন্তু সে যে কিছুই পেল না এই বোধটাতো তৈরি হতে হবে। ক্লায়েন্টের সাথে বাহাস হয় তবে মানুষের যে সাইকোলজিক্যাল বিষয়টা; আর্কিটেক্চার কিন্তু খুব কনফিডেন্ট প্রফেশান অনেকটা মুভি মেকিং এর মতো, অসংখ্য জিনিস নিয়ে এটা করতে হয়, এর মধ্যে এমন কিছুই নাই যা বাদ দেয়া যায়। মানে মিউজিক থেকে শুরু করে লাইট, রঙ, বাতাস, সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব কিছুই বাদ যায় না। এজন্যই যে ক্ষণে ক্ষণে নানান জিনিস এসে হাজির হয়।

মানুষের যে মৌলিক প্রবৃত্তি এদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এটা কঠিন কিছু না। একটা মানুষ মনেপ্রাণে প্রকৃতির অংশ। সেটা এমন না যে পছন্দমাফিক সে বেছে নিয়েছে যে, না আমি এরকমই থাকতে চাই; না হলে সে ছুটি পেলেই গ্রামে ছুটে যায় কেন। অর্থাৎ তার মৌলিক প্রবৃত্তি হচ্ছে সে প্রকৃতির সঙ্গেই থাকতে চায়।

কিন্তু অনেক নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির ভেতর সে চিন্তা করে যে আচ্ছা শহরে বোধহয় এভাবেই থাকতে হয়। তারপর কিছু ইগো সমস্যাও হয়। ইগোও কিন্তু মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তি। ইগো থেকে সে কিন্তু মনে করে যে আমি একটা গাড়ি কিনব, বাড়ি কিনব, গোল্লায় যাক সব এটা দিয়ে আমি আমার ক্ষমতা দেখাব। ক্ষমতা একটা বড় ইগো মানুষের।

এসবের মধ্যে নেচারের সাথে থাকাও তার প্রবৃত্তি। তাকে যদি বলা হয় যে আপনার ৩০০০ স্কয়ার ফিট এ্যাপার্টমেন্টে ৩টা রুম ছাড়াও আমি আপনাকে ওখানে বাগান দেব, পানি দেব, গাছ দেব তাহলে আপনার কি ধারণা যে কেউ না বলবে! আসলে হয়েছে কি মানুষ মনে করে কি থাকার জায়গা বা খুপরি ছাড়া আর বেশি কিছু পাওয়া যাবে না। এটা আসলে একটা ধারণা। যা অনেকদিন ধরে গড়ে উঠেছে সমান্তরালভাবে। মানে দেখতে দেখতে সে ধরেই নিয়েছে যে এরচেয়ে বেশি কিছু পাওয়া সম্ভব নয়।

এটাই আর কি। ঘরটা একটু ছোট বড় হবে, বারান্দাটা থাকবে ইত্যাদি। কিন্তু কেউ যদি তাকে বোঝাতে পারে যে আপনি যা চাচ্ছেন সবইতো পাচ্ছেন তার সাথে এগুলোও পাবেন। কেউতো তাকে বলেনি যে এর চাইতে বেশি আমি আপনাকে দিতে পারি, কেউ বলেনি। সে ক্ষেত্রে হয়তো কেউ যদি বলে যে ভাই আপনার এই এই ডিমান্ডের সাথে এই এই জিনিসগুলোও দেয়া যায় বা আপনি পেতে পারেন আপনি কি নেবেন? সে তো নিশ্চয়ই নেবে তখন, কারণ তারও তো বাচ্চা আছে ফ্যামিলি আছে সে ভাববে কেন নয়; আমি একটা বাগান পেলাম, গাছ দেখতে পারলাম জানালা দিয়ে অথবা পানির ফোয়ারা তখন ওগুলো রাখতে চায়।

সত্যিকার অর্থে ঐভাবে তার সাথে যে আমার অনেক যুদ্ধ করতে হয় বা হয়েছে সেরকম না ব্যাপারটা। তার বোধটাকে একটু জাগিয়ে দেয়া এই। তারপর যখন তার সে জায়গাটা তৈরি হয়ে যায় তখন দেখা গেল নিজেই আগ বাড়িয়ে বলছে যে ঠিক আছে আমাকে একটা জিনিস কম দেন তবু একটা বাগান করে দেন। একটা স্বপ্ন শুরু হয়ে যায়। এখনতো অনেক লোক আসে আমার কাছে, যারা ঐরকম কিছু চায় বলেই আসে।

এটা তৈরি হতে অবশ্য সময় লেগেছে, প্রায় ২০ বছর। সা:জু : আপনার একটা সাক্ষাৎকারে পেলাম আপনি বেসিক্যালি আর্টিস্ট বাইচান্স আর্কিটেক্ট। আপনি আপনার কাজে শিল্পকে কিভাবে উদ্যাপন করেন? র: আ : আমার কাছে ইদানীং অনেক লোক আসে জানতে যে গ্রীন আর্কিটেকচার কি, ইকোলজিক্যাল আর্কিটেকচার বা কার্বন ফুটিং এসব গভীর তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় যেতে চায়। প্রায়শই আমাকে বলতে হয় যে আমি আসলে ঐ আর্কিটেক্ট না। যারা নাকি অঙ্ক করেন; কার্বন পরিমাপ বা জিরো ফুটিং বা ইকোলজিকে ব্যালান্স করা ইত্যাদির জন্য গভীর অঙ্ক করে, এভাবে আমি শুরু করি না।

আমি ছবি আঁকতাম, যে কোনো কারণেই হোক আর্ট কলেজে ঢোকা হয়নি। আসলে নন্দন ব্যাপারটা, ছবির ব্যাপারটা আমার মধ্যে কাজ করে। তো এই জায়গাতেও আমি সেই বোধ নিয়েই কাজ শুরু করি। তারপর যদি প্রয়োজন হয় অঙ্ক করি। সা:জু : কিন্তু দেখা যায় যে, একটা ছেলে বা মেয়ে কবিতা লিখত, ছবি আঁকত বা অন্য যে কোন শিল্প মাধ্যমে সক্রিয় থাকার পর যখন তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়তে যায় তখন তার ভিতরের সৃষ্টিশীল মনটা ক্রমশ অবদমিত হয়ে যায, তখন তারা বলে যে আর্কিটেকচার বা তাদের পাঠ পদ্ধতি এসব সাপোর্ট করে না।

আপনি কিভাবে দেখছেন বিষয়টা? র: আ : এটা তো পরিষ্কার যে প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একাডেমিগুলো বা ইনস্টিটিউটগুলো আমাদের মেধা বিকাশে কিভাবে বাধা হিসেবে কাজ করে। আপনার সম্ভাবনা মানে যেটা দিয়ে আপনি শুরু করেছিলেন সেখানটাকে নিঃশেষ করে দিয়ে একেবারে ছোবড়া বের করে আনে। তারপর আপনি আর কোন কাজে আসেন না সত্যিকার অর্থে। কেবলমাত্র চাকর বাকর হবার উপযুক্ত থাকেন তখন। পশ্চিমা সমাজ আমাদেরকে যেভাবে ট্রেনিং দিয়েছে তাদের চাকর তৈরির জন্য এখনও সেই পদ্ধতির ভেতর দিয়ে আমরা চাকর হয়েই বের হই।

সৃষ্টিশীলতা আমাদের মধ্যে আসলে তৈরি করা হয় না উৎসাহও দেয়া হয় না। সে কারণেই অনেক ক্ষেত্রে শোনা যায় যে আর্কিটেক্চার পড়ে বের হলেও তার ক্রিয়েটিভিটি আর থাকে না। কেন? আর্কিটেকচার পড়ে পেইন্টিং-এ যা বোধ ছিল তার সেই বোধ তো আরো সূক্ষ্ম হবে, সে আরো এগিয়ে যাবে। কিন্তু আমরা বিপরীতটা দেখি। আমাদের একাডেমিক শিক্ষার যে কারিকুলাম এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে আপনাকে বিকশিত হতে দিচ্ছে না।

এটা আমার বেলায় ঘটেছে, আমি তো বুয়েটে খারাপই করতাম, ফেল গ্রেড পেয়েছি অধিকাংশ সময়, বা টায়ে টায়ে পাস করেছি। আমার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ তৈরি হয়েছে, তবে কোনো কারণেই হোক আমি এখানে এসে পৌঁছেছি। এক সময় স্থাপত্য পড়া ছেড়েও দিয়েছিলাম। থার্ড ইয়ারে ভেবেছিলাম আর্ট কলেজে পড়ব। ফরম কিনে পূরণও করেছিলাম।

আসলে আমি আর পারছিলাম না। তবে আর্ট কলেজে ভর্তি হলে ভালো হতো তাও আমি বলি না, কারণ ওখানেও তো একই অবস্থা। আবার জেদ করলাম। জেদ ছিল এটাই যে আমি তো সুন্দর সুন্দর জিনিস ভাবি, ছোটকাল থেকে ছবি আঁকতে গিয়ে একটা ভাবনার মধ্যেই থেকেছি। ছোটবেলা থেকে জলরঙ দিয়ে ছবি আঁকতে গিয়ে একটা অদ্ভুত মিষ্টিক তৈরি হয়, এলোমেলো আঁকার মধ্যেও একটা সুন্দর কবিতা তৈরি হয়।

হয়তো সদরঘাটে বসে ছবি আঁকছি, বাস্তবতাটা অত্যন্ত কঠিন কিন্তু ছবি আঁকায় দেখা যাচ্ছে আলো-ছায়ার খেলা, একটা জায়গায় গাঢ় হয়ে আছে অন্ধকার, আবার আলো বেরিয়ে আসছে। এই যে গভীরতা-ত্রিমাত্রিকতা তো ঐ জায়গা থেকে সরতে চাই না। সৌন্দর্যটা কেন থাকবে না! কেন আমি সিঁড়ি আর দরজার মাপ করতে করতে কবিতা হারিয়ে ফেলব। তাহলে কেন আমি আর্কিটেকচার পড়লাম, এই যে জেদটা করেছি তার মাশুলও দিয়েছি অনেক। সা:জু : বুয়েট ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন এর প্রেক্ষাপটটা কি ছিল? র: আ : সেকেন্ড ইয়ারে আমার মনে আছে যে আমি যখন ড্রইং করলাম আমার টিচার, নাম চলতে চাই না।

যদিও এখন উনি আমার একজন ভক্ত হয়ে উঠেছেন রীতিমতো। উনি আমাকে বললেন, এই রকম ড্রইং তো দেখতে চাই না। আমাদের প্রিলিমিনারি জুরি হয়, জুরিতে রেটিং হয়, তো আমি বললাম, আজকে দেখবেন না কেন? আমি তো ড্রইং করে নিয়ে এসেছি। উনি বললেন, আজকে দেখব না, ইবপধঁংব ুড়ঁ ধৎব নবষড়,ি নবষড়ি ঃযব ভবধৎরহম মৎধফব। এতটাই খারাপ ডিজাইন যে নাম্বার দেয়ার অবস্থা নেই।

আবার হয়তো অন্যদিন অন্য কোনো টিচার বললেন, আমার মনে হয় তোমার অন্য কোন প্রবলেম আছে। আবার বললেন, তোমার পরিবারে কি কোনো মাথা খারাপের দোষ আছে নাকি? এগুলো কিন্তু খুব ভয়াবহ কথা। ঐ বয়সের একটা ছাত্র এসব কথা শুনলে কিন্তু অনেকে নেশা করবে বা বিপথগামী হয়ে পড়বে অথবা আবোল-তাবোল ভাববে। তো জীবন কোথায় যাবে, কেউ জানে না। এরকম কঠিন পর্বগুলোর মধ্য দিয়ে আমি এসেছি।

এমনও হয়েছে যে একজন টিচারকে আমার ডিজাইন দিয়েছি, আমাকে জিরো দেয়া হয়েছিল। মানে উনি বসে দেখে বললেন, জিরো। তখন আমি উনাকে আগলে ধরেছিলাম যে আপনি যেতে পারবেন না। আপনি বসেন আবার এবং আমাকে দেখান, শুধু জিরো দেয়াটাই আপনার দায়িত্ব না, আপনার দায়িত্ব একটা ছাত্র কিভাবে পাস করতে পারে, তার কি করণীয়; সেটাও শিখিয়ে দেয়ার কথা আপনার। শুধু জিরো দিয়ে চলে যাবার কথা না আপনি যেতে পারেন না।

তো এ ঘটনা নিয়ে বুয়েটে আমার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি হয়েছিল। আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে অনেক সময়ই সাহায্য পাইনি। কখনো সখনো আমাকে গ্র“পেও নেয়া হতো না, হয়ত ভাবত গ্র“পে কেন নিব ওকে, ও তো ডিজাইন পারে না। সা:জু : এই পরিস্থিতিতে আপনি ডিসিশান নিলেন যে আর্ট কলেজে আসবেন? র: আ : আর কী করব তখন। আমি ভাবতাম আর তো আমি কিছু করতে পারছি না।

যেহেতু আমি ছবি আঁকায় খারাপ ছিলাম না, ছোটবেলায় কিছু পুরস্কারও পেয়েছিলাম। তো সেটার কারণে কিছু আশাও তৈরি হয় আমার মধ্যে যে আমি তো ভালই ছবি আঁকতে পারি। তাহলে কেন এত হতাশ! আমি তো নেহেরু গোল্ড মেডেল পেয়েছি, নতুন কুঁড়িতে ফার্স্ট হয়েছি এবং আরো বেশ কতগুলো পুরস্কার পেয়েছি, ইন্ডিয়া, কোরিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় পুরস্কৃত হয়েছি। সা:জু : ছবি এঁকে? র: আ : হ্যাঁ, পেইন্টিংস এ। তখন মনে হলো যে আমি কিছু তো পারি।

অথচ এখানে আমি কিছু পারছি না সব সময় বকা খাচ্ছি, প্রায়শই ফেল গ্রেড পাচ্ছি নয়তো টায় টায় ৪০/৪৫ পাচ্ছি। বন্ধুরাও ক্লাসে খুব একটা সহযোগিতা করছে না। আমি তো পুরান ঢাকার ছেলে। বুয়েটে আসে তো অনেক স্মার্ট ছেলেমেয়ে, অনেকেরই গাড়িটারি আছে। তার মধ্যে অনেক ভাগও আছে।

আমি আসি একটা সাইকেল চালিয়ে। সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত হতাশা তৈরি হয়েছিল তখন। সা:জু : তারপর আর্ট কলেজ থেকে ফিরে আসলেন কিভাবে? র: আ : ফিরে আসলাম একটা ছোট ঘটনায়। এমন কিছু না। আমার সঙ্গের একটা ছেলে, সেও বকা-টকা খেত অনেক।

তো ও একদিন খুব জিদ করছিল ক্লাসে, চিৎকার করছিল যে ‘পাস করলে দেখিয়ে দেব আর্কিটেকচার কি জিনিস, আমরা কি কিছু বুঝি না, নাকি? বললেই হলো এটা হবে না, ওটা হবে না’Ñ এরকম আর কি। এখন সে চিটাগাং-এ কাজ করে, মিউনিসিপিলিটির আর্কিটেক্ট। তখন আমার মধ্যেও এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হলো, আমিও জিদ করলাম; আমি কি পারি না! আমি যে কাজটা করেছিলাম তারপরে, থার্ড ইয়ারে লাইব্রেরিতে যাওয়া শুরু করলাম। দ্যাট ওয়াজ দ্য ডিফারেন্স। প্রচুর সময় কাটাতাম।

সা:জু : এসব ঘটনার পর? র: আ : হ্যাঁ! তবে লাইব্রেরিতে যাবার পর এমন কিছু হয়নি যে আগে যা ছিলাম এখন পাল্টে গেছি। আগে আমার কোন কনফিডেন্স ছিল না। আমার যে বোধগুলো ছিল, এই শিল্পকলা বা সৌন্দর্য বোধ। পাখির কথা তখনও বলতাম এখনও বলি। তো তখন হতো কি আমার পাখির কথা শুনে মনে করত ফাজলামো করছি।

কিন্তু লাইব্রেরিতে যাবার পর দেখলাম যে পৃথিবীর অনেক মহান আর্কিটেক্ট, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেছেন, কথা বলেছেন। এই যে কনফিডেন্সটা ডেভেলপ করল আমার তখন আমি আরো জেদি হয়ে উঠলাম। ফিফথ ইয়ারে কিন্তু আমি রীতিমতো টিচারদের সাথে ঝগড়া করতাম। সা:জু : আপনি সেখান থেকে জেদি হয়ে উঠছেন! র: আ : ওই যে কনফিডেন্সটা বিল্ডআপ হলো। আমি দেখতাম যে মিথ্যা বলিনি বরং যা ভাবতাম বা বলেছি আগে তা ঠিকই আছে এবং এর মধ্যে এমন কোন ভুল ছিল না যে সেগুলো অবাস্তব বা অবান্তর কথা।

সা:জু : রেফারেন্স পেয়েছিলেন? র: আ : হ্যাঁ! তখন আমার গলায় একটা জোর এসেছে। মজার ব্যাপার কি তখন আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েরাই আমাকে এসে ডিজাইন দেখাত, ফিফথ ইয়ারে। সা:জু : পুরো পরিস্থিতিটাই বদলে গেল? র: আ : কমপ্লিটলি। মানে এটা অবিশ্বাস্য। আমাদের ক্লাসের কেউ কেউ বলে যে আমাদের ক্লাসের মিরাকেল আমি।

তো আমাদের মধ্যে ভাল করেছে পলাশ আরো দু’একজন যেমন নির্ঝর (এনামুল করিম) ছিল, ও খুব টেলেন্টেড ছিল। তো এরা যারা ভাল করছে তাদের একটা ট্র্যাক ছিল হঠাৎ করে না, এরা ভাল করে আসছে। একমাত্র আমিই ব্যতিক্রম! যাকে নিয়ে কেউ ভাবেনি যে আর্কিটেকচার প্র্যাকটিস করবে অথবা আদৌ কোথায় থাকবে কে জানে! সেখান থেকে আমি এখনও টিকে আছি এটা আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এখনও আমি কাজ করে যাচ্ছি আর্কিটেকচারে। এটা আমার সৌভাগ্যও বটে।

আমার পরিবার, মা, স্ত্রী, অফিসের সহকর্মী, ক্লায়েন্ট, শুভাকাক্সক্ষীসহ অনেক মানুষের ভালবাসা আর সহযোগিতার ফলাফল এই কাজ করে যাওয়া। সা:জু : আপনার কাজে যেভাবে পরিবেশ দেখতে পাই মানে ছয় ঋতু বা অন্যান্য কাজেও জল, সবুজের আধিক্য ইত্যাদি, তো এর পাশাপাশি এখানকার নিজস্ব গৃহ নির্মাণ উপকরণ এবং বাসস্থানের অবকাঠামোগত স্বাতন্ত্র্য নিয়ে কি কোন ভাবনা বা কাজ আছে? র: আ : একটা অনুসন্ধানী মন তো আছেই। এই জায়গাটা খুব কঠিন জায়গা। আর্কিটেকচারটা তো একটা ভাষার মতো। সবকিছুই, এই ধরা যাক সিনেমা, এটা একটা ভাষা।

তো সেই সিনেমাটা কাদের কথা বলে। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে কোন সৃষ্টিশীল ভাষারই দুটো পার্ট থাকে। সেটা যে কাজই হোক না কেন। একটা হচ্ছে যে ওর নিজস্ব কারিগরি একটা অংশ। তো সিনেমা বানাতে গেলে আপনি যে দেশেরই হোন না কেন আর যত স্মার্ট বা যাই হোন না কেন আপনাকে কিন্তু জানতে হবে যে সিনেমায় ফিল্ম লাগে, ক্যামেরা লাগে, এডিট করতে হয়, স্ক্রিপ্ট লাগে, তো এই উপাদানগুলো কিন্তু সাজানোর ক্ষেত্রে একটা টেকনিক্যাল পার্ট আছে।

এটা আপনি জানেন না হঠাৎ আপনি গিয়ে সিনেমা বানাবেন, বললে তো হবে না। তো এটা একটা প্রসেস। এখন কবিতার ক্ষেত্রেও আপনাকে একইভাবে ভাষা জ্ঞান, শব্দ চয়ন, বিষয়, সমাজ সম্পর্কে ধারণা এ সমস্ত অনেক বিষয় জানতে হবে। কারিগরি জ্ঞান এমন একটা জিনিস যেগুলো সবাইকে শিখতে হয়। আর্কিটেকচারেও কিছু কারিগরি বিষয় আছে।

কিন্তু মূল যে বিষয়টা জ্জ এটা দিয়ে আমি কি বলতে চাই। আমি কাদের কথা বলতে চাই, আমি কোন বিষয়ে কথা বলতে চাই, তখন আসে চ্যালেঞ্জটা। প্রথমদিকে আমার তো অনেক সময় লেগেছে বুঝতে। ’৯৮তে আমার মনে আছে আমি একবার এক্সিবিশন করেছি নিউইয়র্কে, সলো এক্সিবিশন; আর্কিটেকচারের উপর। কোন কারণ নেই, এর কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না যে একজন আর্কিটেক্ট যার কাজের কোন আগামাথা নেই সে চলে গেল এক্সিবিশন করতে।

আমার একটা জিদ ছিল যে ২০০০ সাল শেষ হয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক আর্কিটেকচারাল এক্সিবিশন হয়েছে, এটা এমন কোন ব্যাপার না। কিন্তু বাংলাদেশের আর্কিটেকচার এত রিচ ছিল হাজার হাজার বছর ধরে অথচ তাদের একটা সার্চ দিলে কেউ একটা আর্কিটেক্ট খুঁজে পাবে না যে ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশন করেছে। নামটা তো বাদ পড়ে গেল এখান থেকে। কাজের কাজ কি হলো, আমি হতাশ হয়ে ফিরে আসলাম। কারণ আমার কাজ দেখে আহামরি কোন প্রশংসা কেউ করেনি।

বরং ওয়াটার কালারের দুয়েকটা কাজ দেখে ভাল বলেছিল। কিন্তু ওটা আমার একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। আমি তখনই বুঝলাম যে আমি বুয়েট থেকে যা শিখেছি সেটা দিয়ে আমার মনের মাধুরী মিশিয়ে যা করছি, এটা হয়তোবা একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম আমাকে টেকনিক্যালি আরো সাউন্ড হতে হবে এর পাশাপাশি আমার কি আছে, আমার স্থাপত্যের উপাদান কি আছে সেগুলো নিয়ে যোগ করলে পরে তা বাংলাদেশের স্থাপত্য হবে কিন্তু সেটা হাজার বছর আগের হবে না কিন্তু সম্পর্ক থাকবে পাশাপাশি যেটা বিশ্বায়নের যুুগে বাংলাদেশকে প্রতিনিধি করতে পারে যে আমরাও পিছিয়ে নেই। তখন আবার ভাবতে শুরু করলাম এই বিষয়টা কিভাবে দাঁড় করানো যায়।

আমি আবার লাইব্রেরি ওয়ার্ক শুরু করি। আস্তে আস্তে নিজে বই কিনি। একটু একটু করে পড়ি, দেখি। আমি লাইব্রেরি যাই মানে কিন্তু খুব পড়ি না। লাইব্রেরিতে যাইÑ কিছুটা পড়ি, কিছুটা দেখি, কিছুটা কনফিডেন্ট বিল্ডআপ করি, ্অল্প অল্প মনে রাখতে পারি, বেশি কিছু মনে রাখতে পারি না।

আমি বেসিক্যালি খুব পছন্দ করি, যেমন আমি অনেক বছর কাটিয়েছি আমার বেডরুমে, সকালে রোদ আসে আমি জানালা খুলে দিয়ে ফিতা দিয়ে রোদ মাপতাম। কম্পাস দিয়ে ধরে রাখতাম, মাপতাম। এভাবে আমি মাসের পর মাস মেপেছি। এক বছর হয়তো সপ্তাহে দু’বার, মাসে একবার, দু’বার, এরকম মেপে মেপে দেখেছি। সূর্য এক জায়গায় উঠে না।

অনেকদিন পর্যন্ত আমি জানতাম না ব্যাপারটা। আলো-ছায়া ছাড়া কোনো সাহিত্য হবে না এই সূর্যটাইতো জীবনী শক্তি। তো এই সমস্ত অদ্ভুত সূর্যের যে খেলা এটা আসলে সবকিছু, আর্কিটেকচারের খুব পাওয়ারফুল উপাদান। তারপর বাতাস ইত্যাদি নিজে নিজে শিখেছি। সা:জু : নিউইয়র্কে যখন এক্সিবিশনটা করলেন তখন আপনি কোথায় থাকতেন? র: আ : তখন আমি দেশেই থাকি।

আমার আসলে অনেকদিন থেকেই ইচ্ছা যে বাংলাদেশের অন্তত একজন আর্কিটেক্টের একটা আন্তর্জাতিক এক্সিবিশন হোক। সা:জু : দেশে থেকে ওখানে এক্সিবিশন করলেন কিভাবে? র: আ : খুব কঠিন ছিল, কারণ আমি তখন ঘটনাচক্রে ইউনাইটেড নেশানের একটা শুভেচ্ছা পাসপোর্ট পেয়েছিলাম, মাঝে মাঝে এপ্লাই করলে ভিসা দিত। জাতিসংঘের একটা ট্যুর আছে ঐ ট্যুরে পার্টিসিপেট করে ঘুরে ঘুরে দেখা যায়। তো এটা যখন আমি এক সময় পেলাম তখন মনে হলো যে আমি যাব কিন্তু গিয়ে ফিরে আসব এর তো কোন মানে নেই। আমি যখন আর্কিটেকচার নিয়ে কাজ করি, ছবি আঁকি ভাবলাম এটা নিয়েই কিছু করি।

তখন আমার বন্ধু স্থপতি ইয়াসিন আর বনু, ওদের বললাম যে দেখ কিছু করতে পার কি না; একটা এক্সিবিশন করি। টাকা-পয়সা যোগাড় করলাম, তো ওরাও অনেক খাটাখাটনি করল। ওরাও ফিল করত আমার আর্কিটেকচার তারপর ছবি আঁকার প্যাশনটা। হয়তো কিছু খুঁজে পেয়েছে, অথবা বন্ধু বলেই তো ওরা খুঁজে বের করল। খুব ভাল জায়গায় এক্সিবিশন করেছি।

চেলসিয়া বিল্ডিং পৃথিবীর মধ্যে বিখ্যাত। তো ওরা সেখানে একটা ফাঁকা সময় খুঁজে পেল। কাজ দেখে বলল মনে হচ্ছে খারাপ হবে না। মানে আহামরি কিছু না তবু না তাকানোর মতো না। কাজ একটা পর্যায়ে ছিল।

ওভাবেই আসলে ঘটে গেছে ঘটনাটা আর সেই দশ বছর পর আমি এবার আরেকটি এক্সিবিশন করলাম। সা:জু : বেঙ্গল গ্যালারিতে? র: আ : হ্যাঁ বেঙ্গলে। তো ওখান থেকে আশা করি বেশ ভিন্ন একটা জায়গায় আসতে পেরেছি এতদিন পর। সা:জু : বেঙ্গলের এক্সিবিশনে দেখলাম যে আপনার প্রায় প্রতিটা প্রজেক্টের ডিজাইনের সাথেই একটা করে পেইন্টিং-এর সম্পর্ক আছে। তো এরকমভাবেই কি আপনি প্রতিটা কাজই করে থাকেন? র: আ : প্রত্যেকটার সাথে না করলেও আমি পেইন্টিংস থেকেই অনুপ্রেরণাটা পাই।

কারণ, আমি যখন পানি আঁকি, পানির যে চলাচল এটা আমাকে খুব উৎসাহিত করে। সূর্যের আলো এটাও খুব মজার। যেহেতু এর ফাঁকে অনেক দেশে যাবার সুযোগ হয়েছে, পড়ানোর সুযোগ হয়েছে; বিদেশে অনেক ইউনিভার্সিটিতে লেকচার দিয়েছি এর মধ্যদিয়ে অনেক কিছু দেখার সুযোগ পেয়েছি, যেটা আগে ছিল না বা দেখিনি। তো ঐ সময়টায় আমি বুঝেছি যে আমাদের অফুরন্ত সম্পদ আছে। আমাদের তো অনেকদিন ধরে শেখানো হয়েছে, প্রায় ২০০ বছর ধরে ব্রিটিশরা শিখিয়েছে যে আমরা ফকির, আমরা গরিব, আমাদের কিছু নেই, এসব।

কিন্তু ওদেরই অনেক কিছু নেই আসলে। আমাদের যা আছে, ওদের তা নেই। এই যে পানি। যেটাকে আমরা প্রবলেম বলি। এরকম পানি কার আছে? কিন্তু আমাদের সব সময় বলে দেয়া হয়েছে যে বন্যা একটা সমস্যা।

অষ্ট্রেলিয়ায় তো প্রতি বছর ভয়াবহ দাবানল হয়। আমার অষ্ট্রেলিয়ান টিচার গ্লেন মার্কাট আর্কিটেক্ট। উনি হেন কোন সর্বোচ্চ পুরস্কার নেই যা পাননি। সবই পেয়েছেন। পৃথিবীর আর্কিটেকচারের মাথা যে ক’জন উনি তাদের একজন, উনি সুফি ব্যক্তির মতো একজন স্থপতি।

আমাকে অসম্ভব স্নেহ করেন। তো একদিন উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমাদের যে আগুনের সমস্যা, তো বাড়ি ডিজাইন করার সময় এই প্রবলেমটা মাথায় থাকে না, বা এইটার জন্য আলাদা কিছু কি কর? উনি খুব অবাক হয়ে বলল যে ‘হোয়াট ডু ইউ মীন বাই প্রবলেম’ এটাতো প্রবলেম না, এটা একটা নেচারাল ফেনামেনান। মানে দেখেন ওদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা নেচারাল ফেনামেনা আর আমাদেরটা হলো প্রবলেম। তো পশ্চিমারা আমাদের মাথায় ঢুকিয়েছে যে বন্যা এমন একটা প্রবলেম যে আমরা তটস্থ হয়ে থাকি। একটা জিনিস ভেবে দেখেছি কি আমরা যে, এই পানি না আসলে কি হতো আমাদের।

কোথায় যেতাম আমরা। এই পলিমাটি দেশে আছে বলেই কোটি কোটি লোক বেঁচে আছে। পানি আসে বলেই শস্য উৎপাদন হয় খেয়ে পড়ে আছি। এটাকে ম্যানেজ করব না আমরা! এই পানির জন্যই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধতে পারে। আমাদের দেশ এমন একটা দেশ যেখানে মিষ্টি পানিও আছে আবার নোনা পানিও আছে।

এরকম একটা অদ্ভুত কম্বিনেশন যে দেশে, মানে লার্জেস্ট ডেল্টা অন আর্থ; তারপর এত উর্বর মাটি, এত সুন্দর রোদ, এত বৃষ্টি, এত সবুজ। আমাকে সব জায়গায় প্রশ্ন করা হয় তুমি যে এত সবুজ দাও তোমার আর্কিটেকচারে এগুলো পরিচর্যা করতে কষ্ট হয় না? এখন আমরাতো আসলে পরিচর্যা করি না, করতে হয় না। ওরা তা কল্পনাও করতে পারবে না। সা:জু : আপনার যতগুলো প্রজেক্ট দেখলাম প্রদর্শনীতে সেখানেতো কমিউনিটির জন্য কাজ খুব কম মনে হলো। আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবাসন সংকট নিয়ে আপনার ভাবনা কি? র: আ : দেখেন এক্ষেত্রে বলে রাখি সদিচ্ছা থাকলে এগুলো সমস্যা না।

আমাদের ঢাকা নিয়ে তার অবকাঠামো এবং আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করেন। এমনও বলেন অনেকে যে ঢাকা একটি মৃত শহর। কিন্তু আমি চ্যালেঞ্জ করলাম ঢাকার বর্তমান অবকাঠামো একটুও পরিবর্তন না করে এখনও ঢাকাকে তিলোত্তমা নগরীতে পরিণত করা সম্ভব, না হলে আমি কিসের আর্কিটেক্ট। কিন্তু আমার পক্ষে কিইবা করার আছে যদি সরকার বা সেরকম কেউ সাড়া না দেয় বা ব্যাপারটা বুঝতে না পারে। বর্তমানে ঢাকায় আর্কিটেকচার বলতে শুধু উঁচু উঁচু ভবন তৈরিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে।

এ বিষয়ে সরকারের ভাবনা থাকতে হবে। সে তার জনগোষ্ঠীকে কোথায় কিভাবে রাখবে, তার ভূমি কিভাবে ব্যবহার করবে। মাস্টার প্লানের নামে ১৫-২০ বছর পার করলে চলবে না। আমার মনে হয় না সরকার যদি সদিচ্ছা দেখায় তবে কাজের লোকের অভাব হবে। সা:জু : আপনাদের সময়তো অল্প কিছু সংখ্যক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচার পড়ানো হতো আর এখন পাবলিকসহ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমাণের সাথে সাথে আর্কিটেকচার পড়ানোর প্রতিষ্ঠানও বেড়ে চলেছে এটাকে কিভাবে দেখছেন? র: আ : এটাতো আমি মনে করি সবসময়ই পজেটিভ যে অনেকে বুয়েটে পড়তে না পারলেও সমস্যা হয় না।

ট্যালেন্টেড ছেলেমেয়ের সংখ্যা যদি এক হাজার জনও হতো তাহলেও পঞ্চাশ জনের বেশি তখন সুযোগ পেত না। এখন সে সুযোগ হয়েছে। সেই অর্থে এটা ভাল। পাশাপাশি যারা পড়াচ্ছেন সে ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষকও তৈরি করতে হবে। কিন্তু শিক্ষক তৈরির সেরকম সুযোগ কম আমাদের।

সা:জু : আরেকটা জিনিস যেটা বিষয় হিসেবে আর্কিটেকচার পড়ানোর ক্ষেত্রে সেটাও কারণ হতে পারে যে, আমাদের নগর এখনও আপরাইজিং, অবকাঠামো নির্মাণের এখনও অনেক বাকি সেই জায়গা থেকে যেমন কর্পোরেট প্রয়োজনেই চারদিকে এমবিএ, বিবিএ সাবজেক্ট হিসেবে খুলে ব্যবসা করছে তো সেভাবে বর্তমানে যে হারে এপার্টমেন্ট বানানোর হিড়িক চলছে সেক্ষেত্রে আর্কিটেকচার বিষয়ের প্রসারের সাথে এসব সম্পর্ক জায়গাটাকে নষ্ট করছে কি না? র: আ : দুটোই, আসলে যে কোন পেশাই এরকম। সঠিক অর্থে যদি আমরা পেশাটাকে কাজে লাগাই সেই পেশার জগৎটাকে আরো উন্নত করতে পারব আবার পেশাগত দায়িত্ব পালন না করলে কিন্তু সমাজেরই ক্ষতি হয়ে যায়। আর্কিটেকচারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে একজন আর্কিটেক্টই বলেছেন যে, একজন ডাক্তার ভুল করলে মাটি চাপা বা কবর দেয়া হয় এবং একদিন সেটা হারিয়ে যায় কিন্তু একটা ত্র“টিময় দালান যখন দাঁড়িয়ে যায় তখন কিন্তু এটাকে আর মাটি চাপা দেয়া যায় না। ভুল হিসেবেই সেটা থেকে যায়। তো আর্কিটেকচারে ভুল করলে লুকানো যায় না বরং কোন কোন সময় তা একশ’ / দেড়শ’ বছর ভুল হিসেবেই দাঁড়িযে থাকে এবং সহ্য করতে হয়।

তাই আর্কিটেক্টের ভুল করাটা সমাজের জন্যই একটা বড় বোঝা। সেদিক থেকে চিন্তা করলে আর্কিটেকচারে পড়াশোনাটা যেন সঠিকভাবে এগোয়, যারা আর্কিটেক্ট হবেন তারা যেন সেভাবে নেন, এ্যামাউন্টেবিলিটি থাকে যেন তাদের। এটা ঠিক পেইন্টিং না যে ভাল লাগছে না তো সরিয়ে রাখলাম বা ফোল্ডিং করে রেখে দিলাম। এটাকে মানুষ ব্যবহার করবে, দেখবে। এটা তৈরি করতে গিয়ে হয়ত গাছগাছালি কেটে ফেলতে হয়েছে, আবার সেটা লাগাচ্ছে কি লাগাচ্ছে না, ইকোলজি ব্যালান্সটা কতটুকু পরিবর্তন হলো..... অনেক কিছু চলে আসে।

সে তুলনায় এখানে ভুল করাটা সত্যিই দুঃখজনক হবে। সা:জু : আমাদের দেশের স্থাপত্য বিষয়ে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বা কারিকুলাম সম্পর্কে বলেন? র: আ : আরো বেশি সময়োপযোগী, প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত; আমাদের আর্কিটেক্টরা যদি প্রকৃতিকেই ঠিকমতো ধারণ করতে না পারে তাহলে আর্কিটেকচার পড়ে হেল্প করছি না, আসলে আরো জটিল করে তুলছি পরিবেশকে। আমার আরো মনে হয় মানুষের সাথে সম্পর্ক কিভাবে স্বচ্ছ করা যায়, মানে একটা চিন্তাকে আমি যখন তৈরি করতে যাই তখন কিন্তু আবার অনেক রিয়েলিটি যেটা বলি আমরা তার সম্মুখীন হই। যেমন একটা বাড়ি বানাতে গেলে মাটি কেটে.... বিশাল বিশাল সব কাজ করতে হয়। আল্টিমেটলি রূপান্তরটা ট্রান্সফরমেশনের ক্ষেত্রে জায়গাটাকে নষ্ট করে করা হয়েছে এরকমটি যেন না হয়, মিলেমিশে আবার যেন এক হয়ে যায়।

মনে না হয় যেন এখানে নষ্ট করে এটা করেছি। এক্ষেত্রে কারিকুলামটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর আর্কিটেক্টদের তো অনেক কিছু জানতে হয় কেননা সামাজিক যে বিষয়গুলো এখন সমাজ না বুঝলে আমি কিভাবে সমাজের জন্য কিছু তৈরি করব। আবার যদি একটা ব্যক্তি সাইকোলজি না বোঝে, সমাজের ইউনিট হচ্ছে ব্যক্তি, তো আমাকে তো মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে। আর প্রাণীকূলের, প্রকৃতিরও মনস্তত্ত্ব আছে।

তারপর নৃতত্ত্ব বুঝতে হবে। একটা মানুষ, তার কালচার, গঠন অনেক কিছু এরপর ভাষাটা বুঝতে হবে। পাশাপাশি একটা আর্কিটেকচার পেইন্টিং না যে আমরা ভাল লাগল না, বা বিক্রি করলাম না। অর্থনৈতিক যে ভাইবেলিটি আছে টিকে থাকার যে ব্যাপার আছে এটাও থাকতে হবে। অর্থাৎ অর্থনীতিটা বুঝতে হবে।

কারণ বিশাল খরচ হলো, ভাবনার বিষয় থাকে ফেরত আসবে কি না! ফেরত সব অর্থেইজ্জ সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক, শিল্প হিসেবেও। আবার কারিগরি অনেক আকাক্সক্ষাও আছে। তো একটা আর্কিটেকচার করতে গেলে অবকাঠামো নির্মাণ খুব জটিল একটা জিনিস। এটা পড়ে যাবে কি না, মানুষ অত উপরে উঠবে কিভাবে, তারপর উপরে গেলে মানুষের মনস্তত্ত্ব পরিবর্তিত হয়ে যায়, বাচ্চাদের মনস্তত্ত্বও পরিবর্তন হয়ে যায়, তো অনেক কারিগরি দিকও আছে। সেগুলোও জানতে হয়।

যা বলছিলাম যে দার্শনিক আকাক্সক্ষাও কারিকুলামে অবধারিতভাবে আসার দরকার আছে। এখন সাইকোলজি পড়ানো হয় হয়তো কিন্তু রিলেট করা হয় না। সা:জু : এতো এতো বিষয় সম্পর্কে যদি ধারণা নিতে হয় যে এমনিতেই দেখি আর্কিটেকচারে যারা পড়ে তারা দম ফেলার সময়ও পায় না, তো এতগুলো বিষয়কে আত্মস্থ করে কাজ করতে গেলে তো শিক্ষার সময়টা সমস্যা তৈরি করবে। র: আ : হ্যাঁ, সময় অনেক বাড়িয়ে দিতে হবে সেটা একটা দিক আছে যেমন অনেক দেশেই কিন্তু পাঁচ বছর আর্কিটেকচার পড়াশোনা করতে হয়। মাঝখানে দু’বছর আবার কোথাও গিয়ে কাজ করতে হয়, প্র্যাকটিক্যালি কোন ভাল আর্কিটেক্টের সাথে, শ্রীলঙ্কাতেই এটা আছে।

সুতরাং ওরা কিন্তু সময় বাড়িয়ে নিয়েছে। পেশাটাই এরকম জটিল যে এখানে সময়টা বাড়িয়ে নিয়ে সঠিকভাবে শিক্ষিত করেই তাকে সমাজে কাজ করতে দেয়া হয়। না হলে তো সে সমাজের রূপান্তর করতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলতে পারে। তাই সময় বাড়ানোটা অযৌক্তিক না। আবার সময় না বাড়িয়েও কিন্তু সিলেবাস, কারিকুলাম ঠিক করার সময় আরো সতর্কভাবে বাছাই করা যে কোন কোন ইস্যু খুবই সম্পর্কিত।

এবং কয়েকটা ইস্যু আছে যেগুলো সংযুক্ত করে পড়ানো হয়। যেমন সাইকোলজির অনেক ইস্যু আছে পড়াতে পারে কিন্তু আর্কিটেকচারে সব ইস্যু পড়ানো হবে কি না। ্এখন আর্কিটেকচারে কোন ইস্যুগুলো দরকার, মনস্তত্ত্বের সেই বিষয়গুলো ঠিক করে নিলেই হয়, একইভাবে সমাজতত্ত্বের নির্বাচিত কিছু বিষয় পড়ানো যেতে পারে। এখন সব তো পড়ানো সম্ভব না। একটা ধারণা থাকা দরকার যেন কাজ করার সময় বিষয়গুলো মাথায় থাকে।

একইভাবে প্রত্যেকটা বিষয়েই কাজ কর।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.