আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অস্ট্রেলিয়া - ৩


পরের দিনের ভ্রমনটা আমার কাছে মজার ছিল বেশি। ক্লিফ আমাকে নিয়ে গেল জন ফরেস্ট ন্যাশনাল পার্কে বুনো ক্যঙ্গারু দেখাবার জন্য। পাহাড়ের উপর বুশের ভেতর দিয়ে রাস্তা উঠে গেছে আরো উচু পাহাড়ে। আর এই পাহাড় জুড়েই জন ফরেস্ট ন্যাশনাল পার্ক। আমি তো ক্যঙ্গারু দেখবার জন্য গাড়ির জানালা দিয়ে হা করে তাকিয়ে তন্ন তন্ন করে চারিদিকে খুজতে থাকলাম....আহা একটা যদি ক্যঙ্গারু বের হতো!! ক্লিফ বলেছে ওখানে বুনো ক্যঙ্গারুরা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়।

কপাল মন্দ হলে যা হয়। ভাগ্যে একটাও ক্যঙ্গারু জুটলো না। শুধুই ধুধু জঙ্গল আর শুস্ক ঝোপ, বিশাল বিশাল রক। এক জায়গাতে আমারা গাড়ি পার্ক করে জঙ্গলের ভেতরে হাটতে যাবো ঠিক করলাম। একটা লেকের পাশে থামলাম।

প্রথমেই গায়ে বিধলো রুক্ষ ঝোপের কাটা। তার মধ্যও কতযে সৌন্দর্য...দেখতে কিন্তু সবুজ, যেন মোলায়েম আর প্রানবন্ত। হাত দিয়ে ধরলে বোঝা যায় কতটা রুক্ষ। গায়ে বিধলে চামড়া ছিড়ে যায়। প্রচন্ড গরম ছিল সেদিনও।

মাথা ফাটা রোদে লেকের পানি যেন প্রানে ঠান্ডা অনুভুতির পরশ দিয়ে যায়। কি যে শান্ত আর সুন্দর প্রকৃতি ওখানে। শুকনো রুক্ষ ঝোপের ভেতর ও যে কি দারুন সব ফুল ফুটে আছে!! একপাশে যেমন প্রানহীন ঝোপ, অন্য পাশে তেমনই রং এর বাহার নিয়ে চমৎকার সব ফুল ফুটে আছে। প্রানহীন ঝোপে রংগিন ফুলের বাহার সত্যিই অসাধারন! আমরা হেটে চললাম বিশাল বিশাল গাছে ভরা ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়ায় বুশ ফায়ারে মাইলের পর মাইল বুশ পুরে যায় অনেকেই হয়তো জানেন।

ওখানে বুশ ফায়ারে পুরে যাওয়া গাছেরা পোরা ইতিহাস নিয়ে দাড়িয়ে আছে নতুন জন্মানো গাছেদের পাশে। এক ধরনের গাছ দেখলাম ওর নাম "ব্লাক বয়"। কি যে সুন্দর দেখতে!! ওরা বাড়ে খুবই ধিরে। এই সাইজের একটা গাছে বয়স হয়তো দশ বছর আর ওরা বুশ ফায়ারে যখন পুরে যায়, পোরার পরে আবার সেখান থেকেই বাড়া শুরু করে। জঙ্গলের কিছু কিছু যায়গা জুরে শুধু এই জাতীয় গাছ!! গাছ গুলো একবার পুরে যাবার পরে গোড়াটা এমন থাকে আর সেখান থেকেই নতুন জীবন শুরু হয়।

প্রচুর ইউক্যালিপ্টাস গাছে ভড়া জায়গাটি। চারিদিকে ইউক্যলিপ্টাসের গন্ধে ম ম করছে। আমাদের দেশেও ইউক্যলিপ্টাস গাছ আছে তবে এত বড় ইউক্যলিপ্টাসের ফল অন্য কোথাও আগে দেখিনি। ছোট বেলায় শুকনো ইউক্যালিপ্টাসের ফল দিয়ে লাটিম খেলতাম। ওখান থেকে দুটো বিশাল সাইজের ফল নিয়ে নিলাম বাড়ি ফিরে খেলব বলে ।

লেকের পাড় ধরে আরো গভীর জঙ্গলের ভেতর আমারা হেটে চললাম ক্যাঙ্গারুর খোজে। তার বদলে খুজে পেলাম প্রচুর বিশাল বিশাল রক। এক একটার সাইজ ৩/৪ তলাও উচু দেখা গেল। এসবও প্রাকৃতিক, প্রকৃতির গড়া। লেকের পাড় ধরে হাসগুলোর লেকের পানিতে খেলা করা কি যে সুন্দর আর শান্ত।

উইক এন্ড বলে অনেক বাবা মা বাচ্চাদের নিয়ে বেরাতে এসেছেন। লাল টুপি পরা ছোট্ট মেয়েটি লেকের পাড়ে রকের উপর বসে মাছের খেলা করা আর হাঁসেদের সাতাঁর কাটা দেখছে। ও যেন মরুর আর রুক্ষতার বুকে একটুকরো রংগিন জীবন!! প্রচুর ঝাউ গাছও চোখে পড়ল এখানে। দুপুর পর্যন্ত বনে জঙ্গলে হাটাবার পর আমাদের যেমন খিদে তেমনই পিপাসা পেয়েছিল। কাছেই একটা বার + রেস্টুরেন্ট পাওয়া গেল।

ওটেতে গিয়ে ধর্না দিলাম। ওরা বলল খাবার সার্ভ করতে ১.৫ ঘন্টা লাগবে। আমাদের খিদেয় তখন প্রাণ যায় অবস্থা। শুধু দুটো কোল্ড ড্রিংক নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা ভাবলাম। গাছের ছায়ায় বসে ঠান্ডা তরল গলায় পরতেই চাঙ্গা হয়ে উঠলাম দুজন আবার।

কাছেই ছিল একটা ঐতিহাসিক ড্যাম। "Mundaring Weir". ভাবলাম ওটায় ঘুড়ে যাই। অস্ট্রেলিয়ায় পানির অভাব আগেই বলেছি। আজও ওরা পানি খরচের ব্যপারে খুবই সাবধানি। অস্ট্রেলিয়ার কিছু কিছু জায়গায় বিশাল বিশাল সোনার ক্ষনি আছে।

সাউদ্যার্ন ক্রস, কাল্গর্লি ও কুলগার্ডি নামের জায়গা গুলোতে প্রচুর সোনার ক্ষনি যেখানে সাখানে। প্রথম অস্ট্রেলিয়া সোনা পায় সাউদ্যার্ন ক্রসে। ওখান থেকে খুজতে খুজতে কাল্গর্লি পর্যন্ত পৌছে। শহর গুলো পার্থ থেকে প্রায় ৬০০ মাইল দুরে। ১৮৯৮ এর আগে যখন ওরা জানল এই সোনার ক্ষনির কথা তখন ওরা ওখানে সোনার সন্ধানে গেল।

কিন্তু সোনা থাকলে কিহবে জায়গা গুলোতে সোনার চাইতেও দামি "পানি"র বড়ই অভাব। কোন পানি নেই ওর আশে পাশের শহর গুলোতেও। তাই সোনা তোলার জন্য যারা যাবে ওখানে তদের পানির অভাবে জীবনধারনই সম্ভব নয় সোনা তোলা তো দুরের কথা। শুধু সোনা তোলা নয়, জনবসতীও সম্ভব হচ্ছিলনা পানির অভাবে কাছাকাছি শহর যেমন সাউদার্ন ক্রস ও অারো কিছু জায়গা পার্থ থেকে কাল্গর্লি যাবার পথে জনবসতী ছিলনা। আজও ওখানে জনবসতী খুবই কম, শহর গুলো মৃত পুরীর মতন।

এই সময় আইরিশ ইন্জিনিয়ার সি. ওয়াই. ও'কনোর কাল্গর্লি ও আশে পাশের শহর গুলোতে পানি নেবার এক কায়দা আবিস্কার করেন। উনি ঠিক করেন পার্থের Mundaring Weir লেক থাকে পানি পাম্প করে পাইপ দিয়ে কাল্গর্লি পর্যন্ত নেয়া হবে। সবাই উনার এই প্রযেক্টকে অসম্ভব বলে ধরে নিয়েছিল। তবু ব্রিটিশ সরকার (তখন অস্ট্রেলিয়া পুরোপুরি ব্রটিশের দখলে ছিল) এই প্রজেক্টের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন। উনি চরম উৎসাহে কাজে লেগে গেলেন ১৮৯৮ সালে এই ড্যাম গরায়।

আকাশ ছোয়া আশা উনার, সবার অসম্ভব বানীকে উপেক্ষা করে সফল হবার স্বপ্ন নিয়ে আর সোনার দেশে পানির অভাব দুর করবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে কঠিন পরিশ্রমে দিনরাত পার করলেন ১৯০২ পর্যন্ত। ড্যামের কাজ তখন শেষ। পার্থ থেকে ৬০০ মাইল দুরে কাল্গর্লি পর্যন্ত বিশাল পাইপ টানা হলো। পাম্প বসানো হলো, বাধ দেয়া হলো। প্রচুর টাকার প্রজেক্টও বটে।

কনোরের মনে কিছুটা টেনশন, এত কিছুর পরে যদি এই প্রজেক্ট কাজ না করে তাহলে উনি মুখ দেখাবেন কিকরে। পানি পাম্প করা শুরু হলো। ড্যামের ফিনিশিং টাচ তখনও হয়নি তবে মুল কাজ শেষ। এবার চেষ্ট করার পালা। পানি পাম্ম করে ৬০০ মাইল দুরে পাঠানো শুরু হলো।

এতদুরে পাইপ বেয়ে সেই আমলে পানি যেতেও তো কম সময় লাগার কথা নয়। সপ্তাহ কয়েক বা মাসখানেক লাগবার কথা। ওখানে ড্রাইভ করে যেতে লাগে ৮ ঘন্টা। আর পথে প্রচুর বিশাল বিশাল উচু পাহাড় ও চড়াই উৎড়াই। কনোরের ধর্য্য আর ধরে না যেন।

কয়েক সপ্তাহ বা মাস দুয়েক সম্ভবত লেগেছিল ( এব্যপারে সঠিক সময়ের হিসেবটা পাইনি), কিন্তু ততদিনে কনোর হতাশায় ডুবে যান। লজ্বা আর হতশার এক পর্যায়ে উনি আত্বহত্যা করেন। আর ঠিক তার কয়েক ঘন্টা বা কয়েক দিন পরে পানি কাল্গর্লি পৌছে। উনার প্রযেক্ট সাক্সেসফুল হয়। কিন্তু ততদিনে উনি আর পৃথিবীতে থাকনেনি উনার এই অসাধারন সাফল্য দেখবার জন্য।

পানি পেয়ে জনবসতি গরে ওঠে সাউদ্যার্ন ক্রস, কুলগার্ডি ও কাল্গর্লির মত সোনায় ভড়া জায়গা গুলোতে। শুরু হয় সোনা তোলার অভিযান। আর ড্যামটিও দেখবার মতন। বিশাল ড্যাম। অবশেষে পুরো ড্যামের কাজ শেষ হয় ১৯০৩ এ।

এটা এখানকার অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট এখন। ছবি তুললাম ড্যামের, পাম্প স্টেশনের আর ও'কনোরের। ও'কনোর এর শ্রদ্ধায় Mundaring Weir এ তাঁর স্বরনে এক সৌধ তৈরী করা হয়। জায়গাটা এত সুন্দর!! প্রচুর ফুলে আর নানান জাতের গাছ লাল মাটির উপর। টিয়ে, কাকাতুয়া, ম্যাগপাই, পাতিহাঁস আর ক্যাঙ্গারুতে ভড়া।

এরা সাবাই মুক্ত ভাবে শুধু ঘুরেই বেড়চ্ছে না মানুষের কাছে গিয়ে নির্ভয়ে খাবার খাচ্ছে মানুষের হাত থেকে। কিযে চমৎকার ব্যপার!! এর মাঝে সারাদিনে একটাও ক্যাঙ্গারু সেদিন ভাগ্যে জুটল না। চলবে......
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।