আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জ্যোতি বসুর বাংলা

সাংবাদিক

ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত তলানি থেকে শীর্ষে শান্তনু দে আজ চাল, সবজি, মাছ উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম। আলুতে দ্বিতীয়, উত্তর প্রদেশের পরেই। দ্বিতীয় লিচুতেও, বিহারের পরে। ৩৩বছর আগে জ্যোতি বসু যখন প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তখন কিন্তু রাজ্যের এই ছবি ছিল না। সেদিন খাদ্যে ঘাটতি রাজ্য এখন উদ্বৃত্ত।

সেদিন রাজ্যে চাল উৎপানের পারিমাণ ছিল সাকুল্যে ছয় থেকে ৭মেট্রিক টন। আটের দশকেই তা ছাড়িয়ে যায় ১০মেট্রিক টনের লক্ষ্যমাত্রাকে। আর এখন তা আরও বেড়ে হয়েছে সাড়ে চোদ্দ থেকে ১৫মেট্রিক টনে। বামপন্থীই হোন, আর দক্ষিণপন্থী — যিনি যতই আড়াল করার চেষ্টা করুন না কেন, জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের এই সাফল্যকে অস্বীকার করবে কে? ১৯৭৩-’৭৪, মহাকরণে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেসের ‘সুবর্ণ যুগ’, গ্রামবাংলায় দারিদ্র্য সীমার নিচে মানুষের হার ৭৩.২শতাংশ। আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থায় উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, মহারাষ্ট্র।

এমনকি বিহার, ওড়িশাও। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে গ্রাম বাংলার তেইশ বছর। ২০০৪-’০৫, গ্রাম বাংলায় দারিদ্র্য সীমার নিচে মানুষের হার কমে ২৮.৬শতাংশ। বিহার, ওড়িশা তো বটেই, দারিদ্র্য সীমার নিচে মানুষের হার এখন উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, এমনকি মহারাষ্ট্রের চেয়েও কম পশ্চিমবঙ্গে। কে অস্বীকার করতে পারে এই মহার্ঘ সাফল্যকে? অন্তত, যোজনা কমিশন করেনি।

ভারতের যোজনা কমিশন প্রকাশিত একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সংক্রান্ত দলিলেই রয়েছে তার স্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ, অকপট স্বীকারোক্তি। নয়ের দশক। চাল উৎপাদনের নজরকাড়া সাফল্যই প্রসারিত হয়েছে বাগিচা চাষ, বিশেষত সবজি উৎপাদনে এবং মাছ চাষে। ১৯৯১-’৯২, ভারতে সবজি উৎপাদন যখন ৫৮.৫৩মেট্রিক টন থেকে দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ১২৫.৮৯মেট্রিক টন, তখন পশ্চিমবঙ্গে তা একলাফে বেড়েছে পাঁচগুণ। ৪.৬৮মেট্রিক টন থেকে বেড়ে হয়েছে ২২.৪৬মেট্রিক টন।

এবং আলু ছাড়িয়ে সবজির ঝুড়ি উপচে পড়েছে বেগুন, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ঢেড়সে। এবং এই চারটি সবজিতেই পশ্চিমবঙ্গ এখন এক নম্বরে। সেইসঙ্গেই, রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো বিকাশ হয়েছে সামুদ্রিক চাষে। নয়ের দশকের গোড়ায়, উৎপাদনের পরিমাণ যেখানে ০.৬মেট্রিক টনেরও কম, সেখানে এখন তা বেড়ে হয়েছে ১.৩মেট্রিক টন। ১৯৭০-’৮৩, পশ্চিমবঙ্গে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বিকাশের হার ছিল মেরেকেটে ০.৭শতাংশ।

আর ১৯৮৩-’৯৫, তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫.৪শতাংশে। পশ্চিমবঙ্গে কৃষির এই সাফল্য সাধারণ ‘বাজার’, কিংবা ‘রাষ্ট্র’ শক্তির ফসল নয়। সেসময় একলাফে উৎপাদন বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ডাকসাইটে বীজ কোম্পানি ছিল না। তাছাড়া, পাঞ্জাব, কিংবা হরিয়ানার মতো পশ্চিমবঙ্গ পায়নি সেচ, গ্রামীণ বিদ্যুতায়ণ, রাস্তা, কৃষির সম্প্রসারণ, প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও মান্ডির (হাট) সম্প্রসারণের জন্য বিপুল অঙ্কের কেন্দ্রীয় বরাদ্দ। বাংলার ‘সবুজ বিপ্লবে’ এই বাড়তি গতি যোগ করেছে আসলে ভূমিসংস্কার, অপারেশন বর্গা আর ত্রিস্তর পঞ্চায়েত, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের যুগলবন্দী।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ক্ষমতায় আসার অন্যতম ভিত্তি ছিল ভূমিসংস্কার আন্দোলন। ক্ষমতায় আসার পর জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের প্রশাসনিক কর্মকান্ডের মধ্যে সর্বপ্রথম যে বিষয়গুলি প্রাধান্য পেয়েছিল, তার অন্যতম ছিল ভূমিসংস্কার কর্মসূচী। গরিবের হাতে জমি, গরিরেব হাতে পঞ্চায়েত। কে অস্বীকার করতে পারে এই সাফল্যকে? সারা দেশে মোট যা জমি রয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে তার মাত্র ৩.৯শতাংশ। অথচ, গোটা দেশে ভূমিসংস্কার কর্মসূচীতে মোট যত জমি বন্টন করা হয়েছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই বন্টন করা হয়েছে ২২.৬শতাংশ।

আর ভূমিসংস্কার কর্মসূচীর ফলে তাবৎ দেশে যতজন উপকৃত হয়েছেন, তার অর্ধেকেরও বেশি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। অপারেশন বর্গা, যাতে ১৫লক্ষের ওপর ভাগচাষী, বর্গাদার পেয়েছেন জমির স্থায়ী ব্যবহারের অধিকার। জমিদার, জোতদাররা যাতে তাঁদের জোর করে উৎখাত করতে না পারেন, তার জন্য আইনী সুরক্ষার পাশাপাশিই নিশ্চিত করা হয়েছে ফসলের দামের চারভাগের তিনভাগ অংশ। সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পাওয়ার সুযোগ। এবং এটাই ছিল তাঁদের চাষের জন্য যথেষ্ট ছাড়ের সুযোগ।

নিট ফল, আটের দশকের গোড়ায় প্রতি হেক্টর জমিতে যেখানে ধাণ উৎপাদন হতো ২টনেরও কম, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩.৭ থেকে ৩.৮টন। সেচের সুযোগ — একফসলী জমিকে করেছে তিনফসলী। দু’ থেকে তিনফসলী জমির পরিমাণ ৪০শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৮০শতাংশ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।