আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'দৃষ্টির সীমানায় কবি শফিকুল ইসলাম'

"তার ও আগে বৃষ্টি নামুক আমাদের বিবেকের মরভূমিতে/ সেখানে মানবতা ফুল হয়ে ফুটুক, /আর পরিশুদ্ধ হোক ধরা,হৃদয়ের গ্লানি..."--শফিকুল ইসলাম

'দৃষ্টির সীমানায় কবি শফিকুল ইসলাম' --নিজাম ইসলাম কবি শফিকুল ইসলাম একজন সার্থক কবি। সার্থক কবির সকল লক্ষণই তার কাব্য সৃষ্টিতে বর্তমান। যাহা যথার্থ কবিতা, দিব্য কল্পনা যাহাকে জন্ম দিয়াছে, অকৃত্রিম ছন্দসৌন্দর্য তাহাকে বাহিরে ভূষিত করে এবং ভাবের গভীরতা তাহাকে অন্তরে পরিপূর্ণ করিয়া থাকে। তাহার আনন্দ কল্যাণকে আবাহন করে এবং সৌন্দর্যে তাহা জগতের নিত্যসুন্দর অনির্বাচনীয় শব্দার্থসমূহের সমতুল হয়। সাধারণভাবে সংক্ষেপে সংকেতস্বরূপে বলা যাইতে পারে যে, কবিতা অনির্বচনীয় সঙ্গীতের যত সদৃশ এবং যে কবিতায় পাঠক মানবজীবনের প্রসারতা যত অধিক অনুভব করেন তাহা তত শ্রেষ্ঠ।

যিনি কথার সাহায্যে একটি সুন্দর চিত্র অঙ্কিত করেন তিনি কবি; কিন্তু উচ্চতর কবি তিনি, যিনি শুধু চিত্রাঙ্কনে পরিতুষ্ট না হইয়া তাঁহার ছন্দের মর্মে মর্মে সঙ্গীতের অপূর্ব অপরূপ ঝঙ্কারগুলি আনিতে পারেন। যিনি জীবনের একটি সামান্যতম সত্যকে পরিষ্ফুট ও সুন্দর করিয়া তুলিতে পারেন তিনি কবি, কিন্তু উচ্চতর কবি তিনি, যাঁহার কবিতায় সমগ্র জীবনের সুগম্ভীর বিজয়গীতি শ্রুত হয়। যিনি সত্য ও ছন্দের সাহায্যে পাঠকের মনে আনন্দ সৃজন করেন তিনি কবি, কিন্তু উচ্চতর কবি তিনি, যাঁহার আনন্দ এত স্বাভাবিক ও যথেষ্ট যে পাঠক কণামাত্র আস্বাদন করিয়া বুঝিতে পারেন, আমি আগন্তুক মাত্র, আমার অপেক্ষা কবির নয়ন অশ্রুতে অধিক সমাকীর্ণ। আমার অপেক্ষা কবির হাস্য আনন্দে অধিক উদ্ভাসিত। উচ্চতর কবির এই সমস্ত লক্ষণই আমরা কবি শফিকুল ইসলামের যথেচ্ছ দৃকপাত দেখিতে পাই।

আমরা প্রসঙ্গক্রমে কবি শফিকুল ইসলামের যে সমস্ত পদ ও শ্লোক উদ্ধৃত করি তাহাতেই প্রমাণ করে, কবির কাব্য ছন্দের ঝঙ্কারে কি অপূর্ব সুললিত- তাহা যেন সঙ্গীতের আবেশে আপনা-আপনি গলিয়া পড়িতেছে। তাহা রসে মাধুর্যে অনির্বচনীয়। কিন্তু আমরা যে কবির জন্য উচ্চতম কবির সিংহাসন দাবি করিতেছি, যে কোন লক্ষণে নির্ভর করিয়া? আমাদের মনে হয় উচ্চতম কবি তিনি,- যাহাঁর কাব্য অতিমাত্র ব্যাপক, যাহা নিজে শান্তং শিবম্‌ অদ্বৈতম্‌। যাহার শিক্ষা- নাল্পে সুখমস্তি, যো বৈ ভূমা তৎ সুখম্‌। যাহা বিশ্বপ্রকৃতি ও বিশ্ব মানবের সহিত একাত্ম, যাহার মধ্যে জগতের নাড়ীস্পন্দন স্পন্দন স্পষ্ট অনুভূত হয়, যাহা সামান্যতা পরিহার করিয়া ভূমানন্দের অন্তরঙ্গ আত্মীয়রূপে প্রকাশিত হইয়া উঠে, যাহা মানবের মনকে আমিত্ব পরিহার করিয়া বিশ্বের দিকে প্রসারিত করিয়া দেয়, যাহা বিশ্বের ভিতর দিয়া মানব-মনকে বিশ্বেশ্বরের চরনপদ্মের অভিমুখীন করে।

বিখ্যাত ফরাশী সমালোচক স্যাঁৎ বিউবও প্রকারান্তরে এই কথাই বলিয়াছেন যে, ঈশ্বর, প্রকৃতি, প্রতিভা, কলাচাতুর্য, প্রেম ও মানবজীবন - প্রধানত এই ছয়টি শ্রেষ্ঠ কবিতার মূল উপাদান। বিশ্বকাব্যের অনাদি কবির লীলায় আমরা দেখিতে পাই Ethereal-কে Tangible- এর মধ্যে, Spirit-কে Matter- এর মধ্যে, অসীমকে সীমার মধ্যে ধরিয়া প্রকাশ করা। শ্রেষ্ঠ কবির গীতি কবিতাতেই সম্ভবপর। তাহাতে মানব-মনের সকল কালের ও সকল অবস্থার চিত্র পরিস্ফুট করিয়া তোলা যায়। কবি শফিকুল ইসলামের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম নয়।

কবি শফিকুল ইসলামের হাতে প্রকৃতির সকল বৈচিত্র সমাহৃত হইয়া কবির হাতে নূতন রূপে রূপায়িত হইয়া উঠিয়াছে। তুণাঙ্কুর ধুলিকণা শিশিরকণাটি পর্যন্ত নব নব শ্রী ও সম্পদ লাভ করিয়াছে। কবি পাঠকের মনেও সৃজনী-মাধুরীর প্রত্যাশা করিয়া তাঁহার সৃষ্টিকে ব্যঞ্জনাময়ী করিয়াছেন- ছবির আদ্‌রা আঁকিয়া কবি পাঠককে দিয়াছেন তাহার নিজের মনের রং দিয়া ভরিবার জন্য। কবি কবিতাকে নব নব রূপ দান করিয়াছেন। তিনি নিজের সৃষ্টিকে নিজেই অতিক্রম করিয়া নূতন রূপসৃষ্টি করিয়াছেন।

কবি নব নব ছন্দ আবিস্কার করিয়াছেন। তাঁহার বাগবৈভবে ও প্রকাশ ভঙ্গিমায় কবি মানসের যে একটি অভিনব রূপ তিনি প্রকাশ করিয়াছেন তাহা বিস্ময়কর। কবি শফিকুল ইসলাম তার কাব্যগ্রন্থ "তবুও বৃষ্টি আসুক" থেকে শুরু করে "মেঘ ভাঙা রোদ্দুর" "শ্রাবণ দিনের কাব্য" "একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি" "এই ঘর এই লোকালয়" সহ আরো কিছু কাব্যগ্রন্থে জগতবাসীর সৌভাগ্যক্রমে কবি প্রিয়ার কাঁকনস্পর্শে হাজার গীতে কবির কল্পনাটি ফাটিয়া পড়িয়াছে, নয়ন-খড়গে প্রেমের প্রলাপের বন্ধন ছিন্ন হইয়া গিয়াছে। এই প্রেম সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতি ও বিশ্বমানবকে বুকে করিয়া ভূমার দিকে পরম আনন্দে বহন করিয়া লইয়া গিয়াছে। সকল স্রষ্টার সৃজনীপ্রতিভা যে ভাবে ক্রমবিকাশ লাভ করে কবি শফিকুল ইসলাম প্রতিভার বিকাশও সেই ভাবেই হইয়াছে।

প্রথম যৌবনে অন্তর্গূঢ় প্রতিভার বিকাশ-বেদনা তাঁহাকে আকুল করিয়াছে-- তখন কুঁড়ির ভিতর কেঁদেছে গন্ধ আকুল হয়ে, তখন 'কস্তুরীমৃগসম' কবি আপন গন্ধে পাগল হইয়া বনে বনে ফিরিয়াছেন। প্রথম জীবনের রচনায় এই আকুলতার বাণী, আশার বাণী, উৎকন্ঠা, উচ্চাকাঙ্খা, সংকল্প, ক্ষনিক নৈরাশ্যে আত্মসাধনা, মহাসাগরের ডাক, বাধা বিঘ্নের সহিত সংগ্রাম ইত্যাদির কথা আছে। বাস্তবিক কবি শফিকুল ইসলামের সমস্ত রচনার মধ্যে এই সীমাকে উত্তীর্ণ হইয়া অগ্রসর হইয়া চলিবার একটি আগ্রহ ও ব্যগ্র তাগাদা স্পষ্টই অনুভব করা যায়। যাহা লব্ধ তাহাতে সন্তুষ্ট থাকিয়া তৃপ্তি নাই, অনায়ত্তকে আয়ত্ত করিতে হইবে, অজ্ঞাতকে জানিতে হইবে, অদৃষ্টকে দেখিতে হইবে- ইহাই কবি শফিকুল ইসলামের কথা। বৈদিক যুগে ইতরার পুত্র মহীদাস যেমন তূর্যকন্ঠে আহ্বান করিয়াছেন- চরৈবেতি, চরৈবেতি- চলো, চলো-- শফিকুল ইসলামও তেমনি করিয়া ক্রমাগত সীমা অতিক্রম করিয়া সকল বাধা উত্তীর্ণ হইয়া সুদূরের পিয়াসী হইয়া চলার বাণী ঘোষণা করিয়াছেন।

ফুল যখন ফুটিয়া উঠে, তখন মনে হয় ফুলই যেন গাছের একমাত্র লক্ষ্য, যেন সে বন-লক্ষ্মীর সাধনার চরম ধন। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে সে ফল ফলাইবার একটা উপলক্ষ মাত্র। খন্ডের মধ্যে সময়ের তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায় না। বর্তমান হইতেছে ক্ষুদ্র খন্ড ক্ষুদ্র-ভূত ও ভবিষ্যতের মধ্যে হাইফেন মাত্র। একাকী তাহার মধ্যে কোন তাৎপর্য নাই।

কিন্তু সমগ্র জীবন জীবন-অতীত বর্তমান ভবিষ্যত মিলাইয়া যে সমগ্র জীবন তাহার মধ্যে তাৎপর্য পাওয়া যায়। অনাদি কাল হইতে বিচিত্র বিস্মৃতি অবস্থার মধ্য দিয়া জীবনদেবতা কবিকে এই বর্তমান অবস্থায় উপনীত করিয়াছেন। কবি কাজ করিয়া যান, কিন্তু সেই কাজের মধ্যে খন্ড-পরস্পরার মধ্যে তিনি কোনো তাৎপর্য খুজিয়া পান না। কেবল তাঁহার অন্তর্যামী, যিনি তাঁহার ভূত ভবিষ্যত ও জন্ম-জন্মান্তর মিলাইয়া তাঁহাকে চালনা করিতেছেন, তিনিই তাঁহার সমগ্র জীবনের স্বার্থকতা বুঝিতে পারেন। জীবনদেবতা জীবনের ক্ষুদ্র স্বার্থ হইতে কখনো কখনো জীবনকে অন্য দিকে লইয়া যান, তখন লোকে ভাবে যে তাহার জীবন বুঝি ব্যর্থ হইয়া গেল, কিন্তু জীবনদেবতাই আবার সেই জীবনকে স্বার্থকতার মধ্যে ফিরাইয়া লইয়া আসেন, সমস্ত বিফলতার মধ্য দিয়া তিনি চরমের দিকে লইয়া যান।

কবি তখন নিজের মিলন ও বিরহের মধ্যে বিশ্বের মিলন ও বিরহ দেখিতে পান, তিনি জীবন দেবতার প্রেম দিয়া তাঁহার বিশ্ব প্রেমের রাগিণীর সাধনা করেন। যখন তিনি নিজের জীবনের সার্থকতা খুঁজিয়া পাইবেন, তখন জীবন দেবতার সহিত তাঁহার সম্পূর্ণ মিলন ঘটিবে-- তাঁহাদের মধ্যে কোনো বিভিন্নতা থাকিবে না, তখন কবি নিজের মধ্যেই জীবনের সুন্দরকে খুঁজে পাইবেন, তাঁহাকে আর অন্যত্র খুঁজিতে হইবে না। কারণ পূর্ণ সার্থকতা লাভ হইলে অন্বেষণের বিরাম হইবে এবং অন্বেষণ-বিরতির অর্থ-ই পূর্ণ সার্থকতা লাভ। কবি শফিকুল ইসলামের বেলায়ও প্রত্যেকটা পাতার শব্দ যথার্থ। কবির কাব্যগ্রন্থসমূহ পড়তে ভিজিট করুনঃ-- http://www.bbaria.com


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।