আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পক্ষ ও প্রতিপক্ষ

আমার আছে জল

‘জালাল আজ কয় তারিখ রে? হাবিলদার মওলার প্রশ্নে জালাল বলল, ‘বলা মুশকিল। না আছে ক্যালেন্ডার, না আছে ঘড়ি। ’ ‘তোরা একজনও কথাটা বলতে পারবি না?’ ‘কি করে বলবো মাওলা ভাই? খালি এটুকু মনে আছে যে হিলি স্টেশন থেকে সেই যে কানা রাতে বের হয়ে আসলাম ডিসেম্বর মাসের ওটা হয় ১১ অথবা ১২ তারিখ ছিল। এরপর তো আর আলোর মুখ দেখি নাই। ’ জালাল, কমান্ডারকে আর একটা কথা বলতে গিয়েও বলেনি।

কমান্ডার কথাটা ভয়ানক রকম অপছন্দ করবে। তাহলো একশ’ দশ টাকায় কেনা সিটিজেন ঘড়িটা গুলি লেগে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা। হিলি স্টেশনের বাইরে সবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটা পাক আর্মির ছোট একটা টহল দলের সামনে পড়ে ভুয়া পাসওয়ার্ড দিয়ে পাড় হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু একটু পরেই পাঞ্জাবী সুবেদার গালিবের সন্দেহ হলে সে গুলি চালায়। জালাল ছিল দলের সবার পেছনে।

কালভার্টটা মাত্র পার হয়ে বামে ঘুরে ওরা পালিয়ে যেতে পারলো কিন্তু জালালের বাঁ হাতের কব্জির উপর দিকটা গুলির আঘাত থেকে অলৌকিকভাবে মোটামুটি রা পেলেও ওতে ঘড়িটা চূর্ণ হয়ে যায়। এই কমান্ডার দলের সবাইকে প্রথমেই বলেছে, ‘আমার বাড়ির পাঁচজন মারা গেছে এই যুদ্ধে। কাজেই দলের কারো থেকে কোন হা হুতাশ, পিছুটান বা য়তির কথা শুনতে চাই না। আমরা পাঞ্জাবী হানাদারদের মারবো এবং নিজেরা মরা পর্যন্ত ওদের মারতে থাকবো। ’ গোলাম মাওলার পোস্টিং ছিল এবোটাবাদ-এ।

’৭০-এর ডিসেম্বরে ওর ইউনিট রংপুরে বদলী হয়। ছাবিশে মার্চ এগার পদাতিক ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত বাইশ পাঞ্জাবের অনেক বাঙ্গালীকে পাকিস্তানীরা নিরস্ত্র করতে পারলেও হাবিলদার গোলাম মাওলা ৮ জন সৈন্য নিয়ে অস্ত্রসহ পালাতে সক্ষম হয়। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বুরিমারী এলাকায় ওর দল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চালাতে থাকে। ও বিবাহিত। মাত্র তিন বছর বয়স বিয়ের।

বাড়ীতে স্ত্রী ছাড়াও বাবা-মা, চাচা-চাচী এবং এক ছোট ভাই ছিল। বাড়ীতে চিঠি লিখে ও দু’বার জানিয়েছে ও ভাল আছে। এপ্রিল মাসের কথা সেটা। কিন্তু ওকে উত্তর কোথায় দিতে হবে তা জানাতে পারেনি। তাই বাড়ীর কে কেমন আছে জানতে পারেনি।

তারপর পাঁচমাস পার হয়েছে। মাওলা বাহিনী এর মধ্যেই হানাদার বাহিনীর কাছে ঘুম তাড়ানিয়ার খ্যাতি অর্জন করেছে। এরমধ্যে একদিন ও ওর পাশের গ্রাম থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধা ফজলের কাছে বাড়ীর সবার খবর পেল। খবরটা ছিল এরকম। বারই এপ্রিল পাঞ্জাবী সৈন্যদের ছয়জনের একটি দল বুড়িমারী ক্যাম্প থেকে মাগরিব নামাজের একটু পর মাওলাদের বাড়ির উঠানে ঢুকে উর্দুতে মাওলার বাবার নাম ধরে ডেকে জানতে চাইলো।

‘গোলাম মাওলা কোথায়?’ বৃদ্ধ নিশান আলী বলল, ‘ওতো ডিউটিতে। ’ ‘হারামজাদা ঝুট বলতা, বাতা তেরা বেটা আওর উসকা হাতিয়ার কিধার হো?’ হ্যাঁ ইসলাম আর পাকিস্তান রার অগ্রসৈনিক, পিতার বয়সী একজন বৃদ্ধকে এ রকম সোহবতের সঙ্গেই প্রশ্নটা করছিল। নিরর নিশান প্রশ্নগুলোর অর্থও বুঝলো না। ঘরের ভিতর ঢুকতে যাচ্ছিল ছেলের লেখা দুটো চিঠি এনে সৈন্যদের দলনেতাকে দেখাবে বলে। তখনই ওর পিঠে একটা ব্রেনগানের চারটা গুলি ওকে ওখানেই ফেলে দিল।

এরপর পাঞ্জাবীরা আশেপাশে দাঁড়ানো মাওলার চাচা, মা, চাচী, বৌ এবং চাচাত ভাই-এরও একই অবস্থা করলো। এর আগেই পাশের বাড়ির উঠানে টর্চ লাইটের আলো এবং বিদেশী লোকদের উচ্চস্বরের কথা শুনে ফজলের সন্দেহ হয়। ও আস্তে করে বাড়িটার পেছনের আম গাছে উঠে পড়েছিল ঘটনা কি হয় দেখার জন্য। মাওলা এইটা পাস। বয়স ত্রিশ।

দল ত্যাগ করার এমন পরিণতি কল্পনা করেনি। দুঃসাহসী এবং দুর্ধর্ষ ও বরাবরই ছিল। ‘৬৫-তে ও যুদ্ধবন্দী হয়েছিল কাশ্মীর ফ্রন্টে। এক মাইল সুড়ঙ্গ কেটে ভারতীয় বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে ও সেবার মুজাফফরাবাদে অত ফিরে এসেছিল। ফজলের কাছে এ কাহিনী শুনে ওর প্রিতা আরও বেড়েছে।

তবে চেহারায় নেমেছে স্থায়ী মেঘের ছায়া। ‘আচ্ছা ট্রানজিস্টারটা সারাইতে পারলা না। ’ মাওলা এবার ছোলেমানকে প্রশ্নটা করে। ছোলেমান সিগনালের অপারেটর ছিল রংপুর ক্যান্টনমেন্টে। ‘না ওস্তাদ পারলাম না।

একটা স্ক্রু ড্রাইভারও সঙ্গে নাই আর যে বাড়ি খাইছে যন্ত্রডা। বোধহয় রিসিভারডা নষ্ট হইয়া গেছে। ’ মুক্তিবাহিনীর এই দলটাতে প্রথমে ৩৫ জন ছিল। হানাদার সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এখন এই সংখ্যা ১২তে এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর ইপিআর-এর সৈন্য আছে ৮ জন।

ট্রেনিং নেয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩ জন। এবোটাবাদ থেকে পরিচিত বেঙ্গলের সিপাই মন্তাজ বলল, ‘ওস্তাদ পাইপের মধ্যে যে ঢুকছি আর তো বাইর হইতে পারলাম না। আমি বর্তমান অবস্থা নিয়া একটা কথা কই। ’ দলটা হিলি থেকে বের হয়ে এসেছে কারণ হানাদার এবং মিত্র বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর সে সব জায়গায় মুক্তিবাহিনীর থাকার নিয়ম নাই। এরা তখন পাকবাহিনীর টহল থেকে প্রাণে বাঁচার জন্য সরে গিয়ে একটু পেছনের রাস্তার একটা সিমেন্টের ঢাকনা খুলে পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট-এর আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল।

তারপর কতক্ষণ গেছে কেউ বলতে পারছে না। ওদের মনে হচ্ছে আজ হয়তো তের বা চৌদ্দ হবে। বাইরে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। মাওলা বলল, ‘বল তোমার কথাটা কি?’ রেডিওতে সব শেষে শুনছিলাম হানাদাররা এখন পালাইয়া ওগো বড় ইউনিটগুলোর সঙ্গে একত্র হইতেছে, কারণ এখন নিয়মিত যুদ্ধ চলতেছে। তাই তাগো ধরনের এখনই সময়।

ইউনিয়নে, গ্রামে, গঞ্জে আর হাটেবাজারে এই ছোট ছোট দলগুলিই মানুষরে বেশী অত্যাচার করছে বইলা শুনছি। ’ ‘চিন্তাটা আমার মাথায়ও আছে কিন্তু রেকি না করে তা করা যায় না। স্বেচ্ছায় তোমাদের মধ্যে যদি কাজটা কেউ করে বলে যে এখান থেকে বের হয়ে আমরা কোনদিকে যেতে পারবো তাহলে হয়তো ওরকম প্ল্যান করা যায়। ’ মাওলার কথাটা ঠিক। কারণ রেকি করার নামে কেউ যদি বের হয়ে আর ফিরে না আসে তাকে বাধ্য করা যাবে না ফিরতে।

এলেম বয়াতী নামের একজন সিপাই কথাটা শুনে এগিয়ে আসে। ও ওয়াগাহ সেক্টরের কাছে নানগড়ে এই কাজটা করেছিল পঁয়ষট্টির যুদ্ধে। ঘন্টা ছয়েক পর ও ফিরে এসে রিপোর্ট করে। ওর বাড়ি এই থানাতেই। এর প্রতিটি ইউনিয়ন এবং হালট ওর মুখস্থ।

রিপোর্টের শেষ অংশে ও বললো এখানকার সব পাকিস্তানী সৈন্যরা এখন দিনাজপুর শহর এবং হিলির দিকে যাচ্ছে। ও আরও জানালো আজ ডিসেম্বরের চৌদ্দ তারিখ। সন্ধ্যা থেকে যুদ্ধবিরতি আরম্ভ হবে বলে ওর এক পরিচিত সোর্স ওকে নিশ্চিত করেছে। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে মিত্র বাহিনী। সব শুনে মাওলা বললো, ‘বেশ তাহলে চল, আমরা শেষ রাতে বের হই।

’ এটা নীলকুঠি ইউনিয়ন। ইউনিয়ন কাউন্সিলের সড়ক এড়িয়ে শুকনো খালের পাশ দিয়ে ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে মাওলার দলটি এগোতে থাকে। অগ্রহায়ণের প্রচন্ড শীত তার ওপর পরনে অনেকেরই সোয়েটার পাতলা। হাতের অস্ত্র আর গুলির ওজনও কম নয়। ভোর হয়ে আসছে।

শীত বেড়ে চলেছে। অনেকক্ষণ পর পর সবুজ রং এর দু’ একটা বড় লরী দূরের ইটের রাস্তা ধরে দিনাজপুরে দিকে এগিয়ে চলেছে। কেউ কেউ দলনেতার সঙ্গে দৃশ্যটা নিয়ে আলাপ করে। মাওলা বলে, ‘না এগুলো নয়। ’ এখন ওরা যেখানে এসেছে বেশ কিছু ঘরবাড়ি আছে।

টিনের বেড়ার এখন কুঁড়ে ঘর মিলিয়ে অন্ততঃ পঞ্চাশটা বসতি। এই গ্রামটার নাম ডাহুক। খেজুর গাছ আছে এখানে বেশ। ওরা একটা চায়ের দোকানে বসে। দোকানী চায়ের পানি গরম করছে।

ওপরে কাঁচের বৈয়মে লাঠি বিস্কুট। চা খাওয়া হলে রমজান এক টাকার একটা নোট বের করে। দোকানী মুচকি হেসে বলে- ‘আপনাদের চিনতে পারিছি। দাম লাগবে না। ’ আশেপাশে কেউ নেই, তাও ফিস ফিস করে বলে, ‘যুদ্ধে যেতি পারিনি।

অন্ততঃ এইটুকু করতি দিন। ’ এখলাস নামের এই দরিদ্র লোকটা মুক্তিবাহিনীকে চা বিস্কুট খাইয়ে নিজের পকেট থেকে এ পর্যন্ত একশ পঞ্চাশ টাকা ব্যয় করেছে। আর সময়টা এখন এমন যে এক ভরি সোনার দাম একশ ত্রিশ টাকা। ওরা আবার পথে নামে। এই পথটা গ্রামের ভিতর দিয়ে পাশের একটা খালের ঘাটে গিয়ে শেষ হয়েছে।

খালের ওপরে আর একটা ইউনিয়ন আরম্ভ হয়েছে। খালটায় অল্প পানি। দশ পা সামনে এগোতেই মাওলা চাপা স্বরে বলে, ‘সব হুশিয়ার। অস্ত্রে হাত। ’ ওর গলাটা এখন পুরোপুরি পেশাদারী।

মাফলার পরা মাথায় সবার মধ্যেই এতক্ষণে যে একটা জড়তা ভাব ছিল তা মহূর্তে চলে যায়। ওরা সামনে তাকায় এবং বাঁ দিকে সরে গিয়ে একটা ঘন ঝোপের আড়ালে দাঁড়ায়। সবার হাত ট্রিগারে। পাঁচজন মানুষ খালটার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষগুলো দুদিকে তাকালো তারপর পানিতে নামলো।

সবার পরনে খাকী। মাথায় সবুজ হেলমেট। গলায় মাফলার হাতে এবং পিঠে হাতিয়ার। নেমেই সবাই দু’হাত দিয়ে মুখে তুলে অনেকক্ষণ পানি খেতে থাকলো। এবার ওরা এপারের দিকে আসছে।

খুব ধীরে এপারে এসে উঠলো। এবং উঠেই প্রায় ধুলোর মধ্যে বসে পড়লো। কুয়াশা থাকলেও দৃশ্যটা কাছের তাই মাওলার দল সবকিছু দেখতে পাচ্ছে। খাকীদের চোখে মুখে পৃথিবীর সব ক্লান্তি। ওরা পাঞ্জাবীতে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, মাওলা তাও শুনতে পেলো।

‘আর চলা সম্ভব না। ক্লান্তিতে মরে যাচ্ছি। ওয়্যারলেস করলাম কতবার। আমাদেরকে নাকি নেওয়া সম্ভব না। হায় খোদা রহম কর।

’ এদের মধ্যে একজন বললো, ‘সরদার সাহাব; হাতিয়ার আর টানতে পারছি না। ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। তাতে ওজনটা একটু কমতো। ’ আর একজন উর্দুতে বললো, বেশি বেলা হয়নি চল কোন জঙ্গলে লুকাই। এই মহল্লার মানুষ যদি আমাদের অবস্থা বুঝতে পারে তাহলে যে কি হবে খোদা মালুম।

’ সরদার সাহেব মানে দলনেতা বলল, ‘উল্লুকের মত কথা বলো না। যতক্ষণ হাতিয়ার সঙ্গে থাকবে ততক্ষণই জানে বাঁচবার আশা। হাতিয়ার নাই অনুমান করতে পারলে আশেপাশের বেঈমান মালাউন বাঙ্গালীর বাচ্চারা আমাদের শেষ করে ফেলবে। তোমরা ফৌজে ভর্তি হলে কি করে তাই ভাবছি?’ কথাগুলো শুনে মাওলার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। ট্রিগারের ওপর হাত শক্ত হয়ে ওঠে।

কষ্টে নিজকে নিয়ন্ত্রণ করে। সৈন্য পাঁচজন এর মধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। রাস্তা ছেড়ে ওরা বাঁ দিকে যাচ্ছে। ওপাশটা গাছে ভরা। ‘ওস্তাদ,’ রমজানের কথায় মাওলা সবাইকে চুপ থাকতে বলে।

দলটি এখন ঝোপের ভেতর গিয়ে বসেছে। ওরা পিঠের সঙ্গে বাধা হ্যাভারস্যাক খুলে সেখান থেকে সামান্য পাউরুটি আর চিড়া বের করে একটু একটু করে চিবোতে থাকে। দলনেতা সাককু হেকমত উল্লাহ খান পদে হাবিলদার মেজর। কাপুরুষতার জন্য অধীনস্থদের বকা দিলে কি হবে সে নিজেও আসলে কান্তিতে ভেঙ্গে পড়েছে। বার ঘন্টা পর এই দলটি মুখে কিছু দিচ্ছে এবং এই খাদ্য এদের শেষ রিজার্ভ।

এরা ছিল ফুলবাড়ীতে নয় পাঞ্জাবের একটা ইউনিটের অংশ। বার তারিখে মিত্র বাহিনীর প্রচন্ড গোলাবর্ষণের পর থেকে মূল ইউনিট সদরের দিকে চলে যেতে পারলেও এরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পথঘাট চেনা নেই। রাজাকাররাও সব পালিয়ে গেছে। অনুমানের ওপর এরা সেই থেকে পথ চলছে।

মাওলার দলটা ছাড়াও ওদের অজ্ঞাতে আর একদল মানুষ এদেরকে দূর থেকে দেখছিল। এরা এই গ্রামবাসী। বেলা বাড়ছিল, গ্রামবাসীর সংখ্যাও বাড়ছিল। এদের সামান্য খাবার যখন প্রায় শেষ তখন ওরা ব্যাপারটা বুঝতে পারলো যে আশেপাশের কিছু মানুষ ওদেরকে দেখছে। সাককু পানি আর সামান্য চিড়া খেয়ে একটু শক্তি ফিরে পেয়েছে।

তবে তা অস্ত্র তাক্ করার জন্য যথেষ্ট নয়। তারপরও সে সৈন্য তাই ত্রিশ গজ দূরে দাঁড়ানো বল্লম হাতে একজন গ্রামবাসীকে উদ্দেশ করে বলে ফেলল ‘হঠ যাও, গোলী মার দিওংগা। ’ এর মধ্যে ওদের দলের সবাই একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছে। সবাই ঝোপের ওপাশে মাঠের দিকে চলা শুরু করলো। বল্লমধারীর পাশে এখন আরো দশ জন মানুষ জমায়েত হয়েছে।

প্রায় সবার গায়ে চাদর, হাত ভেতরে লুকানো। ওদিকে দুর্বল হাতে হাতের আগ্নেয়াস্ত্র উঁচুতে তুলে ধরার চেষ্টা করতে করতে সাককুর পেছন পেছন চারজন সৈন্যও আস্তে আস্তে এগুতে থাকলো। এবার গোলাম মাওলা তার দল নিয়ে এদিকে থেকে এগাতে থাকলো। এদেরও সবার মাথায় হেলমেট। মাওলার দলটা চোখে পড়তেই সাক্কু পেছন ফিরে বলল, ‘তোম লোক হাম লোককো পিছা কিউ কারতা হ্যায়?’ মাওলা পরিষ্কার উর্দুতে বলল, ‘সাক্কু আমার দিকে ভাল করে দেখ।

’ জন্মস্থান থেকে এগারশ মাইল দূরে এক অজ্ঞাত গ্রামে নিজের নাম শুনে তিনদিন ধরে না ঘুমানো এবং প্রায় অভুক্ত হাবিলদার মেজর সাককু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। কিন্তু ওর চোখ খুব বেশি ভাল। সঙ্গে সঙ্গে মাওলার দিকে তাকালো এবং উঠলো, ‘আরে ইয়ার গোলাম মাওলা! ২২ পাঞ্জাব না?’ কুয়াশা, শীত, স্বপ্ন, দ্বিধা আর বাস্তবতার এক ঘোরের মধ্যে মাওলাকে চিনতে পারছে ও। ওর চোখে এখন ডুবন্ত মানুষের মনে খড়ের স্বপ্ন। ‘হ্যাঁ মাওলাই তবে ইয়ার নয়।

এখন দুশমন। ’ মাওলার উত্তরে সাককুর চোখের স্বপ্ন মিলিয়ে যেতে থাকলো। ওদিকে এই দু’জনের কথোপকথন পেছনে দাঁড়ানো গ্রামের লোকেরা শুনতে পায়নি। বল্লমধারী লম্বা বলিষ্ট মানুষটির পাশে মানুষের সংখ্যা বেড়ে এখন ত্রিশে দাঁড়িয়েছে। সবার হাতও চাদরের নীচে থেকে বের হয়ে এসেছে।

তাদের হাতে ট্যাটা, দাও, হাঁসুয়া, রামদা, শাবল এবং একজনের হাতে একটা দেশী বন্দুক। এরা যে কখন দলে ভারী হয়ে গেছে তা মাওলাও টের পায়নি। মাওলা আর সাককুর কথোপকথনের মধ্যে বন্দুকধারী লোকটা এবার সরাসরি মাওলার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো। ‘আপনি কে, সঙ্গে কারা? এদের সঙ্গে এত কথা কি?’ প্রশ্নটা করলেও একই সঙ্গে মাওলা ও তার বাহিনীর অত্যাধুন্কি এবং ভারী আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর দিকেও সে সমীহ ভরে তাকালো। ‘আমরা মুক্তিবাহিনী, বেংগল রেজিমেন্টের।

’ ‘কিন্তু কার্যকলাপে তা তো মনে হচ্ছে না। এদেরকে এখনও কিছু করেননি কেন?’ ‘না জেনে কথা বলবেন না। ক’জন খান সেনা মেরেছেন? এই অবস্থায় না পেলে এদের কাছে যেতে সাহস পেতেন কিনা সন্দেহ। আমরা তা নই। মার্চ থেকে এদেরকে সামনা সামনি যুদ্ধে মেরে আসছি।

আপনি কি চান নিজেদের মধ্যে মারামারি করি? রাজাকার মনে করলেন আমাদের?’ মাওলার গর্জে ওঠায় বল্লমধারী একটু দমে গেল। বুঝলো এই লোকটা অতিশয়োক্তি করছে না। এর মধ্যে পেছনের জনতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সাককুর বাহিনী আসলে ঘেরাও হয়ে গেছে। মাওলা বুঝতে পেরেছে ওর বাহিনী এত কাছে না থাকলে সাককুর বাহিনীর উপর এই দেশী অস্ত্রের ব্যবহার অনেকণ আগেই শুরু হয়ে যেতো।

বন্দুকধারী এবার বলল, ‘কি করতে চান এখন এদের নিয়ে?’ ‘বিচার। ’ ‘এরা কি আমাদেরকে কোন বিচার করে মেরেছে গত ন’মাস? মুসলিম লীগ আওয়ামী লীগ পার্থক্য করেছে? হিন্দু মুসলমান বিচার করেছে?’ ‘দেখেন, আমার বাবাসহ পাঁচজন এ যুদ্ধে মারা গেছে। তারপরও একটা কথা বলি। এদেরকে অন্ততঃ জিজ্ঞেস করেন বাড়ী কোথায়? পাঞ্জাবী না হলে এরা হয়তো সবাই খুন খারাবী করেনি। আর্মিতে আমার চাকরি এগার বছর ধরে।

এরা বালুচ, পাঠান বা সিন্ধী হতে পারে। ’ জনতা এর মধ্যে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। তাদের ভেতর থেকে ধনি শোনা যাচ্ছে। ‘কিসের অত কথা? ধর শালাদের। ’ বন্দুকধারী এবং বল্লমধারী হাত উঁচিয়ে এদের শান্ত করলো।

বন্দুকধারী, মাওলা এবং বেঙ্গলের তিনজনকে নিয়ে সাককুর কাছে এগোতেই সাককু দুর্বল হাতে ওর বার কেজি ওজনের বেরেটা সাব-মেশিনগান থেকে গুলি করার চেষ্টা করলো। আসলে গুলি এদের ছিল বাড়ন্ত। তাই মাত্র একটা গুলি বের হয়ে আকাশের দিকে উঠে গেল। গুলি বেশি থাকলে এরা অনেক আগেই গুলি করতো। এত কথার মধ্যে যেত না।

বল্লমধারী দিনাজপুর সরকারী কলেজের অংকের লেকচারার। সে বলল, দেখ আমরা তোমাদের সঙ্গে ভাল আচরণ করছিলাম। তার বিনিময়ে গুলি করলে? যা হোক তবুও ‘বাতাও তোমহারা মোকাম কিধার হো?’ ‘মাগরেবী পাকিস্তান মে। ’ ‘আরে সেতো জানা কথাই ‘ডিসট্রিক্ট বাতাও। ’ সাককুর বাড়ী কোথায় মাওলা ভালভাবে জানে।

তা সত্ত্বেও মনে মনে বলল, ‘ইস যদি একটু বুদ্ধি করে উত্তরটা দেয়। মাওলা ঠিক নিশ্চিত নয়। এরা কোন বাঙ্গালীকে মেরেছে কিনা। কারণ সাককুকে ও দশ বছর ধরে চেনে। সাককু একান্ত ধার্মিক।

কিন্তু ও প্রশ্নটার তাৎপর্য বুঝেনি। তাই দুর্বল কণ্ঠে বলল, মন্টগোমারী। ’ একে একে সবাইকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলো। উত্তরও পাওয়া গেল। একজনের বাড়ী ঝিলাম, একজনের ক্যাম্বেলপুর এবং আর একজনের লায়ালপুর।

সবার শেষে যাকে জিজ্ঞেস করা হলো সে বয়সে সবার চেয়ে ছোট। কিন্তু ও এত বেশী ক্লান্ত ছিল যে মাঠের মধ্যে নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাকে ডেকে তোলা হলো। ভেজা বুট ও ময়লা ইউনিফর্ম নিয়ে ও মাঠের ওপর উঠে বসল। ও জানালো ওর বাড়ী গুজরাট।

তবে এ গুজরাট ভারতের নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের। ওর নাম মালিক শাকিল মাহমুদ। শুধু এ এলাকায় নয়, সারা পশ্চিম পাকিস্তানেই গজনীর সুলতান মাহমুদের নাম অত্যন্ত জনপ্রিয়। জন্মের আগেই মারা যাওয়া এই শিশুর নাম রাখা হয়েছিল সেই স্বপ্নপুরুষের নামে।

মালিক শাকিল মাহমুদের ইউনিফর্মের কলার টেনে ধরে অংকের লেকচারার এবার জিজ্ঞেস করল, ‘বল তুই কত মানুষ মেরেছিস? আর কটা মেয়েলোককে বেইজ্জত করেছিস?’ শিশুকাল থেকে চোস্ত গুরুমুকী বলা ১৯ বছরের সিপাই শাকিল প্রশ্নগুলোর অর্থ না বুঝলেও পরিবেশের অর্থটা বুঝতে পেরেছে। ও খুব দুর্বল কণ্ঠে বলল, ‘গত তিনদিন কিছু খাইনি। ঘুমাইনি। আমার মা’র কথা মনে পড়ছে। আমি কাউকে মারিনি।

মুঝে মাত মারো। ’ জনতা এই প্রশ্নোত্তরের অর্থ না বুঝলেও পশ্চিম পাকিস্তানের ভূগোল, প্রশ্নকারীর ক্লাস নাইন ও টেন এ অবশ্য পাঠ্য ছিল। এ সবগুলো জেলাই পশ্চিম পাঞ্জাবে। মোঘল ও গ্রীকদের বংশধর এই দুর্ধর্ষ পুরুষদের বৃটিশরা সৈন্য হিসাবে খুব পছন্দ করত। পাকিস্তানের শাসকরাও এই ধারা অব্যাহত রেখেছে।

প্রশ্নকারী এবার মাওলাকে বলল, ‘নিজ কানে শুনলেন তো?’ পেছনের মানুষগুলো এই প্রচন্ড শীতের মধ্যে এতক্ষণ বল্লমধারী এবং বন্দুকধারীর ইঙ্গিতের জন্য অপেক্ষা করছিল। এবার তাদের হাতের অস্ত্রগুলো ইউনিফর্মধারী মানুষগুলোর উপর নেমে এল। একটু পরেই সাককুর দুটো চোখ শিশির ভেজা মাঠের উপর ছিটকে পড়ল। এরকম দৃশ্য দেখা একজন ভাল মানুষের জন্য খুব আনন্দের নয়। মাওলা তেমনি একজন ভাল মানুষ।

তারপরও দীর্ঘদিনের সহকর্মীর বিকৃত লাশটা দেখতে দেখতে মুহূর্তের জন্য মন খারাপ লাগলেও গোলাম মাওলার চোখ নিজের বাবা-মা, স্ত্রী, চাচা ও ভাইয়ের স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এবার একটি সড়কি উপর থেকে নেমে এসে শাকিলের বুককে দু’টুকরো করে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ওর হাতছাড়া লাল রংয়ের সোয়েটারকে বেশ খানিকটা ভিজিয়ে দিল। এই সোয়েটারটা গত ডিসেম্বরে ওর মা’র হাতে বুনোনো। দিলীপ কুমারের মত সুন্দর চেহারা আর ফর্সা রংয়ের এই মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে মাওলা অস্ফুটে বলল, ‘হায়, আল্লাহ যারা যুদ্ধ লাগালো তাদের বিচার কবে হবে? সামান্য সেপাই এর বিচার এত দ্রুত হচ্ছে?’ দুটো কালো মোষ মাঠের একটু দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইল।

স্বজাতির জবাই করা শরীর বা রক্ত চেনার বুদ্ধি প্রকৃতি এদেরকে দেয়নি। তাই তারা বুঝতে পারলো না মানুষগুলো এখানে এই সাত সকালে কি করছে। কেনই বা করছে? সূর্য-এর মধ্যে উপরে উঠেছে। দিনাজপুরের এই প্রত্যন্ত ইউনিয়ন থেকে অনেক দূরে গুজরাটের আদিল মোহাম্মদ খান গ্রামে সকাল তখন ছ’টা। সময় এখানে পূর্ব পাকিস্তান থেকে এক ঘন্টা পিছিয়ে থাকে।

নিজের বাড়ীর উঠান ঝাঁট দিতে দিতে মাহমুদের মা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছেলের লেখা ৩০শে নভেম্বরের চিঠির কথা ভাবছিলেন। ছেলে ভাল আছে। ওখানে শীত পড়ায় আর কোন অসুবিধা হচ্ছে না। ঝাঁট দেয়া শেষ হতে হতে তার মনে একটা মিষ্টি মুখ ভেসে উঠলো। মুখটি পাশের তহশীলের সরদার আফজাল খান শরীফের কন্যা রিম্মিন খান এর।

এই মেয়েটির সঙ্গে ছেলের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যুদ্ধ শেষে ছেলে ফিরলেই এই শুভ কাজটা সেরে ফেলতে দু’পক্ষ একমত হয়ে আছে। তিনি গত সন্ধ্যায়ও প্রতিবেশির রেডিওতে শুনেছেন ওখানে পাক বাহিনী নিশ্চিত বিজয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। খারাপ মানুষ সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সময় ও প্রতিষ্ঠান খারাপ মানুষকে আরো খারাপ হবার সেই সুযোগ করে দেয়।

১৯৭১ তেমনি একটা সময়। এসব গুরুতর কথা একজন ভাল মানুষ হাবিলদার এর পে বোঝা সম্ভব নয়। আবার সময় ভাল মানুষকেও আরও ভাল করে। চা বিক্রেতা এখলাস তেমনি একজন ভাল মানুষ। তাই হাবিলদার মাওলার দ্বিধা কাটলো না।

ও বুঝতে পারেনি ওর অনেকদিন ধরে চেনা ধর্মভীরু সাককু খান এই ১৯৭১ এ অনেক বদলে গেছে। তবে ও না জানলেও নিজের জননীর জন্য দরদ দেখানো শাকিলসহ সাককুর এই দলের পাঁচ জনের মনে পড়ে গেল ওরা গত ন’মাস এখানে শুধু মুসলমানই হত্যা করেনি, মুসলিম হিন্দু নির্বিশেষে নারীদের অসম্মানও করেছে। কিন্তু তার জন্য জীবনের শেষ মহূর্তেও ওরা কি অনুতপ্ত হলো?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.