আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ সাধাসিধে অলৌকিকতা

কত কিছু যে করতে চাই, তবুও কিছু করতে না পারার দায়ে মাথা খুঁটে মরি ।
আকমল সাহেবের দিকে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। উনি কাউকেই কিছু বললেন না। পরিচিত একজন মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে। উনাকে একেবারে কিছু না বলে গেলে ব্যাপারটা হয়ত খারাপ দেখায়।

তাই আস্তে করে উনাকে বললেন, “ ভাই হঠাৎ মনে হল প্রেশারটা বেড়ে গেছে। যে কোন সময় পড়ে যাবো হয়ত। তাই চলে যাই বরং। ” ইয়া বড় মাঠ। মাঠটা স্কুলের।

মাঠার চারপাশ ঘিরে বড় বড় সাইকাস গাছ। মাঠটা পুরোটাই সিমেন্টে বাঁধানো। ঢাকা শহরের বড় বড় স্কুলগুলোর মধ্যে গণনা করা হলে এর অবস্থান সামনের দিকেই হয়ত থাকবে। প্রতিবছর এখানেই ঈদের নামায পড়ানো হয়। পাশের মসজিদেও ঈদের নামায পড়ায়, তবে এখানেই বেশি লোকেয় জমায়েত।

কারণ জায়গাটাও বেশি আর ঈদগাহ হিসেবে জাকজমকটাও এখানে ভালই হয়। এবারের ঈদের জৌলুসটা যেন আরও একটু বেশি। সিটি কর্পোরেশন থেকে কিছু বরাদ্দ পেয়েছে ব্যবস্থাপনা কমিটি। ঈমাম সাহেব বয়ান করছিলেন, “ আল্লাহর নবী ইব্রাহীম (আ) তখন তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু, তার ছেলে , নূরানী চেহারার ছেলেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানী দেয়ার নিয়্যাত করলেন। বলেন সুবহানাল্লাহ।

” সামনের মুসল্লীরা সমস্বরে বলে উঠলেন, “ সুবহানাল্লাহ। ” আকমল সাহেব তখন থেকেই কেমন যেন উসখুশ করছিলেন। ইমাম সাহেব দাড়িতে হাত বুলিয়ে সবাইকে দেখে আবার শুরু করলেন, “ আল্লাহপাক বলেছেন উনাকে, উনার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কুরবানী দিতে। আল্লাহর আদেশ উনি পালন করতে গেছেন। আর উনার ছেলেও রাজী।

ভেবে দেখেন একবার, কেমন আল্লাহভক্ত ছেলে ! ছেলেকে উলটা করে শোয়ালেন তিনি। আর গলায় ছুড়ি চালালেন। ” ইমাম সাহেব আরেকটু থেকে আবার বলতে লাগলেন, “ আকাশ বাতাস সমস্ত সৃষ্টি হায় হায় করতে লাগল। ছুরি আর চলে না। কোন কিছু কাটে না।

ছেলে ইসমাইল(আ) বললেন উনাকে যেন ছুরি আরও ধার করে। দেখেন কেমন আল্লাহভক্ত ছেলে ! এই ছেলে ইব্রাহীম(আ) জন্ম দিয়েছেন সেই বুড়ো বয়সে। একটা শিশুর জন্য অনেক দুয়ার পরে উনাকে পেয়েছিলেন। আজ আকাশ বাতাস মাটি আর আল্লাহপাকের সমস্ত সৃষ্টি এই শিশুর দুঃখে কেঁদে উঠতে লাগল। আল্লাহর কাছে এই শিশুর জন্য দুয়া করতে লাগল।

বলেন সুবহানাল্লাহ। ” সমস্যাটা হল এখানেই। হঠাৎ করে আকমল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আসলে এসবের কোন মানে হয় না, আর এসব কথার মাঝে বসে থাকাও সম্ভব না। এখন ঈদের নামায পড়তে এসে নামায না পড়ে সবার মাঝে থেকে উঠে চলে যেতে কেমন যেন লাগে।

তাছাড়া ইমাম সাহেবও উনাকে কী মনে করবে ! তাও আকমল সাহেব উঠ চলে এলেন। ভাবছিলেন বড়ো ভাইয়ের বাসায় একবার যাবেন নাকি ! তিনি আর তার বড় ভাই মিলে একটা গরু দিচ্ছেন এবার। ঘরে যপতদিন খান, বড় ভাইয়ের ঘরেই খাওয়া হয়। নিজের ফ্লাটটাও খুব দূরে না। এখন সেদিকেই আগাচ্ছেন।

উনার ফ্লাটটা এখন অবশ্য খালিই পড়ে থাকে। মানে উনি শুধু রাতের বেলা যেয়ে ঘুমান। আর সারাদিন অফিস আর অফিস শেষে অফিসার্স ক্লাবে একটু বসেন। মাঝে মাঝে পাগলা পানিও চলে কয়েক গ্লাস। আসলে আকমল সাহেবের মত ছাপোষা মানুষকে কিন্তু এসবে মানায় না।

উনি খুব যে আহামরী ধনী তাও না। কিন্তু টাকা খরচ করতে উনার টান লাগে না কোন। ছাপোষা ভদ্রলোক বলেই হয়ত অল্পতেই টাল হয়ে যান। তখন নাকি কান্নাকাটি করেন। মাঝে মাঝে চুপি চুপি কখনও বা হাউমাউ করে।

কিন্তু টাল মাটাল হয়ে কেউ কখনও তাকে হাসতে দেখেনি। মানুষ এসময় কাছাকাছি খুব একটা আসে না। কেউ কাছে আসলে তার হাত ধরে বলতে থাকেন, “ ছেলেটার হার্টের অসুখ ছিল। না জানি তখন কত ভয় পাইছে। ” ভদ্রলোককে আসলে এসবের পর আর কেউ ঘাটায় না।

উনার স্ত্রী আর একটা মাত্র ছেলে বাস এক্সিডেন্টে মারা যায়। বছর দুয়েক আগে ঈদুল ফিতরের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন সপরিবারে। অফিসের কাজে উনি দুইদিন আগেই ঢাকায় এসে পড়েন। ছেলে আর স্ত্রী রওনা দেন পরে। নরসিংদি থেকে আসার সময় একটা খাদে উলটে পড়ে যায় বাস।

খাদের নিচে খালের পাড়ে প্রচুর কাঁদা থাকায় বাসটা ভেঙ্গে যেয়ে ব্লাস্ট হয় নি। একেবারে অক্ষতই ছিল। কিন্তু অর্ধেক পানিতে আর অর্ধেক কাঁদার নিচে একেবারে ডেবে যায়। নয়ঘণ্টা পড়ে সেই বাস উদ্ধার করার চেষ্টা করে উদ্ধারকারী দল। আকমল সাহেব এসে পৌঁছান এক্সিডেন্টের তের ঘণ্টা পর।

৩০ জনের মাঝে ২ জন শুধু বেঁচে গিয়েছিল। কাঁদার দিকে যারা ছিল তারা বড় কষ্টে মারা গেছে। এই মৃত্যু বড় কষ্ট। আসলে মৃত্যুরও সময়ে কত শত রকমফের দেখা দেয়। আকমল সাহেবের স্ত্রী আর ছেলে ছিল বাসের যেটুকু কাঁদায় পড়েছিল তার শেষ অংশে।

ছেলেটা ছিল বাসের শেষ সিটে। এই সন্তান আলমল সাহেবের অনেক বেশি বয়সের সন্তান। অনেক সাধ্য সাধনার পরে সাত বছর আগে উনার বাচ্চা হয়। সৌম্য। সৌম্য আর তার মা মারা যায় এই এক্সিডেন্টে।

আকমল দম্পতির বেশি বয়সের সন্তান বলেই হয়ত সন্তানের কিছুটা দৈহিক অপূর্ণতা রয়ে গিয়েছিল। সৌম্যের ছোট বেলা থেকেই হার্টের সমস্যা। আর, বেশ ভাল সমস্যা, খুব ভোগাত ছোট বেলায়। যদিও পাঁচ বছর বয়সের পরে ভোগানোর মাত্রা একটু কমেছিল কিন্তু ছেলেটা মাঝে মাঝে বেশ কষ্টে পড়ে যেত। সেই বাসের হেল্পার বেঁচে গিয়েছিল।

একমাস নাকি কোমায় ছিল। এরপর একদিন হঠাৎ হাসপাতাল থেকে হারিয়ে যায়, ডাক্তারদের ভাষায় পালিয়ে যায়। আকমল সাহেবের খুব ইচ্ছা উনি সেই হেল্পারকে একটা ব্লাঙ্ক চেক দেবেন আর বলবেন, “তোর গালটা এগিয়ে দে। মনে সুখে শুধু একটা থাপ্পড় মারি। “ চিন্তাটা এত সুশীল পর্যায়ে থেমে থাকে না নিশ্চয়ই।

প্রায়ই এটা গড়ায় মনে মনে সেই হেল্পারকে খুন করে ফেলার প্ল্যান পর্যন্ত। উনার কল্পনায় শুধু ভাসে উনার ছেলের চোখ ভরা আকুতি। ছেলেটার হার্টের অসুখ ছিল। ছেলেটা হয়ত মার হাত ধরে বাবাকে ডেকেছে অনেক্ষণ। সেসময় তার মা কী বেঁচেছিল? তার জীবিত মায়ের হাত ধরে বাবাকে ডেকেছে নাকি মৃত মায়ের হাত ধরে? ছেলেটা কী বাবার উপর রাগ করেনি তখন? কতটুকু অসহায় ছিল সে? আকমল সাহেব আর ভাবতে পারেন না।

কূল কিনারা নেই এসব ভাবনার। শুধু শুধু ভেবে ভেবে কষ্ট পাওয়া । কিছু বলার নেই। টাকা জমিয়ে উনার কোন লাভ নেই। যা হাতে আসে, উড়িয়ে দেন।

এলকোহল ধরেছেন। রাত পর্যন্ত যাদের সাথে থাকেন তারা ক্লাব থেকে বের হয়ে প্রমোদবালার দিকে আগায় আর উনি ঘরে ফেরেন। শূণ্য ঘর। হঠাৎ রাগে টেলিভিশনটা ভেঙে ফেলেছেন কয়েকদিন আগে। এখন ভাঙা অবস্থাতেই ওটা পড়ে আছে।

কিছু কাঁচ হয়ত এখনও কার্পেটের ওদিকে পড়ে আছে। আকমল সাহেব দেখেন আর ভাবেন, “ হু কেয়ারস! ” খাওয়া দাওয়া বাইরেই করেন। কখনও আগে এসে পড়লে বড় ভাইয়ের বাসায় খেতে যান। এই ত, পাশেই উনার বাসা। আকমল সাহেবের আরও একটা হালকা পরিবর্তন এসেছে।

উনি এখন আর কিছুর পরোয়া করেন না। আগেও তেমন ধার্মিক ছিলেন না। এটা এখন আরও প্রকট। উনার স্ত্রী একটা সন্তানের আশায় এই পীর সেই পীরের কাছে গেলেও উনি এসবকে পাত্তা দিতেন না সেসময়তেও। তখনও বলতেন, “ এই যুগে অলৌকিক কিছু হয় না।

যখন টেলিফোন ছিল না শুধু তখনই সব অলৌকিক জিনিস ঘটে শেষ হয়ে গেছে। হা হা হা । ” এখন উনি এই ব্যাপারটা বেশ শক্তভাবে বিশ্বাস করেন। সিরাজ সাহেবের সাথে এসব নিয়ে উনার একটু ঝগড়ামত হল সেদিন। সিরাজ সাহেব বেশ ধার্মিক লোক।

আদিবাস নোয়াখালী আর লক্ষিপুরের মাঝামাঝি। পাঞ্জাবী আর গোড়ালীর উপর প্যান্ট পড়ে অফিসে আসেন। মাঝে মাঝে অবশ্য তাকে ক্লাবেও দেখা যায়। সে যাই হোক, সিরাজ সাহেব যুক্তি দেখাচ্ছিলেন, “ জানেন মিয়া সেদিন আমি একটা ট্রাকের থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেছিলাম। আল্লাহ খোদা না থাকলে আমারে বাঁচাইলো ক্যাডা? আমার ফুপাত ভাইয়ের গাড়ি এক্সিডেন্ট হইছিল মিয়া সে সহ আর মাত্র ৩ জন বাঁচছে।

বুঝেন? খোদা যদি কিছু নাই করত, তাইলে হেদের বাঁচাইছে ক্যাডা? আমার এক আত্মীয় দুইবার লটারী পাইছে, বুঝলেন মিয়া? ” এসব উলটাপালটা কথায় আজমল সাহেব বড়ই বিরক্ত হন। এমন এক মূর্খ আর উনি একই পোস্টে চাকরী করেন ভেবে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকেন তখন। আকমল সাহেব আর কথা বাড়ান না, সিরাজ সাহেবকে টানতে থাকেন, “ খোঁচাখোঁচি করে লাভ নাই ভাই। চলেন ক্লাবে যাই, কিছু গলায় ঢালি। আজকে খরচ আমার।

” সবসময় যে চুপ করে থাকেন তা না, মাঝে মাঝে উত্তরও দেন। “ এমন মাথা গরম যেই ট্রাক ড্রাইভার সেই ট্রাকের হাত থেকে সেদিন আরও ১০ জন বাঁচছে। এত অলৌকিক রাস্তায় রাস্তায় হয়? একজন হয়ত মারা গেছে, সেই বেচারার কী দোষ ছিল?অলৌকিক ভাবে ট্রাকের থেকে ১০ জন না বেঁচে ১১ জন বাঁচলে কী হত? আর, যে কোন এক্সিডেন্টে যেকোন দুই তিনজন বাঁচতেই পারে। যারা বাঁচছে তাদের কাছে অলৌকিক লাগবেই। এসব র‌্যান্ডম চয়েস ছাড়া কিছু না।

” সিরাজ সাহেব তাও অনেক কথা বলতে থাকেন। আকমল সাহেব উত্তর দেন না। তবে, পাকস্থলীতে কিছু এলকোহল যাবার পর উনি সিরাজ সাহেবের কানে ফিসসিস করে বলতে থাকেন, “ ইব্রাহীম নবীর ছেলের গলায় যখন ছুরি চলছিল স্রষ্টার সমস্ত সৃষ্টি তার জন্য কাঁদছিল। পরে সেই ছেলের যায়গায় একটা দুম্বা কুরবানী হয়ে গেল। আমার এত রিএকটিভ স্রষ্টা কেন আমার ছেলের জায়গায় আমাকে নিল না? কেন আমার ছেলের জন্য সমস্ত সৃষ্টি কাঁদে না, শুধু আমি কাঁদি? পিতার দোষ নাকি পুত্রের কাঁধে আসে না, এটা ত আয়াতেই আছে।

তাহলে সৌম্য এখন আমার কোলে নেই কেন? আমি ঈদের নামায পড়তে পারলাম না এবার। উঠে আসছি। আমার আর ভাল লাগে না এসব। অলৌকিক বলে কিছু নেই। কখনও হয় না আর হয়ও নি।

কেউ বেঁচে গেলে বাই চান্স র‌্যান্ডমলি বাঁচে আর মরে গেলে সেটাই ত স্বাভাবিক। আমার ছেলেটার হার্টের অসুখ ছিল, বাসায় আসছিলেন না? দেখছিলেন? ছেলেটা কত ভয় পাইছিল বোঝেন? ” উনার কল্পনায় আবারও ভাসে উনার ছেলের চোখ ভরা আকুতি। ছেলেটার হার্টের অসুখ ছিল। ছেলেটা হয়ত মার হাত ধরে বাবাকে ডেকেছে অনেক্ষণ। সেসময় তার মা কী বেঁচেছিল? তার জীবিত মায়ের হাত ধরে বাবাকে ডেকেছে নাকি মৃত মায়ের হাত ধরে? ছেলেটা কী বাবার উপর রাগ করেনি তখন? কতটুকু অসহায় ছিল সে? আকমল সাহেব ভাবেন আর মনে মনে জানতে চান মাটি কাঁপেনি তখন? ছেলেটার জন্য তখন আর কেউ কাঁদে নি? আকমল সাহেব বসে থাকেন।

অনেক্ষণ যেন অনন্তকাল। আকমল সাহেব আর সিরাজ সাহেব মাতাল অবস্থায় দুজনেই কাঁদেন। সিরাজ সাহেবও আকমল সাহেবের মতন করে কাঁদেন। কেন কাঁদেন মাঝে মাঝে উনি মনে করতে পারেন না। তাও কাঁদেন, পাশে কেউ একজন এমন আকুল হয়ে কাঁদছে, তিনি হাসবেন কেন ! আকমল সাহেবকে খোঁচা দেন উনি।

“ আপনার উত্তর আমার কাছে নেই। হয়ত আপনি আপনার উত্তর একদিন পাবেন অথবা হয়ত পাবেন না। এতে স্রষ্টার কী যায় আসে ! ” আকমল সাহেব উত্তর দেন না। আহামরি কোন অলৌকিক কিছু কখনও শোনেন নি বাস্তবে আর বিশ্বাসও করেন না। মাঝে মাঝে এক গরুর দুই মাথা থাকে বা এক ছেলে ছোট থাকতেই অংক পারে এসব ছাড়া আর কোন অলৌকিক শোনা যায় না কখনও।

এসবকে গুরুত্ব না দেয়ারও যথেষ্ট কারণ আছে উনার। গত ঈদ থেকে এই ঈদের এই তিনমাসে উনার আরও একটা পরিবর্তন এসেছে। এখন উনি মাঝে মাঝে নিজে নিজেই হাসেন। এমনি। ভাবেন সৌম্য বড় হয়ে গেছে।

তাকে নিয়ে কল্পনা করেন। মধ্যবয়স্কা স্ত্রীকে নিয়ে মাঝে মাঝে খুব কষ্ট লাগে উনার কিন্তু এই ব্যাপারটা কেন যেন চেপে রাখেন। এমনকি এলকোহল গলাতে ঢালার পরেও। যখন স্ত্রী বেঁচে ছিল তখনও কেন যেন স্ত্রীকে সহজে বলতে পারতেন না তার প্রতি কতটা টান উনার আছে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ভদ্রলোক এখনও যেন লজ্জা পান।

ছয় বছর পরের এক সকাল। উনার অফিসটা মতিঝিল এলাকায়। সোনালী ব্যাংকের চাকরী। সিনিয়ার অফিসার। বিশাল ট্রাফিক জ্যাম পাড়ি দিয়ে এগুতে হয়।

একটা গাড়ি কেনার স্বপ্ন ছিল একসময়। এখন আর টাকা জমান না। রিটায়ারের খুব বেশি বাকিও নেই আর। বাসেই যাতায়াত। উনার সাথে এক ভদ্রলোক যান, উনার পাশেই আরেক অফিসে আছেন তিনি।

জনতা ব্যাংকে। মেরাত সাহেব নেহায়েত ভদ্রলোক। উনার সাথে গল্প গুজব আর উনার এই আত্মপোলব্ধি বোঝাতে বোঝাতে ট্রাফিক জ্যামের সময়গুলো পার করেন আকমল সাহেব। আর সবকয়টা দিনও তেমনই যাচ্ছিল। হঠাত করেই জানালার বাইরে তাকিয়ে চোখ আটকে যায় তার।

একটা অতি পরিচিত চেহারা। খুব পরিচিত। মনে করার চেষ্টা করতে থাকেন আকমল সাহেব। হাজার পাতার স্মৃতি হাতরাতে হাতরাতে যখন ক্লান্ত ঠিক তখন মনে পড়ে সৌম্যদের বাসের হেল্পার ছিল এক লোক। সেই চেহারা, সেই চোখ।

মুখটা কুঁচকে আছে সে রোদ চোখে পড়ার কারণে যেমন তার সামনে স্ট্রেচারে শুয়ে সেদিন ব্যাথায় চোখমুখ কুঁচকে ছিল । পেপারে এর ছবি ছিল। সামনে থেকেও একে হাসপাতালে নিতে দেখেছিলেন উনি। আর কিছু ভাবার সুযোগ নেই। আর আকমল সাহেব নিজেও জানেন যে কীভাবে কী করেছেন।

জ্যামের কারণে সবকিছুই ছিল স্থীর। সবকিছু ছাপিয়ে উঠছিল হেল্পারদের চিৎকার আর আকমল সাহেবের হৃৎপিণ্ডের শব্দ। সেই হেল্পারকে উনি জাপটে ধরেছিলেন। সম্ভবত এরপরেই উনি স্ট্রোক করেন। পাবলিক কিছু না বুঝে সেই হেল্পারকে গণধোলাই দেয়।

হয়ত ভেবেছিল এ বেয়াদবী করেছে বা আঘাত করেছে এই ভদ্রলোককে। হাসপাতালের পাশাপাশি রুমে জায়গা হয় দুজনের। আকমল সাহেবের কেবিনে আর হেল্পারের জেনারেল ওয়ার্ডে। আকমল সাহেব দেয়াল ধরে চলা ফেরা করার মত অবস্থা হবার সাথে সাথেই হেল্পারের রুমে যান আবার। একগাদা অভাবী মানুষ সেখানে শুয়ে আছে।

আলাদা করে আসলে কাউকেই বোঝা যায় না। হাসপাতালের বেডে শোয়া ছেলেটাকে দেখে হঠাৎ অবাক হলেন। না খাওয়া গরীব আর দুর্বল একটা মানুষ। আর কিছু না, আসলে তার পরিচয় এটাই। একে হয়ত কিছুর জন্যে দায়ী করা যায় না।

হয়ত যে কারও অনিচ্ছাকৃত ভুলেই আকমল সাহেবের জীবনটা আজ এমন। হেল্পারের বেডের পাশে রাখা চেয়ারটায় ধপ করে বসলেন উনি। ওর বোধহয় ঘুম ভেঙে গেল। কেন যেন এখন আর এর উপরে রাগ করতে পারছেন না। খপ করে কী ছেলেটার গলা দাবিয়ে দেয়া উচিত হবে ! আকমল সাহেব ভাবতে থাকেন ।

ছেলেটা চোখ মেলে। “ স্যার আপনি আমারে মাইরা ফালান। আপনার আত্মীয়রা আমার বেডের পাশে দিয়াও গেছে। হেদের থেকেই জানলাম বাসে আপনার ছেলে ছিল। কেউ জানত না আমাকে ধরতে যেয়ে আপনি ঢইলা পড়ছেন।

হেরা মনে করসে অন্য কেইস। আমি শুধু বুঝতে পারছি যে আপনি আমারে চিনসেন। আমারে মাইরা ফালান, তাও যদি আপনার শখ মিটে। ” আকমল সাহেব কিছু বলেন না। এসব বাংলা ছবির ডায়লগে উনার মাঝে বিরক্ত হবার ভাবটা আস্তে আস্তে ফিরে আসছে আবার।

আর ছেলেটা খুব নাজুক একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে। ওর মুখে এসব শুনতে ইচ্ছা করছে না। হেল্পার বলতে থাকে, “ স্যার আমরা কেউ কিছু জানি না। আৎকা এক মহিলা এক পোলারে নিয়া কাইন্দা উঠল। এক্কেরে হাউমাউ কান্দন।

হের পোলা নাকি বুকের ব্যাথায় ফিট। আমরা সাথে সাথে বাস থামাইলাম। আর সবাই দৌড় দিয়া ঐ পোলারে ধরলাম। পিছনের সিটের সারি খালি করে হেরে শোয়াইলাম। একটু পরে কেমনে যেন বাস না ট্রাক মোড় ঘুরে কী যেন আমাদের ধাক্কা দিল।

পুরা বাস গড়ায়া গেল। আমি জানালার দিকে লাফ দিলাম। ” আকমল সাহেবের মুখে ততক্ষণে একটা ভয় ধরে গেছে। বুকের ব্যাথা ? বাচ্চাটা কত বড়? হেল্পার আবার বলছে। এতক্ষণ কথা বলে এখন বোধহয় তার কথা ব্লতে কষ্ট হচ্ছে।

সে বলল, “ কি জানি, সাত আট হইবো হয়ত ! হের মা চিল্লাইতাছিল সুমু কইয়া। ” আকমল সাহেবের হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে এতক্ষণে। তাহলে তার ছেলে বাস এক্সিডেন্টের আগেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল? এক্সিডেন্টের মৃত্যুময় বিভীষিকার তাহলে কিছুই সে টের পায় নি ! আকমল সাহেবের কী এখন স্বস্তি অনুভব করা উচিত ? আকমল সাহেব কাঁদতে থাকেন। এক্সিডেন্টের আগেই যদি তার ছেলেটা অজ্ঞান হয়ে যায়, তাহলে সেটা অলৌকিক কিছুই বটে। বাচ্চাটা হয়ত ব্যাথা পায় নি।

তার কল্পনা করা দৃশ্যগুলো তাহলে হয়ত শুধুই কল্পনা। আসলে সাতশ’ কোটি মানুষের পৃথিবীতে কয়টা অলৌকিক হওয়া উচিত? কয়টার খবর আমরা পাই? এক গরুর দুই মাথা বা আকাশ থেকে রুই মাছ পড়া বা ইমাম সাহেবের স্বপ্নে পাওয়া ঔষধ না, সত্যিকার অলৌকিক ঘটনা শুধু ঘটে বিশেষ কারও জন্য। যারটা শুধু সেই বোধহয় বোঝে। স্রষ্টা যখন সত্যিকারের অলৌকিক কিছু ঘটান তখন সেটা পেপারে দেয়ার জন্য না হয়ত কারও প্রতি করুণা থেকে শুধু তার জন্যেই ঘটান। আকমল সাহেব কনফিউশনে ভুগছেন।

ইব্রাহীম নবীর ছেলের মত ছুরির ধার থেকে বেঁচে যাওয়া না শুধু, হয়ত মৃত্যুর মাঝেও অলৌকিকতা আছে। হয়ত উনার ছেলের সাথে তাই ঘটেছে। আকমল সাহেব কান্না থামিয়ে ভাবতে বসেন। এই ভাবনার কোন কূল কিনারা নেই। উনি অনেকক্ষণ ধরেই চুপচাপ বসে থাকেন।

এটাও হয়ত অলৌকিক কিছু, শেষ সময়ে কিছু ভুল ভাঙল অথবা হয়ত শুধুই ভাবনার নতুন খোরাক। © আকাশ_পাগলা [কোন একদিন কোন উপন্যাস হয়ত লিখতে পারব, সেই আশায় এক্সারসাইজ করলাম। এই পর্যন্ত আমার সবচেয়ে বড় লেখা সম্ভবত এটাই। এত কষ্ট করে যারা পড়লেন তাদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। ]
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।