আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্যাতন-৫ রাষ্ট্রীয় নির্যাতন, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার

Only I know what is my goal, My heart is my temple.

কাজী সায়েমুজ্জামান: রাজনৈতিক সহিংসতা না থাকলেও সন্দেহের ভিত্তিতে থেমে নেই গণআটক । পরোয়ানা রয়েছে এমন অপরাধিদের গ্রেফতারে পুলিশের দক্ষতার অভাব থাকলেও বিনা পরোয়ানায় আটকে তারা সিদ্ধহস্ত। আইন শৃংখলার কোন ধরনের অবনতি হলেই তার জের টানে নিরীহ নিরাপরাধ মানুষ। বিনা পরোয়ানায় ধরপাকড়ের খড়গ নেমে আসে তাদের ওপর। সরকারী হিসেবেই গড়ে প্রতিদিন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ১০০ ধারায় ৯০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

এর সঙ্গে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারারও ব্যবহার হচ্ছে। কোন অপরাধ না করেও শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার হচ্ছে এসব লোকজন। এসব ধারার নামে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হলেও সবাইকে আটক দেখানো হয়না। লেনদেন, মারধর অথবা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে নেয়ার আগেই বেশিরভাগ ছেড়ে দেয়া হয়। বাকীরা আদালতে উঠলে সর্বনিম্ন দুইশ’ টাকা জরিমানা দিয়ে ছাড়া পান।

তবে থানার লকাপ থেকে আদালতের হাজতখানা হয়ে তাদের মুক্তি পেতে হয়। এসব স্থানে টানা হেচড়ায় অযথাই হয়রানীর আর দুর্ভোগের শিকার হন ভুক্তভুগী ও তার পরিবার। কোন ব্যক্তি সকাল ১০টার পর গ্রেফতার হলে তাকে পরদিন বিকাল পর্যন্ত একপ্রকার অভুক্তই থাকতে হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে থানা ও আদালতের হাজতের অসহ্যকর দুর্গন্ধ। অপরাধ না করেও থানা পুলিশ আদালত করতে গিয়ে আইনের প্রতিই বিতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছেন লোকজন।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা মহানগরীতে গত জানুয়ারী থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত আদালতের পরোয়ানায় ১০ হাজার ৯০৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর কোন অপরাধ না করেও পুলিশের সন্দেহভাজন হিসেবে এর দ্বিগুনেরও বেশি ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছেন। বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের সংখ্যা ২২ হাজার ১৮৪ জন। এর মধ্যে ডিএমপি অধ্যাদেশের আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২১ হাজার ৩৫৮জনকে। বাকী ৮২৬ জকে গ্রেফতার করা হয়েছে ৫৪ ধারায়।

এরমধ্যে ডিএমপি অধ্যাদেশের ১০০ ধারায় জানুয়ারী মাসে ১৪২০ জন, ফেব্রয়ারী মাসে ১১৭৬ জন, মার্চ মাসে ১০৬৪ জন, এপ্রিল মাসে ১৯৩১ জন, মে মাসে ৩১৯৩ জন, জুন মাসে ২৫৬৭ জন, জুলাই মাসে ২২৪৫ জন, আগস্ট মাসে ২৫৬১ জন, সেপ্টেম্বর মাসে ২৪৫৪ জন, অক্টোবর মাসে ২৭৪৬ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদিকে ৫৪ ধারায় জানুয়ারী জানুয়ারী মাসে ৮৭ জন, ফেব্র“য়ারী মাসে ৭১ জন, মার্চ মাসে ৫৪ জন, এপ্রিল মাসে ৬২জন, মে মাসে ১১৫ জন, জুন মাসে ৯০ জন, জুলাই মাসে ৮৪ জন, আগস্ট মাসে ৮৯ জন, সেপ্টেম্বর মাসে ৯১ জন এবং অক্টোবর মাসে ৮৩ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় সংসদ সদস্য ফজলে নুর তাপসের গাড়ি ল্য করে বোমা হামলার পরই সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার বেড়ে গেছে। গত ২১ অক্টোবর এ বোমা হামলা হয়। এরপরই ব্যাপক ধরপাকড় চলে।

ওই দিন রাতেই ডিএমপি অধ্যাদেশে ১৭৩ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। বোমা হামলার আগের দিনও এ ধরনের গ্রেফতারের সংখ্যা ছিল শুধু ৫৩ জন। ২২ অক্টোবর গ্রেফতার হন ১৮০ জন। এর মধ্যে সাতজনকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে আসল গ্রেফতার ছিল আরও বেশি।

বেশিরভাগকেই আদালতে নেয়া হয়নি। অনেককে আদালতে নেয়ার আগেই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেয়া হয়েছে তারা এতে অন্তর্ভুক্ত হননি। তাপসকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা, ভারতীয় হাইকমিশনার ও এটর্নী জেনারেলকে জীবননাশের হুমকী, রাজস্ব বোর্ডে হামলার হুমকীসহ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে গত ২৯ অক্টোবর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ রাজধানীতে তিন দিনের বিশেষ অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এ অভিযানের ফলে দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন রাতে বাড়ির বাইরে বের হওয়া লোকজন। ওই তিনদিনে পুলিশ রাতে কাজ থেকে ফেরা লোকজনকেও গ্রেফতার করে হাজতে পুরেছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেবেও সারাদেশে এ বছরের ১ লা জানুয়ারী থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত পরোয়না ছাড়া গ্রেফতারের সংখ্যা পরোয়ানা বলে গ্রেফতারের অর্ধেক। এসময় পরোয়ানা বলে গ্রেফতার হয়েছেন তিন লাখ ৩৮ হাজার ৬১৯ জন । আর পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার সংখ্যা এক লাখ ৫৮ হাজার ৯৪২ জন। সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতারের তথ্য সংরতি হয়না: বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন চললেও তথ্য সংরক্ষিত হয়না। শুধু সন্দেহের ভিত্তিতেই পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করে জেলে পুরতে পারে।

দেশের আইনই তাদের এ ক্ষমতা দিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো-স্বাধীনতার পর থেকে যত মানুষকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে তাতে পুরো জাতির এক তৃতীয়াংশই পুলিশের খাতায় সন্দেহভাজন হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর এ যাবত কত লোক সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছে তার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এ তথ্য রাখা হলে দেশের পুরো লোকসংখ্যার একটি বড় অংক পুলিশের সন্দেহকৃত অভিযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। এটা দেশের ভাবমুর্তির জন্য তিকর হবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের অপারেশন বিভাগে এ তথ্য চাওয়া হলে তারা জানান, ৫৪ ধারায় গ্রেফতারের হিসাব দেশের সবগুলো থানা থেকে পাঠানো হলেও তা সংরণ করা হয়না। শুধু পরোয়না বলে গ্রেফতার ও পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার এ দুই বিভাগে তথ্য সংরণ করা হয়। তারা যেকোন তথ্যের জন্য মিডিয়া বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। এ বিষয়ে এআইজি মিডিয়া নজরুল ইসলাম বলেন, আগেও এ ধরনের তথ্য দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা সম্ভব হয়নি। পুলিশের উর্ধ্বতনরা এ ধরনের তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অনুৎসাহ দেখান।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আদালতের পরোয়ানা ছাড়া যাদের গ্রেফতার করা হয় তারা আমলযোগ্য অপরাধ করলেও প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। পরে তার স্বীকারোক্তিতে সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ফলে বলা যায়, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারকৃতরাই ৫৪ ধারায় গ্রেফতার হয়েছেন। সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি দায়িত্বে থাকাকালে মাসিক, ষান্মাসিক ও বাৎসরিক তথ্য সংরণ করা হতো। এখনো এ ধরনের তথ্য সংরণ করা হয়।

তবে সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতারকৃতর বিষয়টি ১৫ দিনের মধ্যেই শেষ করে দিতে হয়। ফলে দীর্ঘ মেয়াদী তথ্য সংরণের দরকার পড়েনা। তিনি বলেন, এসব ধারা ব্যবহার করতে পুলিশ কর্মকর্তাদের সতর্ক হওয়া উচিত। এর প্রয়োগ না করে আইন শৃংখলা ঠিক রাখা সম্ভব হলে এ ধারা এড়িয়ে যাওয়া উচিত। তবে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার সন্দেহের ভিত্তিতে আটক নিয়ে একটি পর্যবেণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।

তারা ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ডিএমপির তৎকালীন ২২টি থানায় গণগ্রেফতার নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছিল। পুলিশের অসহযোগিতার পরেও সংস্থাটি এ বিষয়ে একটি তথ্য উপস্থাপন করে। এতে দেখা যায়, এক বছরে সন্দেহভাজন অভিযুক্ত হিসেবে আটক হয়েছেন ৬৪ হাজার ৫০২ জন। এদের মধ্যে ডিএমপি অধ্যাদেশে গ্রেপ্তার হন ৫৮ হাজার ৭২৮ জন। আর ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় পাঁচ হাজার ৭৭৪ জন গ্রেফতার হন।

এ বছরের গ্রেফতারকে গড় ধরলে গত ৩৯ বছরে শুধু ঢাকা মহানগর এলাকায় সন্দেহভাজন গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা দাড়ায় ২৫ লাখেরও ওপরে। গণ গেফতারের আইনী ভিত্তি: মেট্রোপলিটন এলাকায় সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় মেট্রোপলিটন অধ্যাদেশের আওতায়। ঢাকা মহানগরীতে গ্রেফতার করা হয় ঢাকা মহানগরী পুলিশ অধ্যাদেশ এর ৮৬ ও ১০০ ধারা অনুযায়ী। ১৯৭৬ সালে এ আইনটি তৈরী করা হয়। এছাড়া মেট্রোপলিটনের বাইরে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়।

এ আইনটি ১৮৯৮ সালে ইংরেজরা তৈরী করে। বৃটিশ সরকার গণআন্দোলন থামাতেই সর্বপ্রথম বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন তৈরী করে পথ দেখায়। তারা ৫৪ ধারা তৈরী করে লাখ লাখ মানুষকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করে। হানাদার পাকিস্থানী শাসকদের এ আইন প্রয়োজন মেটাতে পারেনি। তারাও ধড়পাকড়ের জন্য নতুন আইন করে তা প্রয়োগ করে।

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে আগের দুই আমলের নিন্দিত আইন প্রয়োগেও উদ্দেশ্য হাসিল হয়নি। গণতন্ত্র আর মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম আর সবগুলো নিবর্তন আইনে জেলখাটা এই অবিসংবাদিত নেতাও তৈরী করলেন বিশেষ ক্ষমতা আইন। বিরোধীরা একে কালো আইন বলে গালি দিলেও তারা ক্ষমতায় গিয়ে ঠিকই এর ব্যবহার করেছে। কেউ এ আইন রহিত করেনি। আসে জিয়াউর রহমানের আমল।

তিনিও এসব আইনে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তৈরী করা হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ। এ আইনেও বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের বিধান রাখা হয়। এরশাদের আমলে তৈরী আইনগুলোতেও বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের বিধান ছিল। ১৯৯০ সালের পর সংসদীয় গণতন্ত্রের আমলেও এর প্রয়োগ হয়েছে।

এসময় ঢাকা বাদে দেশের অন্য মেট্রোপলিটন পুলিশের জন্যও আইন হয়েছে। এর প্রতিটিতেই সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতারের বৈধতা দেয়া হয়েছে। বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতারের এতো নিবর্তনমূলক আইন থাকতেও গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের খায়েশ মেটাতে পারেনি। তারা জরুরী ক্ষমতা বিধিমালা জারী করেও বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করেছে। এখন এ বিধি না থাকলেও আগের তৈরী সবগুলো আইনই বহাল রয়েছে।

এসব আইনে আগের মতোই নিরীহ লোকজন আটক হচ্ছেন। ইংরেজ উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন দমাতে তারা এ ধারাটি ব্যবহার করেছিল। পাকিস্থান আমলেও বাংগালীদের নিপীড়নের হাতিয়ার ছিল ৫৪ ধারা। এ দুই আমলে এ ধারাটির বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার ছিলেন তারা ক্ষমতায় গিয়ে এ ধারাটি বাদ দেয়ার চিন্তা তো দূরের কথা তা আরও ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করেছিলেন। পরে স্বাধীন বাংলাদেশে তৈরী ছয়টি মেট্রোপলিটন আইনেও সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতারের বৈধতা দিয়ে ধারা রাখা হয়েছে।

এর আগে দুইটি সামরিক সরকারের সময় লোকজনকে এ ধারায় পাইকারী হারে গ্রেফতার করা হতো। ওই সময় পত্রিকাগুলো গ্রেফতারের সংখ্যা ছাপাতো। তবে সরকার তথ্য বিবরণী দিয়ে এ ধরনের সংবাদ ছাপাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করারও নজির রয়েছে। ডিএমপি অধ্যাদেশের ৮৬ ধারায় কোন অবস্থায় পাওয়া গেলে লোকজনকে গ্রেফতার করা যাবে তা বলা হয়েছে। এতে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়ে সন্তোষজনক কৈফিয়ত ছাড়া কোন ব্যক্তি যন্ত্রপাতি হতে নিয়ে ঘুরলে, মুখমন্ডল ঢেকে রাখলে বা ছদ্মবেশ ধারণ করলে, কোন বাড়ি, দালান, নৌযান বা যানবাহনে উপস্থিত হলে, রাস্তা অথবা অন্যকোন স্থানে ঘুরলে, চলাফেরা করলে বা ঘুমিয়ে থাকলে এবং জোর করে কারও বাড়ি ঢুকতে চেষ্টা করলে তাকে গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়াই আটক করা যায়।

এ অপরাধে তাকে এক বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদন্ড অথবা দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দন্ড দেয়ার বিধান রয়েছে। এছাড়াও এ অধ্যাদেশের ১০০ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের মতা দেয়া হয়েছে। কোন পুলিশ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে বা তার সামনে কেউ এ অধ্যাদেশের বা বর্তমানে বলবৎ অন্য কোন অপরাধ করলে পুলিশ কর্মকর্তা তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবেন। আর ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে- যেকোন পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাজিষ্ট্রেটের আদেশ অথবা পরোয়ানা ছাড়াই নয় ধরনের ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করতে পারেন। কোন আমলযোগ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত কোন ব্যক্তি অথবা এ ধরনের কোন কাজে জড়িত বলে যার বিরুদ্ধে যুক্তি সংগত অভিযোগ করা হয়েছে অথবা বিশ্বাসযোগ্য খবর পাওয়া গেছে বা যুক্তিসংগত সন্দেহ রয়েছে।

অপরাধি বলে ঘোষিত ব্যক্তি, চোরাই মাল থাকতে পারে এমন কোন ব্যক্তি, পুলিশ কর্মকর্তাকে কাজে বাধাদানকারী, প্রতিরা বাহিনী হতে পালানো ব্যক্তি, বিদেশে অপরাধ করে দেশে ফেরত ব্যক্তি, মুক্তিপ্রাপ্ত আসামী মুক্তির নিয়ন লংঘন করলে এবং অন্য কোন পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে গ্রেফতারের অনুরোধকৃত ব্যক্তিদের এ আইনে গ্রেফতার করা যায়। এই সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতারের বৈধতা নিয়ে বৃটিশ আমল থেকেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্কি প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদালতে মামলা ও রিট করেছেন। এর প্রেেিত আদালত অনেক নির্দেশনাও দিয়েছেন। তবে অনেক নির্দেশনাই মানা হয়না। ঢাকা মহানগর পুলিশ সদরদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী বেশ কয়েকটি ধারায় পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারে।

এগুলো হলো- ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৫, ৫৬, ৫৭, ১২৪, ১২৮, ১৫১, ১৭১ ও ৪০১(৩) ধারা, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ১০০ ধারা, মটরগাড়ি অধ্যাদেশের ১৬০ ধারা, রেলওয়ের আইনের ১০০, ১০১, ১০২, ১০৮, ১১২, ১১৯, ১২০, ১২১, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১২৯ ১৩১ ও ১৩২ ধারা, পুলিশ আইনের ৩৪ ও ৩৪(ক) ধারা, অস্ত্র আইনের ১২ ও ১৩ ধারা, আফিম আইনের ১৪ ও ১৫ ধারা, শুল্ক আইনের ৬৭ ধারা, বন আইনের ৬৪ক ধারা, জলযান আইনের ৩১ ধারা, জুয়া আইনের ১১ ধারা, পাসপোর্ট আইনের ৪ ধারা, অফিসিয়াল সিক্রেট আইনের ১৪(ডি) ও ১৫(বি) এবং বেঙ্গল পুলিশ রেগুলেশন আইনের ৩১৬ ধারা। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আমলযোগ্য অপরাধগুলো হলো- খুন, ডাকাতি, দস্যুতা, চুরি, ধর্ষন, আত্মহত্যার চেষ্টা, কাউকে অবৈধ আটক, অপহরণ, চাদাঁবাজি,ঘর ভাংগা ও দাঙ্গা। এগুলো সংঘটনকারীদের পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারে। আর বিক্ষোভ, ছোটখাট ঝগড়া যা শান্তিভংগ করে, ঘুষ, শরীরের জন্য ক্ষতিকর পরিবেশ তৈরী করা, মানহানি ও পাবলিক নুইসেন্স সৃষ্টি করা আমলযোগ্য অপরাধ নয়। এগুলো করলে কাউকে গ্রেফতার করা যায়না।

আমাদের টাকা দিতে বাধে, আদালতে গিয়ে দিয়ে আয় : অপরাধ না করেও পুরো একদিন হাজাতবাস করতে হচ্ছে নিরাপরাধ লোকজনকে। রাতে গ্রেফতার হলে পরদিন বিকালে তাদের আদালতে তোলা হয়। এদের প্রত্যেকের এক বেলার খাবারের জন্য সরকারী বরাদ্দ রয়েছে তিন টাকা। বলতে গেলে গ্রেফতারের পর এদের অভুক্তই থাকতে হয়। আদালতের চলতি ভাষায় এরা ‘পাঁচ আনির আসামী’।

ঢাকা মেট্রোপলিটন জজ আদালতের মোট ২৮ এজলাসের মধ্যে ২৩ এজলাসে এসব গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের তোলা হয়। সব আদালতের কাজ শেষে বিকালে একটি বড় দড়ি দিয়ে কোমর বেঁধে সারিবদ্ধভাবে তাদের আদালত ভবনে নেয়া হয়। চলতি মাস থেকে এসব ব্যক্তিদের ৯ ও ২৬ নম্বর আদালতে তোলা হচ্ছে। ২৬ নম্বর আদালতে তিন দিনে ৪৭ হাজার দুইশ’ টাকা আয় হয়েছে। তবে প্রতি মাসে এদের কাছ থেকে কত টাকা আদায় হয় তা জানতে সিএমএম আদালতের নাজির ও জিপি শাখায় ধর্ণা দিলেও তারা বিষয়টি সংবেদনশীল জানিয়ে মূখ্য মহানগর হাকিমের অনুমতি ছাড়া কোন তথ্য হস্তান্তর করতে পারবেননা বলে জানিয়ে দেন।

গত ৮ অক্টোবর কোর্ট হাজতে গ্রেফতারকৃত সন্দেহভাজনদের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। এদের বেশিরভাগকেই রাত ১২টার পর গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা অপরাধ না করেও তাদের ভাষায় ‘জেল খাটার’ জন্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তারা জানান, তাদের গ্রেফতারের খবরও তাদের স্বজনদের কাছে পৌছানো যায়নি। গ্রেফতারকারী পুলিশের এসআইকে এ নিয়ে বহু অনুরোধ করলেও তার মন গলেনি।

তারা আদালত জরিমানা করলে কিভাবে অর্থ জোগাড় করবেন তা নিয়েও চিন্তিত। তবে অনেকের স্বজনেরা বিভিন্ন মারফত গ্রেফতারের খবর পেয়ে আদালতের হাজতের সামনে ভিড় জমান। তারা কোন অপরাধ ছাড়াই তাদের স্বজনদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশকে দোষারোপ করতে থাকেন। এদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে গ্রেপ্তারকৃতদের বেশিরভাগই রাতের কর্মজীবী। অনেকেই রাতে মুটের কাজ করেন।

তারা কাজ শেষে ভোর রাতের দিকে বাড়ি ফেরার পথে গ্রেফতার হন। অনেকে রাস্তায় শুয়ে থেকেও গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন । গ্রেফতারকৃতরা দাবী করেছেন, আটকের পর পুলিশ তাদের কাছে অর্থ চেয়েছে। তারা কোন অর্থ দিতে পারেননি বলে তাদের আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এসময় কোন কোন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমাদের টাকা দিতে বাধে, আদালতে গিয়ে দিয়ে আয়।

’ গ্রেফতারকৃত একজন হলেন গদি মিস্ত্রি আলী হোসেন। তিনি রাজৈর থানার আমগ্রামের মো. আলমের পুত্র। তার অভিযোগ তাকে গ্যান্ডারিয়ার নতুর রাস্তার ইমন স্টিল নামের দোকান থেকে কর্মরত অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি রাত দুইটা পর্যন্ত দোকান খোলা রেখে জরুরী কাজ করছিলেন। এসময় একজস এসআই তাকে দোকান বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়ে যান।

তিনি পরে ফিরে দেখতে পান দোকান খোলা। এ কারণে তাকে ওই এসআই গ্রেফতার করে নিয়ে যান। পটুয়াখালির বাহেরমুজ গ্রামের মুজাফ্ফর মাস্টারের পুত্র শাহজাহানও ডিএমপি অধ্যাদেশে গ্রেফতার হন। তাকে ভিক্টোরিয়া পার্কের থেকে অস্থায়ী রুটির দোকান থেকে রাত দুই টায় গ্রেফতার করা হয়েছে। ৫৪ ধারার অপব্যবহার: বাস্তবে দেখা গেছে মহানগরী পুলিশ অধ্যাদেশে সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতারের ধারা থাকলেও পুলিশ ৫৪ ধারায়ও গ্রেফতার করে থাকে।

কেননা পুলিশ ইচ্ছা করলেই ৫৪ ধারায় গ্রেফতারকৃতকে রিমান্ডে নিতে পারে। যা ডিএমপি অধ্যাদেশে সম্ভব হয়না। গত ৮ নভেম্বর আদালতের হাজতে ৫৪ ধারায় আটক কিরণের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি শিবচর থানার যোদ্ধারমাঠ গ্রামের আদম আলীর পুত্র। যাত্রাবাড়ির থানার পুলিশ তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে।

তবে আদালত তাকে ওই দিনই বিকালে মুক্তির আদেশ দেন। কিরণ জানান, তার নামে একটি চাঁদাবাজির মামলা দিয়েছিল। বর্তমানে ওই মামলায় তিনি জামিনে রয়েছেন। গত ৪ অক্টোবর তার আদালতে হাজিরা দেয়ার তারিখ ছিল। তিনি যথাযথভাবে হাজিরা দেন।

এরপরও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আটকের আগে পুলিশ তাকে জানায়, হাজিরা দিয়ে থাকলে কাগজপত্র দেখাতে হবে। তার কাগজপত্র তার আইনজীবীর কাছে রয়েছে জানালেও ওই পুলিশ কর্মকর্তা তা শুনেনি। তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবে আইনজীবীরা জানান, হাজিরার কাগজপত্র কোন পুলিশ কর্মকর্তা চাইতে পারেনা।

কেউ হাজির না হলে আদালত পরোয়ানা জারি করে। সেই ভিত্তিতে পুলিশ তাকে ফের গ্রেপ্তার করতে পারে। কিরণের মা এ প্রতিবেদকের কাছে ঘটনা ববলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, বাড়ির মালিক শত্র“তার কারণে আমার ছেলের বিরুদ্ধে চাদাবাজির মামলা দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছে। গরীব মানুষ বলে ভালো আইনজীবীও দিতে পারিনি।

এ কারণে ছয়মাস জেল খাটতে হয়েছে। এখন বের হওয়ার পরও পুলিশ বিনা কারণে গ্রেফতার করছে। তাকে ৫৪ ধারা থেকে জামিনে মুক্ত করতে আটশ টাকা খরচ হয়েছে। এখন এ মামলায়ও ফের হাজিরা দিতে হবে। ঘরেখাবার নেই অথচ আমরা এ হয়রানী কিভাবে মোকাবেলা করবো ? আইনজ্ঞরা যা বলেন: সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বুধবারকে বলেন, ডিএমপি অধ্যাদেশ পড়লে মনে হবে পুলিশের কাজই হলো রাজধানীর লোকজনকে সন্দেহ করা।

ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ১০০ ধারা অনুযায়ী পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার করা যায়। আমার কথা হলো কেউ গভীর রাতে আমার বাড়ির সামনে ঘুরবে আর কেউ কাজ শেষে বাড়ি ফেরবে- তারা দুজনতো এক নয়। পুলিম গ্রেফতারে এদের মধ্যে পার্থক্য করছেনা- এটাই সমস্যা। চার বছর আগে ৫৪ ধারার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা হয়েছিল। এতে উচ্চ আদালত এ ধারায় গ্রেফতার করতে বিস্তারিত দিক নির্দেশনা দিয়েছিল।

নির্দেশনা ছিল, সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার করতে হলে ওই সন্দেহের সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে হবে। ওই কারণ লিপিবদ্ধ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে কোন পুলিশ কর্মকর্তা কারণ লিপিবদ্ধ করেনা। তারা আইনের কোন তোয়াক্কা করছেনা। আমাদের দুর্ভাগ্য আইন শৃংখা রক্ষাকারী বাহিনী ক্রসফায়ারে মানুষ মারছে।

আর মন্ত্রীরা তার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছে। ৫৪ ধারার অপপ্রয়োগ এই আইন না মানার প্রবণতারই বহি:প্রকাশ। নির্যাতন-৪ Click This Link


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।