আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভগবানের জাদুর বাক্স

এসো ভাই , তোলো হাই , শুয়ে পড়ো চিত, অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত - জগতে সকলই মিথ্যা , সব মায়াময়, স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়।

ভগবান হঠাৎ সবাইকে ডাক দিলেন, তিনি আসবেন। জনসম্মুখে তিনি আসবেন। চারদিকে হই হই রব, ভগবান আসছেন। চেচামেচি, শোরগোল, ফিসফিস তিনি আসছেন।

ঠিক সময়েই তিনি হাজির হবেন জনতার মাঝখানে। ভগবানকে পূজা দেয়ার জন্য প্রস্তুত সকলে একজন ময়রা দোকানী তার সু-স্বাদু লাড্ডু সাজিয়ে রাখলেন ভগবানকে দেয়ার জন্য। একজন আলু-পটল ব্যবসায়ী তার খাঁচি থেকে ভাল দেখে আলু-পটল সাজিয়ে রাখলেন। একজন চাল দোকানী চালের দাম কমিয়ে দিলেন। একজন গায়ক গলা সেঁধে গান বাধলেন।

একজন নৃত্য শিল্পী ধ্র“পদী মুদ্রা অনুশীলন করে নিলেন। একজন বুদ্ধিজীবী কলম ঝেড়ে কলাম লিখলেন। একজন রাজনীতিবীদ গলা কেশে বক্তৃতা দিলেন “এবারের সংগ্রাম...”। একজন বিউটিশিয়ান বিনা পয়সায় সবাইকে সাজিয়ে দিলেন। একজন আমলা ভরাট কন্ঠে আওয়াজ তুললেন “কে কোথায় আছো দ্যাখোতো সব ঠিকঠাক আছে কিনা...?”।

একদল শিল্পী অয়েল কালারের পেইন্টিং এক্সিবিশন করলেন। সবারই একটাই লক্ষ্য ভগবান আসছেন তাঁকে খুশি করতে হবে। তাঁকে খুশি করতে পারলেই তিনি জাতির জন্য বর দিয়ে যাবেন। একজন উত্তরাধুনিক তরুণ সবজান্তা ভাব নিয়ে বললেন “আরে কুচ পানেকে লিয়ে কুচ খোনাভি পাড়তা হ্যায়”। সবাই সমস্বরে তরুণকে সমর্থন করে বললেন বাহ্ বাহ্ ইয়েতো বহুত আচ্ছা আদমী হ্যায়।

এক পশলা বাতাস শোঁ শোঁ আওয়াজ তুললো- আসছেন ভগবান। অবশেষে নির্দ্দিষ্ট দিনে তৈরী হল বিশাল বেদী। সবার দৃষ্টি ভগবানের পথের দিকে স্থির। সকল জল্পনা শেষে ভগবান দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এলেন। ভগবান হাত নাড়লেন।

যন্ত্রীরা সব ব্যতিব্যস্ত তাদের শ্রেষ্ঠ সুরে ভগবানের হৃদয় ছুঁয়ে দিতে। চারপাশ থেকে কোরাস বেজে উঠলো “ভগবানের জয় হোক”। ভগবান বেদীতে উঠলেন। ধীর অথচ কঠিন এক মোহে সবাইকে বিমোহিত করে ফেললেন। তারপর তিনি আকাশের দিকে দু’হাত তাক করলেন।

সবাই তাঁকে অনুসরণ করলো। ভগবানের ঠোটের কোনে একচিলতে হাসির ঝিলিক দেখা গেল, সাথে সাথেই ভগবানের চোখে জল এলো। ভগবান কান্না করলেন, সবাই কাঁদলো। ভগবান আবার হাসলেন, যথারীতি সবাই আবার হাসলো । সবার অধীর অপেক্ষা ভগবানের স্বর্গীয় ঘোষণা শোনার জন্য।

এল সেই মহেন্দ্রক্ষণ, ভগবান দারাজ কন্ঠে ঘোষণা করলেন - “তোমাদের কাজে আমি খুশি, তাই তোমাদের জন্য দিয়ে যাচ্ছি এক অতি আশ্চর্য জাদুর বাক্স”। চারিদিকে আবার আওয়াজ উঠলো “জাদুর বাক্স- জাদুর বাক্স”। ভগবান এবার বললেন এই জাদুর বাক্স সংরক্ষণের জন্য তোমাদের মধ্য হতে আমি কিছু নিবেদিত প্রাণ লোক চাই। উপস্থিত সকলের মুখেই আবার আওয়াজ উঠলো “নিবেদিত প্রাণ লোক চাই, নিবেদিত প্রাণ লোক চাই”। ভগবান একটু সামনে এসে ঝুঁকে সকলের চেহারা দেখলেন।

তারপর একটি বিশেষ চিহ্ন বহনকারী কয়েকজন কে নির্বাচিত করলেন আশ্চর্য জাদুর বাক্স সংরক্ষণের জন্য। সকলেই আপ্লুত ভগবানের জাদুর বাক্সের কল্পিত চেহারা ভেবে। ভগবান তার প্রতিনিধিদের প্রয়োজনীয় দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে মর্তলোক ত্যাগ করলেন। সকলে হাত নাড়লো ভগবানের উদ্দেশ্যে। জাদুর বাক্স নিয়ে ছড়িয়ে পড়লো হরেক রকমের কিংবদন্তী।

পাড়ার টং দোকানে নিয়মিত চা খেকো জমির আলী পায়ের উপর পা তুলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে: আহ! ভগবানের জাদুর বাক্স কত কি যে দেখা যায়, তাকালেই দৃষ্টি জুড়িয়ে যায়। বোঝোতো? ভগবানের জাদুর বাক্স বলে কথা! মেঘে মেঘে ধান চাষ হয়। কালো মেঘে আমন, সাদা মেঘে আউশ...। শুক্কুর পাশ থেকে বলে উঠে আরে! তুমি কি ওই জাদুর বাক্স দেখেছো নাকি? জমির আলী বলে না...ইয়ে... ত-বে শুনেছি। এদিকে জাদুর বাক্স সংরক্ষণকারীদের ঘুম নেই।

রাজ্যে এলান করা হল- জাদুর বাক্সে জাদু প্রদর্শনীতে সহায়তা করার জন্য কিছু লোক প্রয়োজন। আগ্রহীগণ অতিসত্বর যোগাযোগ করুন। ঘোষণা শুনে আবার ব্যস্ত হয়ে উঠলো জনপদ, ব্যস্ত হয়ে উঠলো মতি, কুতুব, সলিম এবং তরিকরা। সখিনা বিবিরাও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। একজন শীর্ণকায় জয়েফ উদ্দিনও বেরিয়ে এল।

মতি-কুতুবের মত না হোক তার শুধু জাদুর বাক্স মুছে দেয়ার দায়িত্ব পেলেই হল। জয়েফ উদ্দিন তার অভিজ্ঞতার ঝুলি কাঁধে এক বুক আশা নিয়ে বাক্স সংরক্ষণকারীদের সাথে যোগাযোগ করে। বাক্স সংরক্ষণকারীগণ তাকে বলে future is not ours to see, whatever will be, will be.... শীর্ণকায় জয়েফ উদ্দিনের পরীক্ষা নেয়া হয় অ-আ, ক-খ জ্ঞানের। বলা হয় ফলাফল পরে জানানো হবে। অপেক্ষায় থাকে জয়েফ উদ্দিন।

একদিন ঠিক ঠিক ডাক আসে জয়েফ উদ্দিনের, জয়েফ উদ্দিন জাদুর বাক্স মোছার কাজে নির্বাচিত হয়েছে। কাজের বিনিময়ে কিছু পয়সাও দেওয়া হবে তাকে। উল্লাসে ফেটে পড়ে জয়েফ। পয়সা তার কাছে মূখ্য না, ভগবানের জাদুর বাক্স মুছবে সে, এতেই সে মহা খুশি। দূরু দূরু বুকে কম্পিত পায়ে কাজে লেগে যায় জয়েফ।

ঘটা করে শুরু হয় জাদুর বাক্সের মাধ্যমে জাদু প্রদর্শনীর কাজ। রাজ্যের সবাই বসে পড়ে জাদুর বাক্সের সামনে। পাড়ায়-মহল্লায় কমিটি গঠন করা হয় জাদুর বাক্স দেখার জন্য। জাদুর বাক্সের মায়ায়, আবেশে বুদ হয়ে থাকে সবাই। বুদ হয় জয়েফ উদ্দিনও।

বাক্স সংরক্ষণকারীদের একেকজনকে তার মনে হয় মর্তলোকের মহাদেব। জয়েফ ভাবে মহাদেবগণের সামনে উচ্চ স্বরে কথা বলা যাবেনা, তাদের মুখ নিসৃত কথাগুলোতো কথা নয়, মহাবাণী। এই মহাবাণীর এসপার ওসপার করা যাবেনা, তাই জয়েফ গলা টিপে খুন করে তার চরিত্রের প্রতিবাদী সত্বাকে। জয়েফ কাজ করে নিভৃতে। মহাদেবগণদের দেখলে জয়েফ নির্বাক হয়ে যায়, শ্রদ্ধায়, সম্মানে নুয়ে পড়ে।

কাজ চলে সমান্তরাল গতিতে অভিজ্ঞতাও বাড়ে। উপযোগীতা বিধির মত মন্ডা-মিঠাইও কেমন যেন ধীরে ধীরে তেতো হয়ে ওঠে। জাদুর বাক্সের জাদুুও সকলের কাছে উপযোগীতা হারিয়ে ফেলতে থাকে। ভগবান আবার আসেন। এবার আর ঘটা করে নয়।

প্রতিনিধিদের নিয়ে বসেন- জাদুর বাক্সের নতুন রূপ দেয়ার জন্য। প্রতিনিধি বাক্স সংরক্ষণকারীগণ ভাগ হয়ে পড়েন। ভগবানকে এই প্রথম দেখা যায় শেকস্পিয়রের হ্যামলেটের মত ডিলেমায় ভুগতে। (...to be or not to be that's the question ) ভগবান কূল পায়না কি করবেন। সিদ্ধান্ত দেন মতি, সলিমদের সাথে সোনালী হাত (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক)নাড়বেন।

মর্তলোকে ভগবানের এখন নিয়মিত যাতায়াত। সখিনা, কুতুবরা আতঙ্কিত থাকে হ্যান্ডশেকের ভয়ে। বাক্স সংরক্ষণকারীদের সহায়তায় ভগবান একদিন আবার মতি, সলিমদের সাথে গালাগালি ছেড়ে গলাগলি করেন। জয়েফ শুধু নিরবে দেখে আর শোনে। জয়েফের কাছে জাদুর বাক্স মোছার কাজ ভাল লাগলেও ভাল লাগেনা বাক্স সংরক্ষণকারীদের ক্রমান্বয়ে মহাদেব থেকে মহাভগবান হয়ে উঠার দৃশ্য।

সূর্যের চেয়ে বালি গরমের মত ভগবানের প্রতিনিধিরাই হয়ে উঠে একেকজন বড় ভগবান। জয়েফ উপলব্দি করে তার চারপাশে সব ভগবানস্ বাস করে, যারা তার সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। সকলের পেট বাড়ে, পকেট বাড়ে, বাড়েনা কেবল জয়েফ উদ্দিনের। তার চোখ থেকে খসে পড়ে আবেগের রোদ-চশমা। বাস্তবতার রেটিনায় সে দেখে বেলা অনেক বয়ে গেছে।

তার ক্ষিধা পেয়েছে। তার চাই কিছু বাড়তি পয়সা, যা দিয়ে সে কয়েক টুকরো রুটি কিনে খাবে। খাওয়াবে তার অসুস্থ্য মাকে। সে যায় ভগবানদের কাছে ভগবানস্রা তাকে মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। তাতে জয়েফের ক্ষিধা মেটেনা।

জয়েফ মনে মনে ভগবান বুকে পদচিহ্ন আঁকতে যায়, কিন্তু পারেনা। ভগবানদের মুখে সে প্রতিনিয়ত শুনে-“গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই...”। জয়েফের মনে পড়ে যায় ছোট বেলার স্কুলের দরিদ্র শিক্ষক আমিন স্যারের কথা, তিনি প্রায়ই বলতেন- “সাম্যের গেয়ে গান, ইমাম ঠিকই সামনে দাঁড়ান”। একদিন জয়েফ নিজেকে আবিস্কার করে একজন ভিক্ষুক হিসেবে, যে কিনা ভগবানস্দের দ্বারে-দ্বারে হাত পাততে যায়। জয়েফ লজ্জা পায়, সিদ্বান্ত নেয় ভগবানদের কাছে সে আর ভিক্ষা চাইতে যাবেনা।

সে শুধু চেয়ে থাকে...নিরবে কাঁদেনা, সরবে বিক্ষুব্দ হয়না, সবকিছুতেই হাসে। তার মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকে। এ হাসি যেন নজরুলের জাহান্নামের আগুনে বসিয়া পুষ্পের হাসির মত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।