আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ সুখী মানুষেরা

মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা কিংবা অক্ষমতা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত। তা হলো নিজের উপর নিয়ন্ত্রন

সুখ উপাখ্যান কুঁড়িগ্রাম বলে একটা জায়গা আছে বাংলাদেশের মানচিত্রে। এই জায়গাটা ২০টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে কিনা আমার জানা নেই। তবে আজকে এমনি পাঁচটি গ্রামের কথা বলবো, যাদেরকে মানচিত্রে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া অনেক মুশকিল। আর খুঁজে পেলেও তথ্য আপনাকে বিভ্রান্ত করবে।

ভৌগলিক হিসেব নিকেশের যে সীমারেখার, তা এড়িয়ে এই পাঁচটি গ্রাম এক হরিহর আত্না। এদের অন্যরকম ইতিহাসের ছিটেফোঁটাও আপনি পাবেন না শহুরে বিশালতর লাইব্রেরীর জ্ঞান ভান্ডারে। আপনাকে বেরিয়ে পড়তে হবে আপনার পরিচিত গন্ডির অনেক বাইরে। অনেক অনেক দূরে। শহরের কাঠিন্য থেকে অনেক দূরে বলেই হয়তো এতটা সহজ সরল জীবন যাত্রা।

আপনারা পৌঁছুতে পৌঁছুতে আমি না হয় ওদের গল্প বলতে থাকি। সুখ নগর পাঁচটি গ্রামেরই আলাদা নাম রয়েছে, রয়েছে আলাদা পরিচিতি। ধরেন কোনো ফুটবল টুর্নামেন্ট হচ্ছে, তখন তারা স্বনামে প্রতিনিধিত্ব করে। মেলায় নিজেদের বৈচিত্রময় আয়োজন তাদেরকে আলাদা করে চেনায়। তবে বাইরের কারো সামনে এই আলাদা পরিচয় ওরা কখনো দেয় না।

জিজ্ঞেস করলেই হাসিমুখে জবাব দেবে, সুখ নগর, গ্রামের নাম সুখ নগর। এই পাঁচ গ্রামের সুখ নগরের ঠিক কেন্দ্রে একটা কমন মাঠ আছে। খেলাধুলা, ঈদের নামায, মেলা থেকে শুরু করে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য এই মাঠেই সব আয়োজন হয়। সব মিলিয়ে পাঁচ গ্রামের গোপন রহস্য ছাড়া তেমন একটা বৈচিত্র্য খুব সহজে দৃষ্টি গোচর হয় না। ঠিক এই মুহুর্তে গ্রামে ঢুকলেই যে কেউ ঈদ বা অন্য কোনো উৎসব ভেবে ভুল করতে পারে।

আজকের দিনটা সুখনগরের জন্য একটা বিশেষ দিন। কেন্দ্রীয় মাঠে বসেছে বিশাল আয়োজন। ওদের ২৫ বছরের অপেক্ষা আর নিরলস প্রচেষ্টার ফল ওরা আজ পেতে যাচ্ছে। শুরুতে কিছু বুঝে না উঠলেও একটু খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে কোনো একদিনে এমনি একটা সভা বসেছিল। সে সভায় পাঁচ গ্রামের প্রতিনিধিরা মিলে গ্রামের সবার সম্মতিতে এক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

এই গ্রামটাকে তারা সবাই মিলে সুখী মানুষের গ্রাম বানাবে। এই গ্রামের প্রতিটা মানুষের লক্ষ্য হবে একটাই, নিজেকে সুখী করে গড়ে তোলা। আর গ্রামের সব মানুষ মিলে চাঁদা দিয়ে একটা সোনার মেডেল বানিয়েছে। প্রথম সুখী মানুষকে এটা উপহার দেয়া হবে। শুনে আমার একটু হাসি পেয়ে গেল।

এক ধরনের ছেলে মানুষী খেলায় মেতে থাকা মানুষগুলোকে দেখে একটু মজাও পেলাম। সুখী মানুষের সংজ্ঞা কি?এটাই জানতে চাইবেনতো? হা হা হো হো করে হাসবে ওরা সবাই। বলবে “আপনি সুখী কিনা সেটা কি আমি ঠিক করব?” কেউ সুখে আছে কি নাই এটা তার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আমি জানতে চাইলাম, কেউ যদি সোনার মেডেলের জন্য মিথ্যে বলে তখন? ওরা শুধু হাসে। “কিছু ছোটখাট হিসেবতো অবশ্যই আছে।

তবে একটা মানুষ সুখী হলি পরে তাকে দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন। আর আমাদের এখানে সবার সাথে সবার সম্পর্ক্টা অনেক কাছের। আমাদের সবার লইক্ষ্য এক। তবে নিজেদের মাঝে আমরা প্রতিযোগিতা করি না। বরং সুযোগ থাকলি পরে সাহায্য করি।

বুঝতে পারিছেন মশায়? আপনাদের শহুরে কাটাময় জীবন নয় আমাদের। ওসব আপনাদের বুঝে কাজ নেই। ” আজকে দবির উদ্দীন নামের এক লোককে সোনার মেডেল দেয়া হবে। তিনি হচ্ছেন অত্র এলাকার প্রথম সুখী মানুষ। এই মেডেল ২৫ বছর ধরে অপেক্ষা করেছে কারো গলার উঠার।

আরেকটা নতুন মেডেল কেনা হয়েছে। এই মেডেলটা দবীর উদ্দীনের হাতে তুলে দেয়ার সাথে সাথে নতুন মেডেলের অপেক্ষার শুরু। পুরো এলাকা জুড়ে একটা উৎসব উৎসব ভাব। গান বাজনা, হৈহৈ রৈরৈ একটা ভাব। এদের দেখে মনে হবে এদের সবাইকেই একটা করে মেডেল দেয়া হবে।

সময় বাড়ার সাথে সাথে একটু অদ্ভুত লাগছে, সাথে একটু অস্বস্তি। শুরুর দিকের কৌতুহল আর মজা ভাব কেটে গিয়ে কেন জানি একটা দম বন্ধ ভাব লাগছে। নিজেকে এখানে খুব বেমানান মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখনি ছুটে পালাই। তবুও একবার সেই লোকের মুখটা দেখে যাবার লোভ সংবরন করা অনেক বেশি কঠিন কাজ।

যার সুখে এত মানুষের মুখে এত হাসি, তার হাসি মুখ দেখে যেতে না পারলে হয়তো সারাজীবন আফসোস করতে হবে। গুঁটি গুঁটি পায়ে খুব ছোট খাঁট একটা মানুষ আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে মঞ্চের দিকে। সবাই হাততালি দিচ্ছে। কেউবা শীষ বাজাচ্ছে, ঢোল পিটাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে দেখছি, হমম, অবাক হবার মতন ব্যাপারই বটে।

আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া এই মানুষটা যেই সেই কোন মানুষ নন, একজন সুখী মানুষ। মনে মনে একটুও যে হিংসে হচ্ছে না তা না। জীবনে অনেক সেলিব্রেটি দেখেছি। অনেককেই পুরষ্কার নিতে দেখেছি। কখনো এমন অনুভূতি হয়নি।

মনের অজান্তে আমিও হাততালি দিতে শুরু করলাম। যাপিত জীবন ও একজন সুখী মানুষ দবীর উদ্দীনের জীবন পালটে গেল অনেকটাই। হঠাৎ তার গুরুত্ব বেড়ে গেল অনেকখানি। গ্রামের মানুষদের অপরিসীম ভালোবাসা তাকে ঘিরে। কারো বাসায় ভালো কিছু রান্না হলে একটু খানি চলে যায় দবীর উদ্দীনের জন্য, কারো ঘরে কোনো বিশেষ আয়োজন থাকলে ডাক পড়ে তার, কেউ কিছু একটা কিনতে গেলে তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চায়।

কোনো বিশেষ বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে তার জন্য বিশিষ্ট জনদের সাথে একটা বসার আসন। দবীর উদ্দীন প্রাণ খুলে হাসছে এমন ছবি দিয়ে সব দোকানে পোস্টার সাটানো। সবচেয়ে ভয়াবহ যেটা হলো তা হলো অত্র এলাকার সব কয়টা পাঠ্য বইয়ে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হলো। দবীর উদ্দীন একজন সুখী মানুষঃ Dabir Uddin is a Happy Man। কেনা চায় এত এত সন্মান, এত ভালোবাসা।

হয়তো সুখী মানুষের তকমাটা তার সুখে এক ধরনের পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছে। শেষের গল্প মাস তিনেক পরে কোনো এক বৃষ্টি স্নাত দুপুরে চুপি চুপি গেলাম দূর থেকে সুখী মানুষটাকে এক নজর দেখতে। মানুষতো নয় আসলে, সুখের স্বরূপ আবিষ্কারে। দবীর উদ্দীনের বাসার কাছাকাছি আসতেই দেখি তার বাড়ির বারান্দায় বেশ কয়েকজন মুরুব্বী গোছের মানুষ বসে আছে। মাঝখানে থমথমে মুখ করে বসে আছে দবির উদ্দীন।

কোন কারন নেই, তাও হঠাৎ করে বুকটা ধুক করে উঠলো। আমি একটু শোনার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে ভেতরে। “তোমার সমস্যা কি দবীর মিয়া? শরীর খারাপ?” “জ্বী না” “জমি জমা নিয়া কুনু ঝামেলা হইছে কারো সাথে?” “জ্বী না” “পরিবারে কুনু সমস্যা হইছে?” “জ্বী না” “প্রতিবেশিদের কারো সাথে কুনু ধরনের সমস্যা?” “জ্বী না, সেই রকম কিছু হয় নাই। ” “তাইলে সমস্যাটা কি খুইলা বলবাতো? নইলে সমাধান কেম্নে দিমু?” কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে মাথা নিচু করেই দবীর বলতে থাকে “কয়দিন ধইরা এই সমস্যা হইতাছে। আমি রাইতে ঘুমাইতে পারি না।

আর কোনো কারনে ঘুমাইলেও ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেইখা ঘুম ভাইঙ্গা যায়। চোখ দুইটা বন্ধ করলেই ভয় লাগে। ঠিক বুঝাইতে পারুম না কিরাম ভয়। মনে হয় আমার সব কিছু হারাইয়া যাইব একদিন। দিনগুলা অহন যেমন কাটতাছে তেমন সুন্দর কাটব না।

আমারে লোকজন খাতির করব না, কেউ আমার দিকে ফিইরা তাকাইব না,বই থেইকা আমার নাম মুইছা ফালাইব, আমার মেডেল কাইরা নিয়া যাইব। আমার খালি ভয় হয়, আমার সুখ যদি কইমা যায় কুনুদিন? আমি তখন কেম্নে থাকমু? আমারে কইয়া দেন আমি তখন কি করুম। ” বলেই হু হু করে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করে দবীর। কয়েকদিনের বিশাল চাপ প্রশান্তি হয়ে হয়তো গড়িয়ে পড়ছে দু চোখ বেয়ে। বৃষ্টির টিপ টিপ শব্দ ছাপিয়ে যাচ্ছে কান্নার শব্দ।

কেউ কোনো কথা বলছে না। কারো জানা নেই এই প্রশ্নের কি উত্তর। এই সমস্যার কি সমাধান। আযান হচ্ছে মসজিদে। দবীর উদ্দীনকে হয়তো একটা কিছু বুঝিয়ে সবাই মসজিদের দিকে রওনা হলো।

আমি ফিরতি পথ ধরলাম। পেছনে না তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারছি, একজন দবীর উদ্দীন শক্ত হাতে আকড়ে ধরে আছে মেডেলটা। কিছুতেই এটা হাতছাড়া হতে দেয়া যাবে না এটাকে। আর কখনো খোজ নেয়া হয়নি সুখী মানুষ দবীর উদ্দীনের। জানা হয়নি এখনো গ্রামের সবাই সুখের পিছু ছুটছে কিনা।

হয়তো সুখের আস্বাদনের কৌতুহলী আমার এই মনটাও মরে গেছে ততদিনে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।