আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জ্যাকি চ্যান-এশিয়ার কুংফু সুপার স্টার

ভালো আছি
কিংবদন্তীর নায়ক কুংফুর রাজা ব্র“সলী মস্তিষ্কে অজ্ঞাত কারণে রক্তক্ষরণের ফলে ১৯৭৩ সালে মারা যান। ব্র“সলীর আগে কুংফু ছিল স্রেফ হিংস্রতায় ঠাসা মারামারি। তিনিই প্রথম এটিকে শিল্প বা কলার পর্যায়ে নিয়ে যান, কুংফু পরিণত হয় সম্পূর্ণ দৃষ্টিনন্দন একটি খেলাতে। ব্র“সলীর মৃত্যুর পরে সবাই হায় হায় করে উঠেছিল কুংফুর অপমৃত্যু হলো ভেবে। কারণ ব্র“সলীর জায়গা দখল করবার মত ব্যক্তিত্ব গোটা এশিয়াতে ছিল না।

অনেক দিন কুংফু রাজার সিংহাসন ছিল খালি। তারপর গুরুর শূন্যস্থান পূরণ করবার জন্যই যেন আবির্ভাব ঘটল জ্যাকি চ্যানের, এশিয়ার নতুন সূর্য। কুংফুর সঙ্গে কমেডি মিশিয়ে তিনি সৃষ্টি করলেন ভিন্ন ধারার একটি আঙ্গিক। ব্র“সলীর মত তিনিও কুংফুকে দৃষ্টিনন্দন করে তুললেন অসাধারণ দক্ষতা দিয়ে। জ্যাকির ছবি অ্যাকশনে ভরপুর, ভায়োলেন্স তিনি এড়িয়ে যান ইচ্ছে করেই।

কারণ জ্যাকির বিশ্ব জুড়ে কোটি কোটি ভক্তদের বেশিরভাগই শিশু-কিশোর। কোমলমতি এই শিশু-কিশোরদের মনে হিংস্রতার বীজ রোপণ করতে চান না বলেই রক্তপাতের ব্যাপারটি জ্যাকির ছবিতে থাকে না বললেই চলে। জ্যাকি চ্যানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তিনি কখনও এ্যাকশন দৃশ্যে ডামি ব্যবহার করেন না। আর সব ধরনের এ্যাকশন দৃশ্যে নিজেই অভিনয় করতে গিয়ে যে কতবার হাত, মুখ, নাক ভেঙেছেন তার হিসাব নেই। একবার পঞ্চাশ ফুট উচু এক বিল্ডিং থেকে ঝাপিয়ে পড়লেন আরেক বিল্ডিং-এর জানালা লক্ষ্য করে।

প্রথম ‘টেক’ ঠিকই ছিল। কিন্তু স্ট্যান্টম্যান হিসাবে ক্যারিয়ার শুরু করা খুঁতখুঁতে জ্যাকির মনে হলো লাফানোর দৃশ্যটা তেমন নিখুঁত হয়নি। তাই দ্বিতীয়বারের মত ‘টেক’ নিতে বললেন পরিচালককে। আর তখনই ঘটে গেল ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। জানালা ভেঙে, নিচে যে সামিয়ানা রাখা ছিল, ওটা ছিড়েও তিনি আছড়ে পড়লেন কংক্রিটের মেঝের উপর।

পড়েই থাকলেন, আর উঠলেন না। কিন্তু লোকে যে ঠাট্টা করে বলে জ্যাকির বেড়ালের মত নয়টা জীবন, এটা প্রমাণ করতেই যেন তিনি সেবারে মারাত্মক আহত হয়েও বেঁচে গেলেন প্রাণে। জ্যাকির পুরো নাম জ্যাকি চ্যান কোং সাং। এশিয়ার সবচে’ জনপ্রিয় এই তারকাটির আজ সব আছে, যা চেয়েছেন তা-ই পেয়েছেন। কিন্তু তার জন্ম সোনার চামচ মুখে দিয়ে নয়।

১৯৫৪ সালের ৭ এপ্রিল হংকং-এ জ্যাকির জন্ম। এতই গরীব ছিলেন বাবা-মা যে জ্যাকির জন্মের পরে তারা ছেলের ভরণপোষণ যদি করতে না পারেন সেজন্য ডেলিভারির ডাক্তার জ্যাকির বাবা-মাকে দু’শ ডলার দিয়ে সদ্যোজাত সন্তানটিকে কিনে নিতে চেয়েছিলেন । জ্যাকির বাবা রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের এক পারিবারিক বন্ধু এসে বললেন, ‘তোমাদের দু’জনেরই বয়স এখন চল্লিশের ওপরে, হয়তো এটাই তোমাদের একমাত্র সন্তান। আর সন্তান না-ও হতে পারে।

কাজেই ওকে বেচে না দেয়াই ভাল। ’ পরে ওই বন্ধুই হাসপাতালে বিল মিটিয়ে দেন। ছোটবেলা থেকেই ব্র“সলীর ভীষণ ভক্ত জ্যাকি চ্যান। ব্র“সলীর কোন ছবি দেখা তিনি বাদ দেননি। সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে ল্যাম্পপোস্টে লাথি মেরে নিজেকে ব্র“সলীর ভূমিকায় কল্পনা করতে খুব ভাল লাগত তার।

জ্যাকির বয়স যখন সাত, অস্ট্রেলিয়া হাউজকীপিং-এর চাকরি পান তার বাবা-মা। তারা ছেলেকে হংকং-এর বেইজিং অপেরার স্কুলের এক মার্শাল আর্টের ওস্তাদের কাছে রেখে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। ওই অপেরা স্কুলে জ্যাকি প্রথম কুংফু শেখেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক য়্যু শানউয়ান তার সেরা সাত ছাত্রকে নিয়ে ‘সেভেন লিলি ফরচুনস’ নামে একটি দল গঠন করেন। এই সাত ছাত্রের মধ্যে পরবর্তীতে সবচে’ নাম করেন জ্যাকি চ্যান।

আট বছর বয়সে জ্যাকি প্রথম ছবিতে অভিনয় করেন। পরবর্তী আট বছরে ডজন খানেক ছবিতে অভিনয় করেছেন জ্যাকি। কিন্তু ওসব ছবিতে অভিনয় করে তেমন আনন্দ পাননি। তার তখন লক্ষ্য ছিল অভিনেতা নয়, স্ট্যান্টম্যান হবেন। ১৯৭০ সালের গোড়ার দিকে হংকং-এর চলচ্চিত্র ভুবনে দুঃসাহসী স্ট্যান্টম্যান হিসাবে নাম ছড়িয়ে পরে জ্যাকির।

তবে অভিনেতা হিসাবে প্রথম বড় ধরনের সুযোগ পান ১৯৭৬ সালে ‘নিউ ফিস্ট অভ ফিউরি’ নামে একটি কুংফু ছবিতে। ছবিতে জ্যাকির মার্শাল আর্ট দেখে সবাই তাকে দ্বিতীয় ব্র“সলী বলে ডাকতে শুরু করে। জ্যাকির চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার অবিকল ব্র“সলীর মত। ব্র“সলীও হংকং-এ এসে প্রথম তারকা খ্যাতি লাভ করেন। জ্যাকির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।

অচিরেই তিনি হয়ে ওঠেন এশিয়ার সেরা সুপারস্টার। ব্র“সলীর স্বপ্ন ছিল হলিউডেও নাম করবেন। ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ বিশ্বব্যাপী ব্যবসা সফল হলে হলিউডে তাকে ঘিরে উন্মাদনা দেখে যেতে পারেননি ব্র“সলী, তার আগেই মারা গেছেন তিনি। জ্যাকি চ্যান তার স্বপ্ন পুরুষের চেয়ে সৌভাগ্যবান। হলিউডকে ঘিরে তার র্টাগেট সফল হয়েছে ‘রাশ আওয়ার’ সুপারহিট হবার সুবাদে।

জ্যাকির ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ ছবিটিও হয়েছে দর্শক নন্দিত। যদিও আশির দশকের শুরুতে জ্যাকি কয়েকটি হলিউডি ছবিতে অভিনয় করেছেন। কিন্তু ওগুলো তেমন সাড়া জাগাতে না পারলেও হাল ছেড়ে দেননি জ্যাকি। বলেছেন, ‘শুধু ভক্তদের অগণিত চিঠিই আমাকে খারাপ সময়গুলোতেও মাটির উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করেছে। ’ ১৯৭৮ সাল নাগাদ জ্যাকি চ্যান হয়ে ওঠেন এশিয়ার একজন পূর্ণাঙ্গ মুভি স্টার।

তখন থেকে এশিয়ার প্রতিটি কুংফু তারকা জ্যাকি চ্যান হবার স্বপ্ন দেখছেন। তবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মাত্র গুটিকয় তারকা পরিচিতি পেয়েছেন। এদের মধ্যে আছেন জেট লী, চো উন ক্যাট, মিশেল ইয়ো প্রমুখ। জ্যাকির ‘ড্রাঙ্কেন মাস্টার’ ছবিটিকে সর্বকালের র্শীষ দশ মার্শাল আর্ট ছবির মধ্যে ধরা হয়। জ্যাকি শুধু অভিনেতাই নন, তিনি একজন সফল চিত্র-নাট্যকার ও পরিচালকও বটেন।

তবে পরিচালক হিসাবেও তিনি বড্ড খুঁতখুঁতে। আর এ জন্য হংকং-এ অন্যান্য পরিচালকদের যেখানে একটি ছবি শেষ করতে লাগে মাত্র তিন মাস, সেখানে জ্যাকি ছবি বানাতে বছর পার করে দেন। ১৯৯১ সালে তার ‘আর্মার অভ গড-২ অপারেশন কনভর’ মুক্তি পায়। ১৩ মিলিয়ন ডলারে নির্মিত ওই সময় হংকং-এর সবচে’ ব্যয়বহুল এ ছবিটি শেষ করতে জ্যাকির প্রায় দু’বছর লেগেছে। উল্লেখ্য, জ্যাকি তার বেশিরভাগ ছবি নিজেই পরিচালনা করে থাকেন।

জ্যাকির স্বপ্ন একদিন ক্রামার ভার্সাস ক্রামার কিংবা দ্য সাউন্ড অভ মিউজিক-এর মত ছবি বানাবেন। নিজেই বলেছেন, ‘আর কতকাল মারামারি করব। পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। এখনও মারামারি চালিয়ে যাচ্ছি। তবে আগের মত এক টেকে আর পারি না।

জ্যাকি অগামীতে দুটো ছবি বানাবেন। চেঙ্গিস খাঁন ও ঐতিহাসিক চীনা কিংবদন্তী নগক ফেইকে নিয়ে। এ দুটি ছবিতেই আসল সেনাবাহিনী ব্যবহারের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, স্পেশাল এফেক্ট নয়। জানিয়েছেন, ‘আমি পর্দায় সত্যিকারের আর্মি এবং মরুভূমিতে সত্যিকারের ঘোড়া দেখাতে চাই। জ্যাকি এখন টাকার বিছানায় ঘুমান।

অথচ একসময় দাঁত মাজার ব্রাশ কিনবার পয়সাও তার ছিল না। সে দিনগুলোকে আজও ভোলেননি তিনি। তাই তিনি তার বেশিরভাগ সম্পদ বিলিয়ে দিচ্ছেন গরীব দুঃখীদের মাঝে। ইদানীং সমাজ সেবামূলক কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় জ্যাকিকে। এর কারণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, গরীব ঘরে জন্ম আমার।

দশ বছর একটি অপেরা মার্শাল আর্টস স্কুলে ছিলাম। প্রতি মাসে রেড ক্রসের লোকেরা আসত কাপড়, জুতো কিংবা দুধ নিয়ে। একবার এক প্রীস্ট আমাকে কিছু দুধ দিলে আমি বললাম, ‘ধন্যবাদ’। তিনি বললেন, ‘আমাকে ধন্যবাদ দিয়ো না। তুমি যখন বড় হবে, তখন অন্যদেরকে সাহায্য করবে,’ আমি ওই মানুষটির মুখ আজও ভুলিনি।

‘পরে আমি জ্যাকি চ্যান ফাউন্ডেশন গড়ে তুলতে চাইলাম। কিন্তু কাল-পরশু করে আর কিছুতেই ফাইন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছিল না। একদিন যুগোশ্লোভিয়ায় ‘আর্মার অভ গড (১৯৮৬)’ ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে প্রায় মারা যাচ্ছিলাম। হাসপাতালে শুয়ে মনে হলো আমার অনেক কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে। তারপর জ্যাকি চ্যান ফাউন্ডেশনের জন্য কাজ শুরু করে দিলাম।

’ জ্যাকি চ্যান হংকং-এর পো লিউং কাক চ্যারিটি থেকে দশটি এতিম বাচ্চাকে দত্তক নিয়েছেন, অনেক ক্যান্সার রোগী শিশুদের ব্যয়বহুল অপারেশনের খরচ যুগিয়ে তাদের জীবন রক্ষা করেছেন জ্যাকি। তাকে ইউনাইটেড নেশনস গুডউইল অ্যামবাসাডর করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের অ্যান্টি স্মোকিং অ্যামবাসাডরও জ্যাকি। এজন্য তিনি ধূমপানও ছেড়েছেন। জ্যাকি বলিউড শিল্পীদের সঙ্গেও অভিনয় করেছেন।

‘মার্ডার’ খ্যাত নায়িকা মল্লিকা সেরাবতকে নিয়ে তিনি চীনা মিথলজির উপর ‘দ্য মিথ’ ছবিটি করেন। প্রথমে মল্লিকাকে তিনি নিতে চাননি, কিন্তু মল্লিকা যখন বলেন যে তিনি নিজের স্ট্যান্টগুলো নিজেই করবেন তখনই জ্যাকি রাজি হন। বলিউডের মার্শাল আর্ট হিরো অক্ষয় কুমার জ্যাকি বলতে অজ্ঞান। তার স্বপ্ন জ্যাকির সঙ্গে ছবি করবেন। ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে ‘সেভেন ডেডলি আর্টস’ - এ অক্ষয়ের মার্শাল আর্ট দেখে দারুণ মুগ্ধ জ্যাকি।

তিনি অক্ষয়ের দুটি ছবিও দেখেছেন। মার্শাল আর্টের এই দুই অভিনেতা হংকং ট্যুরিজম বোর্ডের চেষ্টায় একত্রিত হন। জ্যাকি অক্ষয়ের প্রশংসা করে বলেন, ‘সাধারণত মার্শাল আর্ট অভিনেতাদের চেহারা সুরত ভাল হয় না। কিন্তু তুমি একদমই ব্যতিক্রম। ’ এছাড়া জ্যাকি আর এক মার্শাল আর্ট হিরো জেট লীর সাথে ‘দ্য ফরবিডেন কিংডম’ ছবিতে অভিনয় করেছেন।

তাকে নিয়ে ‘জ্যাকি চ্যান এ্যাডভেঞ্চারস’ নামে একটি কার্টুন ছবিও তৈরি হয়েছে। জ্যাকি এখনও চুটিয়ে ছবি করে চলেছেন। তবে তার ছেলে জেসির আবার গানের দিকে ঝোঁক। সে খুব ভাল গান লেখে, মিউজিক বাজায়, নাচতে পারে। আগে ছেলেকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখলেও আজকাল আর তার স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপ করেন না জ্যাকি।

জ্যাকির বয়স বাড়লেও এ নিয়ে তার দুশ্চিন্তা নেই। আর ফিল্ম থেকে কবে অবসর নেবেন, জানেন না। মৃত্যুর আগে ভাল ভাল আরও কিছু কাজ করে যেতে চান এশিয়ার সবচে’ জনপ্রিয় কুংফু তারকাটি। সে সব কাজ করতে পারলে তবেই মরে শান্তি পাবেন তিনি।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.