আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকা ক্লাব ও সাম্রাজ্যবাদের সেই চিরায়ত কৌশল

আমি একা। খুব একা । আমার কেউ নেই। অথবা আমি আপনকে চিনিনা। অথবা আপন আমাকে চেনেনা।



মানুষের বিশ্বাসের অপর নামই হলো ধর্ম। বিশ্বাসের বিবর্তনে মানুষের আচরনের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে ধর্ম বিবর্তিত বা বিকশিত হয়। অপশক্তিমানের কর্তৃত্বে পড়ে ধর্ম ব্যক্তিক রুপ ধারন করে। পুরোনো আস্থায় নবাগত অযৌক্তিকতাকেই আমজনতা কখনো কখনো ধর্ম বলে ভূল করে। যুগে যুগে যৌক্তিকতার মানদন্ডে পরিক্ষীত হয়ে ধর্মকে তাই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হয় এবং বলা চলে থিতু হতে হয়।

এভাবেই ধর্ম মানুষের বিশ্বাস কিংবা মানুষের বিশ্বাসই ধর্ম হয়ে ওঠে। মানুষের তথা আমজনতার আচরনই যেখানে ধর্ম হয়ে ওঠে , সেখানে ধর্মালোচনাই জনতার আচরনের আলোচনা বলে গন্য হবে নি:সন্দেহে। আচরনের ধর্ম হিসেবে কিংবা ধর্মের আচরন হিসেবে পোষাক একটি আদি ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা,এটি অনস্বীকার্য। প্রশ্ন হতে পারে,সেই পোষাকী আলোচনায় শার্ট,প্যান্ট,কোট,টাই-এর অবস্থান কোথায়? ধর্মে নাকি আচরনে? আসলে কোথাও না। অর্থকড়ি টাকা পয়সার অফুরন্ত লোভ-লালসা, পুজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদনিয়ে যে যান্ত্রিক বিশ্বায়ন,সে বিশ্বরই আবরন এই পোষাকগুলো।

খ্রিষ্ট্রীয় সমাজে ধর্মীয় কিংবা ভৌগোলিকতার কারনে উপরোক্ত পোষাকগুলো আচরনের মর্যাদা পেয়েছে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা। এই আচরন কিংবা সমর্থন অন্যত্র স্থান পায়নি, যেমন অন্যত্রের আচরন স্থান পায়নি ইউরোপে। সামষ্টিক স্বাচ্ছন্দ্য, যৌক্তিক আচরন তথা ধর্মাচরনের বাহিরে যে আচরনটি রয়েছে তা নিতান্তই বৈষয়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট, অযৌক্তিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত পুজিবাদী ধারনা প্রসূত। বাঙ্গালীরা লুঙি পরে যেমন ইউরোপিয়রা প্যান্ট পরে। আবার আরবের লোকেরা যেমন পায়জামা-পান্জাবী পরে, ভারতের অনেকাংশে পরে ধুতি-পান্জাবী।

মন দেয়া নেয়ার মতোই পোষাকাচরনের ও নেয়া দেয়ার ব্যাপার আছে বটে এবং তার ভুরি ভুরি উদাহরন বিদ্যমান। এসব ঘটনার পরম্পরাই আমরাও পেয়েছি পায়জামা-পান্জাবী ,বোরখা,হিজাব প্রভৃতি। কিন্তু কেন আমরা শার্ট পরি, প্যান্ট টাই পরি তার উত্তর অত সরল নিষ্পাপ নয়। যার সুন্দর কোন উত্তর নেই তারই ডাক নাম অযৌক্তকতা। স্বাচ্ছন্দ্য যৌক্তিক আচরন তথা ধর্মাচরনের বাহিরে তৃতীয় বৈষয়িকতার বদভ্যাস চর্চাই আমাদের বাবু আর ডিস্কো সাজার একমাত্র যুক্তি( নাকি কুযুক্তি)।

সত্য ও সুন্দর প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবী জুড়ে যুগে যুগে বিভিন্ন বেশে,বিভিন্ন নামে বিভিন্ন বিপ্লব সাধিত হয়েছে এবং হচ্ছে। ভবিষ্যতে ও সে ধারা অক্ষুন্ন থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কথা হচ্ছে কোথাকার কোন বিপ্লবী কবে কোথায় কোট টাই আর বাবু সেজে প্রানবাজি রেখে মাঠে ময়দানে নেমেছে? না বাংলাদেশে না বিদেশে। সত্যাচরন তথা ধর্ম প্রতিষ্ঠায় প্যান্ট টাই নিতান্তই লজ্জাবনত। বরং লুঙি-গামছা,পাজামা-পান্জাবীর অর্জিত বিশ্বে প্যান্টটাই মুনাফিকের মতোই কাচুমাচু করে সুবিধাভোগে ব্যস্ত।

যে বাংলায় রক্ত ঝরায় লুঙি-গামছা,সেই বাংলায় পুজির বিকাশ প্রতিষ্ঠায় নেমেছে কোট টাই প্যান্ট। এইসব তথাকথিত পেশাদারি,বৈষয়িক পোষাক-আসাকের দৌরাত্ন এতই বেড়েছে যে তা জনতার পোষাক উতখাতের ও ষড়যন্ত্র করে। তুরস্কের কথাই দেখুন, সাম্রাজ্যবাদের দোসর হালের সেক্যুলারিজম অস্রের বলে সেখানে এতই বলীয়ান যে, নিজেদের পোষাকটি পরা নির্বাচিত মহিলা সাংসদকে সংসদে ঢুকতে দেয়া হয়নি। তিনি হিজাব পরতে পারবেন না অথচ স্যুট-প্যান্ট পরতে পারবেন! অবশ্য তার জবাবটিও ছিল বুদ্ধিদীপ্ত এবং মূর্খদের গালে চপেটাঘাতের মতো। “আমি আমার মাথা ঢেকেছি,মগজ ঢাকিনি”, তার জবাবটি ছিল এই রকম।

সাম্রাজ্যবাদের কালো ছায়া ঢেকে দিয়েছে বামদের কথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ধারনাটিকেও। ভেজাল কমিউনিস্ট সরকারের দেশ ফ্রান্সে হিজাব নিষিদ্ধ করে আইন হয়,অন্য কোন পোষাক নিয়ে নয়। হালে আমাদের দেশেও কিছু পাতি বুদ্ধিজীবী,তথাকথিত শিক্ষকদের হাতে নিগৃহীত হয়েছে কোন কোন পর্দানশীল ছাত্রীরা। সাহেব হওয়ার, স্মার্ট হওয়ার, টিভি চ্যানেলের চোখ ধাধানো জৌলুসধারী মডেল হবার উগ্র বাসনা এইসব পাতি বুদ্ধিজীবী,শিল্পপতিদের দেউলিয়া করে দিয়েছে। বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক,গভেষক ফরহাদ মজহারকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই।

ঘটনার সূত্রপাত, ঢাকা ক্লাব(ক্লাব শব্দটা কেমন মদ মদ গন্ধযুক্ত) -এর নিমন্ত্রিত অতিথি হয়েও কেবল মাত্র আমজনতার পোষাক লুঙি পরার কারনে তাকে ভেতরে প্রবেশে বাধা দেয়া নিয়ে। এ বিষয়ে সাক্ষাতকারে ক্লাবের সভাপতি সাদাত হোসেন সেলিম খুবই বিরক্তিকর আত্নঅহংকারে বলেন অনেক বরেন্য ব্যক্তিবর্গ এই ক্লাবের সদস্য। স্মরন রাখা প্রয়োজন, একজন পাকিস্তানী ও একজন ভারতীয় কূটনৈতিককে এর আগে উক্ত ক্লাবে প্রবেশে বাধা দেয়া হয় শার্ট-প্যান্ট না পরে তাদের নিজস্ব পোষাক পাজামা-পান্জাবী ও ধূতি পরার কারনে। পরে তারা অনুমোদিত পোষাক পরেই নাকি ক্লাবে ঢুকেছেন! হায়রে মজার ক্লাব। মদ আর রমনী মন্থন, রাজনীতির পট-পরিবর্তনের কূট কৌশল এখান থেকেই নাকি শুরু হয়।

বাহিরে ‘মাদকে না বলো’ শ্লোগানধারী লোকগুলোর নিরাপদ আড্ডাস্থল কি ঢাকা ক্লাব নয়? আমেরিকার ঘুষের টাকায় নিজ দেশের হুজুর মেরে সাফ করা পাকিস্তানী সরকারের দূত কিংবা গুজরাটে মুসলিম নারীর পেট চিরে জীবন্ত সন্তান বের করে এনে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠাকাংখী ভারতীয় সরকারের দূত-এই উভয় বীর বাহাদুররা নিরবে নির্লজ্জের মতো পোষাক পরিবর্তন করে ক্লাবে প্রবেশ করেন। সত্যিই তারা বরেন্য ব্যক্তি অন্তত ক্লাবের সভাপতির ভাষ্যমতে। আমরা জনতা প্রকৃতই অহংকার করি , গর্ভ করি ফরহাদ মজহার অন্তত ‘বরেন্য” হতে জাননি। অবশ্য তিনি ভুলে যাওয়া জাতির সামনে শেখ সাদীর কাহিনীটি নতুন করে জীবন্ত করে তুললেও তুলতে পারতেন। আমাদের দেশের ব্যাংক,বীমা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে এখন শাট-প্যান্ট-টাই পরাই অঘোষিত নির্দেশ।

বিশেষ করে বিদেশী ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি দেশী প্রাইভেটগুলোও এ পোশাক পরাকে বাধ্যতামূলক করেছে। শুধূ তাই নয়,শুনলে অবাক হতে হয় যে,অনেক প্রতিষ্ঠান নাকি তার কর্মচারী-কর্মকর্তাদের প্রতিদিন সেভ করে অফিস করতে বাধ্য করে! আমার কাছে এটাকে যতনা আধুনিকতার চর্চা বলা হচ্ছে তার চেয়েও বেশী ইসলামবিদ্বেষী মানসিকতার প্রেক্ষাপট তৈরীর চর্চা মনে হচ্ছে। এ কথা বোধ হয় বলার অবকাশ রাখেনা যে, বাংলাদেশে প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঈর্ষনীয় অবস্থানে আছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। তারা কিন্তু দিব্যি পায়জামা পান্জাবী শাট প্যান্ট প্রভৃতি নিয়েই নির্বিঘ্নে মনোযোগের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। চাপিয়ে দেয়া কোন ব্যাপার সেখানে নেই।

পত্র-পত্রিকা,টিভি চ্যানেল, বহুজাতিক কোম্পানীর বিজ্ঞাপনী সংস্থা আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোরপ্রভূত অবদান রয়েছে আমাদের জাতীয় পোষাকের প্রতি বিতৃষ্ঞা উৎপত্তিতে। হাল আমলে গ্রাম-গন্জের ইংলিশ মিডিয়াম বা কিন্ডার গার্ডেন স্কুলগুলোও নির্বোধ বাচ্চাদের( এমনকি মেয়েদেরও) টাই প্যান্ট-এর চর্চা শেখাচ্ছে। পাঠক লক্ষ্য করুন,এখন আর সাম্রাজ্যবাদীরা শুধূ শিক্ষার ভেতর দিয়েই মগজ ধোলাই দিছ্ছেনা, পোষাকাচরনের ভেতর দিয়েও দিচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের চর্চা এভাবেই সেকেলে সনাতন পদ্ধতি ছেড়ে আরো নব সংস্করন নিয়ে হাজির হচ্ছে। আর সাম্রাজ্যবাদের নোংরা ধ্যান-ধারনাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে আমাদের একশ্রেনীর সুশীল আর তথাকথিত গনতান্ত্রিক সরকারগুলো।

কেউ কি কল্পনা করতে পারেন আমাদের হাসিনা-খালেদা পর্দা করা ছাড়া সৌদি আরবে ঢুকবে অথবা মাথায় হিজাব পরে কোন মুসলিম রমনী ইউরোপের কোন সমুদ্র সৈকতে আনন্দ ভ্রমনে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু ইউরোপীয় কোন বখাটে রমনী আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, পোষাককে থোয়াই কেয়ার করে অশ্লীল পোষাক-পরিচ্ছদ পরে দিব্যি আমাদের সমুদ্র সৈকতগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাধা দেবার কোথায় কেউ তো নেই-ই উল্টো দেশীয় লুঙি-গামছা কে বাধা দেবার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে ঢাকা ক্লাবগুলো। কিছুদিন আগে একটা মজার সংবাদ পত্র-পত্রিকায় সম্ভবত সবাই দেখে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ অপচয় রোধ করার জন্য সচিবদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন টাই-স্যুট পরিহার করার জন্য।

যদি ও বিদ্যুতের সাথে এসবের সম্পর্ক যৎসামান্য তথাপি দেশীয় পোষাকের স্বার্থে এই নির্দেশটি অনেকেরই ভালো লেগেছে। কিন্তু যেহেতু নির্দেশটি শেখ হাসিনা তাই আশ্বস্ত হওয়া মুশকিল ছিল। আশংকাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েছে। মুজিব কোট প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল প্রধানমন্ত্রীর এসব সৎ (?) কাজের আদেশ নির্দেশ। পরিশেষে শ্রদ্ধেয়রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজ উদ্দীন আহমেদের একটা লেখা দিয়ে ইতি টানছি।

“১৮৩৫ সালে লর্ড মেকলে (Macauley) কর্তৃক প্রবর্তিতহয় শিক্ষানীতি। ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি ও জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য ধারা বর্জন করে সাধারণ শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি ছিল এই নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। ভারত শাসনে এই অঞ্চলে উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে তাদের সহায়ক ও সমর্থক গোষ্ঠীতে রূপান্তর করাই ছিল এই শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য। মেকলের নিজের কথায়: এই মুহূর্তে এমন এক শ্রেণী সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে যে শ্রেণী আমাদের এবং লাখ লাখ শাসিতের মধ্যে ব্যাখ্যাকারীর ভূমিকা পালন করবে। এ শ্রেণী এমন এক শ্রেণী হবে, যারা রক্তে ও বর্নে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, অভিমত, নীতিবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিতে হবে ইংরেজ।

[We must at present do our best to form a class whom we govern, a class of persons, Indian in blood and colour but English in taste, in opinions, in morals and in intellect.]। তখন থেকে এ দেশে আসে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি শব্দ। ইংরেজির মাধ্যমে লেখাপড়া শিখে সরকারি চাকরি লাভ, ব্যবসা-বাণিজ্যে অগ্রগতি অর্জন ইত্যাদি লোভনীয় ক্ষেত্রে আকৃষ্ট হয় সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা। ” আমাদের সর্বস্তরের জনগন এবং বিশেষ করে ঢাকা ক্লাবের মুজাহিদুল ইসলাম ও সাদাত হোসেন সেলিমরা এই ইতিহাসগুলো মনে রাখলে সবারই মঙ্গল হবে। কেননা ময়ূরপুচ্ছ পরলেই কাক ময়ূর হয়ে যায়না।

14/10/2009 শরীফ হোসাইন মৌন email: Mob: 01670495397

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.