আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আমাদের গলাবাজি, আমাদের দায়িত্ববোধ

রাজনীতি ও অর্থনীতি এই দুই সাপ পরস্পর পরস্পরকে লেজের দিক থেকে অনবরত খেয়ে যাচ্ছে

এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোনো সশস্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফোজদারীতে সোপর্দ কিংবা দন্ডদান করিবার বিধান সম্বলিত কোন আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোনো বিধানের সহিত সামঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থী, আই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য হইবে না কিংবা কখনও বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে না। -গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, ধারা-৪৭ (৩)। দেশ চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছে। বিচার করবে না এ কথাও তারা বলছে না।

তবে বলার ক্ষেত্রে আগে গলায় যে জোরটি ছিল তা যেন মনে হয় খানিকটা কমে এসেছে। একবার তো দিন-তারিখও প্রায় দেওয়া হয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পর শুরু হবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই প্রণীত হয়েছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইবুনাল) অ্যাক্ট’। সরকার বলছে এই আইনেই বিচার করা হবে।

১৯৭৩ সালে করা আইন দিয়ে ২০০৯ সালে বিচার করতে হলে আইনটির খানিকটা সংশোধন করা প্রয়োজন বলেই অনেকে মনে করেন। বিশেষ করে আইনটি আন্তর্জাতিক মানের কিনা সে প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে সকলেই এই প্রশ্নটি তুলছেন। আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য আইন না হলে বিচার করা সম্ভব হয়তো হবে না। দেশে একটি আইন কমিশন রয়েছে।

তাদের একটি কাজ হচ্ছে আইনকে সংশোধন বা পরিমার্জন করা। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইবুনাল) অ্যাক্ট’ নিয়ে তারা কাজটি করছে। আইন কমিশনের একটি ওয়েব সাইট রয়েছে। কমিশন সাধারণত সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিয়ে আইন সংশোধনের সুপারিশ করে। ওয়েব সাইটে গিয়ে অবাকই হলাম।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আমরা অনেক কথা বলছি। বিচার করার দাবি জানাচ্ছি জোড়ালো গলায়। কিন্তু আমরা যারা গলাবাজি করছি তাদের অনেক কিছু করারও আছে। সেই কাজটি যে আমরা করছি না তার প্রমান পাওয়া যায় আইন কমিশনের ওয়েব সাইটে গিয়ে। সরকার আইনটি পর্যালোচনার জন্য আইন কমিশনের কাছে পাঠায় ২০০৯ সালের ২১ মে।

কমিশন এরপর ৩৩জন বিশেষজ্ঞের কাছে মতামত চায়। আসুন দেখি কাদের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছিল। ১. বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন ২. বিচারপতি এ টি এম আফজাল ৩. বিচারপতি হাবিবুর রহমান ৪. বিচারপতি মোস্তফা কামাল ৫. বিচারপতি গোলাম রব্বানি ৬. বিচারপতি কাজি এবাদুল হক ৭. চেয়ারম্যান, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮. চেয়ারম্যান, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ৯. চেয়ারম্যান, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১০. চেয়ারম্যান, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ১১. চেয়ারম্যান, আইন বিভাগ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ১২. সভাপতি, সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন ১৩. সাধারণ সম্পাদক, সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন ১৪. সভাপতি, ঢাকা বার এসোসিয়েশন ১৫. সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বার এসোসিয়েশন ১৬. ওয়ালিউর রহমান, পরিচালক, বিলিয়া ১৭. ব্যারিষ্টার টি এইচ খান ১৮. ব্যারিষ্টার রফিক উল হক ১৯. ড. এম এ জহির ২০. ব্যারিষ্টার খোন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ২১. ড. কামাল হোসেন ২২. ব্যারিষ্টার আমির-উল-ইসলাম ২৩. ব্যারিষ্টার মাহমুদুল ইসলাম ২৪. ব্যারিষ্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ২৫. ব্যারিষ্টার আবদুল বাসেত ২৬. ব্যারিষ্টার আজমালুল হোসেন ২৭. ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন ২৮. ব্যারিষ্টার আখতার ইমাম ২৯. ব্যারিষ্টার শেখ রাজ্জাক আলী ৩০. ব্যারিষ্টার আবদুর রাজ্জাক ৩১. ব্যারিষ্টার তওফিক নেওয়াজ ৩২. ব্যারিষ্টার আবদুর রাজ্জাক খান এবং ৩৩. ব্যারিষ্টার খান সাইফুর রহমান। এবার আসল কথায় আসি। এই ৩৩ জনের মধ্যে মতামত দিয়েছে মাত্র ২ জন।

একজন হলেন বিচারপতি কাজি এবাদুল হক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আবদুল্লাহ আল ফারুক। সময় বাড়িয়েও কমিশন আর কারো কাছ থেকেই কোনো মতামত পায়নি। এর মধ্যে আবার ড. কামাল হোসেন এবং আজমালুল হোসেন সময় বাড়ানোর আবেদন করেছিলেন। সময় বাড়ানো হলেও তারা কোনো মতামত দেননি। আইন কমিশনের রিপোর্টটি পাবেন এখানে এই হচ্ছে আমাদের দায়িত্ববোধ।

টেলিভিশনে টক শো বা সেমিনারে যেয়ে এদের অনেকেই যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে অনেক কথা বলেন। কলামও লেখেন কেউ কেউ। কিন্তু আসল কাজটি কেউ করলেন না। আমি বিশেষজ্ঞ নই, তবে দু-একজনের সাথে কথা বলে বুঝেছি যে আইন কমিশন আইনটির যেসব ধারা সংশোধনের সুপারিশ করেছেন তা পর্যাপ্ত হয়নি। এখনও নাকি এর অনেক সমস্যা রয়ে গেছে।

সমস্যা থাকার কারনেই আইনটি সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক মানের হতে পারেনি। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে শেষ পর্যন্ত লাভবান হবে চিহ্নিত-অচিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরাই। ২. আইন: ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনে তিন থেকে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাইবুনালকে হাইকোর্টের সম-মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মামলা বিরতিহীনভাবে চলবে এই ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে।

এ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা অথবা অক্সিলারি ফোর্সেস এর যে কোন দেশের নাগরিকের বিচার করতে পারবে ট্রাইবুনাল। এ আইন প্রণয়নের আগে বা পরে আইন ভঙ্গ করলে অপরাধীদের বিচারের মতা ট্রাইবুনালকে দেওয়া হয়েছে। ৩(২) ধারায় অপরাধের প্রকৃতিগুলোও চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ধারা অনুযায়ী হত্যা, ধ্বংস, জোরপূর্বক অবরুদ্ধ রাখা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ প্রভৃতি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যখন কোন বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে করা হয় তখন তা এ আইনে বিচার হবে। এছাড়া গণহত্যা, যুদ্ধ আইনের লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিচার এ আদালতে হবে।

এ আইনের ৪ ধারায় ‘অপরাধের দায়’ সম্পর্কে বলা হয়েছে, সংগঠিতভাবে অনেকে মিলে অপরাধ সংগঠন করলেও সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন। এেেত্র ওই অপরাধ তিনি একাই করেছেন বলে সাব্যস্ত হবে। এ আইনে আরো বলা হয়েছে অপরাধ সংগঠনের নির্দেশদাতা কমান্ডার, উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এবং অপরাধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই এ আইনের ৩ ধারায় অপরাধের জন্য দোষী হবেন। এ আইনের ৩ ধারায় বর্ণিত অপরাধের বিচারের জন্য সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এক বা একাধিক ট্রাইবুন্যাল গঠন করতে পারবে। প্রতিটি ট্রাইবুনালে একজন চেয়ারম্যান এবং সর্বনিম্ন দুই বা সর্বোচ্চ চারজন সদস্য থাকবে।

হাইকোর্টের বিচারক হওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন কেউ অথবা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কাউকে ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান বা সদস্য করা যাবে। এ আইনের বিচারের জন্য সরকার প্রসিকিউটর নিয়োগ দিতে পারবেন। এমনকি সরকার চাইলে আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী এ ধরনের অপরাধ তদন্তের জন্য তদন্ত সংস্থাও গঠন করতে পারেন। বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আইনের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ার উল্লেখযোগ্য দিকের মধ্যে হলো, পুরো বিচার হবে ইংরেজীতে।

তবে কারো প্রয়োজন হলে সরকার দোভাষী নিয়োগ দেবেন। ট্রাইবুনালের বিচার সকলের জন্য উস্মুক্ত থাকবে। তবে আদালত মনে করলে ‘ক্যমেরা ট্রায়াল’ বিচার হতে পারে। আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, বিচার কার্যক্রম স্থগিত করা যাবে। তবে ট্রাইবুনাল যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে ন্যায় বিচারের স্বার্থে মুলতবি প্রয়োজন তাহলে তারা সে আদেশ দিতে পারবেন।

আদালত বৈধ মনে করলে যে কোন সংবাদ পত্র, ম্যাগাজিনে প্রকাশিত খবর বা ছবি, ফিল্ম এবং রেকর্ড করা টেপ সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন। এ আইনের আওতায় দোষী ব্যক্তিকে মৃত্যুদন্ডসহ উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার আদালতকে দেওয়া হয়েছে। এ আইনের অধীনে সংগঠিত অপরাধের জন্য দণ্ডিত আসামি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সাজা ঘোষনার ৬০ দিনের মধ্যে আপিল আবেদন করতে পারবেন। প্রচলিত সাক্ষ্য আইন এবং দণ্ডবিধির বিধান এই আইনের বিচারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.