আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বারাক ওবামা : একাধিপত্যের নায়ক (নোয়াম চমস্কির কলম থেকে)

“বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়। বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে। বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো। অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায় অনায়াসে সম্মতি দিও না। কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়, তারা আর কিছুই করে না, তারা আত্মবিনাশের পথ পরিস্কার

সব শক্তিশালী রাষ্ট্রে কিছু বিশেষজ্ঞ থাকে যাঁদের কাজ হলো, ক্ষমতাবানদের কাজকে মহত্ ও ন্যায্য আর ক্ষমতাহীনদের দুর্দশাকে তাদের ভুল হিসেবে দেখানো।

পশ্চিমে এসব বিশেষজ্ঞকে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে ডাকা হয়। অল্পবিস্তর ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁরা তাঁদের কাজ দক্ষতা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করেন। এ কথা শুনতে যতটা অদ্ভুতই মনে হোক না কেন, লিখিত ইতিহাসের শুরু থেকেই এমন চর্চার দেখা মেলে। এই পটভূমিতে আমরা এখন তথাকথিত একাধিপত্যের যুগের দিকে দৃষ্টি ফেরাব। ২০ বছর আগে বার্লিন দেয়ালের পতনের মধ্য দিয়ে এ যুগের লক্ষণ ফুটে ওঠে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে এক মেরু বিশ্ব তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্র আগের প্রাথমিক পরাশক্তি থেকে বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তিতে পরিণত হয়। কয়েক মাসের মধ্যে জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন গতিপথের রূপরেখা তৈরি করে: সবকিছুই মোটামুটি আগের মতো থাকবে, তবে হেতু হবে ভিন্ন। এখনো দরকার বিশাল সামরিকব্যবস্থা, তবে নতুন কারণে। তৃতীয় বিশ্বের শক্তিগুলোর ‘প্রযুক্তিগত সূক্ষ্মতা’ এই নতুন কারণ।

জ্বালানি-সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপ করার লক্ষ্যে বাহিনী প্রস্তুত রাখতে হবে। এসবই ঘটেছে নীরবে, সংবাদ হয়েছে কালেভদ্রে। কিন্তু যাঁরা দুনিয়াকে বুঝতে চান, তাঁদের জন্য অনেক শিক্ষামূলক বিষয় আছে এতে। জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন আগ্রাসী সামরিকবাদ ও অন্যকে অশ্রদ্ধার চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। বুশের শাসনের দ্বিতীয় পর্যায় কিছুটা সংযত ছিল।

ডোনাল্ড রামসফেল্ড, পল উলফোভিত্স, ডগলাস ফেইথের মতো কট্টরদের সরিয়ে দেওয়া হয়। উপ-রাষ্ট্রপতি ডিক চেনিকে সরানো যায়নি। কারণ, তিনিই ছিলেন প্রশাসনের মূল ব্যক্তি। বারাক ওবামা দায়িত্ব গ্রহণের পরপর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিত্সা রাইস ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ওবামা বুশের দ্বিতীয় পর্যায়ের নীতিগুলো অনুসরণ করবেন। হয়েছেও তাই।

শুধু বদলেছে বলার ভঙ্গি। আর তাতেই দুনিয়া মন্ত্রমুগ্ধ। বেশ আগের, কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের চূড়ান্ত পর্যায়ে কেনেডি প্রশাসনের এক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টার কথা ব্যবহার করে বুশ ও ওবামার মৌখিক পার্থক্য বেশ ভালোভাবে প্রকাশ করা যায়। কেনেডির পরিকল্পনাবিদরা এমন কথা ভাবছিলেন, যা ব্রিটেনকে ধ্বংস করে ফেলত, অথচ এ বিষয়ে তাঁরা ব্রিটেনকে কিছু জানাননি। সেই উপদেষ্টা ব্রিটেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ সম্পর্ক’কে তখন ‘আমাদের লেফটেন্যান্ট, যা চলতি ভাষায় ‘সহকারি’ বলে আখ্যায়িত করেন।

বুশ ও তাঁর সঙ্গীরা দুনিয়াকে মনে করেছেন, ‘আমাদের লেফটেন্যান্ট’। তাই ইরাক আক্রমণের ঘোষণাকালে জাতিসংঘকে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের হুকুম তামিল করতে, নয়তো ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে যেতে। এমন নির্লজ্জ ঔদ্ধত্য স্বভাবিকভাবেই বৈরিতা বৃদ্ধি করে। ওবামা নিয়েছেন নতুন গতিপথ। তিনি দুনিয়ার নেতাদের ও জনগণকে পরিশীলিতভাবে ‘অংশীদার’ হিসেবে সম্ভাষণ জানান কিন্তু মনে মনে তাঁদের ‘লেফটেন্যান্ট’ই মনে করেন।

বিদেশি নেতারা এই ভঙ্গিমা পছন্দ করেন। আর জনতা তো অনেক সময় এতে অভিভূত হয়ে পড়ে। কিন্তু মিষ্টি মিষ্টি কথা ও সুখকর আচার-আচরণ নয়, কাজে প্রমাণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। সামরিক শক্তির দিক দিয়ে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা একাধিপত্যবাদীই রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র একার সামরিক ব্যয়বাদবাকীদুনিয়ার সমান।

বিধ্বংসী প্রযুক্তিতে অন্যদের থেকে যুক্তরাষ্ট্র অনেক এগিয়ে । একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেরই বিদেশে শত শত সামরিক ঘাঁটি আছে। দুটি প্রধানজ্বালানি উত্পাদক দেশ দেশ এর দখলে। স্নায়ুযুদ্ধের হাতিয়ার ন্যাটোকে ওবামা এ কাজে ব্যবহার করতে পারেন। একাধিপত্যের যুগ শুরু হওয়ার সময় ন্যাটোর ভবিষ্যতের প্রশ্ন সামনে আসে।

একসময় সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে প্রতিরক্ষাকে ন্যাটোর বৈধতার যুক্তি বলা হতো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই ছুতো অচল। ন্যাটোকে তখন বিভিন্ন দেশে হস্তক্ষেপের বাহিনী হিসেবে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। চালকের ভূমিকায় থাকে যুক্তরাষ্ট্র। বিদেশে হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচনা ছিল জ্বালানির ওপর নিয়ন্ত্রণ।

স্নায়ুযুদ্ধোত্তর সময়ে ন্যাটোকে পূর্ব ও দক্ষিণে বাড়ানো হয়েছে। ওবামা এই বিস্তৃতি ঘটানো অব্যাহত রাখতে আগ্রহী বলেই মনে হয়। রাশিয়ায় ওবামার প্রথম সফরের আগে আগে জাতীয় নিরাপত্তা এবং এশিয়া ও ইউরেশিয়া বিষয়ক ওবামার বিশেষ সহকারী মাইকেল ম্যাকফাউল গণমাধ্যমকে জানান, ‘ন্যাটোর বিস্তার বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা বিষয়ে রুশদের সঙ্গে আমরা কোনো লেনদেন করতে যাব না। ’ পূর্ব ইওরোপে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা কার্যক্রম এবং রাশিয়ার প্রতিবেশী ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি এবং তা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সম্ভাবনা প্রায় শূণ্য।

ইরানের ক্ষমতাসীন ধর্মীয় নেতারা আত্মহত্যার জন্য মরিয়া না হয়ে উঠলে ইরানের আক্রমণ করার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের এই ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী ব্যবস্থা কখনো সক্রিয় হলে, এর মূল কাজ হবে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের আক্রমণের জবাবে ইরানের পাল্টা আক্রমণের পথ বন্ধ করে দেয়া। অর্থাত্ ইরানের প্রতিরক্ষা ধ্বংস করা। ক্ষেপণাস্ত্রবিরোধী ব্যবস্থা তাই আগাম আক্রমণের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এটা সবার জানা।

কিন্তু এ সত্যটি আড়ালে পড়ে থাকে। ওবামার নতুন পরিকল্পনা রাশিয়ার কাছে উসকানিমূলক মনে হতে পারে। তবে ইউরোপের প্রতিরক্ষা প্রশ্নে এটি অপ্রাসঙ্গিক। ইরানের সঙ্গে পারমানবিক বিরোধ স্নায়ুযুদ্ধের বিভীষিকা ও ভণ্ডামি মনে করিয়ে দেয়। ইরান বিষয়ে শোরগোলের মধ্যে উপেক্ষিত হয় যে, ভারতকে দেওয়া ওবামা প্রশাসনের এই নিশ্চয়তা যে ভারত-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি জাতিসংঘে সদ্য পাস হওয়া পারমানবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) সিদ্ধান্তের বাইরে থাকবে।

ভারত বলেছে, বিশ্বের প্রধান পারমাণবিক দেশগুলোর সমান বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক অস্ত্র এখন তারাও তৈরি করতে পারবে। একই ছাড় ও দম্ভ ইসরায়েলও উপভোগ করে। সামরিক দিক থেকে এককেন্দ্রিক হলেও অর্থনৈতিকভাবে এর কেন্দ্র উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও উত্তর-পূর্ব এশিয়াতে অবস্থিত। বিশ্ব অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য বাড়ছে। একমাত্র পরাশক্তির প্রতিরোধ সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুনিয়া বহু মেরুর হয়ে উঠছে।

এটি ইতিহাসের প্রগতিশীল পরিবর্তনের নিদর্শন। ইন দিজ টাইমস থেকে নেওয়া(অনুবাদ আজকের আজকের প্রথম আলো থেকে নেয়া) নোয়াম চমস্কি: মার্কিন বুদ্ধিজীবী ও ভাষাদার্শনিক। নোয়াম চমস্কির মূল লেখাটি পাবেন এখানে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।