আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দ্য কাইট রানার

মন তুমি কৃষিকাজ জানো না, এমন মানবজমিন রইলো পতিত; ফলালে ফলতো সোনা

আমার এ বছরে পড়া শ্রেষ্ঠ বই হচ্ছে খালেদ হোসেইনীর লেখা দ্য কাইট রানার। এত সহজভাবে লেখা কিন্তু এত ব্যাপক উপলব্ধির বই অনেকদিন পড়ে পড়লাম। মূলত: আফঘানিস্তানের পটভূমিতে রচিত এই বইয়ে উঠে এসেছে আফঘান সংস্কৃতিতে ধনাঢ্য পরিবারে মাতৃহীন এক কিশোরের বেড়ে উঠা, বাবার সাথে তার সম্পর্কের টানাপোড়ন, তৎকালীন আফঘানিস্তানের অমানবিক শ্রেণী বৈষম্য, দুই কিশোরের বন্ধুত্ব, একজনের প্রগাঢ় ভালোবাসার বিপরীতে অপরজনের বিশ্বাসঘাতকতা, যুদ্ধের এবং যুদ্ধপরবর্তী জীবনের ভয়াবহ বাস্তবতার গল্প। বইয়ের মূল চরিত্র আমীর। জন্মের সময় মাকে হারানো, প্রতিপত্তীশালী পিতার সান্নিধ্য বন্চিত আমীরের সারাদিনের সঙ্গী তাদের নিম্ন বর্ণের কাজের লোকের ছেলে, তারই মতো জন্মের পরে মাকে হারানো হাসান।

গল্প এগিয়ে যায় এই দুই কিশোরের হাত ধরে আফঘান ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধির ধারক কাবুলের অলিগলি পেরিয়ে ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতা পর্যন্ত। পথে উঠে আসে রহিম খান, আলী, সানোবার, আসেফ, কামালের মতো চরিত্রগুলো। সেইসাথে উঠে আসে শ্রেণীবৈষম্যের কুতসিত চিত্র, যা থেকে আমীর নিজেও পুরোপুরি মুক্ত নয়। বাবার বিশালত্বের কাছে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হতে থাকা আমীর ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতাকে বেছে নেয় নিজেকে প্রমাণ করার জন্য। সঙ্গে সর্বক্ষণের সঙ্গী কাইট রানার হাসান।

আমীরের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে হাসান মুখোমুখি হয় জীবনের সবচেয়ে বাজে অভিঙ্গতার। যে বিকেল তাদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য উদযাপিত হওয়ার কথা সেটি পরিণত হয় পরবর্তী জীবনের জন্য ভয়াবহ দু:স্বপ্নে। পাপবোধে আক্রান্ত আমীর তার দুর্বল মানসিকতাকে সহ্য করতে না পেরে দূরে ঠেলে দেয় হাসানকে। পরবর্তীতে রাজতন্ত্রের পতনের সাথে আমীরের পরিবারের আফঘানিস্তান ছেড়ে সর্বস্ব হারিয়ে আমেরিকা চলে যাওয়ার মধ্যে শেষ হয় প্রথম অংশ। আমেরিকা পর্বে আমীর এবং তার বাবা নিজেদের আস্তে আস্তে অন্য প্রবাসী আফঘানদের পাশে থিতু করে নেয়ার মধ্যেই লেখক হিসেবে আমীরের আবির্ভাব ঘটে।

জীবনে প্রেম, বিয়ে, বাবার মৃত্যু, লেখক হিসবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া - সবকিছু মিলিয়ে প্রবাসে নতুন জীবনে আমীর কালের আবর্তে আস্তে আস্তে ভুলে যেতে চেষ্টা করে আফঘানিস্তান এবং হাসানকে। তার এই জীবনের ছন্দপতন ঘটায় একটি টেলিফোন কল। আমীর মুখোমুখি হয় এক চরম সত্যের, তার নিজের ভিতরের সংঘাত বাড়তেই থাকে। পূর্বের পাপের প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ পেয়ে আমীর ফিরে আসে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফঘানিস্তানে, যেখানে তালিবান অত্যাচার লোকজনকে যুদ্ধের ভয়াবহতাও ভুলিয়ে দিয়েছে। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া একসময়ের সমৃদ্ধশালী আফঘানিস্তানের রাস্তা তখন দুর্ভিক্ষ আর পিতাহারা বাচ্চাদের অসহায় জীবনের প্রতিচ্ছবি।

এক্ষেত্রে লেখকের একটা চমৎকার উক্তি ছিলো: "There are a lot of children in Afghanistan, but little childhood." এই কঠিন সময়ের মধ্যে নিজের বিবেকবোধকে জাগ্রত করে জীবনে প্রথমবারের মতো চ্যালেন্জের মুখোমুখি দাঁড়ায় আমীর । যুদ্ধের ভয়াবহতায় পিস্ট অসহায় এক বালককে এই ডামাডোল থেকে বাঁচিয়ে তার জীবনকে ভরিয়ে দিতে আমীর শুরু করে তার জীবনের নতুন দৌড়। নতুন এক কাইট রানার হিসেবে। অসাধারণ সহজভাবে লেখা বইটির গল্পে উঠে এসেছে অসাধারণ সব মনস্তাত্ত্বিক উপলব্ধি। গল্পে টানটান উত্তেজনার সঙ্গে ছিলো এমনসব ঘটনার মোড় যেটি কেউ হয়তো পড়তে গিয়ে মাথায়ও আনবেনা।

পাপবোধে জর্জরিত মানুষের আত্মোপলব্ধির পাশাপাশি লেখন চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন সম্পর্কের টানাপোড়ন এবং তার পিছুটান। দেখিয়েছেন কিভাবে মানুষ শেষপর্যন্ত খোদার কাছে তার কর্মের জন্য শরণাপন্ন হয়। দেখিয়েছেন প্রকৃতি কিভাবে শেষপর্যন্ত মানুষের উপর তার প্রতিশোধ নিয়ে নেয়। এককথায় অসাধারণ এই বইটি পড়ে আমার বারবার মনে হচ্ছিলো সিনেমা বানানোর জন্য এটি আদর্শ একটি গল্প। নিজে নিজে অনেক ভিসুয়ালাইজও করেছি গল্পের প্রতিটি মুহূর্ত।

দ্য কাইট রানার নিয়ে ইতিমধ্যে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া চলচ্চিত্রও তৈরী হয়েছে। আমার কেন জানি দেখতে ইচ্ছা করছেনা, যদি আমার কল্পনার ছবিগুলো হারিয়ে যায়!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।