আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রোজার কথা ২

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

জীবনে প্রথম রোজা রাখতে গিয়ে কি ভয়ানক বিপত্তিতে পড়েছিলাম সেটা খুব ভালোই মনে আছে (আগের পর্বে যেটা লিখলাম), তবে এখন লিখতে বসে অনেক চেষ্টা করেও প্রথম সফল রোজা, অর্থাৎ যেদিন প্রথম সজ্ঞানে সাইরেন শুনে ইফতার করতে পেরেছিলাম সেদিনের কথাটা মনেই করা গেলনা। সম্ভবতঃ আগের ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতি বাকী সবগুলোকে খেয়ে ফেলেছে, আর তাছাড়া বয়েসও তো বাড়ছেই। সে যাই হোক, যেহেতু মনে পড়ছেনা তাই রোজার টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলোই লিখি। এখনও এই সিস্টেম আছে কিনা জানিনা, তবে আমাদের সময়ে রোজার মাসে স্কুল বন্ধ থাকাটা ছিল কমনসেন্সের মতো! রোজার মধ্যে আবার কিসের স্কুল!! আমি জানিনা সে যুগে স্কুল বন্ধ বেশী থাকত কিনা, তবে রোজার একমাস পুরো বন্ধ, গ্রীষ্মের ছুটি, এসএসসি পরীক্ষার ছুটি (পরে অবশ্য এসএসসি আর গ্রীষ্মের ছুটি এক করে ফেলা হয়), আরো কত বন্ধ যে ছিলো! এসব শুনলে এযুগের স্কুল-থেকে-ফিরে-দুটা-প্রাইভেট-পড়া-আর-একটা-পিয়ানো-লেসনে-দৌড়ানো বাচ্চাদের কাছে তো স্রেফ রূপকথা মনে হবে। মনে আছে কিভাবে একেকটা বন্ধের জন্য মুখিয়ে থাকতাম।

পরিসংখ্যানের খেলা ক্রিকেট পছন্দ করি, সংখ্যা টংখ্যা মাপতে ভালো লাগে, সেটা সম্ভবতঃ সেই ছোট বয়েসেও ছিলো। সেজন্যই হয়তোবা, স্কুলের ক্যালেন্ডারে রোজার বন্ধের এক দুসপ্তাহ আগে থেকেই গোনা শুরু করতাম আর কয়দিন বাকী স্কুল বন্ধ হতে? কাউন্টডাউন করতে করতে হয়ত একটু ধৈর্য্যই হারিয়ে ফেলতাম, যেজন্য রোজা শুরু হবার আগের দিন আমরা ভাইবোনেরা সবাই মিলে নানান ফন্দি করে হলেও স্কুল কামাই করতামই। যেবার ক্লাস ফোরে উঠি, সেবার খালাতো ভাইটি রায়পুর থেকে ঢাকায় এলো আমাদের বাসায় থেকে পড়বে বলে। জগতের যাবতীয় বাঁদরামি আমরা দুজন মিলে করেছি সেসময়, আমি তো বাঁদর ছিলামই, ওব্যাটা ছিলো আমার চেয়ে কয়েককাঠি বাড়া। রীতিমতো স্মার্ট পিচ্চি যাকে বলে।

ছোকরা সে বয়েসেই কিভাবে যেন জেনে গিয়েছিলো যে বগলের নীচে রসুন রেখে দিলে গা গরম হয়ে যায়, স্কুল মারার অব্যর্থ ঔষধ। আর পায় কে? সেবছরের রোজা শুরুর আগের দিন স্কুল কামাই করবোই করবো, আমরা দুজনেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রান্নাঘরের টিন হাতড়ে কয়েক কোয়া রসুন নিয়ে রেখে দিলাম ব্যাগের ভেতর, রাতের বেলা আমরা দুজনেই বগলের নীচে রসুন রেখে মহা আনন্দে জ্বরের আসার অপেক্ষায়। কতক্ষণ গেলো সেটা তো এখন আর মনে নেই, তবে এটা মনে আছে যে হতচ্ছাড়া জ্বর আর আসলোনা কি ভয়ানক বিপদরে বাবা। এদিকে মাথায় চেপেছে স্কুল কামাই করবই করব! উপায়ন্তর না পেয়ে উর্বর মস্তিষ্কে (!) যে চিন্তাটা এলো সেটাই করলাম।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আলনা থেকে নিজেদের স্কুলের শার্টদুটো নিয়ে চুপিচুপি বাথরুমের বালতিতে ভেজা কাপড়ের সাথে চুবিয়ে রেখে এসে আবার দিলাম ঘুম। সাতটার দিকে মা যখন ডেকে ওঠালেন স্কুলে যাবার জন্য, আমরা তো আর স্কুলের শার্ট খুঁজে পাইনা! বড় আপার মনে হয় স্কুল এমনিতেই ছুটি ছিলো, মা ওকে লাগিয়ে দিলেন শার্ট খোঁজার কাজে। বেচারী সারা ঘর খুঁজেও কোন হদিস করতে পারেনা। এভাবে যখন স্কুলে যাবার সময় পেরিয়ে গেল, তখন আর আমাদের পায় কে, আমরা দুই বান্দর বারান্দায় গিয়ে বাঁদরনাচ নেচে বিজয় উদযাপন করতে লাগলাম। তবে সে নাচ বেশীক্ষণ টেকেনি, দুপুর এগারোটার দিকেই মা কাপড় কাচতে গিয়ে বের করে ফেললেন কি ঘটেছিল; তবে মা আমার চিরকালই অতিমাত্রায় মমতাময়ী, কোনদিন মনে হয় বকাও দেননি।

ঝামেলাটা হলো যখন বড় আপা জানলো, তখন। বাজখাঁই গলার "এক্ষুণই হাতমুখ ধুয়ে খাতাপেন্সিল নিয়ে আয়!", শুনে গুটিগুটি পায়ে আমরা দ্বিরত্ন খাতাপেন্সিল নিয়ে এসে বসলাম সামনের রূমে। সেদিন মনে হয় এক হাজারবার "জীবনে কোনদিন স্কুল কামাই করবনা" বাক্যটি লিখতে হয়েছিলো, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ছোটখাটো-শুকনো আমি বড়বড় চোখে চিওয়াওয়ার মতো কুঁইকুঁই করেও রেহাই পাইনি! রোজার কথা বলতে গিয়ে কি বলছি? যাক, আবার রোজায় ফিরি। কত বছর বয়েসে মনে নেই, তবে মনে আছে যে এক সময় এটা কমনসেন্সের মতো হয়ে গেল যে, যেহেতু সেহরী খেতে ভোররাতে একবার উঠতে হয় সেহেতু সকালে একটু বেশী ঘুমানো যাবে। সে হিসেবেই বাসার সবাইই রোজার মাসে সকালে একটু দেরীতে উঠত।

তবে একদিন সকালে টের পেলাম রোজা হোক বা যাই হোক বাবাকে ঠিকই সকালে উঠে জামাকাপড় পরে অফিসে ছুটতে হয়। বাবার এই কষ্টটা দেখে সে বয়েসেও আমার কাছে একটা ব্যাপার আজব লাগত, একে ওকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম, রোজা রাখে বড়রা, আর স্কুল ছুটি হয় ছোটদের -- কেন? তবে সেটা কখনই এই অর্থ বহন করতনা যে আমাদের স্কুল ছুটি দেয়া বন্ধ করে দাও, বরং সেটার মানে এটাই ছিলো যে বাবাদেরও অফিস ছুটি দিয়ে দাও। বাবার একটা জিনিস ভালো ছিলো যে ছুটির দিন তিনি উদার হয়ে যেতেন। সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরলেই হতো, সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ালেও কিছু বলতেননা। কাজেই ছুটির দিনে বাবার বাসায় অবস্থানটা তেমন কোন সমস্যা তৈরী করতনা।

বরং, বাবার কারণে একটা ঢাল তৈরী হয়ে যেত, আপারা অত মাতব্বরি ফলাতে পারতনা। এবার আসি বন্ধুবান্ধবদের কথায়। সেহরীর সময় সবচেয়ে মজার যে ব্যাপারটা ঘটত সেটা হলো ফজর নামাজ পড়তে যাওয়া। আলো আঁধারীর মধ্যে বন্ধুরা সবাই মিলে বের হতে পারছি, সে বয়েসে এটা একটা বিরাট মজা! এমনকি বন্ধুদের বাসার সামনে গিয়ে, "ঐ সাবু, নামাজ পড়তে নাম!!" বলে ডাক দিলেও কেউ বকা দিতে পারতনা। গার্জিয়ানদের জন্য সেটা এক বিব্রতকর ব্যাপারই ছিলো বৈকি! ভোররাত হোক আর যাই হোক, কেউ "নামাজের জন্য ডাকছে" যখন, তখন মুখের ওপর সেখানে বকাবাদ্য করাটা লোকলজ্জার বিষয় ছিলো বলেই মনে হচ্ছে।

এক রোজার সময়, সম্ভবতঃ ক্লাস ফাইভে, যখন প্রাইমারী স্কুলের সবচেয়ে উঁচু ক্লাসে পড়ার কারণে একটু সেয়ানা সেয়ানা ভাব আসলো নিজেদের মধ্যে, তখন আর নামাজ পড়েই সাথেসাথে বাসায় ফিরে আসাতে আর পোষাচ্ছিলনা। এমনই একদিন হঠাৎ কয়েকবন্ধু মিলে ঠিক করলাম, নামাজ শেষে হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কে যাবো। কিন্তু একথা যেহেতু বাসায় জানানো যাবেনা, তাই ফন্দি আঁটতে হলো যে নামাজ শেষে কি করেছিলাম সেটা একটা নিয়ে একটা কিছু তো বলতেই হবে। সবাই মিলে ঠিক করলাম যে বলবো, রেলওয়ের রেস্টহাউসে শিউলি ফুল তুলতে গেছি, আর সমস্যা কোথায়! ইজি, ইজি! যাক, শুরু হলো আমাদের অভিযান। ফজরের নামাজ শেষে আমরা চারবন্ধু মিলে রওয়ানা দিলাম রমনা পার্কের দিকে।

আমাদের মধ্যে সাবু একটু গায়ে গতরে বড়সড় ছিলো, সেয়ানা সেয়ানা ভাবটাও বেশী ছিলো ওর। সে রমনার রাস্তা চিনত। আর চিন্তা কি! সেই সকালে যে কিরকম থ্রিলিং একটা সময় পার করেছি, আজো ভাবলে মনটা এক ধরনের উত্তেজনায় ভরে যায়। হাঁটতে হাঁটতে বারবার মনে হচ্ছিলো, "আরে! আমি তো বড় হয়ে গেছি!", আর শিউরে উঠছিলাম। একটা শিশুর চিরন্তন আরাধনা -- বড়দের মতো হবো, কোন বাঁধা থাকবেনা, কেউ বকবেনা, কেউ ভয় দেখাবেনা -- সেরকম দিনগুলো যে খুব কাছাকাছি সেটা মনে হয় সেদিনই প্রথম অনুভব করতে পেরেছিলাম।

এটা ছিলো একটা বিরাট মুক্তির মুহূর্ত, এরকম একটা মুহূর্তে অনাগত ভবিষ্যত নিয়ে কোন আশংকা বা অনিশ্চয়তা জন্মায়না, অনাগত ভবিষ্যতের যা কিছু চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার পুরোটাই শতভাগ সম্ভাবনায় টইটুম্বুর। এজন্যই হয়তো শৈশবটা এত সুখের, সব বিস্ময়ই সেখানে সুন্দর, হাতের নাগালে থাকে, বিপন্ন হয়না। আমরা অন্ততঃ দিশেহারা বোধ করিনা। বড় হয়ে কি সেজন্যই আমরা বারবার শৈশবে ফিরে যেতে চাই? যাই হোক, আমার "বড় হয়ে গেছি" অনুভূতিটা যেভাবে নিজের মধ্যে চেপে বসার কথা ছিলো কপালের দোষে সেটা কিন্তু সেদিন হয়নি। কারণ, আর কি? যথারীতি আরেকটা অঘটন।

রমনা পার্কে গিয়ে অনেক লাফঝাঁপ করলাম, স্লিপার (আমরা বলতাম পিছলা), সী-স্য, দোলনা -- আরো যতরকমের দুষ্টামির উপকরণ ছিলো কোনটিই বাদ রাখলামনা। আর সেখানেই শেষমেষ কাল হয়েছিলো। সী-স্য চড়তে গেলাম সাবুর সাথে, ও ব্যাটার ওজন ছিলো মারাত্মক, ও বসতেই এমন এক ঝাঁকুনি খেলাম যে ভয়ে আমি সী-স্য থেকে নেমে দাঁড়িয়ে যাই, আর তখনই ঘটে "হতে পারত চরম ভয়াবহ" ঘটনাটা। নিজে সী-স্য'র যে প্রান্তে বসেছিলাম সেপ্রান্তটা এসে আঘাত করল ঠিক চিবুকের নীচে! সেদিন আসলে বাঁচার কথা ছিলোনা। ভাগ্য ভালো যে লোহার রডের খুব সামান্য অংশই এসে লেগেছে চিবুকে, ভালোমতো হলে সেখানেই সব শেষ হয়ে যেত।

কি ভয়ানক ব্যাপার!!! এখন লিখতে লিখতেও যা ঘটতে পারতো তা ভেবে শিউরে উঠলাম, একবার আলহামদুলিল্লাহ বলে ফেললাম, কৃতজ্ঞতা, কৃতজ্ঞতা। কতবার যে কানের পাশ দিয়ে গুলী গেলো জীবনে! এগুলোকে কি "ফাঁড়া কাটা" বলে? যা হোক, এখন বুঝলেও সেদিন সেমুহূর্তে বুঝিনি বা কেয়ারও করিনি যে কত বড় বাঁচা বেঁচেছি! বরং আঘাতের ফলে চিবুকের কতটুকু কাটা গেছে, কেউ দেখলে বুঝে ফেলবে কিনা, কিভাবে কি করলে বাসায় কেউ টের পাবেনা -- এসব নিয়েই চিন্তিত ছিলাম বেশী। বন্ধুদের একজন সকালের সতেজ দুর্বা ঘাস এনে চিবিয়ে লাগিয়ে দিলো ক্ষতে, টেনশনে কাঁপতে কাঁপতে বাসায় ফিরলাম। "আজ তো একটা কিলও মাটিতে পড়বেনা!" তবে, বাবমা'র একমাত্র পুত্র হবার মজাটাই এখানে, সেদিন মার খাবো কি, বরং আমার চিবুকের কাটাটা দেখে আমার বাপ-মা দুজনেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন, বাবা স্যাভলন নিয়ে ছোটেন তো মা ডেটল নিয়ে -- এমন অবস্থা। আমি আর কি ভাববো, আপাততঃ বেঁচে গেলেও বাবা-মা'র উদ্বিগ্নতা শুধু এই মেসেজটাই দিয়েছিলো যে, "তুই এখনও বড় হসনাই রে গাধা!"।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।