আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফ্যান্টাসীঃ নিয়তির সুর

কত কিছু যে করতে চাই, তবুও কিছু করতে না পারার দায়ে মাথা খুঁটে মরি ।
আকমল সাহেবকে দেখতে যাওয়াটা কোনভাবেই উচিত হয় নি। কোথায় অফিস থেকে এসে খাব দাব, রেস্ট করব, তা না করে উলটা ছুটে গেলাম আকমল সাহেবকে দেখতে। ভুলই হয়েছে। আজকে রাতটা উত্তেজনায় না ঘুমিয়ে এখন এর খেসারত দিতে হয় কী না তা-ই ভাবছি।

“কী-রে, এমন করছিস কেন? এত ছটফটের কী আছে? সন্ধ্যা থেকে দেখি এমন অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। সমস্যা কী? আর, আকমল সাহেবের নামে এসব কী শুনি রে?”, আম্মা পাশে এসে বসল। আম্মার দিকে তাকিয়েই রইলাম শুধু। বলার কিছু নেই। আর আমি ত আসলে নিশ্চিত না যে কালকেই কিছু হবে কী না, আর এসব ব্যাপার ঠিক শেয়ার করার মতও না।

আগে ত পত্রিকায় ছেপে নেই, তারপরে সবাইকে বলা যাবে, “আম্মা মামার অফিসটা গুলশানে না? কালকে দুপুরে যেতে পারি। উনাকে বলে দিও। ” আকমল সাহেবকে মোটামুটি বেঁধে রাখা হয়েছে উনার ঘরে। ভদ্রলোকের মাথার ঠিক নেই ইদানীং। মানে, বেশিরভাগ সময় একদম স্বাভাবিক।

শুধু কয়েকদিন আগে থেকে কেবল রাতের বেলা উনার মাথা খারাপ হয়ে যায়। আমি অবশ্য প্রথমে বিশ্বাস করি নি। ভাবলাম উনার ছেলের বউএর কোন নতুন ফন্দি কী না শ্বশুরকে তাড়ানোর। ভদ্রলোক নিজের মতন থাকেন, আমার সাথে মাঝে মাঝে খেলা নিয়ে যা কিছু গল্প। এই ত।

আকমল সাহেবকে দেখতে গিয়ে দেখি অবস্থা করুণ। ভদ্রলোক একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন। আমার সাথে বেশ সহজ ভাবেই উনার অনেক কথা হল। আমাকে যতটুকু স্নেহ করেন, নিজের ছেলেকেও অতটুকু করেন না বোধহয়, আর করবেনই বা কেন! ছেলেটা ত তার বউ ছাড়া কিছুই বোঝে না। আমাকে ডেকে লুকিয়ে এক তোড়া কাগজ দিলেন।

বললেন, “ আকাশ, বাবা তোমার মত এরকম চুপচাপ ভাবুক একটা ছেলে ছাড়া এই লেখা কেউ বুঝবে না। কাগজের প্রতিটা কথা যে সত্য তার প্রমাণ আমি নিজে। কীভাবে আমি তার প্রমাণ হলাম, সেটা এখন বুঝবে না। কাগজটা পড়ার পড়ে বুঝবে। আর, এটা কাউকে দেখিও না।

ফেরত দেবারও দরকার নেই। ” মনে মনে একটু বিরক্ত হলাম। আরে আজব, এতদিনের খাতির, আমাকে বলবেন বুদ্ধিমান নয়তো ব্রিলিয়ান্ট। আর বললেন কী না ‘চুপচাপ’। যাক, তবু স্বর শুনে মনে হল যেন কম্পলিমেন্ট।

এই ত ঢের। “জিনিসটা কার?”, জিজ্ঞাসা করলাম আমি। “জানি না, বাসে মহাখালী থেকে আসার সময় কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। কাগজের শেষে কিছু পেপার কাটিং বা আরও কিছু লেখা স্টাপলার করা আছে। ওগুলা আমার।

দেখলেই বুঝবে”, উনি উত্তর দিলেন। আশার সময় মনে হল হয়ত একটা দীর্ঘশ্বাস লুকালেন! আজকে সন্ধ্যায় বাসাতে এসেই কাগজগুলো পড়া শুরু করলাম। ------- অফিস শেষে কখনও বাসে বসার জায়গা পাই না। এই বিকালে বাসে দাঁড়াব, এটাইত আমার শত জনমের সৌভাগ্য। আর বসার কথা বাদই দিলাম।

এই দেশে জন্মেছি, কষ্ট ত কপালে লেখা ছিলই। কালকে কী এক ভাগ্যের ফেরেই যেন হঠাৎ সিট পেলাম। বিকাল সাড়ে ৬টায় এই বাসে বসার জায়গা। মানে, ভাগ্য আমার খুলে গেছে, চাই কি একটা লটারীও পেয়ে যেতে পারি এমন একটা আত্মবিশ্বাস তখন আমার। তখনও বুঝিনি ভাগ্য আমার সাথে কত নির্মম একটা খেলা খেলবে কিছুক্ষণ পরে।

১৪ নাম্বার হয়ে আসছিলাম। এরপর সিরিয়ালি ১৩ থেকে ১০ হয়ে ১। এরপরে ধানমন্ডি ১৫। ওখানে নামব। পরে রিকশা করে কলোনী।

জানালার পাশের সিটে বসে বসে কত কিছু দেখতে দেখতে আসছিলাম। একটু পর পর জামে নয়ত সিগনালে আটকাই। আবার ছেড়েও দেয়। প্রায় সন্ধ্যায় আধা খাপছাড়া আলো জ্বালানো শহরটাকে দেখি। কিছুদূর যেয়েই যেন চোখ মুদে আসল।

তন্দ্রার মতন। এসময়ে এরকম ত হয় না আমার। জোর করে যেন কে আমার চোখ মুদে দিল। এখনও মনে আছে, মনে হয় যেন অনেকটা জোর করেই কেউ ঘুম পাড়াল। দুহাত দিয়ে যেন চোখ বুজিয়ে দিল।

চোখ খুলে দেখি বাসে বসে আছি। খা খা দুপুর। বাসে অল্প কিছু লোক। মাথাটা ঝা ঝা করছে। কেন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে যে আমি যেন অন্য কেউ।

শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত। বুঝলাম না আসলে কী হল। সাথে সাথে পকেটে হাত দিলাম। মানিব্যাগে ২ হাজার টাকা বা মোবাইল সবই ঠিক আছে। এই ত হাতের পাশে ব্যাগটাও ঠিক আছে।

ব্যাগের ভিতর কিছু কাগজ আছে। কীসের কাগজ খেয়াল নেই, তবে এগুলো এখনও আছে দেখে বুঝলাম যে কিছুই খোয়া যায় নি। শুধু একটা সমস্যা রয়েই গেল। আমি ঠিক নেই। কেন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে যে আমি যেন অন্য কেউ।

আমি ভর দুপুরে একটা বাসে করে কোথায় যেন যাচ্ছি। খুব সম্ভবত গুলশানের দিকে যাচ্ছে বাস। মোবাইল বের করে তারিখটা দেখলাম। আরও একটা ধাক্কা খেলাম। আমি ছিলাম ৯ ফেব্রুয়ারীতে, অথচ আজকে ১১ জুন।

আমি নিজে নিজে হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম। পরিচিত কাউকে কল দিব? কাকে দিব? কী করব মাথায় ঢুকছে না। বাসটা একটা সিগনালে আটকাল। বুঝাই যায়, অল্প কিছুক্ষণের মাঝে ছাড়া পাবে বাস। রাস্তার দিকে চোখ ফিরিয়ে চেনার চেষ্টা করছি যে আসলেই আমি কোথায় এখন! হঠাৎ চোখ আটকে যায় রাস্তার পাশের এক হোটেলে।

হোটেলের সামনে একটা গোলাপী পর্দা। বাতাসে উড়ছে। এরকম ভর দুপুরেও পর্দাটার মধ্যে কেমন যেন একটা ভেজা ভেজা ভাব। আর, এত হালকা বাতাসে এরকম জোরে জোরে কী করে উড়ছে বুঝলাম না। খেয়াল করলাম, বাতাস যেদিক থেকে আসছে পর্দাটা ঠিক সেভাবে নড়ছে না।

কেমন যেন একটু ব্যাকা ত্যাড়া কোনাকুনি ভাবে পত পত করছে। আরও একটু ভালভাবে মাথা বাড়িয়ে দেখলাম। পর্দার একপাশে একটু ভিতরের দিকে একটা মস্ত কড়াইতে কী যেন রান্না হচ্ছে। এক লোক কিছু একটা ভাঁজছে। পর্দাটা পত পত করে উড়ছে।

অদ্ভূত ভাবে। নিজের ভেতর কী হল জানি না, বাস থেকে নেমে হোটেলটার দিকে রওনা দিলাম। কেন দিলাম বলতে পারব না, বাসের মানুষ অবাক হয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল। আমি সোজা হেঁটে গেলাম। পর্দাটা সড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

এখনও কেন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে যে আমি যেন অন্য কেউ। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হল আমি এসব কী করছি। এরকম বোকামীর মানেটাই কী! আর আমার সাথে হচ্ছেটাই বা কী! আমি ধুপ করে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। মাথাটা এখন ঝা ঝা করছে। ভ্যাপসা গরম।

ফ্যানটাও দূরে। ফ্যানের নিচে দুয়েকজন বেঞ্চের উপর পা উঠিয়ে বসে আছে। ওদের মুখ গুলা হাসি হাসি। তৃপ্তির হাসি। পুরি জাতীয় কিছু একটা খাচ্ছে।

কাউন্টারেও একজন পা উঠিয়ে বসে আছে। এই দুপুরে পুরি ভাঁজছে কেন? যে লোকটা কড়াইয়ের পাশে তার দিকে আবার তাকালাম। ঠিক তেমনি ভাবে রান্না করে যাচ্ছে, যেমনটা বাস থেকে দেখেছি। এর মুখটাও হাসি হাসি। এর হাসিটা যেন লাজুক।

পর্দাটা এখনও সেভাবেই উড়ছে, যদিও ভেতরে বাতাস নেই। পর্দার জন্যই হয়ত বাতাস ঢুকছে না। সব স্বাভাবিক। তবু কী যেন একটা অসঙ্গতি আছে এখানে। ধুম করে ব্যাপারটা খেয়াল করলাম।

যেই লোকটা পুরি ভাঁজছে, কড়াইতে পুরি অনেক আগেই পুড়ে কাল হয়ে গেছে। লোকটা তখনো ভেঁজেই চলেছে। আমি সাথে সাথে বুঝে গেলাম কিছু একটা গড়মিল আছে এখানে। এখন বের হতে না পারলে বিপদ হবে আমার। খুব বড় কোন বিপদ হবে আমার।

আমি চট করে উঠে গেলাম। সোজা হেঁটে বাইরে বেরিয়ে আসতে গেলাম। পর্দাটা সড়িয়ে বের হবার সময়েই কী যেন হল! পুরা শরীর আমার অবশ। শুধু মাথা ঘুড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে পাড়ছি। মুখ খুলতে পারছি না।

হাত নাড়াতে পারছি না, পাও না। আমি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সবার চোখ সাদা। ধবধবে সাদা।

চোখের ভিতরের লাল লালা দাগগুলোও দেখছি, শুধু চোখের কাল মণিটা নেই। কারও নেই। সবার দুচোখ সাদা। আস্তে আস্তে তারা আমার কাছে এগিয়ে আসছে। ওদের মুখগুলা হাসি হাসি।

লাজুক একটা হাসি প্রত্যেকের মুখে। আতংকে আমার মুখ দিয়ে লালা বের হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছিলাম এটাই আমার নিয়তি ছিল। আমার নিয়তি আমাকে জোর করে এখানে ঠেলে এনেছে। ওরা খুব কাছে এগিয়ে আসল।

কীভাবে যেন যতটুকু ক্ষমতা ছিল প্রাণপণে প্রথম লোকটার চোয়ালে হাত ঘুড়িয়ে ধাক্কা দিলাম। ও ছিটকে পড়ল পিছে। এতে পরিস্থিতির কোন হেরফের হয় নি। আমি এখনও হাত পা নাড়াতে পারছিনা। আগের ধাক্কাটাতে আমার নিজের সবটুকু শক্তি শেষ।

হাত পা প্রচন্ড ভারী লাগছে। ওরা আমার কাছে এসে একটা গুঞ্জন তুলল। ওদের শরীরের গন্ধও পাচ্ছি এখন। এত কাছে এসে পড়েছে। সুর করে একটা গান গাচ্ছে যেন।

গানের মাঝে কী যেন বলছে। বলছে, “গোপন রেখ, গোপন রেখ ”। কে যেন চোখ বুজিয়ে দিল আমার। সুর করে গাওয়া গানটা শুনছি, শুনছি আর শুনছি। একটা গুঞ্জন।

কী গোপন রাখব? যদি গোপন না রাখি! চোখ মেলে দেখি আমি এখানে। এই পাগলা গারদে। শ্যামলিতে। আবার আমার অনুভূতি ফিরে এসেছে, আমি যেন আবারও আমিই। এখন আমি হার্ট ফাউন্ডেশনের পাশে উনিশ শয্যা বিশিষ্ট মানসিক হাসপাতালের ৭ নাম্বার বেডে।

একটা এনজিও আমার দায়িত্ব নিয়েছে। আমাকে নাকি ওরা রাস্তায় পেয়েছিল, আমি নাকি নিজের মনে ফুটপাতে হাসতে হাসতে কখনও কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছিলাম। সাভারে নাকি আমাকে পেয়েছে। একটা বাচ্চাকে কামড়ে দেয়ার পর মানুষজন আমাকে ধরে বেঁধে এখানে আনে। আমি প্রতি রাত সুর করে কাঁদি এখন।

মুখ দিয়ে নাকি লালা পড়ে। আর মাঝে মাঝে হঠাৎ আমার মাথায় সেই সুর ভেসে উঠে। তখন সব ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে ইচ্ছা করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাকে এখানে আনার তারিখ ৪ জুন। অথচ, সেদিন আমি ঘুম থেকে উঠে বাসে নিজেকে পেলাম ১১ জুনে।

অর্থাৎ সামনে কিছু একটা হবে। হয়ত আমি পালাব এখান থেকে, কোন একটা সুযোগ পাব বোধহয়। এরপর হয়ত সেই বাসে উঠে বসব। তাই সব কিছু লিখলাম এই কাগজটায়। কেউ যেন হদিস পায় আমার।

এই কাগজটা আমার ব্যাগে রাখব। আমি জানি কোন ভাবে আমার ব্যাগ, মানিব্যাগ আর মোবাইল আমি পালানোর আগে নিয়ে যেতে পারব। আপাতত আমার ইচ্ছা এমন কোন পাগলামী করা যেন আমাকে ওরা বিছানায় বেঁধে রাখে যেন আমি পালাতে না পারি। এখানে আঁটকে থেকে নিজের নিয়তি থেকে আমি পালাতে চাই। এসব লিখে রাখা কী ঠিক হল! আমাকে ত গোপন রাখতে বলেছিল ওরা।

------ চিঠির শেষে একটা পেপার কাটিং। অতিরিক্ত সিডেটিভ দেয়ার কারণে ৫ জুন একজন পাগলের মৃত্যু। ৬ জুন এই কাগজ পেয়েছেন আকমল সাহেব। সেদিন সন্ধ্যাতেই উনি সেই পাগলের লাশ দেখতে যান। এই পাগলের মানিব্যাগ,মোবাইল বা ব্যাগ পাওয়া যায় নি।

এটা আকমল সাহেব নিজে লিখে রেখেছেন। বুঝাই যায়, ভদ্রলোক খাঁটাখাঁটি করেছেন। আকমল সাহেব লাশের একটা ছবিও পেপার থেকে কেঁটে রেখেছেন। পাগলের লাশটার মুখও ছিল হাসি হাসি। কেমন একটা লাজুক হাসি।

আমি শিউরে উঠলাম। ওর একটা কথা আমার মনে পড়ল, “কেন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে যে আমি যেন অন্য কেউ। ” সন্ধ্যায় চিঠিটা শেষ করেই এই রাতে আমি আকমল সাহেবের বাসায় ছুটে যাই। উনার সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু উনার রুমে আমাকে ঢুকতে দিল না কেউ।

জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলাম উনি উদ্ভ্রান্তের মত বসে আছেন। মুখ দিয়ে লালা বের হচ্ছে। সুর করে কাঁদছেন উনি। হঠাৎ খেয়াল হল, আজকে ১০ জুন। কাগজটা যেহেতু আমারই কাছে, এটাকে আপাতত ব্যাগে রেখে দিলেই ভাল হবে।

কালকে বরং এটা অফিসে নিয়ে যাব। মামার পত্রিকায় ভিন্নধর্মী কিছু হিসেবে নিজের নামে ছাঁপানো যাবে। মামার অফিসটা যতদূর খেয়াল আছে বোধহয় গুলশানে। কালকে দুপুরের দিকে অফিস থেকে সময় করে বের হতে হবে। © আকাশ_পাগলা
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।