আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিধানের সংযম

করণিক: আখতার২৩৯

সংযমের ‘মাস’ রমজান, সংযমের প্রশিক্ষণ নেওয়ার ‘কাল’ রমজান। জ্ঞানপ্রাপ্ত কোনো মানবসন্তান যখন এ মাসের নাগাল পাবে, -সে যেন সংযত হয়; -বিধানের এ রকমই দাবি, -যে বিধানের লক্ষ্য শান্তি, -মানুষের শান্তি। (সৃষ্টিগতভাবেই ‘মানুষ’ স্বাধীন। মানবাকৃতির জীবন্ত দেহটিকে স্বাধীনভাবে যে-সত্তাটি আগামীর দিকে ধাবিত রাখে, সেটি বিবেক এবং আবেগের সংমিশ্রিত স্বাধীন সত্তা, -‘মানুষ’ বা মনুষ্যসত্তা। ‘স্বাধীনত্ব’ই মানুষের বা মনুষ্যসত্তার অসংযত হওয়ার সহায়ক উপাদান।

স্বাধীনত্ব উপাদানটি ‘মনুষ্যসত্তা’ ও ‘শান্তি’ এ-দু’য়ের মাঝামাঝি অবস্থান নিয়ে উভয়ের মধ্যে ব্যবধানকারীরূপে অস্তিত্বশীল। মোটকথা, -মানুষ, -‘অসংযত হওয়া না-হওয়া’র স্বাধীনতাপ্রাপ্ত। তবে জীবিত প্রত্যেক মানবসন্তানের চূড়ান্ত লক্ষ্য, -‘শান্তি’। -এবং, সংযমের মাস রমজানই এ-ব্যাপারে সহায়ক সময়, -মানুষের অসংযত না-হওয়ার ব্যাপারে সহায়ক সময়। আবেগের স্বাধীনতাকে প্রশ্রয় না-দেওয়ার সহায়ক সময় বা কাল, -অর্থাত্‌, ‘দেহ এবং মন’ উভয়ের সংযমের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য প্রতিবছর কমবেশি ঊনত্রিশটা মনোনীত নির্দেশিত দিন রমজান মাস নামে চিহ্নিত।

) প্রত্যেক জাত-ধর্মের শান্তিকামী মানুষের আত্মরক্ষার জন্য জাত-স্বাপেক্ষে সংযমের শাসন আছে। যথারীতি, বিশ্বাসী মানুষেরা ‘অসংযত স্বাধীন আবেগ’-কে নিয়ন্ত্রণে রেখে রেখে শান্তির লক্ষ্যে জাতধর্মের বিধান মেনে মেনে চলে। ‘সংযম’ এবং ‘ত্যাগ’ দু’টো আলাদা শব্দ। যথারীতি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ নিয়ে ঐ শব্দ দু’টো প্রচলিত। প্রত্যেক জাত-ধর্মের বিধানের শাসনে ত্যাগের মাধ্যেমেও শুদ্ধির প্রক্রিয়া আছে, তবে রমজানের শুদ্ধিতে ত্যাগ নয়, -নির্দেশ আছে সংযমের।

যেমন, দিন রাত পূর্ণ দিবস পানাহার ত্যাগ করতে হয় না, -দিবসের একাংশ, শুধু দিবাভাগে পানাহার বর্জন ক’রে সংযমের প্রশিক্ষণ নেওয়ার বিধান আছে। তবে দিবাভাগে পানাহারের সাথে সাথে আরও যা’কিছুতে সংযত থাকার নির্দেশ আছে, সেগুলো রমজান ছাড়া অন্য সময়ে বৈধ কি-না, ধাঁধাটা সেখানেই। যেমন, সংযত হওয়ার ধরণ যদি এমন হয় যে, -‘প্রতিদিন বারো জনের ক্ষতি করতাম, আজ রমজানে পাঁচ জনের ক্ষতি করছি; কিম্বা উসকানি দিয়ে সাতটা শান্ত পরিবেশকে কোন্দলময় করতাম, আজ তিনটাকে করছি; কিম্বা অন্যান্য দিনের মত নয়টা মিথ্যা না-ব’লে আজ ছয়টা মিথ্যা বলছি; কিম্বা পাঁচটা মিথ্যাসাক্ষ্য না-দিয়ে তিনটা দিচ্ছি; কিম্বা প্রতিদিন যে হারে অহংকার প্রদর্শন করতাম, রমজানে তারচে’ কম হারে অহংকার দেখাচ্ছি; কিম্বা অন্যান্য সময়ে কারো আড়ালে তার দোষ নিয়ে পাঁচখানা আড্ডায় আলোচনা করতাম, আজ তা’ করছি তিনখানা জলসায়; কিম্বা বিনাদোষে ভিন্নধর্মী বা ভিন্ন-মতাবলম্বীর রক্ত ঝরাতাম, আজ কেবল ধাক্কা দিয়ে ফেলে হালকা আঘাত দেবো; কিম্বা অ-রমজান-কালে যে-হারে অপচয় করতাম, আজ রমজানে তারচে’ কম অপচয় করছি; কিম্বা অন্যান্য দিনে বা রাতে প্রাপকের ন্যায্য ফাইল আটকিয়ে কৌশলে যত নিতাম, রমজানে আজ তারচে’ কম নিচ্ছি ;’ -ইত্যাদি ইত্যাদি ধরণের ‘সংযম-পালন’কে কোনো জাত-ধর্মই ‘বিধানের সংযম পালন’ ব’লে স্বীকৃতি দেয় না, -বরং ‘শয়তানি যুক্তি’ হিসেবেই চিহ্নিত করে এবং ‘শয়তানি যুক্তিময় সংযমের ধারণা’ কেবল শয়তানের ক্রীতদাস বা শয়তানের ভাইয়ের জন্যই গ্রহণযোগ্য। বিধানের সহজ ভাষায় যা’ অবৈধ তা’ সম্পূর্ণরূপেই পরিত্যাজ্য। পরিত্যাজ্যকে পরিত্যাগ করলে তবেই কেউ একজন ‘বিধানে বিশ্বাসী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়।

বিশ্বাসী হ’লে পরে তবেই তার জন্য ‘উপাসনা’ বা ‘সালাত’। (-তালিকার তৃতীয় স্থানে ‘সিয়াম’ বা ‘সংযম’) পরিত্যাজ্যকে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে না-চেয়ে সেগুলো থেকে আংশিক ভাবে সংযত হ’তে চাওয়াকে শয়তানি চাওয়া হিসেবেই ধরা হয়। ‘শয়তানি সংযমের প্রশিক্ষণের মাস রমজান,’-এমন দাবি(!),--এমন দাবি কোনো শয়তানও করে না। বস্তুত চিরঅক্ষম অভিশপ্ত শয়তান, মাধ্যম ছাড়া নিজে নিজে শয়তানি করতে পারে না। আসলে,-‘বিধানের সংযম’ হ’চ্ছে এমন সব বিষয়ে সংযত থাকা যা’ পরিত্যাজ্য নয়।

‘সংযমের প্রশিক্ষণের নির্দিষ্ট’ কালে সংযম পালনের নির্দেশ আছে সেই সব কর্মকাণ্ডে যেগুলো অন্যান্য সময়ে বৈধ হিসেবেই বিধানে বিবেচিত। কিম্বা যেগুলো অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত নয়। যেমন,-‘বৈধ উপার্জনে যোগাড় করা বিধানবৈধ খাদ্যদ্রব্যের অসীমিত ভক্ষণকে সীমিত করা; কিম্বা আঘাতের সম-পরিমাণ প্রতিঘাত করার বৈধ অধিকার এবং সুযোগ পেয়েও আঘাতকারীকে সসম্মানে ক্ষমা ক’রে দেওয়া; কিম্বা অসীমিত ‘বৈধ স্বজনপ্রীতি’কে (যে স্বজনপ্রীতিতে অস্বজনেরা যোগ্য প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত হয় না) সীমিত বা সংযত করা; কিম্বা স্বজনদেরকে বাদ দিয়ে ‘বেশি বেশি পরোপকার’-এর প্রবণতা সংযত করা; কিম্বা বৈধ পার্থিব কর্মকাণ্ডের ব্যতিব্যস্ততা কমিয়ে আনা; কিম্বা অন্যদেরকে সুযোগ না-দিয়ে একাই সমস্ত ভালোর দায়ভার বহন করার প্রবণতা সংযত করা; কিম্বা জাগতিক কর্মকাণ্ডকে এড়িয়ে সার্বক্ষণিক আধ্যাত্মিক জ্ঞানজগতে বিচরণের বৈরাগ্য প্রবণতা সংযত করা। ’-ইত্যাদি ইত্যাদি। তাত্ত্বিক শিক্ষণের নয়, -বরং, -প্রায়োগিক প্রশিক্ষণের অর্থাত্‌ ‘নিজে সংযত হ’য়ে সংযম পালনের’ প্রশিক্ষণ নেওয়ার মাস রমজান।

প্রত্যেক মানুষ অসাধারণ, -সাধারণ হওয়া সাধনার ব্যাপার। সংযমের প্রশিক্ষণের মাস ‘রমজান’ মানুষকে সাধারণ হওয়াতে সাহায্য করে, সাহায্য করে মধ্যপন্থা-অবলম্বী হ’তে। জ্ঞানপ্রাপ্ত কোনো মানবসন্তান যখন এ মাসের নাগাল পেলো, সে যেন সংযত হ’লো, বিধানের এ রকম-ই দাবি। আর ঐ বিধানের লক্ষ্য শান্তি, --মানুষের শান্তি। শেষের আগের কথা, আসুন, আবার একবার সংযত-জাগ্রত-বিবেকে, নিয়ন্ত্রিত-আবেগে আমরা ‘সমস্ত বিষয়টাকে’ এবং ‘নিজেকে’ ভেবে দেখি।

রঙ্গপুর : ১৯/১১/২০০৩ করণিক : মো: নুরুল আখতার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।