আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পূনশ্চঃ ইসলামী ব্যাংক : তত্ত্ব ও প্রয়োগের অসঙ্গতি ও কিছু কথা - (শেষ পর্ব)

“বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়। বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে। বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো। অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায় অনায়াসে সম্মতি দিও না। কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়, তারা আর কিছুই করে না, তারা আত্মবিনাশের পথ পরিস্কার

হযরত মুহাম্মদ যখন রিবা নিষিদ্ধ করেছিলেন তখন সুদ ছিল মহাজনী প্রথার অঙ্গ ।

তখনকার সমাজব্যবস্থা ছিল আদি সামন্ততান্ত্রিক । বিশেষ করে আরব ভূখন্ডে কৃষিব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না , পশুপালন কিছুটা বিকশিত হয়েছিল । সওদাগররা দূর দুরান্ত থেকে বানিজ্য করে অধিকাংশ প্রয়োজনীয় জিনিস আরবে সংগ্রহ করে আনত । তাদের জন্য মহাজনী কারবার কিছুটা প্রয়োজনীয় ছিল । জিনিসপত্র কিনবার জন্য কিছু অর্থ মহাজনের কাছ থকে ধার করে জিনিসপত্র কিনে হাট-বাজারে বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ আয় থাকে ঋণ শোধ করার পরেও বণিকদের হাতে পয়সা থাকত ।

অর্থ ব্যবহারের জন্যই তারা ঋণ দাতা মহাজনকে কিছুটা সুদ প্রদান করতো । এইভাবে বণিক ও মহাজন দুই জনেরই সম্পদ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেত । কিন্তু যারা গরীব তারা জীবনধারনের প্রয়োজনে একবার মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিলে আর তা শোধ করতে পারতো না, ঋণ বাড়তেই থাকতো । ক্রমাগত ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, এমনকি অনেক সময় ঋণ শোধ না করতে পেরে তারা মহাজনের গোলামে পরিণত হতো । নবী ছিলেন সমাজের শোষিত ও গরীব মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ।

নীচু তলার মানুষের প্রতি এই রহমতের ভাব থেকেই তিনি গরীব মানুষকে ধার দেয়া অর্থের সুদ নিতে নিষেধ করেছেন, এমনকি পারলে ঋণের আসলও ফেরত না নেওয়ার কথা বলেছিলেন । তাছাড়া মহাজন কোনো কাজ না করে, কোনো পরিশ্রম না করে শুধুমাত্র অর্থ খাটিয়ে অর্থ বৃদ্ধি করতো, এই অনুৎপাদক আয়কেও তিনি নিন্দা করেছেন । এই হলো সুদ সম্পর্কে কোরআনীয় আদেশের আর্থ-সামাজিক ও সমকালীন পটভূমি । আধুনিক পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রায় সর্বত্রই পূঁজিবাদী ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে উঠেছে , এই ব্যবস্থায় ব্যাংক শুধু মহাজনকে প্রতিস্থাপিতই করেনি, একটি নতুন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও আবির্ভূত ও বিকশিত হয়েছে । ব্যাংক শুধু অতীতের মহাজনদের মতো ঋণ প্রদানই করে না, ঋণ গ্রহণও করে ।

নিজের পূঁজির তহবিল দিয়েই শুধু কাজ করে না, অসংখ্য ব্যক্তির গচ্ছিত মূলধনকেও কাজে লাগায় । অতীতের মহাজনী প্রথায় অর্থের লেনদেন থাকলেও তার সাথে উৎপাদন প্রক্রিয়া কোনোভাবেই যুক্ত ছিল না । আর আধুনিক ব্যাংক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অর্থ বিনিয়োগ না করে আয় করতে পারে না , আমানতকারীদের কোনো সুদও দিতে পারে না । প্রসঙ্গত একটি কথাও এখানে বলা দরকার । সুদ কী ? সুদের হার কীভাবে নির্ধারিত হয় ? আজ থেকে পাঁচশ কি হাজার বছর আগে, সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির কোনো প্রশ্ন ছিল না ।

তখন তাই টাকার কোনো সময়ভিত্তিক অবমূল্যায়ন(devaluation) হতো না । সুদ ছিল সেখানে প্রকৃতই একটি অতিরিক্ত উপার্জন । কিন্তু আজকের পূঁজিবাদী অর্থনীতিতে যেহেতু জিনিসপত্রের লাগাতার মূল্যস্ফীতি ঘটে চলে, তার ফলে টাকার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন(devaluation) ঘটতে থাকে । ২০০০সালের দিকে ১০০ টাকা দিয়ে বাংলাদেশে যা কেনা যেত , এখন তা কিনতে মনে করেন ১৭২ টাকা লাগে । এখন কোনো ব্যক্তি যদি ৯ বছর আগে তার বাড়িতে ১০০ টাকা জমিয়ে রাখতেন , তাহলে আজ তার পক্ষে সেই টাকায় অনেক কম জিনিস কেনা সম্ভব হতো ।

কাজেই কোরান-হাদিস মেনে কেউ যদি ২০০০ সালের দিকে ১০০ টাকা তার থেকে ধার নিয়ে আজকে এসে ১০০ টাকাই শোধ করে, তাহলে আসলে ক্ষতি হয়ে যায় । ব্যাংকের সুদের হার টাকার এই অবমূল্যায়নের ক্ষতিপূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ বৃদ্ধির হারের দিকে লক্ষ্য রেখে আমানতকারীর ক্ষেত্রে তার সামান্য নীচে এবং ঋণ গ্রহীতার ক্ষেত্রে তার সামান্য উপরে নির্ধারণ করে । উপরোক্ত হিসেব ঠিক থাকলে , ব্যাংক হয়তো দেখলো সরল সুদের হার বার্ষিক ১২% হলে টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হয় । সুতরাং সে আমানতকারীকে হয়তো বার্ষিক ১০ % হারে সুদ দেয় এবং ঋণ গ্রহীতের কাছ থেকে বার্ষিক ১৫% হারে সুদ নেয় । সুদের এই চরিত্রও প্রাচীন খেলাফতের যুগ থেকে সম্পুর্ণ আলাদা হয়ে গেছে ।

কিন্তু এই অবমূল্যায়ন রোধ করার জন্য টাকা ব্যাংকগুলো কোথায় পাবে ? ব্যাংকের নিরাপদ লকারে বা ভল্টে টাকা রেখে দিলে তো আর বাড়বে না । তাকে টাকা কোনো লাভজনক ক্ষেত্রে তো বিনিয়োগ করতেই হবে । তাই আধুনিক ব্যাংকের আয় কোনোভাবেই নবী সমালোচিত অনুৎপাদক প্রক্রিয়ায় উপার্জিত আয় নয় । তাছাড়া পূঁজিবাদের বিকাশের মধ্যে দিয়ে একচেটিয়া পূঁজির প্রক্রিয়ায় ব্যাংক পূঁজি ও শিল্প পূঁজির মিলন হয়েছে, ফলে লগ্নী পূঁজির বিকাশ ঘটেছে । একই মালিক শিল্প ও ব্যাংকের মালিক ও পরিচালক হওয়ার ফলে অর্থনীতির দু'টি ক্ষেত্রেই তাদের ভূমিকা অনেক বেড়ে গেছে ।

ব্যাংকের কাজেও অসংখ্য বৈচিত্র্য ও জটিলতা দেখা দিয়েছে । নবীর যুগের সাথে এইসব ব্যাপারে আধুনিক যুগের যে বিরাট পার্থক্যরেখা বিদ্যমান তা অনেকেই মনে রাখেন না । আর মনে রাখেন না বলেই স্বীয় বক্তব্যের সমর্থনে অনেক আজগুবি উদাহরন দিতেও তাদের বাধে না । বাস্তবে সত্তর দশকের গোড়ায় তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদীয়মান পূঁজিপতিরা স্বদেশের ব্যাংক ব্যবস্থাকে অর্থনীতির তৃণমূলে বিস্তৃত করার যে পরিলক্পনা ও কর্মসূচী গ্রহন করে তার জন্য তারা নানা উৎস থেকে পূঁজি সংগ্রহ ও বিনিয়োগ করতে শুরু করে । এরই সুযোগ নিয়ে হয়তো, পেট্রোডলারের স্পর্শপুষ্ট হয়ে কিছু কিছু বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন 'পরহেজগার' ও ধনবান ব্যক্তি ইসলামী ব্যাংক স্থাপন করে ফেলেন ।

অন্যান্য ব্যাংকের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার প্রয়োজনে ইসলামের ঝান্ডা, কোনআনের আয়াত, সাধারন মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসকে তাঁরা বাড়তি হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে থাকেন । এই হলো ইসলামী ব্যাংক স্থাপন ও বিকাশের বাস্তব ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট । ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংক যেমনই হোক, এর 'ইসলামী' লেবেলটি একটি চরম প্রতারনার দৃষ্টান্ত । আগের পর্বটি এখানে - ইসলামী ব্যাংক : তত্ত্ব ও প্রয়োগের মধ্যে অসঙ্গতি ও কিছু কাজের কথা - ১ তার আগের পর্ব - ইসলামী ব্যাংকের আয় : কতোটা সুদবিহীন আসলে ? তার আগের পর্ব - ইসলামী ব্যাংকের কর্মনীতি : বিশেষত্বটা কোথায় ? তার আগের পর্ব - ইসলামী ব্যাংকিং : গড়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু কথা

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।