আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাচ্যের আপেল পেয়ারা

কেউ কেউ একা

মধুমাস শেষ হলেও তার রেশ এখনও কাটেনি। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, কামরাঙ্গা, জামরুল, জাম্বুরা, লটকনসহ নানা ধরনের মৌসুমী ফল দখল করে আছে আমাদের বাজার। ফলের রাজা আম, জাতীয় ফল কাঁঠাল আর নানাবিধ গুণের সমন্বয় হল পেয়ারা। পেয়ারা একটি বেরী জাতীয় ফল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতের পেয়ারা রয়েছে।

মূলত পেয়ারা দক্ষিণ আমেরিকার অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি ফল। তবে মেক্সিকো থেকে পেরুর মধ্যবর্তী অঞ্চলটাকেও এর উৎপত্তিস্থল বলে মনে করা হয়। খুব সম্ভব সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে পর্তুগীজরা ভারতে পেয়ারা আনলে তা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে। কাশী থেকে প্রথম বিপিন রায় পেয়ারা আনেন বলে জানান স্বরূপকাঠির আদমকাঠি গ্রামের ৯০ বছরের বৃদ্ধ মহেন্দ্রনাথ হালদার। পেয়ারা আড়তের মালিক গৌরাঙ্গ বিশ্বাস বলেন, পূর্ন মণ্ডল নাম করে একজন ভারত থেকে প্রথম পেয়ারা আনেন, যার নামানুসারে পেয়ারার নাম হয় পুর্ন মণ্ডলী গয়া।

উষ্ণ ও অবউষ্ণু মণ্ডলের জলবায়ু পেয়ারা চাষের জন্য উপযোগী। যে অঞ্চলে কয়েক মাস শীত থাকে সেখানে পেয়ারার ফলন আরও ভাল হয় এবং গুণাগুণ বৃদ্ধি পায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫০০ মি. উচ্চতায়ও পেয়ারা জন্মাতে পারে। বরিশাল, স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল পেয়ারা চাষের জন্য অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করায় এখানকার অধিকাংশ এলাকা জুড়ে চাষ হচ্ছে পেয়ারা, সাথে অন্যান্য সাথী ফসল। এখানকার অধিকাংশ পেয়ারা চাষি তাদের পূর্বপূরুষের হাত ধরে পেয়ারা চাষে এসেছে, এমনটি জানালেন ৬টা বাগানের মালিক রবিন মণ্ডল।

তারা অভিজ্ঞতাকেই পুঁজি করে করছে পেয়ার চাষ। বাংলাদেশে ৪, ৯০০ হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হয়। উৎপাদন হয় ২৮,০০০ টন পেয়ারা। চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার কাঞ্চননগর পাহাড়ি অঞ্চলের 'কাঞ্চন জাত', ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সমতল ভূমির মুকুলন্দপুরী জাত এবং বরিশাল, স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর, ঝালকাঠি জেলার জোয়ারভাটা অঞ্চলে পূর্নমণ্ডলী জাতের চাষ হচ্ছে। এছাড়া স¤প্রতি নরসিংদী, গাজীপুর, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলে বড়জাতের কাজী পেয়ারার বাণিজ্যিক বাগান গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের মোট পেয়ারা উৎপাদনের ৮০ ভাগ আসে স্বরূপকাঠির ৩টি ইউনিয়ন আটঘর কুড়িয়ানা, জলাবাড়ি, সমুদয়কাঠি অঞ্চল থেকে। এ ছাড়া আন্দকুল, জিন্তাকাঠিসহ ২৬টি অঞ্চলে ৬৪০ হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ৫২২ হেক্টর বাগান রয়েছে কুড়িয়ানা। এ অঞ্চলের ৯০ভাগ অর্থাৎ ১২৫০টি পরিবার ২০২৫টি পেয়ারা বাগানের আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। সিডরের পর বিভিন্ন রোগের প্রকোপ কমে যাওয়ায় এ বছর পেয়ারার ফলন ভাল হয়েছে।

অতিরিক্ত খরার কারণে পেয়ারার আকার ছোট হলেও মোটামুটি খুশি পেয়ারার বাগান মালিকরা। কিন্তু সাথী ফসল হিসেবে হলুদ, কলা, আনারস, লেবু, আমড়ার চাষ করতে নানাবিধ সমস্যার কথা জানান গ্রামবাসী। জালের মত ছড়িয়ে থাকা নদীর জোয়ারভাটার কারণে আইল পদ্ধতিতে পেয়ারার চাষ হচ্ছে বরিশাল, স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর, ঝালকাঠির বিভিন্ন জায়গায়। ছোট ছোট নৌকা আর ট্রলারই তাদের যাতায়াতের মাধ্যম। দেড় বিঘা জমি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে সাব কাবলা করে পেয়ার চাষ করছেন রমেশ রায়।

ফলন এবার ভাল বলেই জানান তিনি। প্রতিদিনই বিভিন্ন আড়তে পেয়ারা আসছে। ক’দিন পরে আরও বেশি আসবে। এখন ৩ থেকে ৪ টাকা কেজি বিক্রি হলেও পরে ১ থেকে ২ টাকাতে নেমে আসবে। তখন ক্ষতিগ্রস্ত হবে পেয়ার চাষিরা।

ছোট নদীগুলোর বিভিন্ন জায়গায় বসেছে পেয়ারাসহ নানা সবজি কেনার আড়ত। আদমকাঠি, কচুয়াকাঠি, কুড়িয়ানা, ব্রাহ্মণকাঠি, ধলহার, ভদ্রাংক, আতা, ভিমরুলী, ডুমুরীয়া, শতদশকাঠি খেজুরাসহ ৩০ থেকে ৩৫টি আড়ত আছে। আড়তদাররা পেয়ারা কিনছে খুবই কম দামে। অথচ সেই পেয়ারাই ঢাকা গিয়ে বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। হিসেবে দেখা যায়, পেয়ারা বিভিন্ন শহরে পাঠাতে ৬০ কেজি পেয়ার ধরে এমন ঝুড়ির দাম ৫০ টাকা, চট ৮ টাকা, লঞ্চ ভাড়া ৮০ টাকা, কুলিভাড়া, চাদাবাজি, মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যেসহ বিভিন্ন শহরে এসে পেয়ারার দাম হয়ে যায় কয়েক গুণ বেশি।

প্রতিবিঘা জমি থেকে পেয়ারা বিক্রির টাকা আসে ২০ থেকে ২৫ হাজার করে। সব খরচ দিয়ে ৫ হাজার টাকা লাভ করলেও পেয়ারা চাষিরা পাচ্ছে না তাদের উৎপাদিত পেয়ারার সঠিক মূল্য। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় সময়মত পৌঁছাতে পারছে না বিভিন্ন জায়গায়। সামগ্রীকভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে সবাই। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ মণ পেয়ারা আসছে প্রতি আড়তে।

এমন ৩০টি আড়তে মোট আসছে ৯০০ মণ। পেয়ারাগুলো ঝুড়িতে ভরে ট্রলারে করে লঞ্চে চলে আসছে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরগুলোতে। অনুন্নত জলপথ যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হওয়ার কারণে ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে অধিকাংশ পেয়ারা চাষি। স্থানীয়ভাবে পেয়ারা সংরক্ষণাগার দরকার। দরকার পেয়ারা দিয়ে তৈরি জ্যাম, জেলি, চাটনীর কারখানা স্থাপন।

পাশাপাশি দরকার কৃষি বিভাগের সহযোগিতা। অনেক পেয়ারা চাষি উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা অসহযোগিতার কথা বলেছেন। অভিযোগ করেছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে তারা এসে রাস্তার পাশের বাগানের একাংশ দেখে চলে যায়। আমরা যোগাযোগ করি গৌরনদী কৃষি স¤প্রসার অধিদপ্তরের কৃষি কর্মকর্তা হৃদয়েশ্বর দত্তের সাথে। তিনি অনেক সীমাদ্ধতার কথা বলেন।

পাশাপাশি পেয়ারা চাষ কীভাবে আরও বাড়ানো যায় সে কথাও বলেন। পেয়ারাকে প্রাচ্যের আপেল বলা হয়। আমাদের দেশের মোট উৎপাদনের ৯০ ভাগই আসে বরিশাল, স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর, ঝালকাঠির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। অথচ এখানকার পেয়ারা চাষিরা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। তাদের ফল বাগানের ওপর শতাংশে ৩ টাকা হারে কর ধরা হয়েছে যা তারা দিতে নারাজ।

সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত ধান পাট চাষিরা ঋণ পেলেও পেয়ারা চাষিরা কোন ঋণ পাইনি। এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য তারা নানামুখী সমস্যার সন্মুখীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একটি সংরক্ষণাগার ও পেয়ারাজাত বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্যের কারখানা স্থাপন করার দাবি জানান এ অঞ্চলের পেয়ারা চাষিরা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.