আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পবিত্র কুরআনে



যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, প্রথম ও তৃতীয় দলটি ইসলামের সত্যতাকে উপলব্ধি করে ইসলাম গ্রহণ করে৷ কিন্তু দ্বিতীয় দলটি যারা মুবাহিলাহ্ করতে চেয়েছিল এবং পরবর্তীতে তা বন্ধের অনুরোধও জানিয়েছিল, তারাও ইসলামের সত্যতাকে অনুধাবণ করতে পেরেছিল কিন্তু কয়েকটি দলিলের ভিত্তিতে ইসলামকে বাহ্যিকভাবে গ্রহণ করেনি যা নিম্নরূপ : ১- পোপ নবীর (সা.)দেয়া চিঠিকে ছিড়ে ফেলেছিল৷ এই ক্ষমতার লোভ ও গোড়ামীতাই সত্যকে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল৷ ২- তারা মুবাহিলাহ্ করতে প্রস্তুত হয়নি৷ যদি তারা ইসলাম ও নবীর (সা.)সত্যতাকে অনুধাবন নাই করতে পারতো তাহলে কেন মুবাহিলাহ্ বন্ধের অনুরোধ করেছিল? আর এটাই হচেছ উপযুক্ত দলিল যে, তারা নবী (সা.)ও ইসলামের সত্যতাকে বুঝতে পেরেছিল৷ ৩- ইতিহাসে এসেছে যে, নাজরানের প্রতিনিধিরা সেখানে ফিরে যাওয়ার সময় রাস্তায় তাদের মধ্যে একজন নবীর (সা.)ব্যাপারে বাজে মন্তব্য করলে পোপ (আবু হারিছাহ্) ঐ ব্যক্তির উপর ভীষণ রেগে গেল এবং বলল কেন মুহাম্মদের সম্বন্ধে খারাপ কথা বলছো? তার এই উক্তির কারণে ঐ ব্যক্তি মদীনায় ফিরে আসে এবং নবীর (সা.)সাক্ষাতে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে৷ (ইতিহাসের এ ঘটনাটিও এই কথারই বহিঃপ্রকাশ যে, নাজরানের প্রতিনিধিরা নবীর (সা.)নবুওয়াতের সত্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিল)৷ ৪- যখন নাজারানের প্রতিনিধিরা সেখানে ফিরে গেল এবং নিজেদের ঘটনাকে মানুষের সামনে বর্ণনা করলো তখন সেখানকার একজন সন্ন্যাসী এ সকল শুনে দারুণভাবে ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে চিৎকার দিয়ে বলে : "হে মানব সকল! আমাকে এই আশ্রমের উপর থেকে নামিয়ে নিয়ে যাও, তা না হলে আমি নিজেই লাফিয়ে পড়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিব"৷ জনগণ তাকে আশ্রমের উপর থেকে নামিয়ে নিয়ে এলো৷ তারপর সে সরাসরি মদীনায় চলে আসে এবং কিছু দিন নবীর (সা.)সংস্পর্শে থাকে৷ তাঁর সাথে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত নিয়ে জ্ঞানগত আলোচনা করে তা সম্পর্কে শিক্ষা নিয়ে পুনরায় নাজরানে ফিরে যায়৷ নবীর (সা.)কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় সে তাকে কথা দেয় যে, মদীনায় ফিরে আসবে এবং মুসলমান হবে, কিন্তু তাতে সে সফল হয়নি... ৮- মুয়া'বিয়ার সাথে ইমাম আলীর (আ.)লিখিত মুনাযিরা : মুয়া'বিয়া ইবনে আবুুসুফিয়ান, সিফ্ফিনের যুদ্ধ সংঘটিত করার পর ইমাম আলীর (আ.)খেলাফতের শেষের দিকে তাঁর কাছে চিঠি দেয়৷ চিঠির বিষয়বস্তুতে নিম্নের চারটি দিক বর্ণিত ছিল : ১- শামের এই বিস্তৃর্ণ সবুজ ভুমিকে আমার হাতে অর্পন কর, যাতে করে এই এলাকার প্রশাসক হিসেবে আমি দায়িত্বভার গ্রহণ করতে পারি৷ ২- সিফ্ফিনের যুদ্ধের কারণে অনেক রক্তপাত হয়েছে এবং আরো হবে তাই তা অব্যাহত দেয়া থেকে বিরত হও৷ ৩- আমরা দুই পক্ষই যুদ্ধের ক্ষেত্রে সমান সমান এবং উভয় পক্ষই আমরা মুসলমান৷ আর দুই পক্ষেই ইসলামী ব্যক্তিত্বরা অবস্থান করছে৷ ৪- আমরা দুইজনই আবদে মানাফের (নবীর (সা.)বংশের তৃতীয় পুরুষ) বংশধর৷ সে কারণেই কেউ আমরা একে অপরের থেকে উচেচ নই৷ সুতরাং এখনো এটা সম্ভব যে অতীতের ব্যাপারে অনুতপ্ত হয়ে নিজেদের ভবিষৎকে ত্রুটি মুক্ত করি ৷ ইমাম আলী (আ.)মুয়া'বিয়ার চিঠির প্রতিটি বিষয়ের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদাভাবে জবাব দেন যা নিম্নরূপ : ১- শাম শহরকে তোমার হাতে অর্পণ করবো না৷ জেনে রাখ যে, আমি যে জিনিষ কাল তোমাকে দেইনি আজ তা দান করবো না৷ (আল্লাহ্র শাসন ব্যবস্থায় আজ ও কালের কোন পার্থক্য নেই আর তা দুষকৃতিকারীদের হাতে পৌছাবে না)৷ ২- তুমি লিখেছো যে, যুদ্ধ আরবদের ধবংসের কারণ হবে, তবে জেনে রাখ যারা যুদ্ধে মারা যাবে তারা যদি সত্যের পক্ষে থেকে থাকে তাহলে তাদের স্থান হবে বেহেশ্তে৷ আর যদি তারা বাতিলের পক্ষে থেকে থাকে তবে তাদের স্থান হবে আগুনের মধ্যে৷ ৩- তুমি দাবি জানিয়েছো যে, যুদ্ধে আমি এবং তুমি সমান সমান এমনটি নয়, কেননা তুমি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছো আমার পর্যায়ে ইয়াকীন বা বিশ্বাসে পৌছাওনি৷ আর ইরাকের অধিবাসীদের থেকে শামের অধিবাসীরা আখেরাতের প্রতি অধিক লোভী নয়৷ ৪- আর তুমি যে বলেছো, 'আমরা সবাই আবদে মানাফের সন্তান' হ্যাঁ এটা ঠিক কিন্তু উমাইয়্যা (তোমার পূর্ব পুরুষ) অনুরূপ (তার ভাই) হাশিমের (আমার পূর্ব পুরুষ) মত নয়৷ আর র্হাব (তোমার পূর্ব পুরুষ) অনুরূপ আব্দুল মুত্তালিবের (আমার পূর্ব পুরুষ) মত নয়৷ তদ্রুপ আবু সুফিয়ান (তোমার পিতা) অনুরূপ আবু তালিবের (আমার পিতা) মত নয়৷ আর কখনই মুহাজিররা ফাত্হে মক্কায় আটককৃত কাফের যাদেরকে রাসূল (সা.)পরবর্তীতে মুক্ত করে দিয়েছিলেন তাদের মত নয়৷ সঠিক বংশধারী আর সত্যের অনুসারীগণ অনুরূপ বাতিলের অনুসারী এবং মু'মিন অনুরূপ খারাপ ব্যক্তির ন্যায় হবে না৷ আর এটা কতই না লজ্জাষ্কর ব্যাপার তাদের জন্য যারা এমন পূর্ব পুরুষের অনুগত্য করে, যাদের অবস্থান হচেছ জাহান্নামের আগুনে৷ এ ক্ষেত্রে নবুওয়াতের সম্মান, গৌরব বা যশ আমাদের অধিকারে৷ যার কারণেই প্রিয়জনকে অপদস্থ আর অপদস্থদেরকে সম্মানিত করেছি৷ যখন মানুষ দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং সত্যকে আকড়ে ধরার ক্ষেত্রে একে অপরের মধ্যে প্রতিযোগীতা করেছিল তাদের সকলের পরে, তোমরা হয় দুনিয়া পাওয়ার জন্য অথবা ভয়ে ইসলামের ছত্র ছায়ায় এসেছিলে৷ সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে কোন প্রকার ফযিলত তোমাদের নেই৷ অতএব সজাগ থেকো শয়তান যেন তোমার মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে ৷ ৯- ইমাম আলী (আ.)নিজের অধিকারকে রক্ষার লক্ষ্যে যে সকল মুনাযিরা করেছিলেন তার কয়েকটি নমুনা : জনাব উসমানের খেলাফতের শেষ দিকে মুহাজির ও আনসারদের একটি দল যা ছিল প্রায় দু'শ জনের মত, মসজিদে নববীতে একত্রিত হয়ে নিজেদের মধ্যে কয়েক দলে বিভক্ত হয়ে দলে দলে আলোচনা বা মুনাযিরা করছিল৷ তাদের মধ্যে একটি দল জ্ঞান ও তাকওয়ার শান-মর্যাদা নিয়ে কথা বলল এবং কুরাইশদের উত্তম ও উজ্জল অতীত ইতিহাস এবং তাদের ব্যাপারে রাসূল (সা.)অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেছিলেন তা তুলে ধরলো৷ সাথে সাথে আরো উল্লেখ করলো যে, রাসূল (সা.)নাকি তাদের ব্যাপারে বলেছেন : ألاْئمَّةُ مِنْ قُرَيشٍ (ইমামগণ সকলেই কুরাইশ থেকে)৷ অথবা বলেছেন : اَلنَّاسُ تَبَع لِقُرَيشٍ، وَ قُريش اَئمَّةُ الْعَرَبِ (মানুষ কুরাইশদেরকে আনুগত্য করবে এবং কুরাইশ হচেছন আরবের নেতৃত্ব দানকরী)৷ এরূপভাবে সব দলই তাদের নিজেদের ব্যাপারে ঐতিহ্যসমূহকে একের পর এক তুলে ধরছিল৷ মুহাজিরদের মধ্যে যে ব্যক্তিবর্গরা উপস্থিত ছিলেন তারা হচেছন যথাক্রমে : আলী (আঃ), সা'দ ইবনে ওয়াক্কাস, আব্দুর রহমান ইবনে আ'উফ, তালহা, যুবাইর, মিকদাদ, হাশিম ইবনে উ'তবাহ্, আব্দুল্লা ইবনে উ'মর, হাসান ও হুসাইন (আঃ), ইবনে আববাস, মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর, আব্দুল্লাহ্ ইবনে জা'ফর৷ আর আনসারদের মধ্যে যে ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন তারা হচেছন যথাক্রমে : উবাই ইবনে কা'য়াব, যাইদ ইবনে ছাবিত আবি আইয়ূব আনসারী, কাইস ইবনে সা'দ, জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ্ আনসারী এবং আনাস ইবনে মালিক ও আরো অনেকেই... তাদের মধ্যে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মুনাযিরা চললো৷ এ সময় উসমান তার বাড়ীতে অবস্থান করছিল এবং আলী (আ.)ও তাঁর সঙ্গী-সাথীরা আলোচনায় অংশ না নিয়ে চুপ করে ছিলেন৷ এমতাবস্থায় উপস্থিত সবাই ইমাম আলীর (আ.)দিকে ফিরে বলল : 'আপনি কেন কোন কথা বলছেন না?' তিনি বললেন : তোমাদের দুটি দলই (মুহাজির ও আনসার) নিজেদের মর্যাদা, সম্মান এবং প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা সম্পর্কে কথা বলেছো৷ তাই আমি তোমাদের দুই দলের কাছেই জানতে চাই যে : "আল্লাহ্ তা'য়ালা কি কারণে তোমাদেরকে এই মর্যাদা ও সম্মানে ভূষিত করেছেন?" উভয় দলই বলল : হযরত মুহাম্মদ (সা.)ও তাঁর আহ্লে বাইতের অস্তিত্বের কারণে আল্লাহ্ তা'য়ালা আমাদেরকে এই পুরস্কারে ভূষিত করেছেন৷ ইমাম আলী (আ.): সত্য বলছো, তোমরা কি জান না যে, তোমাদের দুনিয়া ও আখেরাতে নাজাত পাওয়ার একমাত্র কারণ হচেছ আমাদের এই নবুওয়াতী বংশের কারণেই? আমার চাচাত ভাই মুহাম্মদ (সা.)বলেছেন : "আমি ও আমার খানদান হযরত আদম (আ.)সৃষ্টির চৌদ্দ হাজার বছর আগে আল্লাহ্ দরবারে নূর অবস্থায় ছিলাম, তারপর আল্লাহ্ তা'য়ালা ঐ নূরকে সর্বদা বংশ পরম্পরায় পবিত্র গর্ভে স্থান দিয়েছেন৷ যা কখনই কোন অপবিত্রতা এই নূরকে স্পর্শ করতে পারবে না বা স্পর্শ করার কোন পথও খোলা নেই৷ অতঃপর আলী (আ.)নিজের ফযিলত সম্পর্কে কিছু বর্ণনা তুলে ধরলেন এবং উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন আমি যা বলছি তা কি সত্য, না সত্য নয়? উপস্থিত সকলেই একযোগে সাক্ষ্য দিলো যে, এর সবগুলোই সত্য এবং রাসূলে খোদা (সা.)তাঁর ব্যাপারে এসব ফযিলত উল্লেখ করেছিলেন৷ তিনি আরো বললেন : "তোমাদেরকে আল্লাহ্র কসম দিচিছ যারাই তোমাদের মধ্যে আমার খেলাফতের ব্যাপারে রাসূলের (সা.)নিকট থেকে যা শুনেছো তারা উঠে দাড়াও এবং সাক্ষ্য দাও"৷ এ সময় কয়েকজন যেমন : আবুযার, সালমান, মিকাদাদ, আ'ম্মার, যাইদ ইবনে আরকাম, বোরা' ইবনে আ'যেব উঠে দাড়িয়ে বললেন : 'আমরা সাক্ষ্য দিচিছ যে, এ ব্যাপারে রাসূলে খোদার (সা.)বক্তব্যকে স্মরণে রেখেছি এভাবে; যখন তিনি মিম্বারের উপরে ছিলেন এবং আপনি তাঁর পাশে ছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন : "আল্লাহ্ তা'য়ালা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমি যেন তোমাদের ইমাম ও আমার প্রতিনিধি ও ওয়াসি এবং আমার পরে আমার কাজের দায়িত্ব গ্রহণকারীকে (যার নির্দেশ মেনে চলাকে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য ওয়াজিব (ফরজ) করেছেন) নিয়োগ করবো... হে মানব সকল! আমার পরে তোমাদের ইমাম, মাওলা ও পথ নির্দেশক হবে আমার ভাই আলী (আঃ)৷ وَ هُوَ فِيْكُمْ بِمَنْزِلَتىِ فِيْكُمْ فَقَلَّدُوهُ دِيِنَكُمْ وَ اَطِيعُوهُ فِى جَميعِ اُمُورِكُمْ... "আর তোমাদের মধ্যে তাঁর মর্যাদা অনুরূপ আমার মর্যাদার সমতুল্য৷ নিজের দ্বীনের জন্য তাঁর আনুগত্য করবে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর নির্দেশ মেনে চলবে" ৷ এরূপে ইমাম আলী (আ.)ঐ মুনাযিরাতে উপস্থিত সকলের মধ্যে নিজের ইমামত ও উপযুক্ততার ব্যাপারে দলিল উপস্থাপন করেন এবং তাদের উপর নিজের দায়িত্ব সম্পূর্ণ করেন৷ ১০- মুয়া'বিয়ার রাজনৈতিক চক্রান্তের জবাব : 'আম্মার ইয়াসির' নবীর (সা.)একজন উচচ মানের সাহাবা ছিলেন৷ তিনি ইসলামের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নবীর (সা.)পরে আলীকে (সা.) অনুসরণের মাধ্যমেই পথ চলেছেন৷ আর এরূপে পথ চলতে চলতে সিফ্ফিনের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন৷ নবী (সা.)তাকে বলেছিলেন : تَقْتُلُكَ الْفِئَةُ الْباغِيَةِ (একদল অত্যাচারী জালিম তোমাকে হত্যা করবে)৷ এই কথাটি মুসলমানগণ শুনেছিলেন এবং তাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হয়েছিল যে, নবী (সা.)আম্মারের শান বা মর্যাদায় এরূপ বলেছেন৷ এ ঘটনার অনেক বছর পরে আলীর (আ.)খেলাফতের সময় তাঁর সৈন্য দলের সাথে মুয়া'বিয়ার সৈন্য দলের যুদ্ধ হয়৷ ইতিহাসে এই যুদ্ধটি সিফ্ফিনের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত৷ এই যুদ্ধে 'আম্মার ইয়াসির' আলীর (আ.)সৈন্য দলের মধ্যে ছিলেন৷ যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে অনেক হতাহতির পর মুয়া'বিয়ার সৈন্য দলের হাতে তিনি শহীদ হন৷ যারা সেদিন সন্দেহের মধ্যে ছিল যে, এই দুই দলের মধ্যে কে সত্যের পথে আলী না মুয়া'বিয়া, তারা 'আম্মার ইয়াসিরের' শাহাদতের ঘটনা থেকে নবীর (সা.)বক্তব্য অনুসারে বুঝতে পেরেছিল যে মুয়া'বিয়ার সৈন্য দল হচেছ অত্যাচারী জালিম৷ কেননা 'আম্মারকে' হত্যা করেছে৷ সুতরাং স্বয়ং মুয়া'বিয়াও হচেছ অত্যাচারী, জালিম ও বাতিল৷ এমতাবস্থায় মুয়া'বিয়া দেখলো যে, এই ঘটনা তার সৈন্য দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে এবং এর ফলে সৈন্য দল দুর্বল হয়ে যেতে পারে, তাই সে ততক্ষণাৎ তার কাজের একটি ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের মধ্যে নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করতে চাইলো এভাবে : 'আমি আম্মারকে হত্যা করিনি তাকে আলী হত্যা করেছে৷ কেননা আলী যদি তাকে আমার সাথে যুদ্ধ করতে না পাঠাতো তবে সে নিহত হত না!!' এই ভুল ব্যাখ্যাটিকে অন্যরা বুঝতে না পেরে বিশ্বাস করে নিল৷ ইমাম আলী (আ.)এই ভুল ব্যাখ্যার বিপরীতে একটি উপযুক্ত জবাব পেশ করলেন : "যদি মুয়া'বিয়ার কথা ঠিক হয়ে থাকে তাহলে বলতে হয় যে, হযরত হামযা ওহুদের যুদ্ধে মুশরিকদের হাতে কতল হননি, তাকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)কতল করেছেন (নাউযুবিল্লাহ্) কেননা তিনিই তো তাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন"৷ আমরু আ'সের ছেলে আব্দুল্লাহ্ এই জবাবটিকে মুয়া'বিয়ার নিকট পৌছালে সে এতই রাগান্বিত হয়েছেলি যে, আমরু আ'সকে ডেকে বলল 'তোর অপদার্থ ছেলেকে এই স্থান থেকে বের করে দে!' (এটাও ছিল এক ধরনের মুনাযিরা যাতে শত্রুর নাক কাটা গিয়েছিল) ৷ ১১- এক বৃদ্ধের সাথে ইমাম সাজ্জাদের (আ.)মুনাযিরা এবং তাকে নাজাত দান : কারবালার সেই হৃদয় বিদারক ঘটনার পরে যখন ইমাম সাজ্জাদ (আ.)ও তাঁর পরিবারবর্গকে বন্দী করে দামেস্কে আনা হল তখন শামের অধিবাসী এক বৃদ্ধ ইমামের নিকটবর্তী হয়ে বলল : 'সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্ তা'য়ালারই জন্যে যে, তিনি তোমাদেরকে ধবংস করেছেন এবং তোমাদের শহরের জনগণকে তোমাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন, সাথে সাথে আমিরুল মু'মিন ইয়াযিদকে তোমাদের উপর কর্তৃত্বশালী করেছেন'৷ ইমাম সাজ্জাদ (আ.)এই বৃদ্ধকে (যে ছিল ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ) এরূপ বললেন : তিনি : হে বয়োবৃদ্ধ কোরআন পড়েছো কি? বয়োবৃদ্ধ : পড়েছি৷ ইমাম : এই আয়াতের অর্থটি কি খুব ভালভাবে বুঝেছো যেখানে আল্লাহ্ তায়ালা বলছেন : ( قُل لاَ اَسئَلُكُم عَلَيهِ اَجراً اِلاّ المَوَدَّةَ فِي القُربَى) (বল হে আমার রাসূল, তোমাদের কাছে আমার পরিবারের ভালবাসা ব্যতীত অন্য কোন পারিশ্রমিক চাইনা) ৷ বয়োবৃদ্ধ : হ্যা,পড়েছি৷ ইমাম : এই আয়াতে উল্লেখিত রাসূলের (সা.)পরিবার আমরাই ৷ হে বয়োবৃদ্ধ এই আয়াতটি পড়েছ কি যেখানে বলা হচেছ : ( اتِ ذا القُربَى حَقَّهُ ) (পরিবারবর্গের যে অধিকার আছে তাদেরকে তা দাও) ৷ বয়োবৃদ্ধ : হ্যা পড়েছি৷ ইমাম : আমরাই সেই পরিবার, আল্ল্লাহ্ তা'য়ালা তাঁর নবীকে যাদের অধিকার দিতে বলেছেন৷ তুমি খোমছের আয়াতটি পড়েছ কী? ( وَ اعلَمُوا اَنَّماَ غَنِمتُم مِن شَيىءٍ فاَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِى القُربَى ) (মনে রেখ! যাকিছু উপার্জন করবে তার পাচের এক অংশ আল্লাহ্ ও আল্লাহ্র নবী এবং তাঁর পরিবারের) ৷ বয়োবৃদ্ধ : হ্যা পড়েছি৷ ইমাম : তাত্হীরের এই আয়াতটি পড়েছ কি? ( اِنَّماَ يُريِدُ اللَّهُ لِيُذهِبَ عَنكُم الرِّجسَ اَهلَ البَيتِ وَ يُطَهِّرَكُم تَطهِيراً ) (আল্লাহ্ শুধুমাত্র এটাই চান যে, হে আহ্লে বাইত তোমাদেরকে গোনাহ্ থেকে দুরে রাখতে ও সম্পূর্ণভাবে পাক পবিত্র করতে) ৷ বয়োবৃদ্ধ লোকটি হতভম্ব হয়ে গেল এবং সত্যকে উপলব্ধি করতে পেরে অতীত ব্যবহারের জন্য লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে গেল৷ কিছু সময় চুপ করে থেকে ইমামের কাছে জিজ্ঞাসা করলো যে, 'সত্য সত্যই কি তোমরা তারা'? ইমাম : "আল্লাহ্ এবং আমার পূর্বপুরুষ রাসূলে খোদার (সা.)কসম যে, আমরাই সেই পরিবার"৷ বয়োবৃদ্ধ লোকটি তার হাত দু'টি আকাশের দিকে উচু করে তিনবার বলল : হে আল্লাহ্ তওবা করছি৷ তোমার নবী ও তাঁর পরিবারের সাথে শত্রুতার জন্য তওবা করছি৷ আর তাদের কতল করাতে আমি অসন্তুষ্ট৷ আমি এর আগেও কোরআন পড়েছিলাম কিন্তু এই সত্যকে জানতাম না ৷ বয়োবৃদ্ধের তওবা করার এই ঘটনাটি ইযাযিদের কানে পৌছালে সে এই ব্যক্তিকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়৷ কিন্তু বৃদ্ধ লোকটি সত্যকে জেনে শাহাদত বরণ করলো ৷ ১২- ইমাম সাদিকের (আ.)সাথে মুনাযিরার পরে একজন নাস্তিকের (খোদা অবিশ্বাসী) মুসলমান হওয়া : আব্দুল মালেক নামে এক ব্যক্তি মিশরে জন্মগ্রহণ করেছিল৷ তার ছেলের নাম ছিল আব্দুল্লাহ্৷ (তাই তাকে আবু আব্দুল্লাহ্ অর্থাৎ আব্দুল্লাহ্র পিতাও বলা হতো)৷ আল্লাহ্র উপর তার কোন বিশ্বাস ছিল না এবং সে বলতো এই পৃথিবী নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়েছে৷ সে জানতে পেরেছিল যে, শিয়াদের নেতা হযরত ইমাম সাদিক (আ.)মদীনায় জীবন-যাপন করেন৷ সে মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো এই লক্ষ্যে যে, আল্লাহ্ পরিচিতি ও তাঁর সম্পর্কে ইমামের সাথে মুনাযিরা করবে৷ মদীনায় এসে সে ইমামের খোজ করলো৷ কেউ তাকে বলল : 'তিনি হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গিয়েছেন'৷ সে এই কথা শুনে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হল৷ মক্কায় পৌছে কা'বার অতি নিকটে ইমামকে তাওয়াফ করতে দেখলো৷ সে তাওয়াফকারীদের সারীর মধ্যে প্রবেশ করলো৷ তাওয়াফ করতে করতে সে ইমামকে (অবমাননা সূলভ আচরণ করে) ইচছাকৃতভাবে ধাক্কা দেয়৷ ইমাম অত্যন্ত শান্তভাবে তাকে বললেন : তোমার নাম কি? সে : আব্দুল মালেক (সুলতানের বান্দা)৷ ইমাম : ডাক নাম কি? সে : আবু আব্দুল্লাহ্ (খোদার বান্দার পিতা)৷ ইমাম : " তুমি যে মালিকের (বাদশাহ্) বান্দা (যা তোমার নাম থেকে বুঝা যাচেছ) সে কি যমিনে বাদশাহ্ না আসমানের? আর তোমার (ডাক নাম অনুসারে) ছেলে তো খোদার বান্দা, তাহলে বল দেখি সে কি আসমানী খোদার বান্দা না যমিনের? যে উত্তরই তুমি দিবে তাতেই তুমি পরাজিত হবে"৷ আব্দুল মালেক কিছু বলল না৷ হিশাম ইবনে হাকাম ইমামের এক বিজ্ঞ ছাত্র সেখানে উপস্থিত ছিল, সে আব্দুল মালেককে বলল : 'ইমামের কথার উত্তর দিচছ না কেন'? আব্দুল মালেক হিশামের কথায় চৈতন্য ফিরে পেল৷ তার চেহারার রং পাল্টে গিয়েছিল৷ ইমাম অত্যন্ত নরমভাবে তাকে বললেন : অপেক্ষা কর আমার তাওয়াফ শেষ হোক৷ তাওয়াফ শেষে আমার কাছে আসবে আমরা দু'জন আলোচনা করবো৷ যখন ইমাম তওয়াফ শেষ করলেন, সে ইমামের কাছে আসলো এবং তাঁর সম্মুখে বসলো৷ ইমামের একদল ছাত্রও সেখানে উপস্থিত হলো৷ তারপর ইমাম ও তার মধ্যে আলোচনা শুরু হল এরূপে : ইমাম : তুমি কি বিশ্বাস কর যে, এই পৃথিবীর, এই যমিনের উপর-নিচে, বাহ্যিকতা ও আভ্যন্তরিণতা আছে? সে : হ্যাঁ৷ ইমাম : তুমি কি কখনো যমিনের নিচে গিয়েছো? সে : না৷ ইমাম : তাহলে কিভাবে যমিনের নিচের খবর সম্পর্কে জান? সে : যমিনের নিচের বিষয়ে কোন খবর জানি না৷ তবে মনে করছি সেখানে কোন কিছুই নেই৷ ইমাম : সন্দেহ ও ধারনা হচেছ একধনের বিপথগামীতা৷ যখন তুমি কোন কিছুর উপর ইয়াকিন (বিশ্বাস) স্থাপন করতে পার না তখন সন্দেহ বা ধারনার বশবর্তী হয়ে কিছু বলবে না৷ এরপর ইমাম বললেন : তুমি কি আসমানের উপরে গিয়েছো? সে : না৷ ইমাম : তুমি কি আসমানের বিষয়ে কিছু জান বা জান কি সেখানে কি আছে? সে : না৷ ইমাম : বিষ্ময় সূচক শব্দ ব্যবহার করে বললেন, তুমি না পশ্চিমে গিয়েছো না পূর্বে, আর না যমিনের নিচে গিয়েছো না আসমানের উপরে, আর না আসমান ভেদ করেছো যে জানবে সেখানে কি আছে৷ এতসব বিষয়ে অজ্ঞ থাকা সত্বেও তুমি খোদার প্রতি অবিশ্বাসী (তুমি তো উপর ও নিচের অস্তিত্ব সম্পর্কে এবং তাদের পরিচালনকারী যে খোদা সে সম্পর্কেও অজ্ঞ, তাহলে কিভাবে তাঁর অবিশ্বাসী হলে?) বিবেকবান কোন ব্যক্তি যে বিষয়ে জ্ঞাত নয় সে বিষয়কে কি অস্বীকার করে?" সে : এ পর্যন্ত আমার সাথে কেউ এরূপে কথা বলে নি এবং কেউ আমাকে এরূপে চিন্তা করার পরিস্থিতিও সৃষ্টি করে নি৷ ইমাম : সুতরাং তোমার এ সকল বিষয়ের প্রতি সন্দেহ রয়েছে যে, এমন কিছু আসমানের উপরে এবং যমিনের নিচে আছে না নেই? সে : হ্যাঁ, হয়তো এমনই৷ (এরূপে সে অবিশ্বাসের পর্যায় থেকে সন্দেহের পর্যায় নেমে আসে)৷ ইমাম : যে ব্যক্তি কিছুই জানে না সে একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির উপর কোন দলিল ও যুক্তি আনতে পারে না৷ হে মিশরী ভাই! আমার কাছ থেকে শুনে শিক্ষা অর্জন কর৷ আমরা কখনই আল্লাহ্ অস্তিত্বের ব্যাপারে কোনরূপ সন্দেহ করি না৷ তুমি কি সূর্য, চন্দ্র, রাত ও দিনকে দেখ না যে, সূর্য উদয় হয় এবং বাধ্য হয়ে নির্দিষ্ট পথে ঘুরতে থাকে বা পুনরায় ফিরে আসে৷ আর তারা তাদের চলার পথে বাধ্য৷ এখন তোমার কাছে জিজ্ঞাসা করছি : যদি সূর্য ও চন্দ্রের চলে যাওয়ার শক্তি থাকতো (ইচছাকৃতভাবে), তাহলে কেন ফিরে আসে? আর যদি নিজেদের চলার পথে বাধ্য না থাকে তবে কেন রাত দিন হয়ে যায় না এবং দিনই বা কেন রাত হয়ে যায় না? ভাই আমার! আল্লাহ্র কসম, তারা তাদের চলার পথে বাধ্য৷ আর যিনি তাদেরকে তাদের চলার পথে বাধ্য করেছেন তিনি তাদের নির্দেশক ও পরিচালনকারী৷ সে : সত্য বলছেন৷ ইমাম : বল দেখি, যার উপর তুমি বিশ্বাসী বা যার (দাহ্র অর্থাৎ যমনা বা কালের) উপর ধারনা করছো যে, সে এই কিছুর পরিচালক এবং মানুষকে নিয়ে যায়; তাহলে কেন সে তাদেরকে ফিরিয়ে দেয় না আর যদি ফিরিয়ে দেয় তাহলে কেন নিয়ে যায় না? হে মিশরের অধিবাসী! সব কিছুই তাদের নিজ নিজ কাজে বাধ্য এবং তা থেকে পালিয়ে যেতে পারে না৷ কেন আসমান ঐ উপরে এবং কেন যমিন এই নিচে অবস্থিত? কেন আসমান যমিনের উপর ভেঙ্গে পড়ছে না? আর কেনই বা এই পৃথিবীর সব কিছুই এলো-মেলো হয়ে যাচেছ না?! (যখন ইমামের উপযুক্ত দলিল ভিত্তিক আলোচনা এ পর্যায়ে পৌছালো, আব্দুল মালেক তখন নিজেকে সন্দেহের অবস্থান থেকে সরিয়ে ঈমানের পর্যায় অবস্থান করলো)৷ ইমামের উপস্থিতিতে ঈমান আনলো এবং এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্র প্রতি সাক্ষ্য দিলো৷ সাথে সাথে স্পষ্ট করে বলল : 'তিনিই হচেছন খোদা বা পারওয়ারদিগার যিনি আসমান ও যমিনের সব কিছুরই নির্দেশক এবং তাদেরকে টিকিয়ে রেখেছেন'৷ 'হুমরান' নামে ইমামের অন্য আরেক ছাত্র সেখানে উপস্থিত ছিল, সে ইমামের দিকে ফিরে বলল : "আপনার তরে আমার জীবন উৎসর্গীত, আজ যেমনভাবে এই খোদা অবিশ্বাসী লোকটি আপনার হাতে ঈমান আনলো বা মুসলমান হল, সেদিন অনুরূপভাবেই কাফেররাও আপনার পিতা রাসূলে খোদার (সা.)হাতে ঈমান এনেছিল"৷ নব মুসলমান আব্দুল মালেক ইমামের কাছে নিবেদন জানালো যে, "আপনি আমাকে আপনার ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করুন"! ইমাম সাদিক (আ.)হিশাম ইবনে হাকামকে বললেন : "আব্দুল মালেককে তোমার নিজের কাছে নিয়ে যাও এবং ইসলামী আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে তাকে শিক্ষা দাও"৷ হিশাম, সে ছিল একজন প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি আগে থেকেই শাম ও মিশরের লোকদেরকে ইসলামী শিক্ষা দান করতো, আব্দুল মালেককেও তার পাঠশালায় নিয়ে গেল৷ উসূল, আক্বায়েদ (আক্বীদাগত বিষয়) এবং ইসলামী আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে তাকে শিক্ষা দান করলো যাতে করে সে পরিশুদ্ধ আক্বীদা ভিত্তিক হতে পারে৷ আর হিশাম তাকে এমনভাবে শিক্ষা দান করলো যে, ইমাম তাতে যথেষ্ট সন্তুষ্ট হলেন ৷ ১৩- উপায়হীন ইবনে আবিল আ'উযা : আব্দুল কারিম, সে 'ইবনে আবিল আ'উযা' নামে প্রসিদ্ধ ছিল৷ একদিন ইমাম সাদিকের (আ.)সাথে মুনাযিরা করার জন্য তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে দেখলো একদল লোক সেখানে উপস্থিত৷ তাই ইমামের নিকটবর্তী স্থানে চুপ করে বসে থাকলো৷ ইমাম : "তোমার এখানে আসার কারণ হচেছ যে, যে বিষয়সমূহ তোমার ও আমার মধ্যে আলোচিত হচিছল তা অব্যাহত দেয়া এমনটাই নয় কি? সে : হ্যাঁ, আমি এই উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছি হে নবীর (সা.)সন্তান! ইমাম : তোমার কথায় আমি আশ্চার্য হই একারণে যে, তুমি আল্লাহ্কে বিশ্বাস কর না কিন্তু আবার সাক্ষ্য দিচছ যে আমি রাসূলের (সা.)পুত্র এবং বলছো হে নবীর (সা.)সন্তান! সে : অভ্যাস আমাকে এমনভাবে বলতে শিখিয়েছে৷ ইমাম : তাহলে কেন চুপ করে বসে আছ? সে : আপনার শান ও মর্যাদা আমাকে আপনার সম্মুখে কথা বলতে বাধা দেয়৷ কেননা আমি তো ঐ পর্যায়ের নই৷ আমি অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিকে দেখেছি এবং তাদের সাথে কথাও বলেছি কিন্তু যে শান ও মর্যাদা আপনার ভিতর পরিলক্ষিত হয় তা অন্য কারো মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না৷ ইমাম : যেহেতু তুমি কিছু বলছো না, তাই আমিই শুরু করলাম৷ তিনি তাকে বললেন : "তুমি কি তৈরীকৃত না তৈরীকৃত নও?" সে : না, আমি তৈরীকৃত নই৷ ইমাম : বল দেখি, যদি তৈরীকৃত হতে তাহলে কেমন হতে? সে বেশ কিছু সময় চুপ করে থাকলো এবং তার পাশে কাঠের যে অংশটি পড়ে ছিল তা হাতে নিয়ে কয়েকবার নাড়া-চাড়া দিয়ে তৈরীকৃত বস্তুর বিশেষণসমূহকে বর্ণনা করলো : লম্বা, চওড়া, গভীর, খাট, নড়া-চড়া করে, নড়া-চড়াহীন ও ........... এগুলো সবই হচেছ তৈরীকৃত বস্তুর বিশেষত্ব৷ ইমাম : যেহেতু এগুলো ব্যতীত তৈরীকৃত বস্তুর অন্য কোন বিশেষণ সম্পর্কে অবগত নও সেহেতু জেনে রাখ যে, তুমি নিজেও তৈরীকৃত এবং নিজেকে অবশ্যই তৈরীকৃত ভাববে৷ কেননা এ সকল বিশেষণ তোমার মধ্যে প্রতিনিয়ত নতুনরূপে দেখতে পাবে৷ সে : আপনি আমার কাছে এমন একটি প্রশ্ন করেছেন যা আগে কেউ করেনি এবং ভবিষ্যতেও কেউ করবে না৷ ইমাম : ধরে নিচিছ যে, আগে তোমার কাছে এমন প্রশ্ন কেউ করেনি কিন্তু কিভাবে জানলে যে ভবিষ্যতেও কেউ এ ধরনের প্রশ্ন তোমার কাছে করবে না? আর এ কথা বলাতে তুমি ত্রুটি করছো৷ কেননা তুমি বিশ্বাস কর যে, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমস্ত কিছুই সমান৷ তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে কিভাবে কোন কিছুকে প্রথম এবং কোন কিছুকে শেষ মনে করছো আর কথা বলার সময় অতীত ও ভবিষ্যৎ শব্দ ব্যবহার করছো কিভাবে? হে আব্দুল কারিম! আরো ব্যাখ্যা দিলে বলবো, তোমার যদি একটি হামীয়া'ন (লম্বা ফিতাযুক্ত টাকার থলি যা কোমরে বাঁধা হয়) পূর্ণ স্বর্ণ মুদ্রায় ভর্তি থাকে আর কেউ যদি বলে যে, ঐ হামীয়া'নের মধ্যে কি স্বর্ণ মুদ্রা রয়েছে? সেক্ষেত্রে তুমি কি বলবে যে, না এর মধ্যে কিছুই নেই৷ সে যদি তোমাকে স্বর্ণ মুদ্রা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে বলে, আর তোমার যদি স্বর্ণ মুদ্রার ব্যাখ্যা জানা না থাকে তবে এই ব্যাখ্যা জানা না থাকার করণে কি তুমি বলতে পার যে, এর মধ্যে কিছুই নেই? সে : না, ব্যাখ্যা জানা না থাকার করণে বলতে পারবো না যে এর মধ্যে কিছুই নেই৷ ইমাম : পৃথিবীর ব্যাপকতা একটি হামীয়া'নের থেকে অনেক অনেক গুনে বেশী৷ এই যে, তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি এই পৃথিবীতে আশ্রয় নিয়েছো তৈরীকৃত বস্তু হিসেবে৷ কারণ তুমি তৈরীকৃত বস্তু এবং অতৈরীকৃত বস্তুর মধ্যের বিশেষণ সম্পর্কে অবগত নও৷ যখন আলোচনা এ পর্যায়ে পৌছাল তখন সে দারুণভাবে উপায়হীন হয়ে পড়লো এবং চুপ হয়ে গেল৷ তার পাশে বসে থাকা অনেকেই এই আলোচনার পরে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল এবং অনেকেই পূর্বের অবস্থায় অর্থাৎ কাফের অবস্থায় রয়ে গেল ৷ ১৪- তৃতীয় দিনের মুনাযিরা : উল্লেখিত আলোচনার তৃতীয় দিনে ইবনে আবিল আ'উযা সিদ্ধান্ত নিল যে, ইমাম সাদিকের (আ.)সাথে নিজেই মুনাযিরা শুরু করবে এবং তা অব্যাহত দিবে৷ সে ইমামের কাছে উপস্থিত হয়ে বলল : 'আজ আমি আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই'৷ ইমাম : "যা কিছু জানতে চাও জিজ্ঞাসা কর"৷ সে : কোন দলিলের ভিত্তিতে এই পৃথিবী নতুন, অর্থাৎ আগে এর অস্তিত্ব ছিল না কিন্তু পরবর্তীতে কিভাবে অস্তিত্বে আসলো? ইমাম : যে কোন ছোট এবং বড় জিনিষকে কল্পনা কর, যদি তার সাথে অনুরূপ কোন জিনিষ একত্র কর তাহলে তা পূর্বের তুলনায় বৃহত হয়ে যাবে৷ আর এটাই হচেছ কোন জিনিষের প্রথম অবস্থা (ছোট অবস্থা) থেকে দ্বিতীয় অবস্থায় (বৃহত অবস্থায়) পরিবর্তন হওয়া এবং নতুন হওয়ার অর্থও হচেছ এটাই৷ যদি ঐ জিনিষ কাদিম (পুরাতন বা অন্তিম বা আদিকাল থেকে) হয় (অর্থাৎ প্রথম থেকেই ছিল এমন) তাহলে অন্য রূপ পরিগ্রহ করবে না৷ কেননা যে সকল জিনিষ নিঃশেষ হয়ে যায় অথবা রূপ পবির্তন করে তারা পুনরায় অস্তিত্ব পাওয়ার যোগ্যতা রাখে এবং সাথে সাথে ধবংস হওয়ারও৷ সুতরাং ধবংস অথবা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় তা হাদিস (নতুন) হতে শুরু করে৷ যদি তা শুধুমাত্র কাদিম (পুরাতন বা অন্তিম বা আদিকাল থেকে) হত তাহলে তা বড় হওয়ার জন্য পবিবর্তন হত বা নতুন হত (এটাই হচেছ কোন জিনিষের পুরাতন হওয়ার ব্যাখ্যা)৷ আর একটি জিনিষ কখনই একই সঙ্গে নতুন ও পুরাতন এবং চিরন্তণ ও অস্তিত্বহীন হতে পারে না৷ সে : যদি ধরেও নেই যে, অতীতে ও ভবিষ্যতে ছোট ও বড় হওয়াটা এরূপই যা আপনি বয়ান করেছেন (এ পৃথিবীর নতুন হওয়াটা)৷ কিন্তু যদি সমস্ত কিছুই ছোট অবস্থায় থেকে যায় তাহলে এ ক্ষেত্রে সেগুলো নতুন হওয়ার ব্যাপারে আপনার দলিল কি? ইমাম : আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু এই পৃথিবীতেই রয়েছে (যা প্রতিনিয়ত রূপ পবিবর্তন করছে)৷ এখন যদি এই পৃথিবীর স্থানে অন্য এক পৃথিবীর কথা চিন্তা করি এবং আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে স্থির করি, তাহলে সেক্ষেত্রেও একটি পৃথিবী ধবংস হয়ে এক নতুন পৃথিবী তার স্থলাভিষিক্ত হবে৷ আর এটাই হচেছ নতুন হওয়ার অর্থ৷ আর যখন তুমি এরূপ মনে করছো যে (প্রতিটি জিনিষ যদি ছোট অবস্থায় থেকে যায়) তার উত্তর হচেছ এরূপ : যদি ধরেও নেই যে, প্রতিটি ছোট জিনিষ তার নিজের স্থানে ছোট থেকেই যাচেছ; তবে তো এই ধরে নেয়া ও মনে করার জগতে এটাই সঠিক যে, প্রতিটি ছোট জিনিষের সাথে অনুরুপ কোন ছোট জিনিষকে একত্রিত করা সম্ভব৷ আর এই দুটি ছোট জিনিষকে একত্রিত করার ফলে তা বড় রূপ ধারন করবে৷ আর এই যে তা বড় রূপ ধারন করেছে এরূপ কল্পনা করাও সঠিক৷ আর এই যে তা বড় রূপ ধারন করেছে এরূপ কল্পনা করাটাই হচেছ এক রূপের পরিবর্তীত রূপ যা নতুন হওয়ার বিষয়টিকে প্রমাণ করে৷ হে আব্দুল কারিম! এই যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে তোমার আর কোন যুক্তি থাকার কথা নয় ৷ ১৫- ইবনে আবিল আ'উযার হটাৎ মৃত্যু : ইমাম সাদিকের (আ.)সাথে উল্লেখিত মুনাযিরার এক বছর অতিবহিত হওয়ার পরের বছরে সে পুনরায় কা'বার পাশে ইমামের নিকটবর্তী হলে ইমামের একজন ভক্ত তাঁকে বলল : 'হে ইমাম! ইবনে আবিল আ'উযা কি মুসলমান হয়েছে'? ইমাম : তার অন্তর ইসলামের ব্যাপারে অন্ধ৷ সে মুসলমান হবে না৷ ইমামের নূরানী চেহারা তার দৃষ্টিগোচর হতেই সে বলল : 'এই যে আপনি, আমার মাওলা!' ইমাম : কেন এখানে এসেছো? সে : দেশের রছম-রেওয়াজ ও আইন-কানুন এবং নিজের ইচছায় যাতে করে মানুষের পাগলামো, ন্যাড়া হওয়া ও পাথর ছোড়াকে (যা হাজ্জ মৌসুমে পালন করে থাকে) দেখবো৷ ইমাম : তুমি এখনো সেই ভুল পথেই বিদ্যমান রয়েছো? সে কথা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে ইমাম তাকে বললেন : হজ্জ মৌসুমে মুনাযিরা এবং উগ্রো হওয়াটা জায়েয নয়৷ ইমাম তাঁর গায়ের আ'বাটি ঝেড়ে বললেন : যদি সত্য এটাই হয়ে থাকে যার উপর আমরা বিশ্বাসী -যদিও এটা ছাড়া কোন সত্যই নেই এবং একমাত্র সত্য এটাই-সেক্ষেত্রে আমরাই হচিছ পুরস্কৃত না তুমি৷ আর যদি সত্য তোমার পক্ষে থাকে -যদিও এমনটি নয় বা তোমার সাথে নেই- তবুও আমরা এবং তুমি উভয়ই পুরস্কৃত হব৷ সুতরাং যে কোন দিক দিয়েই আমরা পুরস্কৃত৷ কিন্তু তুমি এ দুটি পথের মধ্যে একটিতে৷ আর যদি তা সত্য না হয় তবে ধবংস প্রাপ্ত হবে৷ এ পর্যায়ে তার অন্তর নাজুক অবস্থায় পতীত হলে আশে পাশের সকলের দিকে ফিরে বলল : আমার অন্তর ব্যাথা করছে, আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও৷ যখন তাকে ফিরিয়ে আনা হলো তখন দেখা গেল যে, সে মৃত্যুবরণ করেছে, আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করুন ৷ ১৬- হিশামের সাথে মুনাযিরার ফলশ্রুতিতে আব্দুল্লাহ্ দাইছানির ইসলাম ধর্ম গ্রহণ : হিশাম, ইমাম সাদিকের (আ.)একনিষ্ট ও অভিজ্ঞ ছাত্র ছিল৷ একদিন আব্দুল্লাহ্ দাইছানির সাথে -যে ছিল খোদা অবিশ্বাসী- হিশামের দেখা হলে সে তাকে জিজ্ঞাসা করলো : তোমার কি খোদা আছে? হিশাম : হ্যাঁ৷ সে : তোমার খোদা কি শক্তিমান? হিশাম : হ্যাঁ, তিনি শাক্তিমান এবং সকল কিছুর উপর কর্তৃত্ব রাখেন৷ সে : এ বিশাল পৃথিবীকে একটি মুরগীর ডিমের মধ্যে আনার ক্ষমতা কি তোমার খোদার আছে তবে পৃথিবীও ছোট হবে না আর মুরগীর ডিম বড় হবে না? হিশাম : এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য আমাকে সময় দাও৷ সে : এক বছর সময় তোমাকে দিলাম৷ হিশাম ইমাম সাদিকের (আ.)কাছে উপস্থিত হয়ে বলল : 'হে রাসূলে খোদার (সা.)সন্তান! আব্দুল্লাহ্ দাইছানি আমার কাছে এসে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছে যার উত্তর দেয়ার জন্য আল্লাহ্ ও আপনি ব্যতীত অন্য কেউ আমার অবলম্বন নেই'৷ ইমাম : সে কি প্রশ্ন করেছে? হিশাম : সে বলেছে, এ বিশাল পৃথিবীকে একটি মুরগীর ডিমের মধ্যে আনার ক্ষমতা কি তোমার খোদার আছে তবে পৃথিবীও ছোট হবে না আর মুরগীর ডিম বড় হবে না? ইমাম : হে হিশাম! তুমি কয়টি ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট? হিশাম : আমি পঞ্চ ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট (দৃষ্টিগত, কর্ণগত, জিহবাগত, স্পর্শগত ও নাসিকাগত)৷ ইমাম : কোনটি এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ছোট? হিশাম : দৃষ্টিগত৷ ইমাম : চোখের মনির পরিমাপ কতটুকু? হিশাম : একটি মুগ ডালের পরিমানে৷ ইমাম : হে হিশাম! তোমার মাথার উপরে ও সামনে লক্ষ্য কর এবং আমাকে বল কি দেখতে পাচছ? হিশাম এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল : 'আসমান, যমিন, বাড়ী, প্রাসাদ, মরুভুমি, পাহাড় ও নদী দেখতে পাচিছ৷ ইমাম : যে ক্ষমতাবান আল্লাহ্ ঐ সমস্ত কিছুকে তাদের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক হওয়া সত্বেও তোমার মুগ ডালের পরিমানে এক চোখের মনির মধ্যে স্থান দিয়েছেন, সে আল্লাহ্ অবশ্যই এই পৃথিবীকে একটি মুরগীর ডিমের মধ্যে স্

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.