আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কী উদ্দেশ্যে কাদের বিরুদ্ধে লালগড়ে এই যৌথ সামরিক অভিযান ?

“বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়। বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে। বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো। অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায় অনায়াসে সম্মতি দিও না। কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়, তারা আর কিছুই করে না, তারা আত্মবিনাশের পথ পরিস্কার

১৮ জুন থেকে টানা সামরিক অভিযান চালিয়েও লালগড় এলাকায় একজন মাওবাদীরও সন্ধান পায় নি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের যৌথ বাহিনী ।

অথচ এই প্রায় অস্তিত্বহীন মাওবাদীদের ধরার নামেই এলাকার নিরীহ গ্রামবাসীদের লাঠিপেটা , নির্যাতন ও গ্রেফতার চলছে । পশ্চিম বংগের পত্রিকার খবর, এবং আমাদের দেশের পত্রিকাতেও এসেছে - আতংকে গ্রামের পর গ্রাম জনশুন্য হচ্ছে । এভাবেই গত এক পক্ষকাল ধরে 'মাওবাদী সন্ত্রাস' দমনের নামে এলাকায় 'শান্তি প্রতিষ্ঠার' অভিযান চলছে। সামরিক অভিযানের শুরুতে পত্রিকায় খবর দেখে মনে হল যেন পশ্চিম মেদিনীপুরের সমগ্র জংগলমহল এলাকা মাওবাদীদের দখলে চলে গেছে। অথচ সমগ্র অভিযানে এখন পর্যন্ত একজন মাওবাদীও মারা গেল না , কোনো মাওবাদী গ্রেফতার হল না , পুলিশ মিলিটারির গায়েও কোনো আঁচড় লাগলো না ।

কিছু মাওবাদী যারা ঝাড়খন্ড থেকে এসেছিল , যাদের ধরার জন্যই এই অভিযান , তারা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে । গুলি বিনিময়ের উত্তেজক খবর পত্রকায় প্রকাশিত হলেও গুলি কোথা থেকে আসছে , কারা গুলি ছুড়ছে , মাওবাদীদের হাতে যদি এ কে ৪৭ এর মত ভয়ানক অস্ত্র থেকেই থাকে তবে তার গুলিতে একজনও আহত হল না ক্যানো , এ সবের কোনো হদিশ এখন পর্যন্ত পেলাম না । যেসব সাংবাদিক অনেক কষ্ট স্বীকার করেও বনজংগলের মধ্যে যৌথবাহিনীর এই অভিযানের সংগী হয়েছিলেন , তারাই লিখছেন ,"... যুদ্ধের কিছুই দেখা হল না । সবই যেন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা । " ভারতবর্ষের ভূমিপুত্র বলে কেউ দাবি করলে এই আদিবাসীরাই করতে পারে ।

কিন্তু সেই সুদূর আর্যদের থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পরবর্তী আধুনিক ভারতীয় সমাজ - সমস্ত জায়গাতেই তারা বঞ্চিত । ২০০১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী আদিবাসীদের সংখ্যা ভারতের মোট জনগোষ্টীর ৮.২% । কিন্তু সংখ্যানুপাতিক বিচারে শিক্ষা , সরকারী চাকরি অর্থনৈতিক অবস্থার দিক থেকে তাদের চিত্র পুরোটাই তমসাবৃত । সিপিএম সরকারের তিন দশকেও এদের প্রতি দরদের অনেক কথা উচ্চারিট হলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয় নি । সরকারি তরফে যতটুকু টাকা এদের উন্নয়নের নামে বরাদ্দ হয়েছে , স্থরে স্থরে তা লোপাট হয়েছে , তাদের কাছ অব্দি পৌছেনি ।

পাশাপাশি সিপিএম নেতাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে । আদিবাসীদের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের মর্মান্তিক দুঃখের সংবাদ বাইরের পৃথিবীতে খুব একটা আসে না । এসব নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠলেই সরকার মাওবাদী নাম দিয়ে সর্বশক্তিতে তা দমন করেছে । তারপর গত ২ নভেম্বর শালবনিতে জিন্দালদের কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে মূখ্যমন্ত্রী ফেরার পথে ল্যান্ডমাইন বিষ্ফোরন ঘটলে যেন আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল । মাওবাদী নাম দিয়ে আবারও এদেরই উপর শুরু হলো অত্যাচার ।

আন্দোলন আবারও গড়ে উঠলো পুলিশী অত্যাচারের বিরুদ্ধে । আন্দোলনের এক পর্যায়ে 'পুলিশী সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারনের কমিটি' জনগনই গড়ে তুললো, কোনো রাজনৈতিক দল নয় । কমিটি পুলিশী আক্রমনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর পাশাপাশি ঘোষনা করে, অবিলম্বে সরকারকে তাদের বাঁচার দাবিগুলো মেটাতে হবে , বিনা বিচারে আটক ও মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা সকলকে মুক্তি দিতে হবে , এবং মহিলাদের স্লীলতাহানির জন্য, নিরীহ মানুষের উপর অকথ্য নির্যাতনের জন্য পুলিশকে ক্ষমা চাইতে হবে । আন্দোলনের সমগ্র পর্যায়ে জনগনের কমিটিই আন্দোলন পরিচালনা করেছে , এই আন্দোলনের নেতা ছত্রধর মাহাতোও বলেছেন , মাওবাদীরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের সমর্থন দিয়েছে , কিন্তু এখন ছত্রধর মাহাতোকেই মাওবাদী আখ্যা দিয়ে জনগনের আন্দোলন নয় , মাওবাদীদের আন্দোলন এটা - এভাবে দেখানো হচ্ছে । মাওবাদীরা এভাবে জনগনের কমিটি করে প্রকাশ্যে হাজার হাজার জনতাকে সাথে নিয়ে গণতান্ত্রিক দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালনা করেছে - এমন খবর কখনো দেখি নি ।

তারা বিচ্ছেন্ন ভাবে ব্যক্তি হত্যা ও বিষ্ফোরন ঘটায়, যার সাথে চীনা কমুউনিস্ট নেতা মাও সে তুং এর চিন্তাধারার কোনো সম্পর্কই নেই। বাস্তবে বিপথগামী হয়ে নিজেদের অজ্ঞাতসারেই তারা গণ আন্দোলন বিনষ্ট করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন । কথা হলো , সরকার ছত্রধর মাহাতোর সাথে আলোচনা করতে করতেই হঠাৎ করে 'মাওবাদী সন্ত্রাস' ও 'লালগড় আক্রান্ত' বলে প্রচার করা শুরু করলো ক্যানো ? কারন তাদের মাথায় চিন্তা এলো যে , লালগড় আন্দোলনের দাবি মেনে যদি মীমাংসা করা হয় , তাহলে আন্দোলনের এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে আদিবাসী ও ভূমিহীন মানুষ জন আরো বড় আন্দোলনের পথে যাবে । পাশাপাশি এ অঞ্চলে যে ব্যাপক খনিজ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আছে , তাকে রক্ষার নামেও যাতে কোনো আন্দোলন গড়ে না ওঠে । কাজেই মাওবাদী তকমা লাগিয়ে বাসর রাতেই বিড়ালটা মেরে দাও ।

নন্দীগ্রামে সিপিএমের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন তাকেও সরকার শুরুতে মাওবাদী আখ্যা দিয়েছিল , ধোপে টেকে নি সে অজুহাত । নন্দীগ্রাম ঘটনায় সিপিএম নেতাদের যে সন্ত্রাসের খবর পত্রিকার পাতার খোরাক হয়েছিল , লালগড়ে ' মাওবাদীদের সন্ত্রাস ' দিয়ে সেটাকে ঢাকা ও হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধারের চেষ্টাও একটা কারন । আবার দীর্ঘদিন ধরে সিপিএম ও কংগ্রেসের মধ্যে যে গভীর বন্ধুত্ব চলছিল , লোকসভা নির্বাচলের প্রাক্কালে ও অব্যবহিত পরে সেটা কিছুটা চিড় খেলেও পুনরায় তাকে মেরামত করার চেষ্টা শুরু হয়েছে এই যৌথ অভিযানের মাধ্যমে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.