আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ খোলা নৌকায় বসবাস

কত কিছু যে করতে চাই, তবুও কিছু করতে না পারার দায়ে মাথা খুঁটে মরি ।
কে যেন বলেছিল, ঢাকা শহরে নাকি পাখি নাই। আজব। কাক কী পাখি না? ভোরের দিকে লক্ষ লক্ষ কাক আমার বারান্দার সামনে হাউমাউ মানে কা কা করে সেটা কী ওই ব্যাটার চোখে পড়ে না? সারাদিন মাথার উপর কা কা। আবদুল্লাহপুর বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি।

সময় এক ঘণ্টা এগিয়ে দেয়ায় প্রায়ই বিকাল মনে করে দুপুরে সবখানে হাজির হচ্ছি। এইদিকে পরিবেশটা সুন্দর খুব। বাসে আসার সময় দেখেছি, রাস্তার চারপাশে বেশ সবুজ। ভীড় কম, আর গাছ বেশি। রাস্তাগুলো খুব উঁচু করে বানানো।

ঢালু মাটিতে সবুজ ঘাস। আর, বাতাসটা ঠাণ্ডা। এখন আমার যাত্রা হল গরু মহিষের হাঁটের দিকে। হাঁটা শুরু করলাম। ত, সমস্যা ওই একটাই।

মাথার উপর বিদ্যুতের খুঁটিতে বসা কাকের দল। কাক দেখে সকালের কথা মনে পড়ল। এই কাকের জ্বালায় ভোরের জীবনও অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। “গুড মর্নিং ঢাকা, হেল্লো এভরিবডি, আশা করি প্রত্যেকে খুবই ফাইন আছেন। এই সকালে এক কাপ চা খেলে কেমন হয়? আসুন এখন হয়ে যাক, এক কাপ ক্লিপটন চা।

”, এফ এম এর চিৎকার। ধূর, রাতে এফএম বন্ধ না করেই শুনতে শুনতে বোধহয় ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। মোবাইলের ব্যাটারীর দফারফা এভাবেই হয়। চার্জ ঠেকে এসেছে তলানীতে। এখন আবার সাতসকালে চার্জ দেবে কে? আরে, এই সকালে আবার কল দিল কে ! “হ্যালো, এই ঘুম থেকে উঠছ ?”, মোবাইলের ভিতর থেকে পরিচিত একটা কণ্ঠ ভেসে আসল।

“আরে স্নিগ্ধা? হ্যাঁ উঠছি। তুমি এত সকালে কী মনে করে?” মনে মনে খুশি হয়ে উঠি। “তোমরা দুজনে ত আর ঘুমাতেই দিলা না। দুইদিন পরপর হয় কী?” কপট রাগে স্নিগ্ধা তেড়ে উঠে। “রাতে আমি ত আমার বিছানাতেই ছিলাম।

তোমাকে জাগিয়ে রাখলাম কীভাবে? হা হা হা”, মেয়েটাকে ঠাণ্ডা করার কিঞ্চিত প্রয়াস। ও হেসে ফেলে বলল, “এই ফাজিল অসভ্যতা করবানা। দুইদিন পরপর তোমরা ঝগড়া কর কেন? তুমি নাকি আবার আমার বান্ধবীর সাথে ঝগড়া করছ?” উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ, তোমার বান্ধবীর সাথে আমিই ঝগড়া করি। আর, তোমার বান্ধবী ত চুপ করে থাকে। তাই না?”“যেটাই করুক, কালকে সারাদিন নাকি মিথিলার কল ধরনি? বেচারী ত সারা রাত ঘুমাতে পারেনি।

আর, আমাকে সাত সকালে জাগানো হল তোমাকে উঠানোর জন্য। তুমি হয়ত ওর কল রিসিভ করবা না, তাই আমাকে কল দিতে হল। ” স্নিগ্ধার কথা শুনে মনে হল, “তার মানে, মিথিলা আরও আগে উঠছে । হমমম, নাহ, মেয়েটা ভালই। ” “ঝগড়ার সময় ত এগুলা বুঝ না।

এই শোন, এখনই মিথিলার সাথে কথা বলে মিটমাট কর”,স্নিগ্ধার কল দেয়ার আসল কারণ পরিষ্কার করল। “কল দিতে পারব না। আজাইরা খাতিরের ইচ্ছা নেই। তোমার বান্ধবীই আগে কল দিক। ” আমার কথা শুনে ও দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “ধূর, তোমাদের ব্যাপার তোমাদের।

শোন, ও পারলে তাই দিত। সকালে ওর মোবাইলে সমস্যা হয়েছে। আমাকে ওর আম্মুরটা দিয়ে কল দিছিল। তোমাকে এই সকালে কল দেয়ার কারণ হল, আমি আর মিথিলা দুজনে আমার চাচার বাসায় যাব, ওখান থেকে বের হওয়ার সময় তুমি ওই দিকে আসবা। আমি চলে আসব, আর তোমরা দুজন থাকবা।

” অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি বললাম,“আরে না না। তুমি আসবা কেন? তোমাকে না দেখে আমার ভাল লাগে নাকি?” স্নিগ্ধা কপট রাগ করে বলল, “হইছে, হইছে, চাপাবাজী অফ দেন। আমি থাকলে পরে তুমিই বেশি কথা শুনাবা। ” জিজ্ঞাসা করলাম “কোথায় আসব?” স্নিগ্ধার কথায় জানলাম, “আবদুল্লাহপুর। ওখানে বিশাল গরু মহিষের হাঁটটা চেন? ওখান থেকে একটু এগুলেই সামনে পড়বে কার্ভ পয়েন্ট।

সেখানে আমি আসবে। “ ওই দিকে কখনও যাওয়া হয়নি। তবে, রাস্তায় ঐ দিকে যাওয়ার বাস দেখেছি শুধু। তাই বললাম, “চিনি না। জীবনে যাই নাই।

যাবও না। ”“তুমি একটা ছেলে নাকি গাধা? গরুমহিষের হাঁটের সামনে দাঁড়াবা তাহলে, আমরা এসে নিয়ে যাব। ” মেয়ে পুরা ক্ষেপে গেছে দেখে তাড়াতাড়ি বললাম, “হমমম, দেখি। ” এখনও মেয়ের রাগ পড়েনি। স্নিগ্ধা বলল, “ঐ, আবার দেখাদেখি কী ?” কথা না বাড়িয়ে রাজি হয়ে গেলাম, “আচ্ছা, আচ্ছা।

আমি আসতেছি। সাড়ে চারটায়। বাই। ” ত, এই হল ঘটনা। ক্লাস ছিল মাত্র দুটা।

ক্লাস শেষে এক ঘন্টা আড্ডা মেরে বাসে উঠে পড়ি। যার ফলশ্রুতিতে আমি এখন এখানে। কিছুক্ষণ পরে, দূর থেকে মনে হল স্নিগ্ধা আসছে। “কী ব্যাপার একা কেন?” কাছে আসার পরে জিজ্ঞাসা করলাম। “ ও পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে।

একা একা বসে আছে। হাঁটতে নাকি ওর কষ্ট হচ্ছে। জলদি চল। ” স্নিগ্ধা বলতে লাগল, “ এটুকু হেঁটেই যেতে পারব। চল।

” মনে মনে বুঝলাম, মেয়ে আমার সাথে রিকশায় উঠতে চাচ্ছে না। মিথিলা কিছু একটা মনে করবে এই ভয়ে? কী জানি। ” বললাম, “ হ্যাঁ, চল। ” একটু সামনে এসেই বেশ কাঁদা। সকালে বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছে এদিক।

সাবধানে পা বাঁচিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। তবে, পরিবেশটা অস্বস্তিকর না। আগেই বলেছি, রাস্তা উঁচু করে দেয়া। আর, পাশে বিস্তর গাছপালা। ঢালু মাটি।

ঢাকার ভিতরের দিকের কাঁচাবাজারের পাশের কাঁদার মত না। পুরা পরিবেশটাই ভেঁজা ভেঁজা। “ এই স্নিগ্ধা, হঠাৎ আমাকে তোমার চাচার বাসায় নিবানা?” স্নিগ্ধাকে খুঁচাচ্ছি। “ আমার চাচা কেন? মিথিলার চাচার বাসায় যাও। আমার বাসায় গেলে কী পরিচয় দিব? ” স্নিগ্ধা আমার দিকে তাকিয়ে বলল।

“ আমি বলব, তুমি আমার সেকেন্ড বউ। সমস্যা কী?” বলতে লাগলাম, “ আর, তোমার চাচার বাসায় যেয়ে কিছু খাব না ত। ”খাওয়ার কথা শুনে হেসে ফেলল ও, “ এহ, শখ কত ! কারো সেকেন্ড বউ হওয়ার ইচ্ছা নেই। আর, খেতে চাইলেও খাওয়াব না। নিবই না।

” হাসি দিয়ে স্নিগ্ধার কথার উত্তর দিলাম, “ আসলে তোমার চাচাত বোনকে দেখার জন্যই আমার এত আগ্রহ। ” স্নিগ্ধা আবারও হেসে ফেলল, “ ঐ, আমি কিন্তু সব কথা জায়গামত পাস করে দিব। তখন বুঝবা। ” আমি তাড়াতাড়ি করে থামালাম, “ আরে আরে, ভয় দেখাও কেন। মিথিলা শুনলে আমার মাথা ফাটাবে।

” এমন সময় আবার শুরু হল ঝুম বৃষ্টি। আমি আর স্নিগ্ধা তাড়াতাড়ি রাস্তার পাশের একটা বড় ঝাকড়া গাছের নিচে দাঁড়ালাম। এরপরও একটু একটু পানির ছাঁট হালকা আসছিল। “ এই দেখ না, পাখিটা কী সুন্দর ”, কী একটা পাখি দেখিয়ে স্নিগ্ধা হঠাৎ যেন আনমনা হয়ে গেল। ওর এই কণ্ঠটার সাথে আমার অনেক আগে পরিচয়।

“ স্নিগ্ধা?” আমি আস্তে করে ডাকলাম। ও পাশ ফিরে তাকাল, “হমমম। ” আমি বলতে লাগলাম, “ আমার উপর কী তোমার কোন রাগ আছে স্নিগ্ধা? আমার সে সময়ের আচরণের জন্য আমি দুঃখিত। ” স্নিগ্ধা গাঢ় চোখে তাকালো আমার দিকে। বলল,“ তোমার উপর রাগ থাকবে কেন? তুমি আবার কবে কী করলা?” “ কথার অর্থ না বুঝলে কথাটা তোমার জন্য ছিল না ”,এটা বলার পরে স্নিগ্ধাকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখে বললাম, “ তখন সময়টা অন্যরকম ছিল স্নিগ্ধা।

আমি যেমন একটা মেয়ের কথা ভাবতাম, যেমনটা স্বপ্ন দেখতাম, তুমি সেরকম ছিলে না। চুপচাপ আর শান্ত একটা মেয়ের মনের ভিতর কি খেলা করে সে মুহূর্তে বুঝিনি। তুমিও ত বলতে পারতে কিছু। ” “ আমি আর কী বলতাম, আমার সাথে মিথিলাকে দেখে সারাক্ষণই তুমি ওর দিকে তাকিয়ে ছিলা। বাসায় এসে আমাকে কল দিয়ে মিথিলার উচ্ছ্বল প্রশংসা।

আর, তখনও ত আমাদের সম্পর্কটাকে আমরা বন্ধুত্বই বলতাম, তাই না? ” স্নিগ্ধা খুব আস্তে করে বলল। “ বন্ধুত্ব? হ্যাঁ তাই ত। আমি এক্সডেন্ট করেছি শুনে তোমার সে কী কান্না। আমার সাথে ঝগড়া করে গাল ফুলিয়ে সারাদিন থেকে পরের দিন আবার আমার রাগ ঠাণ্ডা করা। বন্ধুত্বই ত।

তখন ত তাই ভাবতাম। আমরা কত বোকা ছিলাম। তাই না?”, আমার কথা শুনে স্নিগ্ধা বলল, “ এখন আর এসব বলে কী লাভ? তখন অনেক কিছুই ভেবেছ, শুধু আমি কী ভাবি সেটাই ভাব নি। আমি আসলে খুব বেশি সাধারণ একটা মেয়ে। ” “ সাধারণ হওয়ার জন্য যে প্রতিভা লাগে সেটা বুঝার ক্ষমতা আমার ছিল না।

তখনকার সময়, যখন আমাকে শোনাতে যে, সারাদিন আমার কথা তোমার কতবার মনে হয়েছে আর আমি যখন ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিতাম, সে সময়ের কথা হঠাৎ মনে পড়ছে ”, আর কথা না পেয়ে চুপ করে রইলাম। রাস্তাটা খুব সুন্দর। চারিদিকে মানুষ নেই। শুধু দূরপাল্লার বাস যাচ্ছে। আর, মাঝে মাঝে যাচ্ছে কিছু প্রাইভেট কার।

পাশ দিয়ে হুস করে একটা গাড়ি ছুটে গেল। গাড়িটার দিকে তাকানোর কারণেই বোধহয় স্নিগ্ধার চোখে হালকা পানির ধারাটা খেয়াল হল। “ তুমি আর মিথিলা ত এখন সুখেই আছ। এখন আর এসব বলে লাভ কী? ” স্নিগ্ধা নিরবতা ভাঙল। “ হ্যাঁ,সুখেই আছি।

তবুও, মাঝে মাঝে তোমার কথা হঠাৎ মনে পড়ে। আসলে তোমার সাথে যখন সারাদিন কথা হত, সে সময়টায় যেসব গান শুনতাম, ওগুলো যখন আবার প্লেলিস্টে ঘুরেফিরে আসে, সে সময়ের কথা আবার মনে পড়ে। আর আজকে অকারণেই মনে পড়ছে। ”, ওর দিকে তাকিয়ে বললাম। ও বলতে লাগল,“ আমি প্রথম যেদিন তোমার সাথে দেখা করতে যাই, সারাটা সময় মিথিলার দিকে তাকিয়ে ছিলে।

তাই তোমার খেয়াল নেই, আমি সেই দিন এই ড্রেসটা পড়েছিলাম। মিথিলাকে সেদিন সাথে নিয়ে ভালই করেছি। তোমাদের একটা গতি হল। ” আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম। এজন্যই বোধহয় পুরোনো কথা মনে হচ্ছে আজকে আবার।

ওর চোখের পানির ধারাটা আরও একটু স্পষ্ট হয়েছে। আর, কিছু ভাবি নি। মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। দূর পাল্লার একটা বাস পাশে দিয়ে ছুটে গেল। হুশ।

বৃষ্টির আওয়াজে ফুঁপিয়ে উঠা কান্নার শব্দ অনেকটুকুই ঢাকা পড়েছে। “ মিথিলার কী হবে? ”, আমার কাঁধে চোখ মুছে স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করল। “ অ হ্যাঁ, চল। আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব ”, ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে হাঁটা দিলাম। স্নিগ্ধা অবাক চোখে আমার পিছন দিকে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ করেই সব শেষ করে দিলাম। জটিল এই জীবনটাকে আর জটিল করতে চাই না। বৃষ্টি কমে এসেছে। “ নিশি রাতে যদি দেখ আমাকে, চাঁদ হয়ে ভেসে যেতে ঐ দূর আকাশে একটিবার না হয় ডেকো গো আমায়, না হয় জানিয়ো বিদায় মিষ্টি হাসি হেসে। ” © আকাশ_পাগলা
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।