আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সর্বরোগের মহৌষধ: সরকারি প্রতিষ্ঠানের সামরিকীকরণ এবং বেসরকারিকরণ



বাংলাদেশে বর্তমানে সর্বরোগের মহৌষধ টাইপের একটা সংস্কৃতি চালু হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি রোধ এবং কাজে গতি বৃদ্ধিতে খুব সহজ দুটো সমাধান বের করেছে উপরমহল। এক হলো সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারিকরণ এবং আরেকটি হলো সামরিকীকরণ। দুটির মধ্যে দ্বিতীয়টি অধিক জনপ্রিয়। দ্বিতীয়টিতে আসার আগে প্রথমটি নিয়ে একটু আলোচনা করি।

পাবলিকের ট্যাক্সের টাকায় চলে এমন অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান পাবলিককে কোন সেবাই দিতে পারত না। নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর কাজের দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগে এমন অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিবর্তিত করা হয়। এর মধ্যে কিছু ব্যাংক, বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ, টেলিযোগাযোগ, কারখানা এবং বিমান উল্লেখযোগ্য। ভালো! আমাদের দেশে মাথা ব্যাথার একমাত্র চিকিৎসা মাথা কেটে ফেলা মানে সরকারি চাকুরেদের মানসিকতা কোনভাবেই পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না বলে বাধ্য হয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়দায়িত্ব বেসরকারি কর্তৃপক্ষের হাতে দেয়া হয় যদিও কোম্পানির শেয়ারের ৫১% থাকে সরকারের মালিকানায়। এতে করে কাজে যেমন গতি আসে তেমনি প্রতিষ্ঠানেও আসে এসি।

পাবলিকের সামনে সরকারের অক্ষমতা প্রকাশ হলেও পাবলিক সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। সরকার আর পাবলিকের বাইরে আরেকপক্ষ এই সুযোগে বগল বাজায়। তারা হলো এদেশের ব্যবসায়ীবৃন্দ। তাদের কল্যাণেই তো অর্থনীতি এবং পরিসংখ্যান প্রবৃদ্ধি, জিডিপি, জিএনপি অমুক সূচক তমক সূচকের হিসেব দেখিয়ে দেশ কতটা উন্নতির শিখরে গেল তার আষাড়ে গল্প শোনায়। আমজনতা অধিকাংশই এই জিডিপি, জিএনপি আর প্রবৃদ্ধির গাণিতিক হিসেব বোঝে না, তারা শুধু দেখে পাতের ভাতের পরিমাণ দিন দিন কমছে।

আসলে কী, টাকা দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায় বেশ আগে থেকেই। ব্যবসায়ীদের হাতে ভালো পরিমাণ টাকা থাকে এবং তারা যখন দেখে সরকারের প্যান্ট খুলে যাচ্ছে তখন টাকা দিয়ে (ভদ্র ভাষায় বিনিয়োগ) সরকারি প্রতিষ্ঠান তথা সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। যে দেশে মেরুদণ্ডহীন সরকার জনগনের আশা আকাঙ্ক্ষার কোন প্রতিফলন ঘটাতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক সে দেশের পুঁজিবাদিরা সরকারের প্রভুগিরি করবে সেটাই স্বাভাবিক। আসছে বাজেটে নাকি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি থাকবে যাতে কিনা সরকারের দায়িত্ব অনেকটাই পালন করবে এফবিসিসিআই বা বিজেএমইএ'র নেতারা। পাতি থেকে রাঘব বোয়াল সব ব্যবসায়ীরাই যেখানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সিদ্ধহস্ত সেখানে তারা এধরণের সুযোগের শতভাগ সদ্ব্যবহার যে করবে তা বলার জন্য জ্যোতিষ শাস্ত্রে পিএইচডি করা লাগে না।

টিভিতে দেখলাম এক টকশোতে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা, সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং অর্থনীতি বিষয়ক কলাম লেখক টিটা সাহেব এসেছেন। অনুষ্ঠানে আলোচনার বিষয় ছিল এই পিপিপি। মিন্টু সাহেব বেশ ঠোঁট কাটা দেখলাম। অকপটে বলছে যে ব্যবসায়ীরা চাইবে কীভাবে বেশি লাভ করা যায়। তারা দেখবে মুনাফা।

কোন রাস্তা যদি পিপিপির আওতায় হয় তাহলে বেসরকারি মুনাফাভোগী পার্টনার দেখবে কতদিনে তার বিনিয়োগকৃত অর্থ উঠবে। এরপরে লাভ উঠবে কতদিনে। আংকেল বলেছেন ভালোই। তিনি আরও বলেছেন, কাজ শেষে সরাকর যদি বলে, "আমি গরীব দেশের সরকার, তোমাদের টাকা দিতে পারব না, তাহলে কোনভাবেই হবে না। " অতি উত্তম কথা।

উনারা ব্যবসা করতে এসেছেন মুনাফার জন্য। মুনাফা তো উনারা করতে চাইবেনই কিন্তু একটা দেশের ব্যবসায়ীরা যখন দিনে দুপুরে সরকারকে এভাবে থ্রেট দেয় তাহলে সে দেশ যে ব্যবসায়ীদের কতটা নিয়ন্ত্রণে তা বুঝতেও আর সময় লাগে না। কিন্তু কী আর করা? সরকারের বেতনভুক্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা যখন প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের সাথে বাটপারী করে তখন ব্যবসায়ীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যতীত দ্বিতীয় আর একটি মাত্র পথ বিজ্ঞজনেরা আবিষ্কার করেছেন। এবার সেটিতে যাই। সরকারি প্রতিষ্ঠান।

পদে পদে দুর্নীতি, পিয়ন শাসায় প্রতিষ্ঠানের পরিচালককে। বিগবস এবং কেরাণী সকলের ছেলে মেয়েরাই নর্থ সাউথে পড়ে। কী করা যায়? কী করা যায়? ইউরেকা! ইউরেকা! আছে সর্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সামরিক বাহিনী। মাটি হইলে সেনা, পানি হইলে নৌ আর আকাশ হইলে বিমান বাহিনী। হাসপাতালে চিকিৎসকরা ফাঁকি দেয়, কর্মচারীরা ঘুষ খায়, আউটডোরে দালালদের দৌরাত্ম? নো টেনশন! বিশিষ্ট বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ডা. .......... কে হাসপাতালের পরিচালক বানায়ে দাও।

এক্কেরে ঠান্ডা বানায়ে দিবে। কলেজে দুর্নীতি? পাস করে ছেলেরা সামরিক বাহিনীতে যেতে উৎসাহী নয়? বিগ্রে জে. ........., এনডিসি, পিএসসি আজ থেকে নতুন অধ্যক্ষ। রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে অর্থ পাচার? দুর্নীতি? কোন চিন্তা নেই। এবার আসছেন মেজর জেনারেল .................. , এনডিসি, পিএসসি। এক ঢিলে দুই পাখি।

এলাকাও ঠান্ডা(?) থাকবে আবার কোটিপতি রপ্তানিকারক, আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্কটাও গভীর হবে। রিটায়ার্ড করার পর................। চা বোর্ড, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পর্যন্ত যথাক্রমে বিগ্রে জে., মে. জে এবং কর্ণেলদের আনাগোনা। সাবাস বাংলাদেশ! কীয়ের মধ্যে কী??! পাবলিকের কোটি ট্যাকা খসাইয়া শিখাইলাম ক্যামনে কামান দিয়া গোলা মারবেন, বন্দুক দিয়া গুলি মারবেন, জগিং করবেন, চুল কাটবেন, পার্টি এটেন্ড করবেন, মেধাবী হবেন, বিদেশে প্রশিক্ষণ নিবেন আর আপনেরা সব হাসপাতাল, কৃষি, ব্যবসা, টেলিফোন, পানি, বিদ্যুৎ অবসর প্রাপ্ত ডিগ্রি লাগায়ে সরকারে যোগ দ্যান ক্যান? পাবলিকের ট্যাক্সের কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রশিক্ষণ নিলেন, পাবলিকরে কী দিলেন, দেশে যুদ্ধ লাগবে সেরকম তেমন কোন সম্ভাবনাও নাই অথচ দিন দিন আপনাদের উন্নত সুযোগ সুবিধা, প্রশিক্ষণ দেওয়া হইতেসে আর আপনারা প্যারেড কইরা স্বাস্থ্য বানায়া, জুতা পালিশ কইরা ঘুইরা বেড়ান আর পাবলিকের টাকায় নেয়া বিদেশি প্রশিক্ষণ দিয়া হয় অবসরের পর লাখ টাকার চাকরি নেন নাইলে পাবলিকের টাকায় কেনা অস্ত্রের শক্তি দিয়া ব্যবসায়ীদের লগে খাতির করেন অবসরের পর ব্যবসায় নামার আশায়। আজিব লাগে এইগুলান! গরীব দেশ।

খাওয়া পায়না মানুষ। শিক্ষা, চিকিৎসার মত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। যেখানে আইন-শৃঙ্খলার নাই কোন নিশ্চয়তা, রাস্তা-ঘাটে নাই নিরাপত্তা সেখানে প্রতিরক্ষার মত এত দূরের বিষয়কে কেন এত অগ্রাধিকার দেয়া হয়? খাদ্যের চেয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বেশি বাজেট দেয়ার চেয়েও হাস্যকর এবং কষ্টদায়ক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের চেয়ে বেশি বাজেট সামরিক খাতে বরাদ্দ দেয়া। যে দেশের মানুষ খেতে পারে ঠিক মত সে দেশে সামরিক বাহিনী কীভাবে খেতে না পারা বা উচ্চমূল্যে খাদ্য কিনে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষের করের টাকায় ভর্তুকি দেয়া কম মূল্যের খাবার খায়। সেই দেশে এমন এক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আছে যাদের নেই কোন বিবেক, নেই কোন হৃদয়।

তারা বুঝে শুধু উচ্চ মুনাফা। কতটা নিকৃষ্ট হলে একটা শ্রেণী রমজান মাসে মানুষের কষ্টের চাহিদাকে পুঁজি করে দ্রব্যমূল্য ইচ্ছেমত বাড়িয়ে দেয়। এক মাসে মানুষকে ফতুর করে নিজেদের পকেট ভারী করে। সিন্ডিকেটে বসে এক সাথে দ্রব্য মজুদ করে, দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে, মুনাফার উপর মুনাফা করার নিষ্ঠুর আনন্দে মেতে ওঠে পাষাণ এই আধুনিক মহাজনেরা। বিদেশ থেকে ১০০ টাকায় জিনিস কিনে দেশে ১০০০০ টাকায় বিক্রি করে তিনশ গুণ লাভ করতেও দ্বিধা করে না তারা।

সবশেষে দেয় কর ফাঁকি। হালে তো আবার গরীবের গরীব শ্রেণীর ভাঁঙ্গা থালা পরিষ্কার করার অসাধারণ নৈপুণ্য আবিষ্কার এবং প্রচলনের জন্য নোবেলও পেয়ে গিয়েছে একজন। দলে দলে আধুনিক এই মহাজনরা এই পথে আসছে। দুস্থ শ্রেণীকে নামমাত্র মজুরি দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে লাভের বড় অংশ খেয়ে ফেলে "সমাজ উন্নয়নের এনজিও" খুলে বসছে এই শ্রেণী। ইচ্ছামত মুনাফা করা তো আর দুর্নীতি না।

১০০ টাকা ঘুষ খাওয়া দুর্নীতি কিন্তু ১ টাকার পণ্য ১০০ টাকায় বিক্রি করে অর্জিত মুনাফা দুর্নীতি না। চলছে, চলবে। এভাবেই???

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।