আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রথম আলোর নসিহত 'বদলে যাও বদলে দাও': জনগণের নৈতিকতা নিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণীর ভাববাদী নষ্টামী



কোন একটি দেশের বিদ্যমান অবস্থার যদি সত্যিকার পরিবর্তন করতে হয় তবে কেবল ব্যাক্তিকে যদি বলা হয় তুমি নিজে পরিবর্তিত হয়ে যাও, তোমার মত বাকিদেরকেও পরিবর্তিত হতে বলো, তাহলে সবাই পরিবর্তিত হলে আল্টিমেটলি পুরোদেশটিই পরিবর্তিত হয়ে যাবে- তাহলে সেটা আপাতদৃষ্টিতে বেশ যুক্তিযু্ক্ত কথা মনে হলেও বাস্তবে এর মাঝে মস্তবড় ফাকি আছে। কারণ- আমরা সবাই জানি যে প্রাথমিক ভাবে কোন ব্যাক্তির আচার আচরন বাস্তব পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল, কোন একটি বাস্তব পরিস্থিতিতে ব্যাক্তি চাইলেও যে কোন কাজ করতে পারেনা, বা যে কোন প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে পারেনা- তা সে ব্যাক্তির উইল পাওয়ার বা ইচ্ছাশক্তি যতই থাকুনা কেন। আবার যদি বলা হয় ব্যাক্তি হলো বাস্তব পরিস্থিতির দাস তাহলেও ভুল বলা হবে। কারণ যেহেতু মানুষ চিন্তাশীল, তাই সে বাস্তব পরিস্থিতিকে একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত নিজের মতো করে চিন্তা করে গ্রহণ করে যেকারণে দেখা যায় একই ধরণের বাস্তব পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ধরণের আচরণ করে থাকে। তাহলে যেটা ঘটে তা হলো বাস্তব পরিস্থিতি যেমন ব্যাক্তির চিন্তা এবং কাজের উপর প্রভাব ফেলে তেমনি ব্যাক্তির চিন্তা ও কাজও বাস্তব পরিস্থিতির উপর প্রভাব ফেলে।

কিন্তু মনে রাখতে হবে যে বাস্তব পরিস্থিতির ভূমিকাটা অনেক বেশী নির্ধারক কেননা ব্যাক্তির চিন্তা ও কাজ বাস্তব পরিস্থিতির উপর প্রভাব ফেললেও তার একটা সীমা থাকে( যে সীমা বাস্তব পরিস্থিতি দ্বারা নির্ধারিত) অর্থাত চাইলেই কোন বাস্তব পরিস্থিতিতে যে কোন ধরণের চিন্তা ও কাজ করতে পারেনা। এখন ধরা যাক, একটি দেশের বাস্তব পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হবে। সন্দেহ নাই ব্যাক্তির চিন্তার মধ্যে যদি কোন পরিবর্তন না আসে কিংবা ব্যাক্তি যদি নিজেকে পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক না থাকে তাহলে সেই বাস্তব পরিস্থিতির তো আর আপনা-আপনি পরিবর্তন হবে না। ফলে এটা নিয়ে সন্দেহ নাই ব্যাক্তির অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে দেশের অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে আর দেশের অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে ব্যাক্তির চিন্তা-ভাবনা, মনমানসিকতা ইত্যাদিরও পরিবর্তন করতে হবে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই মনে হতে পারে, আরে এটাতো একটা চক্র হয়ে গেল- ব্যাক্তির পরিবর্তন করতে হলে দেশের পরিবর্তন করতে হবে আবার দেশের পরিবর্তন করতে হলে ব্যাক্তির পরিবর্তন করতে হবে! এ চক্র আমরা ভাঙবো কিভাবে? দৈনিক প্রত্রিকা প্রথম আলো একটা সহজ সমাধান আমাদের সামনে হাজির করেছে- তা হলো- "নিজেকে বদলাতে হবে আগে" আর তা হলেই "একটি একটি করে শপথে বদলে যাবে দেশ"! এখন প্রশ্ন হলো ব্যাক্তি যার যার মতো নিজের সুবিধা বা ইচ্ছা মতো পরিবর্তিত হলেই কি দেশের পরিবর্তন হবে? আবার ব্যাক্তির মনমানসিকতার পরিবর্তনের সাথে সাথে যদি ব্যাক্তি যেই বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করে সেটারও যদি পরিবর্তন না ঘটতে থাকে তাহলে কি ব্যাক্তি স্রেফ সদিচ্ছা দিয়ে তার পরিবর্তিত পরিস্থিতি ধরে রাখতে পারবে? শপথ এবং তার বাস্তবায়ন পঞ্চগড়ের এক রিকশা-ভ্যান চালক প্রথম আলোর কাছে শপথ করেছেন: "যাত্রীদের কাছে বেশী ভাড়া নেব না"- রিকশা-ভ্যানের সঠিক ভাড়াটি আসলে কত? এটা কিভাবে নির্ধারিত হয়, রিকশা চালকের সার্বিক প্রয়োজন বিবেচনা করে নাকি তাকে যতটুকু না দিলে সে কোন রকমে খেয়ে পরেও বেচে থাকতে পারবে না সেই বাস্তবতা থেকে? আবার চাল-ডাল-তেলের দাম বেড়ে গেলে কি তিনি বেশী ভাড়া না নিয়ে পারবেন? সেখানকার পুলিশ সুপার অঙ্গীকার করেছেন: "আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করব।

" কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকও শপথ করেছেন: কক্সবাজারের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের জন্য তার পক্ষে যা করা সম্ভব তিনি তা করবেন- একজন পুলিশ সুপার আর জেলা প্রশাসকের পক্ষে কতটুকু করা সম্ভব? তারা যদি আন্তরিক ভাবে চান, তাহলেও কি ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের সন্ত্রাশ-চাদাবাজি বন্ধ করতে পারবেন? ঠাকুরগায়ের এক শিক্ষার্থী প্রথম আলোর ব্যানারে শপথ লিখেছেন: চাকুরী পেলে আমি ঘুষ খাবনা এবং ঘুষ দিয়ে চাকুরী নেব না। খুবই ভালো ইচ্ছা- কিন্তু তার যদি মামা চাচা না থাকে তাহলে তার আদৌ কোন চাকুরী হবে কি? সেক্ষেত্রে তার পরিবারে যদি অভাব অনটন থাকে, যদি তাকে উচ্চশিক্ষিত করতে গিয়ে তার পিতা-মাতার প্রায় নি:স্ব দশা হয় তাহলে তিনি কি তার শপথ অক্ষুন্ণ রাখতে পারবেন? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরীকমিশনের চেয়ারম্যান প্রতিজ্ঞা করেছেন: বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মান সমুন্নত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাব। একদিকে ক্রমশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে গবেষণা ও শিক্ষার মান ক্রমশ নামিয়ে দেয়া হচ্ছে, ক্রমশ ব্যয়বহুল করার মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষাকে সাধারণের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং অন্যদিকে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে সার্টিফিকেট বিক্রির ব্যাবসা- এই পরিস্থিতি তিনি করবেন উচ্চ শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ! শিক্ষা সম্পর্কে শাসকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি যতদিন না পাল্টানো যাচ্ছে, যতদিন শিক্ষাকে তার আলু-পটলের মতো আর দশটা সাধারণ পণ্যের মতো বিবেচনা করা বন্ধ না করবেন, ততদিন মঞ্জুরী কমিশনের একজন চেয়ারম্যান যতই প্রতিজ্ঞা করুন না কেন শিক্ষার মান তিনি সমুন্নত রাখতে পারবে না। একটি বাচ্চা মেয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে: আমি বড় হয়ে একজন চিকিতসক হব এবং এদেশের চিকিতসা বঞ্চিত শিশু, কিশোর বৃদ্ধিসহ প্রতিটি মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করব- প্রশ্ন হলো উচ্চশিক্ষাব্যাবস্থার এই সংকটের বাস্তবতায় মেয়েটি চিকিতসক হতে পারবে তো? যদি পারে তবে তার পরিবারকে কতটাকা খরচ করতে হবে তার জন্যে? আর চিকিতসক হয়ে যাওয়ার পর তার এই মনমানসিকতা কি থাকবে? পুজিবাদী অর্থনৈতিক বাস্তবতায় যখন অর্থই সকল সুখের মূল তখন সেকি অর্থ উপার্জনের সুখ থেকে, প্রয়োজন থেকে, নেশা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে? লক্ষহীন বদল এবং শ্রেণী স্বার্থের দ্বন্দ্ব: বদলে যাব ভাল কথা কিন্তু বদলে কেমন হবো? এখন যেমন স্রেফ নিজের স্বার্থই দেখছি তখনও কি তাই দেখব? আমি যদি নিজের স্বার্থ না দেখি তাহলে আপনি বা আর কেউ বা 'দেশ' কি আমার স্বার্থ দেখবে? ধরা যাক. আমি বদলে গিয়ে চুরিচামারি বন্ধ করে দিলাম। ফলে আমার আয় কামাই কমে গেল।

এখন আমার অসুখ হলে আমাকে কে দেখবে, আমার সন্তানের শিক্ষা-চিকিতসার ভার কে বহন করবে? নিজেকে বদলে ফেলার প্রসঙ্গে এধরণের সামাজিক নিরাপত্তামূলক বিষয়গুলোর মিমাংসা না করে কি কেউ আসলে এমন বদলের দিকে এগিয়ে যেতে পারে যা তার ক্ষুদ্র স্বার্থের বাইরে? কই প্রথম আলোর বদলে দেয়ার আহবানের মধ্যে তো এবিষয়ে কোন বক্তব্য দেখছি না! তাহলে সবাই যদি নিজ নিজ স্বার্থ অনুযায়ী বদলায় তাহলে কি সত্যিকারের দিনবদল আসবে? পেশাদার চোর চুরি ছেড়ে দেয়ার শপথ করলো কিংবা নেশাখোর শপথ করলো নেশা ছেড়ে দেয়ার কিন্তু রাষ্ট্র তার যে দ্বায়িত্ব এই চোর বা নেশাখোরকে চাকরি বাকরির মাধ্যমে পুনর্বাসন করা সেটা করলো না কারণ রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণী আবার তার শ্রেণী স্বার্থ অনুযায়ী শপথ করেছে সরকারী কারখানা সব বেসরকারী করে ফেলার। ফলে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয়ার ক্ষমতা আর রাষ্ট্রের নেই, সেক্ষেত্রে ঐ চোর বা নেশাখোরের পক্ষে কি তার প্রতিজ্ঞা ধরে রাখা সম্ভব হবে? কাজেই ব্যাপারটা যেরকম সহজ-সরল বলে প্রচার করা হচ্ছে তা ততটা সহজ-সরল নয় যে একটা পত্রিকার কাছে শপথ বাক্য উচ্চারণ করেই লোকে নিজে এবং তার দেশকে বদলে ফেলতে পারবে। পরিবর্তনের সামগ্রিক লক্ষ, উদ্দ্যেশ্য এবং প্রকৃয়াটি পরিস্কার না করে স্রেফ ব্যাক্তির শুভ বুদ্ধির উপর ছেড়ে দিলাম এবং আপনা আপনি সব পরিবর্তন হয়ে গেল এটা বেশ হাস্যকর একটা ব্যাপার এবং জনগণের নৈতিকতা নিয়ে তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। এ কথাগুলো একসময় উঠবে বলেই হয়তো প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক মিজানুর রহমান খান আগে ভাগেই বলে রেখেছেন: অঙ্গীকার করার উদ্দেশ্য হলো মানুষ তার কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করবে। কোন সামগ্রিক বিষযে পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার করা এই প্রচেষ্টার অংশ নয় (প্রথম আলো, ৩০ মে, ২০০৯)।

তাহলে কেন বাবা প্রচার করছ একটু একটু বদলের ফলেই বদলে যাবে দেশ! পাঠকের কি মনে হয় পরথম আলো গোষ্ঠী সত্যি সত্যি এরকমটা ভাবে যে এইভাবে কোন কিছু বদলানো যায়! আমরা জানি আপনারাও এটা জানেন যে এইটা একটা বিরাট ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু হঠাৎ এই সময়টাতেই তার এরকম ধাপ্পাবাজির প্রয়োজন পড়ল কেন? পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে এই পরথম আলো গোষ্ঠী ১১ই জানুয়ারি পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে নিজেদের ( সুশীতল সমাজ সহকারে ) কৃতিত্ব বলে প্রচার করতে কত বেপরোয়াই না ছিল। অথচ এখন যখন পাশা উল্টে গেছে তখনই তারা সাধু সেজে শপথ বাক্য পাঠ করানো শুরু করেছে। ভাবখানা এমন যে তারা জাতির নোংরা বিবেক পরিশুদ্ধ করার অভিযানে নেমেছে! এইটা আসলে তাদের ফিকে হয়ে যাওয়া ইমেজকে ঘষাঘষি করে চকচকে করে তোলার একটি চেষ্টা। তবে এই মাল কিন্তু নতুন না দুনিয়ায়।

কর্পোরেট হাউজগুলার কর্মকান্ড যখনই জনগণের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে তখনই এরা ইমেজ পুনরুদ্ধারে নানা রকম খেইল খেলে। বিভিন্নভাবে খেলা গেলেও এই খেলার একটাই নাম- ব্র্যান্ডিং। তাদের কাছে আপনি অবশ্য একটা আজব শব্দবন্ধ শুনতে পাবেন- ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি’। আজব এ কারণে যে দুনিয়াবী যে কোন ভাষাতেই আপনি বলেন না কেন ‘কর্পোরেট’ আর ‘সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি’ দুটি ভিন্ন দ্যোতনার ধারক-বাহক। অনেকটাই কাঁঠালের আমসত্ত্বের মত।

আমরা অবশ্য এটার একটু ভিন্ন উপমা দাঁড় করিয়েছি- এটা এমন এক সাপ মারার খেলা যাতে রোগী না বাঁচলেও, সাপ না মরলেও তন্ত্র-মন্ত্রেও ব্যাপক প্রদর্শনীর জোরে ওঝার মান বাড়ে আর দর্শকও আসল অস্ত্র লাঠির কথা ভুলে থাকে। পাঠক আশা করি ঠিক ঠিক জায়গা মত উপমানদের বসিয়ে নেবেন, আপনাদের উপর সেই আস্থা আমাদের রয়েছে। ভাববাদ বনাম দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ প্রথম আলো তার প্রথম পাতায় প্রায়ই বিভিন্ন ব্যাক্তির সাফল্যের কাহিনী ফলাও করে ছাপায় যার মূল কথা হলো: ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। দেখা যায় নিজের ইচ্ছা এবং চেষ্টার জোরে অনেক কর্মহীন, অস্বচ্ছল মানুষ তার নিজের এবং তার আশাপাশের মানুষের ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে বেশ ভালো মনে হলেও এর এধরনের প্রচারের একটা রাজনৈতিকতা আছে।

কারণ ঐ সাফল্যের কাহিনীর সাথে সবসময়ই একটা গোপন ধিক্কার লুকিয়ে থাকে: ঐ মানুষগুলো যদি নিজের ইচ্ছার জোরে নিজের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে তাহলে বাকিরা কেন পারছেনা, নিশ্চয়ই তারা ঠিকঠাক চেষ্টা করছে না, নিশ্চয়ই তারা অলস কিংবা বুদ্ধিহীন! এধরণের দর্শন কেবল প্রথম আলোর ব্যাপার নয় পুরো বুর্জোয়া অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায়ই এর পুজারী। যে দর্শন আমাদেরকে শেখায় ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয় কিংবা নিজে ভালো তো জগত ভালো তার প্রাতিষ্ঠানিক নাম হলো ভাববাদ বা আইডিয়ালিজম। ভাববাদের মূল কথা হলো: বাস্তবতা নির্ভর করে আমাদের মনের উপর কিংবা কতগুলো ভাব বা আইডিয়ার উপর। অন্যদিকে বস্তুবাদ বলে মানুষের আইডিয়া তার বাস্তব পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। আর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলেছে মানুষের আইডিয়া বস্তুজগতের উপর নির্ভরশীল হলেও তা স্রেফ বস্তুজগতের প্রতিফলন নয়, বস্তুজগত যেমন আইডিয়ার উপর প্রভাব ফেলে আইডিয়াও তেমনি বস্তু জগতের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

যদি প্রশ্ন করা হয় সমাজের মানুষ কেন ধনী ও দরিদ্রে বিভক্ত তাহলে আইডিয়ালিজম বা ভাববাদ বলে যারা বুদ্ধিমান, দূরদর্শী, তারা নিজেদের সম্পদ অপচয় না করে, সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যাবহারের মাধ্যমে ধনী হয়েছে। আর বাকি যারা নির্বোধ, অলস কিংবা অপচয়কারী তাদের কোন উন্নতি হয়নি। অর্থাত ভাববাদিরা বলে সবকিছুই ব্যাক্তির চরিত্রের উপর কিংবা তার ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল। আর অন্যদিকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলে যেহেতু সমাজ বিকাশের ক্রমধারায় বলপ্রয়োগ কিংবা অন্যান্য বিভিন্ন প্রকৃয়ায় উতপাদিকা শক্তির মালিকানা কিছু মানুষের হাতে হস্তগত হয়েছে এবং বাকি বেশির ভাগ মানুষের সেই মালিকানায় কোন ভাগ নেই এবং বেশিরভাগ মানুষ কাজ করে যা অর্জন করে তার বেশীরভাগটাই মালিক শ্রেণীর হস্তগত হয় ফলে বেশীরভাগ মানুষ দরিদ্র আর অল্পকিছু মানুষ ধনী। তাই কারো দারিদ্র তার ব্যাক্তিগত অক্ষমতার কোন বিষয় নয়, সমাজে উতপাদনের উপকরণের মালিকানা এবং উতপাদিত পণ্যের বিনিময়ের বৈষম্যের কারণেই তারা দরিদ্র এবং তাদের দারিদ্র দূরকরতে হলে এই বিদ্যমান মালিকানা সম্পর্কই পাল্টাতে হবে।

আর ঠিক এ কারণেই পুজিবাদী অর্থনীতির ধারক বাহক মিডিয়াগুলো বস্তুবাদী দর্শনের বদলে ভাববাদী দর্শনের প্রচার চালায় যেন লোকজন আজকের এই বৈষম্যমূলক ব্যাবস্থা পুরোপুরি উল্টে-পাল্টে দেয়ার সংগ্রামে নিয়োজিত না হয়, যেন ব্যাক্তির দোষগুণ ভালমন্দকেই সবকিছুর জন্য দায়ী করে। মিডিয়া যখন চার্চ সামন্তযুগে চার্চগুলো যে ভূমিকা পালন করতো আজকের দুনিয়ায় বোধহয় মিডিয়ার ভূমিকা অনেকটি সেরকম হয়ে উঠছে। চার্চগুলো সামন্তরাজাদেরকে সরাসরি ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে স্বীকৃতি দিয়ে ভূমির উপর রাজার মালিকানা এবং তা থেকে প্রাপ্য ফসলে রাজার মালিকানাকে বৈধতা দিত। ভূমিদাসরা যেন তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে সবকিছু উলোটপালট করে দিতে না পারে তার জন্য তাদেরকে বোঝাত সবই কপালের লিখন কিংবা হাতের পাচটা আঙুল যেমন সমান হয় না তেমনি সমাজে সবার অর্থনৈতিক অবস্থাও একরকম হয় না কিংবা সবই তার বা তাদের পাপের ফল। কাজেই সে যদি নিয়মিত প্রার্থনা করে আর চার্চের কথা মতো ভালো হয়ে চলে তাহলেই তার অবস্থার পরিবর্তন হবে, এই জগতে না হলেও অন্তত: পরজগতে তো হবেই।

বর্তমান যুগের সেক্যুলার চার্চ মিডিয়া এই ইহজগতে ব্যাক্তির মন্দথাকার আসল কারণের আশপাশ দিয়েও না গিয়ে ইহকালে তাকে সুখী ও ভোগী থাকার নানায় উপায়-অবলম্বন বাতলে দেয় যার কেন্দ্র হলো ব্যাক্তির ইচ্ছা বা উইল পাওয়ার। এই ভাবে বুর্জোয়াদের হেজিমনি টিকিয়েরাখার জন্য মিডিয়া ব্যাক্তির উপর ভর করে। ভোগবাদ, ব্যাক্তিবাদ, বিশেষ ব্যাক্তিকে সাফল্যের নায়ক হিসেবে হাজির করে আল্টিমেটলি বাকিদেরকে অনায়ক বা সাধরন হিসেব প্রতিপন্ন করা ইত্যাদির মাধ্যমে মিডিয়া যেন চার্চের মতোই একটা অথরিটি বা কর্তা হয়ে উঠে যে বার বার জনগণকে প্রিচ বা নসিহত করে যদি ভালো থাকতে চাও, সুখে থাকতে চাও তো এই কর, সেই কর- মিডিয়ার এই নসিহত সাবান, শ্যাম্পু, পোশাক-আশাকের স্টাইল থেকে শুরু করে আজকে একেবারে সরাসরি ব্যাক্তিকে বদলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। এদের এই নসিহতে মুগ্ধ হয়ে আমরা যদি স্রেফ ব্যাক্তিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ বা গোটা দেশের পরিবর্তনের ভ্রান্ত স্বপ্নে বুদ হয়ে থাকি তাহলে যখন স্রেফ নিজের ইচ্ছা শক্তির জোরে প্রতিজ্ঞা ধরে রাখতে পারব না তখন নিজ নিজ নৈতিকতাবোধের উপরই আস্থা হারিয়ে ফেলে ভাবতে থাকব আরে আমি নিজেই তো ভালো না, অনেক চেষ্টা করেও তো ভাল হতে পারলাম না তাহলে অন্য মানুষ কেমনে ভালো হবে আর সমাজটাই বা কেমনে ভালো হবে! এভাবে গোটা জাতির মাঝে একটা গোপন অপরাধবোধ ছড়িয়ে পরবে, সবাই হতাশা গ্রস্ত হয়ে অবশেষে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক সমাজব্যাবস্থাকে অপরিবর্তনীয় বলে মেনে নেবে এবং সত্যিকারের সমাজবদল সূদুরপরাহতই থেকে যাবে। আগে নিজেকে বদলাতে হবে তাহলে সমাজ এমনিতেই বদলে যাবে এটা যেরকম ভ্রান্ত তেমনি সমাজ বদলালেই আপনা আপনি সবমানুষ ভালো হয়ে যাবে এটাও একই পরিমাণ ভ্রান্ত।

যেহেতু ব্যাক্তি ও সমাজ পরস্পরের সাথে দ্বান্দ্বিক ভাবে সম্পর্কযুক্ত ফলে কোন একটাকে আলাদা করলে চলবে না। দুটোকে একসাথে চালানোর উপায় হলো সমাজবদলের সংগ্রামে নিয়োজিত হওয়া। তাহলে সেই নির্দিষ্ট লক্ষ অর্জনের সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই, সে সংগ্রাম করতে করতেই ব্যাক্তি এবং সমাজ উভয়েরই বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আসবে। তো এই সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের শুরু আমরা কোথা থেকে করব? আমাদের লক্ষ্যটাই বা কি হতে পারে? না, পাঠককে কোন নসিহত আমি দিতে চাই না বরং আমি এই মূহুর্তে কতগুলো সম্ভাবনার উল্লেখ করতে চাই। যেমন বলা যেতে পারে এই মূহুর্তে আমরা সবাই টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি কিংবা যেখানে এই ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে উঠেছে সেখানে সামিল হতে পারি।

আমরা আমাদের জাতীয় সম্পদ তেল-গ্যাস-বন্দও রক্ষার আন্দোলনে যোগ দিতে পারি। এইখানে অনেকেই হয়তো বলবেন ‘ওফ, সেই পুরানা গান, সেই পুরানা সুর’। আর আমি উত্তরে বলব- হরে ভাই সেই পুরানা গানই কারণ এখনো এই ঐক্যবদ্ধ আমরাই কেবল পারব সত্যিকারের পরিবর্তনের সূচনা করতে। আঁটি ও বাঁশের গল্পটি পুরানা হয়ে গেলেও মিথ্যে হয়ে যায়নি। তাই কেবল প্যাসিভ একখান শপথের মাধ্যমে আপনি আসলে কিছুই বদলাতে পারবেন না, তা আপনার ইরাদা যত পাক্কাই হউক না কেন।

আপনাকে অবশ্যই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে রাজনৈতিক আন্দোলনে, সামাজিক আন্দোলনে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.