আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দস্যুতাই যাদের জীবন ১: দস্যুরাণী ফুলন দেবী

সৃষ্টিকর্তার সকল অপূর্ব সৃষ্টির মাঝে একমাত্র খুঁত সম্ভবত তাঁর সেরা সৃষ্টি ...

দস্যূ বলতেই প্রখমে কিরকম চেহারা ভেসে আসে মনে? ঢুলতে থাকা জলদস্যু জ্যাক স্প্যারো নাকি দরিদ্রের বন্ধু রবিন হুড?। এদের অপর একটা নাম হোল "আউট ল"। পুলিশ বাহিনীর ঘুম হারাম করে দিতেন তাঁরা। সিসিলির তুরি জুলিয়ানোর মতো এদের কারো দীর্ঘজীবনের জন্য রাতে মানুষ প্রার্থনা করতো, আবার বিলি দা কিডের মতো কারো কারো ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতে হতো বাচ্চাদের। এদের মাঝে কেউ ছিলেন রবিন হুড কর্তৃপক্ষের চক্ষুশুল কিন্তু গণমানুষের বন্ধু, কেউ ছিলেন প্রভাকরণের মতো - অনেকের দেবতা অনেকের জন্য জল্লাদ।

আবার কেউ ছিলেন আমাদের ওসামার মতোই নির্বিচারে হত্যাকারী এবং সবার দ্বারা ঘৃণিত। কারা এরা ? কেমন ছিল তাদের জীবন? আজ তাদেরই একজন উয়ঠ আসবেন স্বলপ্ পরিসরে - দস্যুরাণী ফুলন দেবী: দস্যুরাণী বলে পরিচিত ফুলনদেবীর জন্ম ১৯৬৩ সালে ভারতের এক নিচু জাতের এক মাল্লার ঘরে। ১১ বছর বয়সে এক অন্যায়ের প্রতিবাদ করবার অপরাধে তার বিয়ে হয়ে যায় বাপের বয়সী এক লোকের সাথে। ফুলনের গ্রাম এবং আশপাশের কয়েকটা গ্রামের জায়গীর ছিল সেখানকার ঠাকুর বংশের জমিদারদের। তারা মাঝেমাঝে গ্রামে এসে দরিদ্র গ্রামবাসীদের ওপর নির্যাতন চালাতো আর ফসলের ভাগ নিয়ে যেতো।

ফুলনেদের যে অল্প কিছু জমি ছিল তাও তারা দখল করে নেয়। ছোটবেলার প্রতিবাদী স্বভাবের ফুলন গ্রামবাসীদের স্তম্ভিত করে দখলকারীদের নেতা, মায়াদীনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। আদালতে ফুলনের রুদ্রমূর্তি আর স্বভাবগত ক্রোধন্মত্ত আচরণের কারণে কেস খারিজ হয়ে যায়। এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে ঠাকুরেরা তাকে ধরে নিয়ে যায় বেমাই নামে প্রত্যন্ত এক গ্রামে। এরপর তার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন।

দু সপ্তাহ ধরে প্রতি রাতে ঠাকুর ও তার লোকেরা ফুলনকে গণধর্ষণ করে। প্রতি রাতেই ফুলন জ্ঞান না হারানো পর্যন্ত চলতো এ পাশবিকতা। ১৬ দিনের মাথায় এক রাতে নির্যাতন শেষে তারা ফুলনকে মৃত মনে করে ফেলে রাকে। মৃতপ্রায় ফুলন এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পালিয়ে যায় নিজ গ্রামে। তখন ফুলনের বয়স সতের।

পালাতে গিয়ে ফুলন ধরা পরে এক দস্যুদলের হাতে। দলনেতা বাবু ফুলনকে পেয়ে ধর্ষণ করবার চেষ্টা করে কিন্তু বাবুর সহকারী বিক্রমের ফুলনের ওপর মায়া পড়ে যায় সে বাবুকে খুন করে ফুলনকে রক্ষা করে। পরবর্তীতে ফুলনের সাথে বিয়ে হয় বিক্রমের এবং দস্যুদলের নতুন দলনেতা হয় বিক্রম। সে ফুলনকে রাইফেল চালানো শিখিয়ে দেয়। খূব দ্রুতই ফুলন দক্ষ হয়ে ওঠে রাইফেল চালনায়।

তার এই নতুন দক্ষতার সাথে তার রুদ্র মেজাজ মিলিয়ে সে বিক্রমের যোগ্য সহকারী হয়ে ওঠে। ফুলন তার আলাদা বাহিনী নিয়ে প্রথম হামলা চালায় তার প্রাক্তন স্বামীর গ্রামে। নিজ হাতে ছুরিকাঘাতে তার স্বামীকে খুন করে সে রাস্তায় ফেলে রাখে এবং গ্রামবাসীকে বলে এরপর থেকে বাল্যবিবাহকারীদের অবস্থা এমনি হবে। ফুলন তার সংগঠিত দস্যুদল নিয়ে ক্রমাগত ধনী গ্রাম এবং জমিদারবাড়িগুলোতে আক্রমণ চালাতে থাকে। মাঝে মাঝে তারা ধনী জমিদারদের মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করে নিয়ে আসতো।

প্রতিটা ডাকাতির আগেই ফুলন দুর্গা দেবীর পুজো দিতো। তার দস্যুদলের আবাস ছিল চম্বলের বনভূমিতে। ভাগ্যের কি খেয়াল, একবার এক ধনী ঠাকুর বংশের ছেলের বিয়েতে ডাকাতী করতে হাজির হয়ে ফুলন সেখানে এমন দুজন মানুষকে চিনে ফেলে যারা বেমাইয়ে তাকে ধর্ষণ করেছিল। ক্রোধে উন্মত্ত ফুলনদেবী আদেশ করে বাকী ধর্ষণকারীদেরকেও ধরে আনার। কিন্তু বাকিদের পাওয়া না যাওয়ায় লাইন ধরে ঠাকুর বংশের বাইশজনকে একসাথে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয়।

বেমাইয়ের এই গণহত্যা ভারতবর্ষে ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং ফুলনদেবীকে ধরার জন্য স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গঠন করেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু ততদিনে দস্যুরাণীর নাম দাবানলের মতো ছড়িয়েং পড়েছে ভারতবর্ষে। গণমানুষের এই নেত্রীর পক্ষেও আন্দোলন শূরু হয়। আর পুজোর সময় দূর্গার মূর্তির চেহারা তৈরী হতে থাকে ফুলনের মুখের আদলে। প্রায় দু বছর চলে যায়, ফুলনের দস্যুদলের অনেকে ধরা পড়ে অনেকে মারা যায় পুলিশের এনকাউন্টারে।

কিন্তু হয়তো মা দূর্গার কৃপায় বা তার অসাধারণ কৌশল এবং লোকপ্রিয়তার কারণে পুলিশের কাছে ফুলনদেবী অদরাই রয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকারই হার মেনে নিয়ে ফুলনের সাথে সন্ধি করবার আহবান জানায়। ফুলনদেবী ততদিনে অসুস্থ এবং একা হয়ে পড়েছিলেন, তাই তিনি মেনে নেন। তবে তিনি সন্ধির জন্য অনেকগুলো শর্ত বেঁধে দেন যার মাঝে অন্যতম ছিল যে তাঁকে মৃত্যূদন্ড দেওয়া যাবে না। এবং তিনি কেবলই মহাত্মা গান্ধী এবং দূর্গা দেবীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করবেন, পুলিশের কাছে নয়।

অবশেষে ১০,০০০ মানুষ আর ৩০০ পুলিশের সামনে ফুলনদেবী অস্ত্র জমা দেন গান্ধী আর দূর্গার ছবির সামনে। ৪৮টা ভিন্ন ভিন্ন অপরাধের জন্য অপরাধী সাব্যস্ত করে তাঁকে জেলে পাঠানো হয় যেখানে ১১ বছর কাটান তিনি। জেল থেকে বের হয়ে ফুলন সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ এবং '৯৯ তে পরপর দুবার লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি নিচু সম্প্রদায়ের মানুষের শিক্ষা বিস্তারের জন্য একলব্য সেনা নামে একটি বাহিনী গঠন করেন। তবে এমপি হিসেবে তিনি সফল ছিলেন না তাই জোরশোর প্রচারণা চালাবার পরও তৃতীয়বারের নির্বাচনে হেরে যান ফুলন।

১৯৯৪ সালে শেখর কাপুর ফুলন দেবীকে নিয়ে অতি বিখ্যাত ব্যান্ডিট কুইন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন । যদিও ছবিতে তাকে পজিটিভ চরিত্রেই দেখানো হয়েছে তবুও পরে অবশ্য তিনি দাবী করেন যে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের বেশিরভাগ অংশই মিথ্যা কাহিনীর ওপর ভিত্তি করা। এবং এ চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করবার আন্দোলনও করেন তিনি। পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার যখন শেষের পথে তখন, ২০০১ সালের ২৫শে জুলাই চিন্তিত ফুলন গাড়ি থেকে তাঁর নতুন দিল্লীর বাসভবনের সামনে নামছিলেন। একই সময় রাস্তার অন্যপাশে অটোরিকশা থেকে নামে তিন যুবক - শের সিং রানা, ধীরাজ রানা এবং রাজবীর।

তাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে ফুলন দেবী এবং তার দেহরক্ষী নিহত হন। পরে ঐ তিন যুবক স্বীকার করে যে তারা বেমাই গ্রামের ঠাকুর বংশের সন্তান এবং তারা তাদের বিধবা মাদের অশ্রু মোছানোর জন্যই তারা ফুলনকে হত্যা করেছে। যেভাবে শুরু হয়েছিল নৃশংসতার মাধ্যমে ১১ বছরের ফুলনের যাত্র শুরু হয়েছিল তা অনেক নাটকীয়তার পর থেমে গেল ৪২ বছরে। কিন্তু দস্যুরাণী ফুলনদেবী কি নায়িকা না খলনায়িকা? এই বিচারের ভার নাহয় আপনাদের ওপরই ন্যসবত করলাম। পরের পর্বে "দস্যুতাই যাদের জীবন ২: সিসিলিয়ান রবিনহুড সালভাতর জুলিয়ানো"


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।