আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রূপান্তর- কল্প গল্প



বিয়ের পর থেকেই ওর একটাই অনুযোগ; কথা বলার মানুষ চাই। বাপরে! মেয়েটা কথা বলতে পারেও বটে! খুব সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গে সঞ্চিতার নীচু স্বরে গাওয়া গান শুনে। (আমি আবার -এমনকি ঘড়ির টিক টিক আওয়াজের শব্দের ভেতরও ঘুমাতে পারিনা!) নাস্তার টেবিলে শোনাবে বাজারের ফিরিস্তি আর রান্নার পরিকল্পনা। নিত্য নতুন চমকপ্রদ সব রান্নার ধাক্কায় আমি পেরেশান। তাই বলে ভাববেন না যেন, ও খুব খারাপ রাঁধে।

বিয়ের পর আমার ওজন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বাজারটা নামিয়ে দিয়ে, গোসলে ঢুকে শুনতে থাকি ওর খোলা গলার গান। রান্না করতে করতে মানুষ যে গান গাইতে পারে সেটা আমি আগে জানতাম না! (খেয়াল করে দেখুন- নাটক সিনেমায় কিন্তু কখনো এমনটা দেখায় না। তাই না?) চেম্বার থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা। এর ভেতর ও কমপক্ষে আট দশবার ফোন করে ফেলেছে।

আজকে ঢাকায় কোথায় কি হলো; কে কী করলো; কালকে কী হবে; কী হবার সম্ভাবনা আছে; সব আমার জানা সারা! বিশ্বাস করুন, যারা পেপার পড়ে, তাদের চাইতে আমি অনেক বেশী খবর পাই পেপার না ছুঁয়েও। রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত বাক বাকুম চলতেই থাকে আমার বৌটার। আর বেচারার সারাদিন করার আছেটাই বা কি? ছেলেপুলে নেই (ভবিষ্যতে হবার সম্ভাবনাটাও নাকচ করে দিতে পারেন। ) সঞ্চিতা বড় হয়েছে বিদেশী পালক বাবা মা এর কাছে। উনারাও চলে গেছেন দেশ ছেড়ে বিয়ের পর পর।

এদিকে আমি নিজেই আরেক হতভাগা। একলা মানুষ, নিকট অভিভাবকদের কেউই পৃথিবীতে নেই। আত্মীয় স্বজন বলতে ঢাকায় কেউ থাকেনা। তাই বুক ভরা মায়া নিয়ে মেয়েটা খালি সঙ্গ খোঁজে। কথা আর শব্দের সাগরে ভেসে নিজের একাকীত্ব ঘোচায়।

তাই, সারাদিন এমন কথামালার ভেতরে থেকে থেকে; যদি আমি বেচারার- কানের পাশ দিয়ে, কিছু কথা অগোচরে চলে যায়; হা হু করার ভেতর দিয়ে; তাহলে নিশ্চই আমাকে দোষ দেবেন না? পড়শীকে নিয়ে কি যেন এক সন্দেহের কথাটাও, এর আগে কতোবার বলেছে; মনে করতে পারবো না। ছুটির সেই দিনে, ফুরফুরে মেজাজে আমিও গলা মেলাচ্ছিলাম তার সাথে। সম্ভবত আমাকে গাইতে শুনেই, সে গান থামিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলো! "তোমাকে না বল্লাম বইটা এনে দিতে?" আমি একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। "কোন বইটা? কবে বলেছ?" "আরে সেই যে, কাবিল কোহকাফির লেখা ' জিন ও আদম সুরত'। " শুনেছেন কথা?! এই জাতীয় বইও নাকি মানুষে লিখে!! "জিনের বই দিয়ে কি করবে? জিনের প্রেমে পড়লে নাকি?" "ইয়ার্কি রাখো! " কপট রাগে গলা ভারী করলো সে।

"তোমাকে কতদিন বলেছি, পাশের বাসার লোকটা একটা জিন। আমি বইটা থেকে জিনের লক্ষণ গুলি মিলিয়ে নিলে কনফার্ম হতে পারতাম। তাহলে মিলি আন্টিকে আনিয়ে জিনের সাথে দেখা করিয়ে দিতাম। " সর্বনাশ! এই পাগল বলে কি?! এতবড় অদ্ভুত কথা, কানের পাশ দিয়ে, কখন, কিভাবে গেলো?! কড়া ধমক দিয়ে সেখানেই ইতি টেনে দিলাম ব্যাপারটার। "জিন-ভূত বলে কিছু নেই।

খামাখা লোক এনে সিন ক্রিয়েট করানোর কোন দরকার নেই। লোকটা জিন হোক, ভূত হোক, ব্রম্ম দৈত্যি হোক, আমাদের কিছু যায় আসেনা। ঐ বাসার দিকে একদম আর উঁকি মারবে না। খবরদার!" যারা বিবাহিত তারা জানেন, এই কথার পর বৌরা সাধারণত কি করে! সেও কথা শেষ হবার আগেই, আমার বিধি নিষেধ দিব্যি ভুলে গেলো। তার পীড়াপীড়িতেই, আমিও কয়েকদিন ধরে স্পাইগিরি করলাম।

পাশের বাসার লোকটার যে কোন একটা সমস্যা আছে সেটা ঠিকই টের পেলাম তার অল্প কিছুদিনের ভেতরেই। বয়স্ক করে ভদ্রলোক। একা থাকেন সম্ভবত। সম্ভবত বল্লাম এ কারণে, মাঝে মাঝেই নানা ধরনের লোক দেখি বাসাটায়। কোনদিন পিচ্চি একটা, কখনো ছোকরামতো, কোনদিন তরুণ।

সব মনে হয় ফুটফরমায়েশ খাটার লোক। এতো ঘন ঘন কাজের লোক বদলায় লোকটা, একটু চোখে লাগার মতোই ব্যাপার। ঘটনাটা হলো এক কার্ফিউ এর ভেতরে দুপুর বেলায়! নাওয়া খাওয়া শেষ করে একটু গড়াগড়ি দেবার চিন্তা করছিলাম। ( চাওয়া পাওয়া কম বলে আমি খুব বেশী একটা চেম্বারে বসি না। কি হবে বসে, কার জন্যই বা করবো? দুজন মোটে মাত্র মানুষ।

অল্পতেই বেশ চলে যায়) সঞ্চিতা কি নিয়ে যেন খুনসুটি করছিলো। দরজায় ঘন ঘন আঘাতের শব্দে দুজনেই চমকে উঠলাম। আমি সদর দরজা খুলে দেখি পাশের বাসার দরজা খোলা। এক বৃদ্ধ মতো লোক আমার দরজা ধরে থর থর করে কাঁপছেন। পলকেই বুঝলাম হার্টের কেইস।

চিন্তার সময় ছিল না। দুজনে ধরাধরি করে উনাকে বসার ঘরে সোফায় শুইয়ে দিলাম। আমি একটা ইনজেকশনের জন্য সিরিন্জ বের করতেই ভদ্রলোক হাতে কি যেন একটা এম্পুল ধরিয়ে দিলেন। লেবেল পড়ে দেখলাম, এটাও হার্টের জন্যই লাগবে। দ্বিধা না করে উনার দেয়া ইনজেকশনটাই পুশ করে দিলাম।

এখন তিন ঘন্টা অজারভেশনে রাখতে হবে। ঠিক মিনিট পনেরো পর থেকে অস্বাভাবিকতাটা ধরা পড়তে শুরু করলো। বুড়ো লোকটা কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছিলো শুরু থেকেই। আমাদের দুজনের বিস্ফোরিত চোখের সামনে দিয়ে তার শরীরের চামড়াটা কেমন যেন ফোসকা মতো উঠতে শুরু করলো। মনে হচ্ছিল চামড়ার নীচে মাংস টগবগ করে ফুটছে।

ওঃ! কী বীভৎস সেই দৃশ্য! অসহ্য যন্ত্রনায় (কিংবা কোন অজানা প্রতিক্রিয়াতেই হয়তো হবে) বৃদ্ধের শরীর কেঁপে কেঁপে কুকড়ে উঠে সংকুচিত হয়ে যেতে লাগলো। কতোক্ষণ সম্বিত হারা হয়ে ছিলাম বলতে পারবোনা। যখন ধাতষ্হ হলাম; সঞ্চিতা মুর্ছিতা হয়ে পড়ে আছে কার্পেটের উপর। আর বিছানায়, বৃদ্ধের কাপড়ে এক ৮/১০ বছরের ছেলে ঘামের সাগরে শুয়ে আমাদের, শংকিত দৃষ্টিতে দেখছে। চোখের সামনে পুরো বিবর্তনটা ঘটলো দেখেই হয়তো অবাক হবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম।

তাই বাচ্চাটা যখন হাত বাড়িয়ে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলো। কোন কথা না বলেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেটা নিলাম। লেখাটা হুবাহ তুলে দিচ্ছি- " আমি সৈয়দ মারুফ হাসান। আপনি এই চিরকুটাটা পাওয়ার অর্থ হচ্ছে, আমার বিবর্তন আপনার দৃষ্টিগোচর হয়েছে এবং আমি এই মুহুর্তে শারীরিক ভাবে যোগাযোগে সক্ষম নই। আমি একজন জেনেটিক সাইন্টিস্ট, জরা ও বিবর্তনের উপর আমি ইসরাইলে বসে গবেষণা করছিলাম বিগত এক যুগ ধরে।

কিন্তু একটা যড়যন্ত্রের তথ্য প্রকাশ করে দেয়ায় আমার উপর নির্মম অত্যাচার চালানো হয় ও শাস্তি হিসাবে অসম্পূর্ণ পরীক্ষার গিনিপিগ বানানো হয়। এর সাইড এফেক্টের ফলে আমার ভেতরে কিছু ব্যাখ্যাতীত পরিবর্তনের সূচনা হয়। প্রতি ২৪ ঘন্টা পর পর আমার দেহে জেনেটিক কোড বদলে যায় ও আমি বয়সের বিভিন্ন পর্যায়ে রূপান্তরিত হই। কখনো বিশ বছর বয়সী যুবা থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু; কিংবা পয়ত্রিশ বছরের পৌঢ় থেকে যাটোর্ধ বৃদ্ধ। এর কোন প্রতিযেধক বের করা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে।

রূপান্তরের কারণে আমি সাময়িক ও দীর্ঘ মেয়াদি স্মৃতি বিভ্রমের শিকার হই বলে এই চিরকুটের মাধ্যমে আপনার সাহায্য ও অনুকম্পা প্রার্থণা করছি। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি স্বাভাবিক রূপান্তরে ফিরে আসছি আবার দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন। " চিরকুট টা হাতে নিয়ে বসে রইলাম দীর্ঘক্ষণ। বাচ্চা ছেলেটা পুরাটা সময় ভীত সন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে থাকলো আমাদের দুজনের দিকে। সঞ্চিতা অবশ্য এরই ভেতরে আরো দুবার মূর্ছা গেছিলো! শেষ মেশ দুজনে শলা পরামর্শ করে বাচ্চাটাকে বাসায় নিয়ে আসলাম।

ছেলেটা ও দিব্যি আমাদের হাত ধরে চলে আসলো। পরের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাবো না আর। সঞ্চিতার এখন একাকীত্ব ভালো ভাবেই ঘুচেছে। কোনদিন বোনের কোলের বাচ্চা , কোনদিন বৃদ্ধ শশুর মশাই, কোনদিন কলেজ পড়ুয়া দেবর কিংবা কখনো দুর সম্পর্কের মামা!! এদের নিয়ে সুখেই আছে সে!! যা কিছু হ্যাপা; সেটা পোহাতে হয় আমাকেই! সকালে বাচ্চার জন্য খেলনা কিনতে বের হলাম তো, পরদিন ছুটতে হয় ডায়বেটিক মিষ্টির খোঁজে। কোনদিন লুঙ্গি সেলাই করে এনে দেখি, লাগবে হাফপ্যান্ট! বড়ই যন্ত্রনায় পড়েছি।

তবে আপনাদের চুপিচুপি বলি, আমরা দুটি মানুষ কিন্তু, এখন সেই অদ্ভুত জিনকে নিয়ে বেশ ভালোই আছি। (একটা লোকের বয়স প্রতিদিন বদলে যায়- এই কনসেপ্ট টা রানা'র খসড়ায় ছিল- লেখক)

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।