আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তুমি খুলে দাও সেই নবজীবনের দ্বার------------------------

কত আজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই দূরকে করিলে নিকট,বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।

একদিন আমরা পাড়ার কয়েকজন ছেলেমেয়ে একটা নতুন কিছু করার ইচ্ছা থেকেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের পাড়ায় এবং এর আশ পাশের এলাকায় যে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আছে তাদের সম্বর্ধনা দেব। আমরা পাড়ার উঠতি বয়সি কিছু ছেলেমেয়েদের এটা একটা উদ্যোগ। শুরু করেছি আমরা, কিন্তু আমাদের এই কাজকে যে ভাবে সবাই সাহায্য সহযোগিতা করেছে, সাহস দিয়েছে মনেই হয় নি যে আমরা ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া কয়েকটা ছেলেমেয়ে খেলার ছলে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম। সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম সাংগঠনিক কাজ।

আমরা কাজটা খুব সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছিলাম। যেখানে আমি উদাত্ত কন্ঠে আবৃত্তি করেছি---------------------------------------- কবি শামসুর রাহমানের “তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধিনতা। “----------------------------------------------------- এটাই আমার জীবনের প্রথম মঞ্চে উঠা। এই প্রথম জানলাম আমি আবৃত্তি করতে পারি। যা আমি শিখেছি আমার বাবার কাছ থেকে।

বাবার আনেক কবিতা মুখস্থ ছিল । রাতে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল আমরা ভাই বোনরা মিলে বাবার সাথে ছাদে চলে যেতাম। বাবা আবৃত্তি করত আমরা শুনতাম, শুনে শুনেই প্রেমে পরেছি কবিতার। চিনেছি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীন, দ্বীজেন্দ্রলাল রায়, মাইকেল মধূসদণ থেকে শুরু করে গোলাম মোস্তফা, মহাদেব সাহা, শক্তি চট্টপধ্যায়, নির্মলেন্দুগুন, রফিক আজাদ সহ অনেক অনেক কবিকে। আর শুনে শুনে মুখস্ত হয়ে গেছে যে কত কবিতা ।

এখন একটা খেলা হয় গানের শেষ আক্ষরের সাথে মিলিয়ে আর একটা গান গাইতে হবে প্রতিপক্ষকে। যাকে বলে অন্তরক্ষরমিল। আর আমরা খেলতাম, একটা কবিতা একজন বলবে, অন্যজনকে বলতে হবে এটা কোন কবিতা ? কার কবিতা ? এর পরের লাইনগুলো কি? ------আমার মা -------। খুব সাধারন আর খুব বেশী আবেগপ্রবন ঠিক এক বাঙ্গালী মেয়ে। মাকে নিয়ে গেলাম সেই আনুষ্ঠানে।

আমার বাবাও ছিলেন ঐ অনুষ্ঠানের একজন আতিথি। অনুষ্ঠান শেষ হবার পর , অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করতে করতে রাত ১২টার দিকে বাড়ি ফিরলাম। মার মুখে কেন যেন হাসি নেই, কেমন যেন ভীত, থমথমে। বাবা মাকে জিজ্ঞাস করলো ''কি হয়েছে?'' মা কিছু বলল না। কাপড় বদলাতে চলে গেল।

কাপড় বদলাতে যেয়ে মা পড়ে গেল। ওখানে আমার ছোট বোন ছিল, চট করে মা কে ধরে ফেলল। আমার বাবা একজন ডাক্তার ছিল। বাবা পরীক্ষা করে দেখল মার রক্তচাপ অনেক বেড়ে গেছে। কড়া ঘুমের ঔষধ দিয়ে মাকে ঘুম পাড়ান হল।

তবুও সারাটা রাত মা শুধুই ছটফট করল, আর প্রলাপ বকে গেল। সকালে দিকে মা বেশ সুস্থ হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে গত রাতের কথা শুনলাম মার মুখ থেকে। মা যেখানে বসে ছিল সেই জ়ায়গাটা বিশেষ অতিথিদের জন্য। আমার মা এই আনুষ্ঠানের একজন উদ্দ্যোক্তার মা তাই নিয়মানুসারে বিশেষ বারাদ্দের আসনে তার একটি আসন আছে।

এ ছাড়াও তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। মার পাশে বসে ছিলেন সমাজের একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মান জানাবার জন্য এই আনুষ্ঠানে তিনি অনেক টাকা দিয়েছেন। ভদ্রলোক পাশে বসে মার সাথে অনেক গল্প করেছেন অনেক কথা জিজ্ঞাস করেছেন। কথায় কথায় এক পর্যায়ে ভদ্রলোককে মা চিনতে পেরেছে।

এই চিনতে পারাটাই মার জীবনের একটা মর্মান্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে । এই ভদ্রলোকের ডাক নাম টুনা চৌধুরী। মার বাপের বাড়ীর পাড়ায় এখনও তিনি টূনা রাজাকার নামে পরিচিত। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি কিছুদিন গাঢাকা দিয়ে ছিলেন। তারপর আবার ফিরে এসেছেন।

এরপর ঢাকায় বসবাস করা শুরু করেছেন। রংপুরের স্বাধিনতা আন্দোলনের সময় ২৫শে মার্চ তারিখের মিছিলে যে রাজাকার গুলি চালিয়েছিল ইনি তিনি। যার গুলিতে প্রান হারায় ঠাকুর বাড়ীর আট বছরের ছেলেটা। যার লাশ কোলে নিয়ে রংপুরের আপামর জনগন স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার হয়েছিল। আমার মা সেই সময়ের একজন সদ্য বিবাহিতা তরুনী।

আমার বাবাকে ২৬শে মার্চ ভোরেই গ্রেফতার করা হয় তার বাসভবন থেকে। তারপর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ছেড়ে দেয়। বাবা তখন যুদ্ধে চলে যান। মা এই টুনা চৌধুরীদের ভয়ে সারা দিন মাটির নিচে লুকিয়ে থাকত। এই টুনা চৌধুরী নানার বাসায় এসে প্রকাশ্যেই নানাকে বলতো ''তোমার মেয়েটা কই?! জামাই আর আসবে না।

যদি বাঁচতে চাও মেয়েটা কোথায় বলে দাও। "" এই টুনা চৌধুরী নানাকে বলতো ''স্বাধীনতা চায় তোমার জামাই আমি ওর রক্তে গোসল করব। -------------------------'' ------------------------------------- এই লোকগুলি আমার বড়মামার লাশটাকে আমার নানার বাড়ীর পেছনে শিয়াল কুকুর কে খেতে দিয়েছে তবু কবর দিতে দেয় নি। একরাতে বোবা প্রতিবন্ধী মাত্র তের বছরের সালেহাকে টুনা চৌধুরীর দল ধরে নিয়ে যায়, যার খোঁজ আজও মেলেনি। ---------------------সেই লোক যদি এসে মার পাশে বসে এই স্বাধীন দেশে যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সমবর্ধনা দেয়া দেয়া হচ্ছে সেই আনুষ্ঠানে, তাও আবার বসেছে বিশেষ আসনে।

মা কিভাবে স্থীর থাকে। মা বার বার করে শুধু আপন মনেই বাবাকে জিজ্ঞাসা করে গেল ''ও কিভাবে আমার পাশে বসে? ওরতো আমার পায়ের কাছে বসা উচৎ!!!!!!!!!!!!!'' আমার বাবা -------------সে এখন বৃদ্ধ হয়েছে বেশ/ তার জগত জুড়ে শুধু দুঃখের বেসাতী/অস্তিত্তের প্রতিটি রন্ধে লাল, নীল কষ্টের তান্ডব/ আলোহীন পান্ডুর চোখে চেয়ে দেখে / সহযোদ্ধার ধূসর বধ্য ভূমি। ------ --- এই কবিতার মুক্তিযোদ্ধার মত নত মুখ। মা খুব সহজ সরল একজন মানুষ। তার মনের মাঝে যে জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে তার কোন উত্তর আমাদের জানা নাই।

তার প্রশ্ন ছিলো স্বাধীনতার এত বছর পর ও -------------''ওরা কি ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার সাহস পায়? ওরা এই ধরনের অনুষ্ঠানে টাকা দেবার সাহস পায়?'' বড় সহজ মনের বড় সরল প্রশ্ন। আমরা এত জটিল প্রশ্নের উত্তোর দিচ্ছি কত জটিল অংক কসছি কিন্তু এর কোন উত্তর নাই আমাদের কাছে। খুব সত্য ও খুব নির্মম বাস্তব হল এই অধিকার ওদের আমরাই দিয়েছি। আমরা ওদের ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। কিন্ত ওরা যে হায়েনা আমরা তা বুঝতে পারিনি।

পরবর্তিতে আমরা একটা কাজ করেছিলাম। টুনা চৌধুরীর টাকা তাকে ফেরত দিয়েছিলাম। কিন্তু ---আমরা টুনা চৌধুরীকে পারিনি বলতে -------তুই রাজাকার, তুই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বর্ধনা দেবার জন্য এই প্রজন্মের হাতে টাকা দেবার সাহস কোথা থেকে পাস, তোর টাকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বর্ধনা দেবার মত নীচ কীট এই প্রজন্ম নয়। আমাদের এই প্রজন্ম রাজাকারদের বিচার চায়। যুদ্ধোপরাধীদের বিচার চায়।

এক বার ও কি আমরা চিন্তা করি কোথায় লুকিয়ে আছে আমার মা, বাবার মত আসংখ্য বাঙ্গালীর বেদনা, ঘৃণা, যন্ত্রনা। আমাদের এই প্রজন্ম রাজাকারদের বিচার চায়। কবে ওদের বিচার সম্পন্ন হবে। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মা শান্তিতে ঘুমাবে। আমরা এই প্রজন্ম স্থীর হব।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।