আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভূমেন্দ্র গুহ বললেন : আত্মহত্যা করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ!



জীবনানন্দ দাশ যখন বেঁচে ছিলেন তখন আমার জন্ম হয়নি। জীবনানন্দ দাশ যে বছর চলে গেলেন মৃত্যুর হিমে, সেই ১৯৫৪ সালে কলকাতার ট্রামের ধাক্কা খেয়ে, সে বছরও আমার জন্ম হয়নি। জন্ম হবে কি, আমার বাবাই তো তখন মাত্র দশ বছরের বাচ্চা ছেলে। তাহলে? তাহলে জীবনানন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলো কীভাবে? সময় ডিঙানো তার কবিতার মাধ্যমে! তিনি কি অর্ধশতকের ব্যবধান পাড়ি দিয়ে এসেছিলেন 'রূপসী বাংলা' কবিতার মতো শঙ্খচিল বা শালিক হয়ে কখনো আমার বাসার বারান্দায়, আমার সঙ্গে স্বপ্নিল আড্ডা জমাতে। তিনি কি কাক হয়ে কখনো ডেকেছিলেন আমার নাম ধরে দুপুরের নির্জনতায়।

তিনি কি পেঁচা হয়ে কখনো মুখ লুকিয়েছিলেন আমার কর্মকা- দেখে। তিনি কি হাঁস হয়ে ভেসেছিলেন আমাদের গ্রামের পুকুরটিতে, ধবল বক হয়ে উড়েছিলেন আমাদের চেনা আকাশের নিচু মেঘের তলা দিয়ে! মনে পড়ে, বহুবার সারি সারি হাঁস দেখে, শালিক দেখে, উড়ন্ত বকের ঝাঁক দেখে ভেবেছি এদের মধ্যে নিশ্চয়ই আছেন জীবনানন্দ। হয়তো ওদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলেছি- নিতে ভাসতে কিংবা আকাশে উড়তে কেমন লাগছে কবি? জীবনানন্দ নিরুত্তর। আমি তার কবিতা সমগ্রের পাতা ওল্টাই আর পড়ি, কবিতা ভর্তি নক্ষত্র, ধানক্ষেত, মেঠো ইঁদুর, শীত বা হেমন্তকাল, ঝরে পড়া কাঁঠাল পাতা বা মৃত্যু আর মৃত্যু- হাড়ের ভিতর দিয়ে যারা শীত বোধ করে মাঘ রাতে;- তাহারা দুপুরে ব'সে শহরের গ্রিলে মৃত্যু অনুভব করে আরো গাঢ়-পীন। রূপসীও মরণকে চেনে মুকুরের ওই পিঠে-পারদের মতো যেন।

(মৃত্যু) কিংবা, স্মৃতিই মৃত্যুর মতো,- ডাকিতেছে প্রতিধ্বনি গম্ভীর আহ্বানে ভোরের ভিখিরি তাহা সূর্যের দিকে চেয়ে বোঝে। (আমিষাশী তরবার) কিংবা, অজস্র বুনো হাঁস পাখা মেলে উড়ে চলেছে জ্যোৎস্নার ভিতর কাউকে মৃত্যু ফেলে দিলে। নিচে অন্ধকারের অচল অভ্যাসের ভিতর। (হঠাৎ-মৃত) অবাক হয়ে ভাবি তিনি কেন বারে বারে মৃত্যুচিন্তা দ্বারা আক্রান্ত। পৃষ্ঠা ওল্টাই পশ্চিম বাংলা থেকে বের হওয়া ছোটকাগজ 'বিভাব'-এর জীবনানন্দ দাশ জন্মশতবর্ষ সংখ্যার।

দেখি জীবনানন্দ দাশের কিছু দুর্লভ মুহূর্তের ছবি। দুটি ছবি আমার চোখে আটকে থাকে, একটি মা কুসুমকুমারী দাশের মৃতদেহের সামনে উদাসীন ভঙ্গিতে তার দাঁড়ানো ছবি; অপরটি ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর শুয়ে থাকা ফুলে ঢাকা তার মৃতদেহের ছবি। ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যু, পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত জীবনানন্দই একমাত্র উদাহরণ। কেউ কেউ মনে করেন এটা দুর্ঘটনা নয়, এটা আত্মহত্যার চেষ্টা। কিন্তু এভাবে নিজ মৃত্যুকে বেছে নেয়ার চেষ্টাই বা তিনি করবেন কেন? পশ্চিমবঙ্গের কবি ও খ্যাতিমান চিকিৎসক ভূমেন্দ্র গুহ মনে করেন, তিনি হয়তো আত্মহত্যা করেছেন।

ভূমেন্দ্র গুহর সঙ্গে জীবনানন্দের প্রথম যোগাযোগ হয় সাহিত্য পত্রিকা ময়ূখ সম্পাদনা করতে গিয়ে। তিনি জীবনানন্দকে শেষ দুবছর খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর এত বছর পরও এই যে ট্রাঙ্কভর্তি এত এত লেখা আবিষ্কার হলো, এর পেছনের মানুষটি হচ্ছেন ভূমেন্দ্র গুহ। তিনি ১৯৫৪ সালে জীবনানন্দের মৃত্যুর পর তার বাসা থেকে ট্রাঙ্কভর্তি অসংখ্য লেখা উদ্ধার করেন। যার মধ্যে রয়েছে জীবনানন্দের গল্প, উপন্যাস, দিনলিপি ও চিঠিসহ অসংখ্য কবিতা।

ব্যক্তি জীবনানন্দকে জানতে তার এই লেখাগুলোর রয়েছে বিশাল ভূমিকা। জীবনানন্দ দাশ ডায়রি লিখতেন ইংরেজিতে। ভূমেন্দ্র গুহ তার এই অপ্রকাশিত লেখাগুলোর পাঠোদ্ধার করে পাঠকদের সামনে হাজির করেছেন। ভূমেন্দ্র গুহর মোট কবিতার বই আটটি। তিনি তার সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার।

সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। ২. ২০ এপ্রিল বেঙ্গল গ্যালারিতে সাহিত্য পত্রিকা 'কালি ও কলম'-এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টি, জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আলোচনা। আলোচক ভূমেন্দ্র গুহ। ফটোগ্রাফার মাসুদ আনন্দকে সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যায় আমরা যাই সেখানে। দেখা হয় হলভর্তি তরুণ-প্রবীণ অসংখ্য জীবনানন্দ অনুরাগীর সঙ্গে।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাত। এরপর শুরু হয় প্রশ্ন-উত্তর পর্ব। অনুষ্ঠান চলতে থাকে ভূমেন্দ্র গুহকে উদ্দেশ করে ব্যক্তি জীবনানন্দ সম্পর্কে প্রশ্নের মধ্য দিয়ে। জিজ্ঞেস করা হয়, জীবনানন্দ দাশ কি জানতেন, তিনি কত বড় কবি? উত্তরে ভূমেন্দ্র গুহ বললেন- `হ্যাঁ। জানতেন তো বটেই! জীবনানন্দ দাশ প্রকৃত প্রস্তাবে কবিই ছিলেন, অন্য কিছু নয়।

সৃষ্টি ও সৃজনকল্পনা ছাড়া আর অন্য কিছুর প্রতি তার কিঞ্চিত মনোযোগও ছিল না। নিজের প্রতিভা নিয়ে তিনি ছিলেন সজাগ। জীবনান্দ দাশ জানতেন প্রকৃতি তার মধ্যে অনন্য সৃজন ক্ষমতা দিয়েছে। ' স্ত্রী লাবণ্য দাশ সম্পর্কে বললেন ' লাবণ্য দাশ ছিলেন খুবই সুন্দরি মহিলা। নিজের রূপসৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি সব সময় সচেতন থাকতেন।

কিন্তু জীবনানন্দ দাশ সবসময়ই তার স্ত্রীকে উপেক্ষা করতেন, এমনকি তার স্ত্রীও। এ বিষয়ে তিনি তার ডায়েরিতে লিখেছে- if his wife died it would be beneficial for his writing. তিনি আরও বললেন 'লাবণ্য দাশ মহিলা হিসেবে অসাধারণ ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ উৎকৃষ্ট স্বামী ছিলেন না। উৎকৃষ্ট পিতাও ছিলেন না। কাব্য নিয়েই ছিল তার যত সাধনা।

ধ্যান। কবিতার জন্যই, সাহিত্যের জন্যই তিনি তিক্ত জীবনযাপন করে গেছেন। তিনি তার স্ত্রীকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে জীবনানন্দ দাশ সংসার চালাতে যে অক্ষম, এটা বোঝাতে তার স্ত্রী ভালোবাসতেন। ' ব্যক্তি জীবনানন্দ খুব লাজুক প্রকৃতির ছিলেন কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন 'তিনি লাজুক ছিলেন না।

কাউকে উপেক্ষা করাকে কি লাজুক বলা যায়? উনি আমাদের সবাইকে উপেক্ষা করতেন। সাহিত্যিক তর্ক করতেন না। ওনার স্বভাবই স্বল্পভাষী। ' তিনি বলেন, 'জীবনানন্দের বরিশাল বাতিক ছিল। কলকাতার জীবনে তিনি বরিশালের বিষয়ে কথা বলতে খুব ভালোবাসতেন।

তিনি আমাকে বিভিন্ন সময় জিজ্ঞেস করতেন- তুমি কাউনিয়া চেনো নাকি...। ' জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুটা আত্মহত্যা ছিল কি না এ জাতীয় প্রশ্ন করা হলে ভূমেন্দ্র গুহ বলেন- কলকাতার ইতিহাসে জীবনানন্দই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তার ডায়েরির লেখাগুলো পড়লেই বোঝা যায়, তিনি মৃত্যুচিন্তায় চিন্তিত ছিলেন। এক্ষেত্রে এটা আত্মহত্যা হলেও হতে পারে। এছাড়াও ভূমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দের মধ্যে বাইপোল ডিজঅর্ডার আবিষ্কার করেছেন।

তার মতে, এটা এক ধরনের মানসিক সমস্যা। এ জাতীয় সমস্যা থাকলে একজন মানুষ আনন্দের চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছাতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি প্রতিভাবান লেখক হলে, হয়ে ওঠেন অসম্ভব সৃষ্টিশীল। আবার এ রোগ থাকলে তিনি পৌঁছে যেতে পারেন হতাশার চূড়ান্ত জায়গাটিতে। শেষ চার বছর জীবনানন্দ কষ্ট করে গেছেন খুব।

চাকরি নেই। চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। কোথাও পেলেন না। জীবনানন্দ হয়তো উভয় ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত জায়গাটাতেই পৌঁছে গিয়েছিলেন। ১৯৪৮ থেকে ৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি কিছুই লেখেননি।

জীবনানন্দের উপন্যাস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘জীবনানন্দ দাশ একমাত্র লেখক যিনি উপন্যাস কি তা বুঝতে চেয়েছেন। উইলিয়াম ফকনারের মধ্যেও ছিল এ ব্যাপারটা। তার প্রত্যেকটা উপন্যাসই প্রায় একই টাইপের। তার ‌'আমরা চারজন' আমার খুব প্রিয়। ' তিনি কোন দায়বদ্ধতা থেকে জীবনানন্দের অপ্রকাশিত সাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন কিংবা জীবনানন্দকে নিয়ে এই কাজ শেষ করার জন্য তিনি কোনো উত্তরসূরি রেখে গেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কবি বলতে যা বোঝায়, জীবনানন্দ দাশ তাই-ই ছিলেন।

আসলে কোনো দায়বদ্ধতা থেকে এ কাজে আমি অংশ নিইনি। দায়িত্ব নিজে থেকেই ঘাড়ে এসে পড়েছে, করছি। কেউ না কেউ তো এই কাজ করতোই। ১৯৯৪ সালে আমি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর কাজহীন সময় কাটাচ্ছিলাম। এর মধ্যে একদিন জীবনানন্দের ভাইপো এসে বললো ট্রাঙ্কভর্তি তার অপ্রকাশিত পালিপিগুলো নিয়ে কাজ করতে।

তখন থেকেই আমি জীবনানন্দ দাশের লেখাগুলোর পাঠ উদ্ধারের কাজে লেগে গেলাম। আমি চাই মৃতুর আগ পর্যন্ত এ কাজ করে যেতে। আমার আসলে কোনো উত্তরসূরি নেই। এ কাজ আমাকেই শেষ করে যেতে হবে। ' তিনি আরও বলেন, 'ময়ূখ' পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে জীবনানন্দের কাছ থেকে যখন কবিতা চাইতে তিনি গিয়েছিলেন তখন তার বয়স ১৯ বছর।

ওই বয়সে ওই সময় তার কবিতা তার কাছে যেমন ভালো লাগতো, এখনো তেমনই ভালো লাগে। জীবনানন্দ অনেক বড় কবি!


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.