আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জামিল সকলের হৃদয়ে জাগরুক...



জামিল মধ্যেবিত্ত পরিবারের একটি ছেলে। জামিলের বাবার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট এবং একজন ব্যারিস্টার। তাদের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো কিন্তু মনুষ্যত্ববোধ ও মমতার অভাব তাদের মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। আর তারই স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় জামিলের ঘটনাটির দিকে আলোকপাত করলে। জামিলের বাবা ছোট্ট একিট চাকরি করতেন এবং যা বেতন পেতেন তাতে করে পরিবারের চাহিদা মেটানোই কষ্টকর হয়ে যেত।

ক্লাস থ্রিতে পড়া জামিল ক্লাসের অন্যদের পেছনে ফেলে দুই রোল করে মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়। চার পাশের আট-দশজন বাচ্চাদের মতোই বেড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল সে - চোখে মুখে ছিল ভরপুর হাসি আর প্রাণবন্ত। বয়স তখন মাত্র ৮ বছর। হঠাৎ একদিন সকালে আমার বড় ভাইয়া আমাকে নাস্তা খাওয়ার সময় জামিলের কথা জানাই। তখন পর্যন্ত জামিলকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি, মমতাবোধ জন্ম হওয়া তো দূরের কথা।

সে যাই হোক, মাত্র ৮ বছরের একটি শিশু। এই শিশুটির সাথে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটে আমার বড় ভাইয়ার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাধ্যমে। স্পষ্টভাবে দিনটির কথা আজও মনে আছে - ২ মে, ২০০৮। আমি বড় ভাইয়া ও ভাবির সাথে জামিলের ফুফু ও ফুফার বাসাতে বেড়াতে যাই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জামিলের ফুফা আমার বড় ভাইয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

কথা প্রসঙ্গে ভাইয়ার বন্ধু আমাকে বলেন, জামিলের কথা। প্রথম পর্যায়ে ঠিক বুঝে উঠতে একটু কষ্ট হয়েছিল, ভীষণ অবাকও হয়েছিলাম উনার কথা শুনে - "প্রতি সপ্তাহে চার ব্যাগ "এ" পজেটিভ ব্লাড প্রয়োজন হচ্ছে জামিলের জন্য, আমরা আর জোগাড় করতে পারছি না"। ধীরে ধীরে জানতে পারলাম, জামিলকে সংগ্রাম করতে হয়েছে এক অসুখের সঙ্গে, যার নাম - "অ্যাপলাস্টিক অ্যানিমিয়া" (এটা এক ধরনের ক্যান্সার)। মুহুর্তের মধ্যে ভেতরে গভীর যাতনা অনুভব করলাম, আমার সমস্ত দরদ ও মমতা দিয়ে ছোট্ট এই শিশুটিকে কাছে টেনে নিলাম। একমাত্র ফুফার পরিবার বাদে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরা কেন এই যাতনা অনুভব করল না? তাদের মধ্যে কী মনুষ্যত্ববোধ কিংবা এতটুকুও মমতাবোধ নেই? যদি থাকতোই তাহলে গ্রামে থাকা বাবা-মা'র অনেকটাই লাঘব হতো, অনেকটাই সহজ হতো জামিলের চিকিৎসা - এ সকল নানান বিষয় মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।

ঘৃণার জন্ম হয় তাদের প্রতি - যাদের অনেক ধন-সম্পদ হয়তো রয়েছ, কিন্তু একটি সুন্দর 'মন' -এর বড়ই অভাব। আমাদের সমাজে এমন অসংখ্য মানুষই হয়তো রয়েছেন জামিলের এই ঘটনাটি পড়ে যাদের মধ্যে একটু হলেও নিজের প্রতি অনুশোচনা হবে, একইসাথে শুভবুদ্ধিরও উদয় হবে এটাই মনে- প্রাণে প্রত্যাশা করি। জামিলের অসুখের জন্য প্রতি সপ্তাহে ৪ ব্যাগ ব্লাড দিতে হতো তাকে। ব্লাড দিতে একটু দেরি হলে, তার কান এবং দাঁত গোড়া দিয়ে ব্রাড বের হতে থাকতো। ব্লাড নিতে নিতে তার ছোট্ট দুটি হাত যেন নিস্প্রাণ, সূঁচের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল।

এত কিছু সহ করে বাব-মা'র কাছে না থাকার কষ্ট এতটুকুও ছুঁতে পারে নি তাকে, একটু সময়ের জন্যও ম্লান করতে পারেনি তার মুখের সুন্দর হাসি। ঢাকার বাইরে থেকে নিয়মিত খোঁজ-খবর নেয়া আর মাঝে-মধ্যে দু-একবার দেখে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না জামিলের বাবা-মা'র। তাকে বাঁচানোর জন্য শিশু হাসপাতালের ডাক্তার সেলিমুজ্জামান জামিলের চিকিৎক ছিলেন, উনি এক পরামর্শে বলেন দেশের বাইরে বোনমেরু ট্রান্সপ্লান্ট করাতে হবে। এতে প্রায় ১৫-২০ লাখ টাকার প্রয়োজন হবে। কী করে এত টাকা জোগাড় করবে তার পরিবার? তাহলে কী সম্ভাবনাময় একটি ভবিষ্যত অঙ্কুরেই ঝরে যাবে? এমনই একটি পরিস্থিতিতে অঢেল সম্পত্তির মালিক না থাকলেও মহৎ হৃদয়ের দু'টি মানুষ - জামিলের ফুফা ও ফুফু এগিয়ে এসেছিলেন জামিলকে বাঁচাতে এবং উদ্যোগী হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন আরো অনেককেই।

জামিলের ফুফাই প্রথম ব্লাড সংগ্রহের বিষয়টি আমাকে জানায়। এরপর ব্লাড সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি স্বনামধন্য বেশ কয়েকটি পত্রিকায় যোগাযোগ থাকার সুবাদে জামিলকে বাঁচাতে সকলকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবার জন্য আহবান জানাতে সমর্থ হই। ডেইলি স্টার, প্রথম আলোসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকাতে খবরটি গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয়। মনে পড়ে, জামিলের মাথায় আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি এমন এক সময় জামিল আমার হাত ধরে বলেছিল, "ফুফু আমি ভালো হয়ে যাব, তাই না? তার কথায় নিরুত্তর থাকার কোন উপায় ছিল না আমার, তাই জবাবে বলেছিলাম - হ্যাঁ তুমি ভালো হয়ে যাবে। আমি এমনিতেই শিশু এবং বয়স্কদের প্রতি দূর্বল।

তাই সে সময়টাতে জামিলের কথা মনে পড়লেই আমার ভাইয়ের সন্তানদের কথা মনে হতো। মমতায় ভরা তার মুখ আমাকে খুব অল্প সময়েই যেন অতি আপন করে নিয়েছিল। প্রায় চার মাস নিয়মিতভাবে ব্লাড দেয়া অব্যাহত থাকলো। প্রথম পর্যায়ে ৭ দিনে এক ব্যাগ ব্লাড দিতে হলেও পরবর্তীতে প্রতি সপ্তাহে ৪ ব্যাগ ব্লাডের প্রয়োজন অনুসারে সংস্থান করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আরো অনেকেই এগিয়ে এসেছিল সহায়তার জন্য।

নাম না উল্লেখ করলেও তাদের সকলের নাম কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ রাখার মত। নানা পর্যায়ে যোগাযোগ করে এবং পত্রিকায় খবর প্রকাশ হওয়ার পর প্রায় ১০ লাখ টাকা জোগাড় হলো। যেন একটু হলেও আশার সঞ্চার হলো সকলের মনে। ঠিক হলো বোনমেরু ট্রান্সপ্লান্ট করার জন্য তাকে ভ্যালোরে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু নিয়ে যাবার পথে অন্ধপ্রদেশ রেল স্টেশনে জামিলের মুখের হাসি চিরদিনের মতো নিস্প্রভ হয়ে গেল।

কত প্রাণ অকালে এভাবে ঝরে যায়, ক'জনই বা তার খবর রাখে। জামিলের খবর কোন পত্রিকায় প্রকাশ পায় নি। তাই তার আত্মীয়-স্বজনেরা জেনেছিল কি-না, তা জানি না। জানলে দুঃখ প্রকাশ আর স্বান্ত্বনা ছাড়া কী বা দেবার ছিল তাদের! কিন্তু উপরিউক্ত ঘটনা থেকে আমার মতো আরো অনেকেই হয়তো নির্দ্বায় স্বীকার করবেন যে, জামিলের মত এ ধরণের অনেক প্রাণই আছে যাদের বাঁচানো সম্ভব। শুধু প্রয়োজন মানুষের মত একটি 'মন'- এর।

এই মনের যেন আজ বড়ই অভাব আমাদের সমাজে। তা না হলে জামিলের প্রাণও আজ বাগানের সুগন্ধি ফুলের মতো প্রাণবন্ত হয়ে ফুটত, সুবাস ছড়াতো চারিপাশে। কিন্তু প্রাণহীনভাবেই জামিল একটি সুবাস যেন অজান্তেই ছড়িয়ে গেছে সকলের মনে, তা হলো - মনুষ্যত্ববোধ ও মমতার সুবাস - সে সুবাসে পুষ্ট হয়ে উঠুক সকল মন - এটায় যেন জামিলের আত্মার পরম শান্তি নিশ্চিত করবে। জামিল সকলের হৃদয়ে জাগরুক হোক!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.